ছেলে যদি বাড়ি ফিরে গর্বভরে হাঁকে, বাবা, ছাঁক্কা পঁচিশ নম্বর টুকে মারলাম, আমি কি উঠতে-পড়তে হেডমাস্টারকে ফোন করি, না দাঁত বের করে সাপোর্ট-হাস্য দিই? অতিমারীর সময় সরকার যদি বলে, চাল মজুত করবেন না, আমি কি খুচরো ঠোঙা বয়ে বাড়ি আসি, না একদানে কুড়ি কিলো আনাই, অন্যরা মরুক? কিন্তু যখন একটা লোক সুবিধে পাওয়ার লোভে এ-পার্টি থেকে ও-পার্টি নিপুণ ট্র্যাপিজ-লাফ দেয়, তার নীতি নিয়ে আমি হোয়াটসঅ্যাপে নাগাড়ে চিল্লিয়ে খাক, আর আড্ডায় এমন মেগা-স্তম্ভিত, হাত থেকে পটেটো চিপ্স খসে কপ্পুর। স্বপক্ষে সওয়াল: সব কিছুরই মাইক্রো-ম্যাক্রো আছে তো রে বাপ, আমারটা দৈনন্দিন খুচখাচ চ্যুতি, এদেরটা প্রকাশ্যে দু’কানকাটা প্যারেড। কথাটার গোড়ায় ভণ্ডামির কুড়কুড়ে সোয়াদ থাকলেও, যুক্তিটা চিপ্সের মতো ফঙ্গবেনে নয়। যদিও আমি সারাজীবন পুষেছি: ‘সুবিধে পেলে তক্ষুনি খাবলাও, কারণ আমি না করলে অন্য কেউ করত’, আমি ওই পাল্টি-মাস্টারের সামনেই জিভ নিংড়োব যদি আমার মেয়ের চাকরির সুবিধে হয়, আমি নীতি মেনে চলি লিচ্চয়, ঠিইক যতক্ষণ শাস্তির ভয়— তবু আম-নাগরিকের ঘুষ দিয়ে কাজ আদায়ের দুর্নীতি, আর পার্টির পান্ডার কোটি টাকা তছরুপের, বা খোলা বাজারে নিজ আদর্শকে কিলো-দরে বেচে দেওয়ার দুর্নীতির তফাত অবশ্যই আছে। আর কিছু না হোক, মাত্রার তফাত। লোভের মাত্রা, এবং সে-লোভ চরিতার্থ করতে গিয়ে অন্য মানুষের যে ক্ষতি হচ্ছে তার মাত্রা। চিমটি কাটার মধ্যেও হিংস্রতা আছে, কিন্তু তাকে তো ছুরি-মারার সমান ফাঁসি দিতে পারো না। রামাশ্যামার নীতিহীনতারও অভিঘাত অবশ্যই আছে, ভাগ্নে শিখছে ‘নিজপানে মাইক্রোস্কোপ তাক করিব না কভু’, কিন্তু তা, একজন ক্ষমতাবানের প্রকাশ্য নীতি-লাথানোর তুল্য নয়, কারণ ওতে গোটা সমাজে ঢালাও প্রশ্রয়বার্তা ছড়িয়ে যায়, ‘সব চলতা হ্যায়, লজ্জার কিছু নেই।’ তা নীতিহীনতার অপরাধবোধকে পাইকারি হারে লঘু করে দেয়, বারোয়ারি নীতিশৈথিল্যের উৎসব-আবহ তৈরি করে।
যদি একটা দেশে শাসক দল সমালোচকদের মুড়ি-মুড়কির মতো গ্রেফতার করে, জেলে পাঠায়, হ্যারাস করে, দেশদ্রোহী তকমা দেয়, সে-দেশে টুইটে বা ফেসবুক পোস্টে অসহিষ্ণুতা, নাগাড়ে খিস্তি, দাঁত বার করে টুঁটি কামড়ে ধরা রমরমাবে। কারণ, হাওয়ায় উড়ছে: ঔচিত্যের বালাই না রেখে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার মধ্যে অন্যায় নেই, বরং পরোয়াহীন দাপট রয়েছে। সে-দেশের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন মাঠে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের দিকে তেড়ে তেড়ে গিয়ে খেঁকুরে ভাবভঙ্গি করেও আইকনত্ব হারাবেন না, উল্টে এই আগ্রাসী বডি-ল্যাঙ্গোয়েজের জন্য বীরপুজো পাবেন। ক’দিন আগেই ভারত একটা টেস্টে খাটালের মতো পিচ বানিয়ে, দুর্দান্ত স্পিন করে জিতে গেল। তবু আইসিসি নো-গাঁইগুঁই, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের টাকা বেশি, সুতরাং ক্ষমতা বেশি, তাদের চটালে মহা বিপদ। কোহলি বলে দিলেন, ও-সব পিচ-টিচ কোনও ব্যাপার নয়, দু-দলেরই ব্যাটসম্যানেরা বাজে খেলেছেন। মোদ্দা মানে: ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানেরা ভারতীয়দের তুলনায় খারাপ স্পিন খেলেছেন। ঠিক। কিন্তু জঘন্য পিচে একটা দল অপেক্ষাকৃত ভাল খেলে জিতেছে মানে পিচটার সব দোষ উবে গেছে, এ কোন দেশের যুক্তি? প্রথম দিন থেকে বল পড়ে ধুলো উড়ছে যে-পিচে, তা ভাল? রবিচন্দ্রন অশ্বিন ঝাঁজিয়ে বললেন, ‘ভাল পিচ কাকে বলে? কে তার সংজ্ঞা ঠিক করে দেবে? প্রথম দিনে চমৎকার সিম, আর শেষ দু-দিনে চমৎকার স্পিন হলেই দারুণ পিচ? কে এসব নিয়ম করেছে?’ সত্যি, এ-ই তো সক্রেটিসীয় এষণা: সমাজের জ্যাঠামশাইরা কে? ‘ভাল’ কি আপেক্ষিক নহে? এতদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত ও সমাদৃত পিচ-উৎকর্ষের সংজ্ঞাকে ধ্রুব মেনে চলতে হবে কেন? ভারতীয় দল (এবং অধিকাংশ সমর্থক) মনে করে, ও-সব ভুল-ঠিকের প্রশ্ন তখন উঠবে, যদি হেরে যাই। যতক্ষণ জিতছি, হাতে-গরম ফল পাচ্ছি, কলার ও ট্রফি যুগপৎ তোলো। অর্থাত, অসুবিধেটা কার হচ্ছে? অন্যের। তাতে আমার কী? অথচ সভ্যতার মূল সূত্রটাই হল, অন্যের অসুবিধের প্রতি সমান মমত্ব নিয়ে তাকাও।
আর ইদানীং ভারতীয় সমাজের হ্যাপেনিং মন্ত্র: অন্যকে ঘেঁটি ধরে খালের জলে ভাসিয়ে দাও। একটা দল বলছে অমুক সম্প্রদায়কে দেখলেই পেটাও, দেশ থেকে বের করে সিধে পাকিস্তানে পার্সেল করো। তাই শুনে সুবিধেজনক অবস্থানে থাকা সম্প্রদায় কোথায় বলবে, ‘ছি ছি, এসব কী! বরং আমারই দায়িত্ব, যাতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এখানে থাকতে বিপন্ন না বোধ করে’— তার বদলে সে ডান্ডা নিয়ে নেত্য করছে (ঝান্ডা নিয়েও) আর বলছে, ইকিরমিকির দুরন্ত ফিকির, এই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী দলটাকে ভোট দিই, তাতে শত্তুরগুলো মরবে আর ভড়কাবে, আমার ফুলটু মস্তি। যদি তাদের বলা হয় এসব ধারণা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যায়, মানবিকতারও, তারা ফুকারিবে, ওররে নেকু, ওগুলো পাশ্চাত্য মূল্যবোধ, সেকুলারিজম বলে আদতে কিছু হয় না, উহা আঁতেলদের সাজানো ধাস্টামো, আমরা তাদের ভেংচে বলি সিকুলার, লিবটার্ড। যারা অন্যকে সহন করে, তারা ভীরু, অক্ষম। যারা অন্যদের দাবড়ে দহন করে, দোহন করে, তারা সিকন্দর (যে জেতে, সে-ই…)। এই বিকৃত মনোভঙ্গি এখন শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীময় দিব্যি ফুরফুরে মতবাদ বলে গ্রাহ্য। আগে লোকে এসব অন্তত সর্বসমক্ষে বলতে লজ্জা পেত, এখন দাপিয়ে ইনস্টাগ্রাম্য চণ্ডীমণ্ডপে নিয়মিত খ্যামটা নেচে বলছে, ঝাঁপিয়ে পাশা চেলে বলছে। কচে বারো, আসছে আরও।
আসছেও বটে নূতন, নাগাড়ে, র্যাট-ট্যাট-ট্যাট। জামাল খাশোগি সৌদি আরবের সাংবাদিক, তাদের রাজপরিবারেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন, পরে গন্ডগোল হওয়ায় পালিয়ে আমেরিকায় আশ্রয় নেন ২০১৭-য়। ওয়শিংটন পোস্ট-এ মাসিক কলাম লিখতেন, সেখানে সৌদি রাজকুমার মহম্মদ বিন সালমানের শাসন-নীতির কড়া সমালোচনা করতেন। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে গেছিলেন, নিজের ডিভোর্স সংক্রান্ত কাগজ নিতে, তাঁকে বলা হয় চারদিন পরে আসতে। সেদিন তিনি যান, ঢোকামাত্র তাঁকে খুন করা হয়, তারপর দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়। সৌদি সরকার প্রথমে বলে, আরে না না, উনি তো একটু পরেই বেরিয়ে গেছিলেন। প্রায় দু’সপ্তাহ পরে বিবৃতি দেয়, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকজন জোরজার করছিল, ধস্তাধস্তিতে কেউ এট্টু গর্দান টিপে ধরে, তিনি আচম্বিতে মারা যান। তার ক’দিন পর স্বীকার করে, তাঁকে পরিকল্পনা করেই খুন করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর বলে, এসব কথা রাজকুমার মহম্মদ বিন সালমান কিচ্ছুটি জানতেন না, তাঁর অজান্তেই কয়েকজন রাজপরিবার-ঘনিষ্ঠ মানুষ এই হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। গত সপ্তাহে, আমেরিকার রাষ্ট্রীয় তদন্ত সংস্থা বলেছে, তারা নিশ্চিত, রাজকুমার সব জানতেন এবং তাঁর স্পষ্ট অনুমোদন ছিল খাশোগিকে বন্দি বা হত্যা করার প্রস্তাবে।
যখন ২০১৮-য় এই ঘটনার পর আমেরিকায় প্রকাণ্ড হইহই, অনেকে চাইছে সৌদি আরবকে একঘরে করা হোক, ট্রাম্প বলেছিলেন, রাজকুমার ব্যাপারটা জানতেন কি না, আমরা শিওর নই। তা ছাড়া, আমাদের সম্পর্ক তো রাজকুমারের সঙ্গে না, দেশটার সঙ্গে। জোলো গোঁজামিল, কিন্তু ট্রাম্পকে তো আমরা নীতিরিক্ত বলেই জানি। নির্বাচনী প্রচারের সময় এই প্রসঙ্গ টেনে বাইডেন ট্রাম্পকে তুলোধোনা করতে ছাড়েননি, এও বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হলে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। এখন তিনি রাষ্ট্রপতি, এখন তাঁর দেশের তদন্ত সংস্থা বলছে, রাজকুমার খুন করিয়েছেন। এবার? বাইডেন বলছেন, ইয়ে… মানে… আমরা যে এই তদন্ত-সিদ্ধান্তটা প্রকাশ্যে বলছি এটাই কি তাঁর যথেষ্ট শাস্তি নয়? সৌদি রাজপরিবারের কিছু কিছু লোকের ওপর আমরা আমেরিকায় আসা বা ব্যবসার ব্যাপারে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করব নিশ্চয়, কিন্তু, ম্ম্ম্… রাজকুমারকে তার আওতায় আনতে পারব না। পারবেন যে না, আহা গো বড্ড সদিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুতে যে পারবেন না, তার কারণ স্পষ্ট: সৌদি আরবের হাত ধরেই আমেরিকাকে ইরানের সঙ্গে শত্রুতা চালিয়ে যেতে হবে এবং ইজরায়েলের সঙ্গে বন্ধুতা। বাইডেন বলেছেন, তিনি ফোন করেছিলেন সৌদি আরবের রাজপরিবারে, রাজার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু রাজকুমারের সঙ্গে মোট্টে বলেননি। শুনলেই অশ্রু এসে যায়, উলিবাবালে, প্রেমিক-প্রেমিকার অভিমান, মিঠে-আড়ি ও ফুলো ঠোঁট। অথচ এক নিরপরাধ মানুষ খুন হয়েছেন, একজন সমালোচক খুন হয়েছেন, বাক্স্বাধীনতা— যা নাকি আমেরিকার (এবং আধুনিক পৃথিবীর) সর্বোচ্চ সম্পদ— খুন হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বদল হল, রাষ্ট্র একই অনীতি-গত্তেই তড়পাল তাহলে? নির্লজ্জ ও পূর্ণ ভণ্ড এই ‘ট্রাম্পি সোনা দুটো হাম্পি দে না’ ইউ-টার্ন কি আমাদের বাংলার ডিগবাজিয়াদের দেড়া হল না?
অবশ্য হালফিলের বুলি অনুযায়ী, চোখের চামড়া-হীনতাও এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। বুক বাজিয়ে তেজিয়ান অশ্বের ন্যায় পুকারো, চিঁহি চিঁহি, আমি দৃপ্ত নী-হী (উয়ার মানে নীতিহীন)। অথচ এই যুগ মনুষ্যেতিহাসে সর্বাধিক জন-নজরদারির যুগ, সর্বোচ্চ জন-আলোচনার যুগ, সমাজমাধ্যমে জনতার রায় বিখ্যাত লোকের কেরিয়ার মারতে-বাঁচাতে পারে, প্রত্যেক কথা নথিবদ্ধ থাকে এবং সমুদয় অকাজ তোরঙ্গের ধুলো ঝেড়ে কেউ না কেউ লোক-গোচরে আনে। কমন সেন্স বলে, এই কালে মানুষ এট্টু লুকিয়েচুরিয়ে ফেরেব্বাজি করবে, নইলে তাদের অতীত-বাণী আর বর্তমান-ডায়লগ পাশাপাশি কাট করে বসিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ছেড়ে দেওয়া হবে, তা ভাইরাল স্পাইরালে বাঁইবাঁই। কিন্তু বাপ, এ প্রজাতির অভিযোজন-ক্ষমতা দেখে ঈশ্বর ডাঁয়ে-বাঁয়ে মুচ্ছো! লজ্জার স্প্রে এড়াতে না পারলে লজ্জার অ্যান্টেনাটিকেই আমূল ছেঁটে ফেলার স্ট্র্যাটেজি শুধু হোমো নন-এথিকাস’এরই ব্রেনে ঝলকাতে পারে। সে এই জমানার নাড়ি টিপে বুঝে গেছে, চোরের মা’র বড় টিআরপি। ঘোষিত আনুগত্য যখন নিমেষে বিসর্জন দিচ্ছে পাঁচ-দশ কোটি টাকা সাবড়ে, তখন সে নিশ্চিত, পাবলিক দু’বচ্ছরে তার বিবেক-ছ্যাতরানির কথা ভুলে যাবে, কিন্তু প্রকাণ্ড টাকার ঈর্ষা ও সমীহটা টনটনিয়ে মনে রাখবে। তাই ওই উদ্ভট ধ্বনি। ও কী? ও কী গো? বিবেক ফ্লাশ হল। ইহা আমাদের ক-মোড। খ-মোড, কাল বলব।