ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৭


    বিমল মিত্র (April 2, 2021)
     

    পর্ব ৬

    তখন গ্রীষ্মকাল। এপ্রিল মাস। গ্রীষ্মকালটাই আমার কাছে ভয়াবহ। গরমে আমি যন্ত্রণায় ছটফট করি। তবু তখন লিখতে হয়। কলকাতায় থাকলে ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে আলো জ্বেলে লিখি। কিন্তু লোনাভালা পাহাড়ি জায়গা। ঠাণ্ডা আবহাওয়া। যে-বাড়িটাতে বসে আমরা কাজ করি তার চারিদিকে ঢালু খাদ। পাহাড়ের চুড়োর ওপর বাড়িটা। খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা এক সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমি এক-একটা পাতা লিখি, গুরু তামাক খেতে খেতে সেটা শোনে। তারপর অমলেন্দু সেটা কপি করে। কপি করার পর সেখানা টাইপ করে মিস ভালেকর। তারপর আব্‌রার একমনে তার অনুবাদ করে হিন্দিতে। গুরু দত্ত তখন মিলিয়ে নেয় সমস্ত।

    প্রতিদিন এমনি করেই আমাদের কাজ চলে। এমনি করেই রাত গভীর হয়। তারপর যখন রাত বারোটা-একটা বাজে তখন আমার চোখদুটো জুড়ে আসতে চায়। ওদের সকলের পরের দিন দেরি করে উঠলেও চলে, কিন্তু আমার তা নয়। আমাকে ভোর ছটার সময় উঠে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ লিখতে হয়। প্রতিদিন আমাকে সজাগ থাকতে হয় কবে সপ্তাহ শেষ হবে, কবে লেখা পাঠাতে হবে কলকাতায় ‘দেশ’ অফিসে।

    কিন্তু সেদিন এক কাণ্ড হল। কাণ্ডটা এমন কিছুই নয়। কিন্তু আমার কাছে সেটা অবাক বলে মনে হল। গুরু কি আগে কখনও এমন করে।

    মনে আছে তখন দুপুরবেলা। দুটো কি তিনটে বেজেছে। হঠাৎ বড়-বড় করে আওয়াজ হল। বাইরে চেয়ে দেখি বৃষ্টি পড়ছে। গুরুও চেয়ে দেখল, হ্যাঁ বৃষ্টি পড়ছে। গুরুর চোখে মুখে ছেলেমানুষের মতো আনন্দ ফুটে উঠল। আমি গুরুর দিকে চেয়ে দেখি— সে বাইরের দিকে চেয়ে হাঁ করে একমনে বৃষ্টি দেখছে।

    হঠাৎ উঠে দাঁড়াল গুরু। বললে— চলুন বিমলবাবু— উঠুন— বৃষ্টি এসেছে, আর কাজ করতে ভালো লাগছে না—

    বললাম— কিন্তু কোথায় যাবেন এই বৃষ্টিতে?

    — যেখানে খুশি। এই বৃষ্টিতে আর ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না— কিছুতেই ছাড়ে না। শেষকালে হাত ধরে টেনে তুলে দিলে সবাইকে। ছেলেমানুষের মতো আনন্দে লাফাতে লাগল গুরু। তার আনন্দ দেখে আমারও আনন্দ হতে লাগল। আমিও যেন গুরুর সমবয়সী হয়ে গেলাম। আমারও সেই মুহূর্তে যেন বয়স কমে গেল। মনে আছে আমরা সবাই গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে উঠলুম গুরুর গাড়িতে। ছাতি নেই। সবাই ডিনার-টেবিলের প্লাস্টিকের চাদরগুলো মাথায় দিয়ে কোনও রকমে গাড়ির ভিতর গিয়ে বসলুম। আর গুরু গাড়ি চালাতে লাগল। এপ্রিল মাসের সেই প্রথম বৃষ্টি— সে একেবারে আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি। গাড়ির ওপর মায়া নেই গুরুর। গাড়ি ভেঙে যাক, গাড়ি ডুবে যাক, গাড়ি রসাতলে যাক, তবু এমন বৃষ্টির মধ্যে গুরু ঘরের মধ্যে বসে থাকবে না। এমন সুযোগ নষ্ট করবে না। গুরু গাড়ি চালাচ্ছে আর জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখছে। কাচের ওপর জল পড়ে সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। কিছু দেখা যায় না। তার ওপর অঝোর ঝরণ বৃষ্টি। দুপাশে দিগন্ত পর্যন্ত ছড়ানো ধানক্ষেত। তার ওপাশে আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়। সার-সার পাহাড়। আকাশ-পাহাড়-ধানক্ষেত বৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেছে। আর গুরু আনন্দের চোটে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মেইল জোরে গাড়ি চালাচ্ছে। আমার ভয় হতে লাগল। বোম্বে-পুনা রোড সামনে পড়ে আছে! পিচের চড়াই উতরাই রাস্তা। বড়-বড় লরি-বাস চলে দিনরাত সে-রাস্তা দিয়ে যদি কোনও বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে তাহলে আমরা সবাই গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। গুরু চালক আর ভেতরে আমরা কজন ভয়ত্রস্ত বিপন্ন প্রাণী।

    ছেলেমানুষের মতো আনন্দে লাফাতে লাগল গুরু… আমিও যেন গুরুর সমবয়সী হয়ে গেলাম… মনে আছে আমরা সবাই গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে উঠলুম গুরুর গাড়িতে। ছাতি নেই। সবাই ডিনার-টেবিলের প্লাস্টিকের চাদরগুলো মাথায় দিয়ে কোনও রকমে গাড়ির ভিতর গিয়ে বসলুম। আর গুরু গাড়ি চালাতে লাগল। এপ্রিল মাসের সেই প্রথম বৃষ্টি— সে একেবারে আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি। গাড়ির ওপর মায়া নেই গুরুর। গাড়ি ভেঙে যাক, গাড়ি ডুবে যাক, গাড়ি রসাতলে যাক, তবু এমন বৃষ্টির মধ্যে গুরু ঘরের মধ্যে বসে থাকবে না। এমন সুযোগ নষ্ট করবে না।

    আমি চিৎকার করে উঠলুম— একটু আস্তে চালান—

    গুরু হাসতে লাগল— আপনার ভয় করছে?

    এখনও ভাবলে আমার ভয় লাগে। গুরু না হয় বেপরোয়া। জীবনকে কি করে বিপদ্‌জনক করে তোলা যায় সেইটা গুরু জানত, কিন্তু আমরা তো ছা-পোষা সংসারী জীব। আমরা দিনরাত করি চিন্তা, কি করে বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারি— ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা’।

    কিন্তু গুরুর কথা আলাদা। গুরু বলত— বিমলবাবু, মৃত্যুর জন্য ভাবি না, কিন্তু জীবনের জন্যেই আমার যত ভয়—

    — কিসের ভয়? আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম।

    গুরু বললে— শুধু আমার একলার নয়, আমাদের হিন্দি সিনেমার ব্যবসায় যত লোক আমরা আছি, সকলেই কিছু-কিছু টাকা করেছি। উনিশ-কুড়ি লাখ টাকা আমাদের সকলের ক্যাপিটাল। কিন্তু একদিনে এক মুহূর্তে সব চলে যেতে পারে—

    বললাম— কেন, চলে যাবে কেন?

    গুরু বললেন— আমাদের ছবির ব্যবসা হল পুরো গ্যাম্‌ব্লিং। আজ রাজা, কাল ফকির। তাই ভয় হয় বড়। এই যে এত নাম-ধাম হয়েছে, সংসার হয়েছে, বিয়ে করেছি, বাড়ি ফিরেছি, এ যদি চলে যায়? এখন আর এ-সব বাদ দিয়ে চালাতে পারব না। এখন আর ট্যাক্সিতে চড়তে পারব না—

    তাই দেখতাম, কলকাতায় যখন গুরু আসত তখন একটা প্রাইভেট গাড়ি থাকত গুরুর হোটেলের দরজার সামনে। গুরু সেটা ভাড়া করে রাখত। দিন পিছু বিয়াল্লিশ টাকা করে ভাড়া গুণতো। কখনও চড়ত, কখনও চড়ত না। কিন্তু দরজার সামনে গাড়িটা হাজির থাকা চাই!

    এ তো সমস্তই এক মুহূর্তের ব্যাপার। এক মুহূর্তের মধ্যেই সব নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। এ-সবই নিভে যেতে পারে। এ ভাবনা সত্যিই ভয়াবহ ছিল গুরুর কাছে। গুরু বলত— আপনি হয়তো ভাবছেন এত টাকা থেকেও কেন এত ভয়। এ ভয় বেঁচে থাকার, জীবন-যাত্রার, জীবন-ধারণের ভয়!

    গুরুর কথা শুনে আমার মনে হত, গুরু তার মনের কথা আমাকে খুলে বলেছে। এর চেয়ে সত্যি কথা আর কিছু নেই। সত্যি, মরে যাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা আরো শক্ত! জীবন নেওয়ার চেয়ে তাই জীবন দেওয়া শক্ত।

    কিন্তু তা হলে গুরু কেন মারা গেল? গুরু কি নিজের জীবন নিজেই নিয়ে গেল নিজের হাতে? গুরু কি সত্যিই হেরে গেল? জীবন কি শেষ পর্যন্ত তার কাছে দুর্বহ হয়ে উঠল? সে-কথা পরে বলছি।  

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

    পর্ব ৮

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook