ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মুখঋত: পর্ব ৩

    ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় (March 20, 2021)
     
    সাজুগুজু আর অতিমারী

    জামাকাপড় পরা নিয়ে লোকজনের কী মাথাব্যথা, বাপ রে! কার কখন কীভাবে সাজা উচিত, কী জামাকাপড় পরে থাকা উচিত, এটা নিয়ে বোধহয় একটা রুল-বুক আছে। যদিও বইটা হাতে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার, তবে লোকমুখে এর গাথা বেশ প্রচলিত। সবার পংক্তি ও অধ্যায় মুখস্থ। তাই বোধহয় অলিতে-গলিতে, চায়ের দোকানের কাকু থেকে শুরু করে মোড়ের মাথার জেঠিমা সবাই বলতে পারেন— কোন জামাটা বেশি ছোট, কোনটা বেশি খোলামেলা আর কোনটা বেশি ঝলমলে। একই সঙ্গে ‘রামায়ণ’ বা ‘মহাভারত’ বা ‘পঞ্চতন্ত্র’-এর মতো, লোকের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় বর্ণের কাহিনী। কোন রং গায়ে থাকলে মানুষ চেনা সহজ, কোন রং কীভাবে বুঝিয়ে দেয় মানুষের মনের অবস্থা, তার চরিত্র। এই চূড়ান্ত কঠিন ‘মনস্তত্ত্ব’টিকে সরলীকরণ করে আমাদের গণতন্ত্রের চারিপাশে ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন একদল কাঁকড়া, যাঁদের আমরা সমাজের ধারক ও বাহক বলে মনে করে থাকি। 

    চলছিল ভালই, তবে হঠাৎ করে এল কোভিড-১৯। এল ‘নিউ নর্মাল’। নিয়ে এল নতুন নতুন নিয়ম। বদলে দিল পুরনো অনেক প্রথা। আর এই জামাকাপড় পরা বা সাজগোজ করার কায়দায় বিরাট বদল এল। ‘মাস্ক’ এসে পাল্টে দিল প্রচলিত ফ্যাশন-ধারাকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় হিট হয়ে গেল মাস্কের ব্যবহার, বদলে গেল পোশাক আর রূপসজ্জার সংজ্ঞা। 

    আমরা অবচেতনেও জানি, আমাদের রোজকার বেঁচে থাকায় কোনও এক অদৃশ্য শক্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, প্রায় সব ক্ষেত্রেই। যদিও সেটা আসলে একটামাত্র শক্তি নয়, অনেকগুলো শক্তির সমাহার। আমাদের সামাজিক কাঠামো, পিতৃতন্ত্র, পুঁজিবাদ— সব মিলিয়েই নির্ধারিত হয়, উচিত আর অনুচিতের সংজ্ঞা। পোশাকও এই শাসিয়ে দেওয়া নিয়মের বৃত্তে আবদ্ধ। যে পোশাক তৈরি হয়েছিল মানুষের নগ্ন দেহটাকে রক্ষা করার জন্য, তা এখন সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। এতে তৈরি হয়েছে আরও এক রকমের বিভাজন। আর শুধু যে সামাজিক গুরুত্ব বা ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ বোঝানোর জন্য রূপসজ্জা তা নয়, কখনও কখনও তা নাকি আপনার মানসিকতার পরিচয়! যদি তা-ই হয়, তা হলে ভারতবর্ষের যে লোকগুলো পরনের কাপড় পায় না, তাদের মানসিকতাটা কী? না কি আগে সেই রাষ্ট্রের মানসিকতা পরীক্ষা করতে হবে, যা এতগুলো লোককে বস্ত্রের জোগান দিতে পারেনি? যে রাষ্ট্রের নিয়ামকরা মনে করেন, বছরে একবার ‘কম্বল দান’ অনুষ্ঠান করলেই দায়মুক্ত হওয়া যায়? 

    এত বিভাজনের দেশে আরও একটি বিভাজন তৈরি না হলেই ভাল ছিল। কিন্তু তা তো হয় না। আমাদের ভারতীয় পরিচয়ের এক গৌরবময় বৈশিষ্ট্য হল, আমরা অপর একটি মানুষকে তার রং, নাম, বর্ণ, লিঙ্গ ছাড়াও এখন পোশাক দিয়ে বিবেচনা করতে পারি, তাকে বিচারের কাঠগড়াতেও তুলতে পারি। সেই আদালতে সবাই মহামান্য বিচারপতি। ‘আপনি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে আছেন মানে আপনি জরুরি নন’, বা ‘দেখুন দেখুন কত বেশি সেজে এসেছে দেখুন’ প্রভৃতি রায়/শুনানি এই আদালতের রেকর্ড-কক্ষে রাখা রয়েছে। এই কক্ষ খুবই পুরাতন। 

    কিন্তু নতুন অতিমারী ব্যাঘাত ঘটাল ‘আদালত’-এর কাজে। এখন আপনি যা-ই পরুন না কেন, আপনার পরনে হাফপ্যান্ট থাক কিংবা টাক্স থাক, মাস্ক তো পরতেই হবে! ব্যাস! অমনি ধসে পড়ল আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা মন্থর, স্থূল ভারতীয় প্রথা। এবার আর কেউ বুঝতে পারছে না, কী দিয়ে সৌন্দর্য বিচার করবে। কারণ ভারতীয় শিশুদের জন্মলগ্ন থেকেই শেখানো হয় যে ‘মুখ’ হল সৌন্দর্যের একমাত্র তীর্থস্থান, শরীর বা মনের আর কোনও অংশ— বুদ্ধিবৃত্তি বা মনন তো দূরের কথা— মুখশ্রীর কাছাকাছিও আসে না। কিন্তু মাস্কের ব্যবহার তো এই সৌন্দর্যের সংজ্ঞা গুলিয়ে দিচ্ছে। 

    তার আগে অবশ্য, দেশের শাসনের ভার যাঁদের ওপর, তাঁদের একজন জানিয়েছেন, পোশাক দেখেই নাকি বোঝা যায় মানুষটি কেমন। এই প্রকার প্রেরণা পেয়ে বেশ খানিক উদ্বুদ্ধ জাতি এগিয়ে গেছিল আরও নিম্ন মানের বিশ্লেষণে। আমাদের এমনই অবস্থা যে ক্যালেন্ডার দেখতে ভুলে যাই। ২০২১ দাঁড়িয়ে যে ১৩৫০-এর মস্তিষ্ক আমাদের গোটা জাতি ধরে রেখেছে, তার হাত ধরেই অবক্ষয় আসছে, যাকে স্বাগত জানাচ্ছে মধ্যমেধা আর অল্প-শিক্ষা। ছোট প্যান্ট, হাফপ্যান্ট, কাটা জিনস, হাতকাটা জামা, স্লিভলেস ব্লাউজ, টাইট গেঞ্জি বা হাওয়াই চটি পরলেই ‘এ কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড’ বলে একঝাঁক চোখের নজর সারা শরীরটাকে ধর্ষণ করে যায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। পুরুষ হলে তা-ও মারধর করে, গণপিটুনি দিয়ে আমাদের অশিক্ষিতের আদালতে তুলে দেওয়া যায়, কিন্তু কোনও নারী যদি এই কাজ করলে ভারতীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও ধর্মের অবমাননা হয়, যার শাস্তি হত্যা অথবা ধর্ষণ। 

    সেক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এক আশীর্বাদ, যা আমাদের নিয়ে গেল আবার সেই প্রাথমিকে, যেখানে শেখার শুরু। নিউ নর্মাল আমাদের পচে যাওয়া নোনা জলের আদালতের বৃথা বিচারের ওপর কড়া আঘাত করেছে। পোশাক আসলে আরামের জন্য, ভালবাসার জন্য। কে কী পরে স্বাভাবিক বোধ করে তার বিচার করার অধিকার কার আছে? এই প্রশ্নের সম্মুখীন জাতি এখনও ভাবছে। ভাবতে ভাবতে মুখ বাঁকাচ্ছে কি না, বুঝতে গেলে মাস্ক সরাতে হবে!

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook