ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • অসুখের ঠাকুর

    দেবদত্ত পট্টনায়েক (Devdutt Pattanaik) (March 26, 2021)
     

    যখন বাংলার ঘরে ঘরে মানুষের অসুখ হত, পরিবারের মেয়েরা তখন পুজো করতেন জ্বরা-জ্বরীর, যাঁরা ছিলেন জ্বর-বিকারের ঠাকুর দুই যমজ ভাই-বোন। এই জ্বর-ধরানো ঠাকুরদের বিষয়ে, অথবা তাঁদের পূজা-পদ্ধতির ব্যাপারে, বিশেষ কিছু জানা যায় না। 

    তবে পুরাণে একটা গল্প পাওয়া যায়। দক্ষ যখন যজ্ঞ করেন, তিনি শিব ছাড়া আর সমস্ত দেবতাকে নিমন্ত্রণ জানান। এতে বেশ কিছু মুনি-ঋষি ভীষণ রেগে গিয়ে শিবের কাছে নালিশ করেন। তবে শিব ছিলেন দক্ষের যজ্ঞের ব্যাপারে নির্বিকার, নিমন্ত্রিত না হওয়ায় তাঁর কিছুই যায় আসেনি। অবশেষে এই মুনি-ঋষিদের পীড়াপীড়িতে শিবের কপাল থেকে ঝরে পড়ে এক বিন্দু ঘাম। এই ঘামের থেকে জন্ম নেন জ্বরা (এবং তার সঙ্গে সম্ভবত জ্বরী, যদিও সে কথা কোথাও বলা নেই), এবং যজ্ঞভূমিতে গিয়ে তিনি ছড়াতে শুরু করেন অসুখ। তার প্রকোপে পবিত্র আগুনের চারপাশে বসা লোকজনের শরীর তপ্ত হয়ে ওঠে, পেশিতে ব্যথা শুরু হয়, চামড়ায় চুলকুনি হয়, নানা গোপনাঙ্গে দাগ দেখা যায়, ফুসকুড়ি-গোটার দাগে ভরে যায় দেহ। অবিরাম হাঁচি আর কাশির চোটে পুরোহিতরা মন্ত্র পড়া থামিয়ে দিতে বাধ্য হন, তাঁদের কর্কশ হয়ে ধরে যাওয়া গলার স্বর আর শ্লোকপাঠের উপযুক্ত থাকে না। মুনি-ঋষিরা বলতে থাকেন, ‘শিবকে উপেক্ষা করার এই পরিণতি!’ অবশেষে দক্ষ শিবের আরাধনা করতে বাধ্য হন, এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শিব যেমন সহজেই ক্ষুব্ধ হন, প্রসন্নও হন তেমনই তাড়াতাড়ি। অতএব তিনি সবার অসুখ দূর করে দেন, এবং সেই দিন থেকে বৈদ্যনাথ বা সকল বৈদ্যের প্রভু নামে পূজিত হচ্ছেন। 

    ভারতবর্ষ জুড়ে সপ্তমাতৃকা নামে সাতজন মা অথবা সাতজন কুমারী রূপে দেবীদের পীঠস্থান রয়েছে। সাধারণত এই পীঠস্থানগুলি পুকুর বা নদীর ধারে, অথবা নিমগাছ বা তেঁতুলগাছের পাশে সিঁদুর-মাখানো পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়। মহারাষ্ট্রে এঁরা ‘সতি অসরা’ নামে খ্যাত, যেটি সম্ভবত ‘সপ্ত অপ্সরা’ শব্দের অপভ্রংশ। বলা হয়, এঁরা গর্ভবতী মহিলাদের অকালে গর্ভপাত (miscarriage) করিয়ে দিতে, অথবা অল্পবয়সি শিশুদের শরীরে ফোঁড়া-ফুসকুড়ির অসুখ বাধিয়ে দিতে সক্ষম। এই দেবতারা ঠিক কোথা থেকে এলেন, সে বিষয়ে কেউই জানে না, সারা ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামে গ্রামে এঁদের সন্ধান পাওয়া গেলেও এঁদের উৎপত্তির ব্যাপারটা আগাগোড়াই রহস্যে ঢাকা। কোনও কোনও গল্পে সপ্তর্ষি নক্ষত্রমণ্ডলের সাত ঋষির সাত স্ত্রী-দের সঙ্গে এঁদের যোগসূত্র স্থাপন করা হয়। বলা হয়, একবার এঁরা বিবাহের কোনও চিহ্ন (সিঁদুর ইত্যাদি) শরীরে না ধারণ করেই পবিত্র হোমের আগুনের সামনে যান, অথবা পুকুরে স্নান করেন। ফলে আগুনের তাপে, অথবা জলের আর্দ্রতায়, তাঁদের সবারই গর্ভে সন্তান আসে। অতএব ব্যভিচারের দোষে অভিযুক্ত করে তাঁদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাই এখন তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান। যে নারীরা তাঁদের সতী, পবিত্র দেবী বলে স্বীকার করে না, তাদের অনিষ্ট করতে এঁরা বদ্ধপরিকর। শিবের পুত্র স্কন্দকে এঁরা হত্যা করবার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি এঁদের মা বলে সম্বোধন করেন এবং এঁদের স্তন্যপানও করেন। তার ফলে কেউ এঁদের অমান্য করলে তাদের উপর জ্বরের অভিশাপ দেবার শক্তি এঁরা অর্জন করেন। কৃত্তিকা বা প্লেইয়াডেস নক্ষত্রমণ্ডলের সঙ্গেও এই দেবীদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। 

    জ্বর-বিকার ঘটানোর এই সাত মাতৃমূর্তিকে একজন দেবী হিসেবে পুজো করার প্রচলনই অবশ্য বেশি। এই দেবীর নাম জরী-মরী মাতা; জরী অর্থে জ্বরী বা জ্বরের অসুখ, আর মরী এসেছে মরু অর্থে মরুভূমির রুক্ষ, অনুর্বর তাপ থেকে। বিশেষ করে বসন্তরোগের ক্ষেত্রে এই দেবী পূজিতা হন শীতলা নামে; শীতল দেবতা যিনি, দই, বিয়ের কনের সাজ, অথবা নিম, লঙ্কা, তেঁতুল বা লেবু জাতীয় শীতল করার দ্রব্যের মানত-এ তিনি শীতল হন। শীতলা মাহাত্ম্যের বর্ণনা অনুযায়ী দেবীর বাহন গাধা, তাঁর হাতে থাকে ঝাড়ু, জ্বর-সারানো জলের পাত্র, এবং একটি ঝুড়ি— যার মধ্যে রয়েছে ডাল (সেই ডালের দানাগুলো বসন্তরোগের গুটির মতো দেখতে)। তাঁর সঙ্গীরা হলেন জ্বরা, ঘেঁটুকর্ণ (যিনি চর্মরোগের ও নানারকম চুলকুনির অসুখের ঠাকুর) এবং রক্তাবতী (যাঁর প্রভাবে রক্তস্রাবের নানা অসুখ হয়)। দক্ষিণ ভারতে যাঁকে অবহেলা করলে জ্বর হয় এবং যাঁকে মান্যতা দিলে জ্বর সারে, সেই দেবীর জায়গা অবশ্য প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিয়েছেন মারিয়াম্মা। এ সব মন্দির ভারতবর্ষ জুড়ে আজও জনপ্রিয়।

    আজকালকার দিনে খুব বেশি মানুষ আর বিশ্বাস করেন না, অসুখ হল অপদেবতার অভিশাপ, বা দেবতার ক্রোধ, যা তাঁরই পূজায় প্রশমিত হবে। তবে গল্পগুলো রয়ে গেছে। এতে বোঝা যায় আমরা প্রথাগত ভাবে অসুখ জিনিসটাকে অতিপ্রাকৃতিক হিসেবে নয়, বরং প্রাকৃতিক শক্তির ভারসাম্যের অভাব হিসেবে বিশ্বাস করি। এই প্রবন্ধের প্রত্যেকটি গল্পেই কিন্তু অসুখের মূলে রয়েছে কষ্ট ও যন্ত্রণা; দক্ষের শিবকে অমান্য করা, ঋষিদের তাঁদের স্ত্রীদের প্রতি সন্দেহ ও পরিত্যাগ করা, অবিবাহিতা বা অপুত্রক হবার দোষে মহিলাদের প্রতি কুব্যবহার। সেকালে শরীরের অসুখকে সামাজিক পীড়নের, অথবা চারপাশের পৃথিবীর প্রতি আমাদের দয়া-দাক্ষিণ্যের অভাবের ফল হিসেবে দেখা হত। এই দেবতাদের আমরা ভয় করতাম, কারণ জীবনের বিষয়ে কিছু ধ্রুব সত্যকে আমরা মেনে নিতে নারাজ ছিলাম।  

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook