ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঈশ্বরও নয়, বীরপুরুষও নয়: পর্ব ২


    অস্কার গুয়ার্দিওলা-রিভেরা (Oscar Guardiola-Rivera) (March 26, 2021)
     

    পর্ব ১

    অবশ্য এই নকল করাটাও খুব উৎপাদনশীল হতে পারে। সাহিত্যশিল্পের বিশ্বজোড়া বাজারে গার্সিয়া মার্কেসের হোমার-তুল্য বা সোফোক্লিস-তুল্য ক্যাটালগটির বিক্রিবাটা চলতেই পারে, চলতে পারে তার পক্ষে-বিপক্ষে বাজি ধরার খেলা। তাঁর কল্পিত, দেবত্বারোপিত রূপের চোখ-ধাঁধানো আলোয় স্প্যানিশ ভাষায় লেখা তথাকথিত ‘আধুনিক সাহিত্যিক ফিকশন’ বৈধতা পেতে পারে সর্বযুগের কল্পিত সার হিসেবে, যার হিসেব-নিকেশ করবেন সারা পৃথিবীর প্রকাশনার কোম্পানিতে বসা ম্যানেজার আর গাণনিকরা। 

    একই কাণ্ড ঘটে পরজীবী (বেরসিক, মারাত্মক সিরিয়াস) রাষ্ট্র/বাজারের ক্ষেত্রে, যে তার নগণ্য উৎপাদনকারীদের রক্ত চুষে খায়, তারপরে হত্যা করে, ছেড়ে দেয় মহামারী বা মৃত্যুর হাতে, অথবা সন্ত্রাসবাদ আর গেরিলাদের প্রতি সহানুভূতির অভিযোগ চাপিয়ে আরোপিত নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়, যেমনটা করেছিল গার্সিয়া মার্কেসের বেলায়। বলা যায়, গার্সিয়া মার্কেসকে দেবতার আসনে বসানোটা আসলে পয়সার অন্য পিঠ; তাঁর একান্ত বিনীত, মানুষী, অনাধ্যাত্মিক সত্তার ভিতর যে ফাটলগুলো, যে অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো, তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একরকমের মুখোশ বা রূপকল্প মাত্র।

    ঠিক এই অন্তর্দ্বন্দ্ব বা সংঘাতেরই স্বরূপ চিনতে চায়, পরিষ্কার করে দেখাতে চায় তাঁর লেখা, রসিকভাবে, বিদ্রুপের সাহায্যে। চায়, যাতে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে আমাদের স্মৃতি-সক্রিয়তা ঠিকমতো কাজ করতে পারে। আমাদের অপদার্থ আমলা, আমাদের বেরসিক সঙের মতো প্রশাসক, দেশনায়ক, আচমকা হয়ে ওঠা ‘বুদ্ধিজীবী’ যারা এই ক’দিন আগেও খবরের কাগজ বা টিভি রিয়ালিটি শো’য়ের তারকা ছিলেন, বীরপুরুষের বেশে প্রেসিডেন্ট বা সি ই ও, সাংস্কৃতিক জিনিয়াস বা স্বৈরাচারী, বা এরকমই স্বকামী অহঙ্কারী যত মানুষ যাঁরা নিজেদের সামনে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রহসন-হয়ে-ওঠা-ট্র্যাজেডির দর্শকদের সামনে ‘ব্রহ্মাণ্ডের হর্তাকর্তা বিধাতা’ সাজেন— গার্সিয়া মার্কেস লেখেন যাতে এঁদের সবাইকে নিয়ে আমরা হাসতে পারি, ঠাট্টা করতে পারি।

    এই হাসিটাই আসলে প্রতিবাদের সর্বজনীন মাধ্যম, ‘মোহভঙ্গের প্যারাডাইম’-এর নৈরাশ্যবাদের চেয়ে সক্রিয়তার ঢের উপকারী অভিমুখ। প্রথমটি যেন বাতাসের মতো, লাইটহাউসের মতো আলো দেয়, আমাদের সতেজ করে। সে নিঃশ্বাস নেবার বাতাস এনে দেয়, আর এই অতিমারীর যুগে আমরা তো জানিই নিঃশ্বাস নেওয়া বা না-নেওয়ার কতটা গুরুত্ব! নগণ্য উৎপাদক গার্সিয়া মার্কেসের সক্রিয়তার এটাই ফসল। দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ মোহভঙ্গের প্যারাডাইম, যেন উত্তর সাগরে বোম্বেটের হাতের বাতি। তারা ইচ্ছে করে দূর থেকে ওই আলো দেখিয়ে নাবিকদের পথ ভুলিয়ে এনে, পাথরে ধাক্কা লাগিয়ে জাহাজডুবি করিয়ে দেয়, পরে সব লুটপাট করে নেবে বলে। এ পথ ধ্বংসের পথ, কেবল শূন্যতা উপহার দেয়। অন্যভাবে বলা যায়, এ পথ অত্যন্ত উৎপাদনশীল হলেও মোটেই উৎপাদনকারী নয়।


    এভাবেই আজ এই কলোম্বিয়ান লেখকটিকে পড়া আমাদের উচিত; একজন উৎপাদনকারী হিসেবে। যে পাঠকেরা তাঁর জ্ঞাতি নয় বরং অজ্ঞাত, সেই অচেনা এবং অপরিচিত পাঠকের সঙ্গে তিনি এক রকমের আঁতাঁত করছেন, যাতে সমস্যাগুলোকে সঙ্গে রেখে একটা অন্য রকমের ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করা যায়। লাইটহাউসের মতো আলো দিচ্ছে তার লেখা, পরিষ্কার করে দেখাচ্ছে আমাদের সমকালকে, দেখতে সাহায্য করছে, হাসতেও। 

    তিনি বলেছিলেন, যে আমেরিকায় একটিই কাল্পনিক/পৌরাণিক চরিত্র আবিষ্কার করা হয়েছে, এবং সেটি হচ্ছে স্বৈরাচারী। এই কটাক্ষের অর্থ বোঝা যায় তাঁর লেখাকে এইভাবে দেখলে। এটুকু যোগ করা দরকার যে, আজকের এই স্বৈরাচারী ঠিক সাবেকি ইডিপাস টাইরানুস নন, তার এক রকমের ভাঁড়ামি করা কল্পিত সিম্যুলেশন; নিজেরই নকল, অর্থাৎ নিছকই একটি পণ্য, সুবিধামতো তাকে ভোগ করে বর্জন করাই শ্রেয়। 

    বইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত

    যে রূপকথাটি এখানে বেশি প্রযোজ্য, সেটি নার্সিসাসের উপাখ্যান, যদি তার রূপ এবং প্রতিফলিত ছবির রূপক হিসেবে আমরা ধরে নিই আমাদের আইফোনের সর্বকামী দৃষ্টিকে, প্রযুক্তিজগৎ জুড়ে চিত্রকল্পের জঞ্জালগুলোকে, যা আমাদের স্বয়ংক্রিয় জীবনযাপনের অ্যালগরিদমগুলোকে প্রতিনিয়তই (ভুয়ো) খবর পাঠিয়ে যাচ্ছে। 

    স্বৈরাচারীরও অবশ্য শিক্ষা হয়েছে। সে নিজের সামরিক পোশাক ছেড়ে ফেলেছে, সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের ভড়ং আর তার নেই, কালো রোদচশমা আর পুরুষালি গোঁফটাও গেছে। সে এখন ছাই-রঙা স্যুট পরে, মুখের ভাষা থেকে শরীরের পোশাক সবটাই তার এখন খুব ব্যবসায়িক। সে এখন অ্যাক্রোনিমের ভাষায় কথা বলে, ক্যামেরার সামনে তুলে ধরে যত রকমের মাপজোক আর এক্সপার্ট সমীক্ষা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের না হলেও, ক্যামেরার সামনে প্রহসনের এবং নিজেদের সং সাজানোর তারা সত্যিই হর্তাকর্তা-বিধাতা হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারা আমাদের হাসায় না, হত্যা করে।


    একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। মোহভঙ্গের প্যারাডাইমের পরিসরে যে উৎপাদনশীল সাহিত্য রয়েছে, তা আসলে পাশ্চাত্যের ও প্রাচ্যের গণ-ইউটোপিয়াগুলোকে (গত শতাব্দীর ইতিহাসে যার বিপুল গুরুত্ব ছিল) মুছে ফেলার বা নাকচ করার বৃহত্তর একটি প্রচেষ্টার অংশ। এই ইউটোপিয়ান চেতনা বা প্রেরণার ধারক হিসেবেই গার্সিয়া মার্কেসের সক্রিয়তাকে দ্যাখা উচিত। অতএব, ভবিষ্যতকে ধীরে ধীরে নাকচ করে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা, এই সক্রিয়তা তারই বিরোধিতা করে। 

    সেক্ষেত্রে আমাদের মূল প্রশ্ন, এবং গার্সিয়া মার্কেসের লেখা কীভাবে পড়ব সেই আলোচনার মূল বিষয়, স্মৃতি নিয়ে। আর অন্তত এই ক্ষেত্রে গার্সিয়া মার্কেসের লেখা অতীতের সেই লাতিন আমেরিকান ‘বুম’ এবং ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’-এর (সেই অসার্থক নামটি, কোনও এক বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেনের বা ভাষার ভুলের ফল) স্বর্ণযুগের চেয়ে আমাদের এই যুগে হয়তো আরও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

    অর্থাৎ, স্প্যানিশ ভাষায় লেখা আধুনিক সাহিত্যের স্বাভাবিক-করণের প্যারাডাইমের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। আধুনিক সাহিত্যিক ফিকশনের ধ্বংসাবশেষে ‘ট্র্যাজিক’ নিয়তির হাত থেকে তাকে রক্ষা করাই প্রয়োজন। একটু খোলসা করে বলতে গেলে, আমাদের আলোচনার বিষয় হিসেবে যদি স্মৃতিকে দেখি, শুধু দক্ষতা বা উৎপাদনশীলতার বিচারে নয় বরং অন্য রকম ভবিষ্যতের গঠনে স্মৃতির সার্থকতার বিচারে (অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং কল্পিত, উন্নত জীবনের বাসনার যোগসূত্র যে সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের নিরিখে), তবে দেখা যায় গার্সিয়া মার্কেসের লেখায় মহামারীর উপস্থাপনা, বিশেষ করে বিস্মৃতির মহামারী, ‘একাকিত্বের একশো বছর’ বইতে যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, আমাদের সমকালে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। 



    আরও খুলে বলা যাক। ‘মোহভঙ্গের প্যারাডাইমের’ যে বিষয়টি, তথাকথিত ‘ভার্গাসলোসাবাদ’ যার একটি নমুনা, তাকে বেভার্লি ভেঙে বোঝাচ্ছেন বিল ক্লিনটনের বিখ্যাত সেই উক্তির সাহায্যে, যে, ষাট এবং সত্তরের দশককে কে কোন চোখে দেখছেন, সেটাই আমেরিকান সংস্কৃতির মূল বিভাজনের স্মারক, তার নিরিখেই বিচার করা যায় কে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিচ্ছেন, আর কে রিপাবলিকানদের। অর্থাৎ আমেরিকান মহাদেশ দুটিতে সশস্ত্র আন্দোলন বা বিপ্লব নিয়ে কার কী মতামত, আর ‘(তথাকথিত) মায়েরা রোসাদা-র নতুন (এখন আর অতটা নতুন নয়) প্রশাসন’ বা এই শতাব্দীর প্রথম দশকে পিংক টাইডের যে প্রগতিশীল আন্দোলনের সরকার আমেরিকান মহাদেশে ঢেউ তুলেছিল (যাদের নিয়ে আমি লিখেছি ‘কেমন হত যদি লাতিন আমেরিকা পৃথিবী শাসন করত?’ বইতে), তাদের নিয়ে কার কী দৃষ্টিভঙ্গি, এই দুইয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। তবে বেভার্লির বক্তব্যে আর একটু সংযোজন করা যাক, সমকালীন কয়েক বছরে প্রতিক্রিয়াশীল উত্তর-ফ্যাসিজমের উত্থানের কারণগুলো খুঁজতে। ঐতিহাসিক স্মৃতির নিছক উৎপাদনশীল শক্তি অথবা ভবিষ্যতের কারিগর হওয়ার উৎপাদনকারী শক্তির নিরিখে এই যোগসূত্রগুলোর কথা তুলছি কেন? উত্তরটা সহজ। কেউ যদি সশস্ত্র আন্দোলন বা বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে, আর গত শতাব্দীতে তার প্রতিপক্ষ ছিল যে ফ্যাসিস্ট শক্তি, এই দুটিকে সমানভাবে ভুল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন, তাহলে আমেরিকার সংশোধনবাদী বামপন্থী পিংক টাইডের সরকার অথবা ব্রিক্স আঁতাত, যার মধ্যে এ শতাব্দীতে ভারতও রয়েছে, এদের প্রতিও তাঁর অত্যন্ত সন্দেহ থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। এই ধরনের মানুষ নিজেদের মডারেট মধ্যপন্থী হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন, এবং পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতে যে কোনওরকমের অগ্রমুখী জীবন যে সম্ভব, সে বিষয়েও এঁদের সন্দেহের শেষ নেই।  

    এই যে এক সর্বগ্রাসী নৈরাশ্যবাদ, যা অতীতের ইউটোপিয়াকে মুছে ফেলে ভবিষ্যৎকেও নাকচ করে দিতে চায়, তা আমাদের সমকালের বিষাক্ত, মহামারী-রূপী, অমৌলিক ফ্যাসিবাদের জন্ম এবং লালনের জন্য বড় উর্বর মাটি। এখানেই বাস্তব এবং কল্পনার সেতুবন্ধনে স্মৃতির ও উৎপাদনকারী বা সৃষ্টিশীল সক্রিয়তার ভূমিকা নিয়ে দু’ধরনের ভাবনার মধ্যে আমাদের যে তুলনামূলক আলোচনা, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমরা এই মতাদর্শে বিশ্বাস করি না ওই মতাদর্শে, বা কোনও মতাদর্শেও যদি না করি (বলে রাখা ভাল, ওই অবিশ্বাসটি নিজেও আসলে একটি মতাদর্শ), সেসব এখানে প্রশ্ন নয়। বরং প্রশ্নটা এখানে নেহাত বস্তুবাদী; এটা সময় এবং ইতিহাসের প্রশ্ন। আমরা স্মৃতির সক্রিয়তা এবং তার নগণ্য উৎপাদনকারীদের ভবিষ্যতের কারিগর হিসেবে দেখব, না কি সেই সক্রিয়তাকে আমরা নিছকই উৎপাদনশীল, অর্থাৎ যান্ত্রিক এবং বর্জ্য হিসেবে দেখব, সেই প্রশ্ন। যদি প্রথমটি হয়, তবে শৈল্পিক সক্রিয়তা এবং নৈতিক-রাজনৈতিক চেতনার মিলনক্ষেত্রে বিরাজ করছে ইতিহাস স্বয়ং! অতীতের ইতিহাস নয়, ভবিষ্যৎ ইতিহাসের সম্ভাবনা। যদি দ্বিতীয়টি হয়, তবে ভবিষ্যতের নিয়তি আগে থেকেই নির্ধারিত করে তাকে নাকচ করে দিতে হয়। 

    অতএব দ্বিতীয় বোধটিকে যে অবসাদবাদী, বা আরও বিশদে বললে চির-নৈরাশ্যবাদী বলে চিহ্নিত করা যায়, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বেভার্লি যখন আর্জেন্তিনার কার্শনার প্রশাসনের নিরিখে সাহিত্যতাত্ত্বিক বিয়াত্রিজ সালোর মন্তব্যের কথা বলছেন, এবং সেটারই জের টেনে রাজনৈতিক ভাবুক বা তাত্ত্বিকের ভূমিকায় অভিনয় করা মারিও ভার্গাস লোসার মতো মানুষদের নিয়ে লিখছেন, তিনি এই নৈরাশ্যবাদের কথাই বলছেন। ভার্গাস লোসার মতো মানুষদের বলা যায় মতামত-নির্ধারক; নিজেদের চির-নৈরাশ্যবাদকে তাঁরা অনুমোদিত ও স্বীকৃত মতামত সাজিয়ে সবার উপর চাপিয়ে দেন, একই সঙ্গে খারিজ করে দেন ভিন্ন সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতকে। টমাস কার্লাইল যাকে ‘ভিজ্যুয়ালিটি’ বলেছেন, এঁরা ইতিহাসকে দেখেন সেই চোখে, অর্থাৎ উপর থেকে, যেন কোনও দৈব পর্বতের চূড়ায় বসে। এ ইতিহাস হল বীরপুরুষদের ইতিহাস, যুদ্ধজয়ীদের ইতিহাস, স্মৃতিকে ‘এলিথিয়া’ বা স্থিতিকে তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়ার যন্ত্র হিসেবে দেখার গ্রিক জীবনবোধ। এ হল ট্র্যাজেডির আকারে গোটা ইতিহাসকে সাজিয়ে নেবার প্রচেষ্টা, মূল বিষয় সেখানে ‘ফরটুনা’ বা যে অনিবার্য অদৃষ্ট থেকে কারও মুক্তি নেই, যে পাপ বা ভ্রান্তির থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। সে পাপের প্রায়শ্চিত্তের একমাত্র উপায় এক ধরনের পুনর্জন্ম, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া। ট্র্যাজেডির কাব্যশৈলী এবং দর্শনের ভাষায় বলতে গেলে, এনাগনরিসিস এবং ক্যাথারসিস, প্রায়শ্চিত্ত এবং শুদ্ধিকরণ। 

    ১০
    একটু লক্ষ করে দেখবেন, আমি কিন্তু এখানে শুধু ভাবাবেগ বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি না, বরং প্রাতিষ্ঠানিক মনোভাবের কথাও বলছি। গার্সিয়া মার্কেসকে কীভাবে মনে রাখব, সে বিষয়ে ভাবার এটাই মূল কারণ, কী ভাবে তাঁর লেখা পড়ব, ট্র্যাজেডি এবং সময় নিয়ে তাঁর জীবনবোধকে বুঝব। 

    হ্যাঁ, আমি গার্সিয়া মার্কেস এবং ‘ভার্গাসলোসাবাদের’ মধ্যে একটা তুলনা জোর করেই আনছি, উস্কানি দিয়েই আনছি। দুজনের মধ্যে তো আর কখনও হাতাহাতি হয়নি! গার্সিয়া মার্কেস ছিলেন কিউবার সমর্থক এবং বামপন্থী, সে তুলনায় নোবেল প্রাইজে ভূষিত ভার্গাস লোসাকে প্রতিষ্ঠিত জনমতে অনেক বেশি পলিটিক্যালি কারেক্ট, শোভন, এবং তাঁর সমকালের সঙ্গে অনেক বেশি মানানসই লাগে; অতিউদারপন্থী বা লিবেরটারিয়ান, মোহভঙ্গের প্যারাডাইমের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত, স্বাধীন সমাজের যারা ‘শত্রু’ তাদের ঘোষিত শত্রু, এল পাইস দে এস্পানা বা ওলা পত্রিকার সহজাত বুদ্ধিজীবী। তা ছাড়া এটাও একটা তফাত, যে ইনি এখনও বেঁচে আছেন। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে যা যা বলা যায়, জেরাল্ড মার্টিন তাঁর চমৎকার জীবনীতে নিশ্চয়ই বলে ফেলেছেন। ভার্গাস লোসার জীবনী তিনি কবে লিখবেন, সেই অপেক্ষায় আমরা রয়েছি। 

    ভার্গোস লোসার সঙ্গে মার্কেস

    অতএব, গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে আমরা আর কী বলতে পারি? কিছুই না। সামান্য কিছু। অল্প কিছু বলতে পারি। বিনীতভাবে কিছু বলতে পারি। বলতে পারি, তিনি ছিলেন একজন নগণ্য উৎপাদনকারী, এবং আজকের যুগে তাঁর লেখা সেভাবেই পড়া হোক। বলতে পারি, এ মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যে অতিমারী চলছে, তার নিরিখে উৎপাদনকারী গার্সিয়া মার্কেসের লেখা অন্যভাবে পড়া যায় কি না, আসুন সেই প্রশ্ন তুলি। লা হোখারাস্কায় তাঁর কিছু লাইন পড়ে (‘মৃতের উপর যে বাতাস টগবগ করে ফোটে, মনে হয় আমি সে বাতাসের প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছি, ম্যাকোন্দোকে ধ্বংস করেছে যে নিয়তি, তার সারের’) কেউ কেউ ট্র্যাজেডির কাব্যশৈলীর বা দর্শনের আভাস পেয়েছেন। পেতেই পারেন। ‘পাতার তুফান’ (লা হোখারাস্কা) থেকে ‘ইডিপাস মেয়র’ (এদিপো আলকাদে), এন্থ্রোপোফেজি এবং গ্রাস নিয়ে তাঁর ১৯৫০-এর খণ্ডসাহিত্য থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘একাকিত্বের একশো বছর’, ফকনার থেকে সোফোক্লিস, গার্সিয়া মার্কেস কলোম্বিয়ার অনন্ত যুদ্ধকে গ্রিক ট্র্যাজেডির নিরিখেই দেখে থাকবেন। 

    এভাবে তাঁর লেখা পড়লে, যার সমস্যাগুলো নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি, স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা নায়ক বা বীরপুরুষের ট্র্যাজিক নিয়তির ধারক হিসেবে দেখা যায় মহামারীকে। স্বৈরাচারী বীরপুরুষ, আমেরিকায় সৃষ্ট সেই কাল্পনিক জীব। তবে মহামারী নিয়ে আমাদের যা বাস্তব অভিজ্ঞতা, তা তো সেই নানা রকম বীরপুরুষদের কাহিনি শোনায়নি, বা প্রাচীনকালের অশুভ শক্তি হিসেবে স্বৈরাচারীর মূর্তিকে এযুগের অশুভ শক্তি সাজিয়ে তোলেনি। আমাদের বাস্তবটা বরং অনেক বেশি মামুলি, আমরা টের পেয়েছি যে আমাদের হাতের পুতুল করে রেখেছে অপদার্থ আমলারা আর টিভির রিয়্যালিটি শো’য়ের তারকারা, যাদের আসলে একটাও দরকারি কথা বলার নেই। অন্তঃসারশূন্য যত প্রাণী, তাদের নিজেদেরই মূর্তিগুলোকে দেবতা বানিয়ে আমাদের স্ক্রিন জুড়ে  টুইট, লাইক, আর বারবার হাস্যমুখ ছবির অন্তহীন প্রদর্শনীর জোরে কোন উচ্চ আসনে তুলে দেওয়া হয়েছে।  
    ইতিহাস বা প্রলয় থেকে তারাও কিছু শেখেনি, আমরাও না। সে কথা আমরা জানি, কিন্তু মানতে চাই না। না-দেখতে, না-বুঝতে আমরা ভালবাসি, প্রকৃত আলোর থেকে আমরা কেমন যেন পালিয়ে যাই আমাদের গুহার নকল নিরাপত্তায়, চোখ-রূপী ডিজিটাল স্ক্রিনে ডিজিটাল ছায়ামূর্তিদের নাচন-কোঁদনের আরামে। এখানে এনাগনরিসিসও নেই, ক্যাথারসিসও নেই। নেই প্রায়শ্চিত্তের জ্ঞানচক্ষু, নেই স্বীকারোক্তির প্রশ্রয়ে মনের যত মলিনতা দূর করার সুযোগ। তাই যদি হয়, তবে ট্র্যাজেডির জীবনবোধ আর যথেষ্ট রইল না। 
    অতএব এই শেষবারের জন্য, গার্সিয়া মার্কেসকে আজ কীভাবে পড়া উচিত? গোড়াতেই বলে রাখা ভাল, ইতিহাসের মোটেই পুনরাবৃত্তি ঘটে না, আমরাও ইতিহাস থেকে সবসময়ে শিক্ষা নিই না। স্বৈরাচারীর স্বীকারোক্তি, বা তার অনুপস্থিতি, কোনওটাই আর যথেষ্ট নয়। আমাদের এখন যে অবস্থা, তাকে প্রলয় বা সর্বনাশ কোনওটাই বলা যায় না। সত্যি বলতে, সর্বনাশের সমস্যা এটাই যে, সে কখনওই ঠিকমতো সর্বনাশ করতে সক্ষম হয় না। ম্যাকোন্দোকে ধ্বংস করেছে অনেক মামুলি, পরিমিত কোনও শক্তি। আর তাকে পাল্টানোর দায়িত্ব আমাদেরই। ঈশ্বর বা বীরপুরুষের জন্য অপেক্ষা করলে আর চলবে না।

    Read in English   

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook