ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হেঁশেলের হিস্‌সা: পর্ব ২


    জয়ন্ত সেনগুপ্ত (March 19, 2021)
     
    নিরামিষের নানা কথা

    এপার-ওপার দুই বাংলার সম্মিলিত স্ট্যাটিস্টিক্স ঠিক জানি না, তবে এটুকু জানি যে, কেরালার মতোই, পশ্চিম বাংলায় বিশুদ্ধ নিরামিষাশীর সংখ্যা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে কম, আন্দাজ ৬ শতাংশ। বহু দিন থেকেই বাঙালি ব্রাহ্মণদের মধ্যে মাছ-মাংস খাওয়া রীতিমতো প্রচলিত ছিল। প্রাচীন স্মৃতিকারদের মতামত উদ্ধার করে বাংলার অন্যতম প্রথম ও প্রধান স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, শুধু চতুর্দশী প্রভৃতি তিথিতে এগুলি খাওয়া নিষিদ্ধ, অন্যান্য দিনে আমিষভোজনে দোষ নাস্তি। বস্তুত মাছ-মাংস খাওয়ার অভ্যেস আমাদের বাংলায় এতই সুপ্রচলিত ছিল, যে এই সমর্থন জানানো ছাড়া বেচারা ভবদেব ভট্টের উপায়ান্তর ছিল না। তবে কি ‘মাছে ভাতে বাঙালির’ হেঁশেলে নিরামিষ দুয়োরানি হয়েই ছিল বরাবর? অবশ্যই নয়। বাঙালির মাংস খাওয়ার ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস নিয়ে একবার একটি ছোট লেখা লিখেছিলাম, তখন মাংসের সেই মহোল্লাসে চাপা পড়ে গিয়েছিল বাংলার নিরামিষ রান্নার অতুলনীয় ঐশ্বর্যের বৃত্তান্ত। সেই পাপের অন্তত আংশিক স্খালনের তাগিদেই এই লেখার অবতারণা।

    কী কী আনাজপাতি দিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালি হেঁশেলে নিরামিষের এই ঐশ্বর্য? প্রাচীন কাল থেকেই বেগুন-লাউ-কুমড়ো-কচু আমাদের ঘরের জিনিস, আর ফলের মধ্যে তাল-কলা-আম-কাঁঠাল-আখ-নারকোল, আর অনেক পরে পর্তুগিজরা এসে যোগ করলেন আলু আর পেঁপে। এ সবের আশেপাশে আমরা প্রকৃতির অবহেলা ও অনাদরের দান গ্রহণ করেছি অকাতরে, সে শালুক-শাপলা-কচুর লতি-কলমি হোক, বা নিশ্চিন্দিপুরের এক দরিদ্র পরিবারের ফুটোফাটা চালাঘরটির পাশে এক অলোকসামান্য গরিমায় ফুটে-থাকা পাতালকোঁড় হোক। ভারতীয় খাদ্যবিধির সম্ভবত সর্বোত্তম ঐতিহাসিক কে টি আচাইয়া বলেছিলেন যে বাংলার নিরামিষ রান্নার অতুলনীয় বিশেষত্ব হল হরেক কিসিমের শাকসবজি আর অন্যতর উপচারকে একসূত্রে এক সুষম ব্যঞ্জনায় (অথবা ব্যঞ্জনে) গ্রথিত করা— যেমন নিমপাতার সঙ্গে বেগুন, কুমড়োর সঙ্গে পুঁইশাক বা ছোলা, ঝিঙের সঙ্গে পোস্ত, কলাইয়ের ডালের সঙ্গে মৌরি-হিং-আদা। কলাগাছের প্রতিটি অবতারকে— থোড়, মোচা, কাঁচকলা, পাকা কলা, এমনকী কখনও কাঁচকলার খোসা বাটা অব্দি— আমরা যেমন সৃষ্টিশীল ভাবে রাঁধি আর খাই, তার তুলনা কি আর ভূ-ভারতে কোথাও পাওয়া যাবে? বক, কুমড়ো, সজনে— এত রকম ফুল খাওয়া হয় আর কোন প্রদেশে? কেরলের আভিয়াল ভারি ভাল জিনিস বটে, কিন্তু বাঙালি সভ্যতায় শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ভক্তিযোগের অতুলনীয় অবদান শুক্তো বা লাবড়া বা নিমঝোলের সঙ্গে কি তার তুলনা চলে? অথবা উত্তর ভারতের ‘ভেজিটেবল নওরতন কোর্মা’র সঙ্গে আমাদের হরেক রকম পাঁচমিশালি তরকারির, যার মধ্যে আছে ডালনা, ঘন্ট, ছেঁচকি, চচ্চড়ির মতো বিচিত্র সৃষ্টিশীলতার উদ্ভাস? আর শুধু ভারতের অন্যত্রের সঙ্গেই বা তুলনা কেন, বেচারা সায়েবরা কোথায় জানবে এই করণকৌশল? বুদ্ধদেব বসু তাই যথার্থই বলেছিলেন, ‘ডালনার সঙ্গে চচ্চড়ির ঠিক ততটাই মিল যতটা ঘোড়ার সঙ্গে ছাগলের; দুটো জন্তুকেই “চতুস্পদ” বলা যেমন হাস্যকর, দুটো খাদ্যকেই “কারি” বলাও তেমনি’। বাস্তবিকই, পশ্চিমের নানান বেকিং আর ডেজার্ট তৈরির করণকৌশলে ড্রায়েড, ক্যান্ডিড (candied) ফলের খোসা বা ‘পীল’ ব্যবহার করার চল আছে, কিন্তু আমাদের মতো লাউ, আলু, পটল, কুমড়োর খোসা দিয়ে খোলতাই রান্নার কায়দা আর কারই বা জানা আছে? হরেক বড়ি, বড়া, কাঁঠালবিচি দিয়ে তরকারি রান্নায় ভ্যালু অ্যাডিশন? গয়নাবড়ির মতো শৈল্পিক সৌকর্য? পাঁচফোড়ন বা রাঁধুনির মতো মশলা? চালের চল্লিশা, যার মধ্যে আছে সাদা ভাত, ঘি ভাত, পোলাউ, ফেনা ভাত, খিচুড়ি, ভুনি খিচুড়ি, বা সর্ষের তেল, পেঁয়াজ রসুন সেঁকা শুকনো লঙ্কা, আর আলুর ভর্তা সহযোগে পান্তা ভাতের মতো কমফর্ট ফুড? গেস্টাপো-সুলভ ইন্টারোগেশনের মতো শোনালেও, বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই নিরন্তর প্রশ্নমালার সামনে বাঙালি ছাড়া অন্যদের অধোবদন হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। আর দেখুন, ঝাল-ঝোল-কালিয়া-সালন— দুই বাংলার আমিষ রান্নার রকমারি কারিকুরিকেও আমাদের শাকসবজিরা বহন করতে পারে অনায়াসে, নয়তো কি আমরা এঁচোড়ের ডালনাকে ‘গাছপাঁঠা’ শিরোপা দিতে পারতাম?

    তবে ডালনার (ডাল-না, অর্থাৎ যা ডাল নয়) কথা যতই বলি, আর ছোলার ডাল ব্যাপারটা বাংলায় প্রথম দেখে ব্রিটিশরা তাকে যতই ‘বেঙ্গল গ্রাম’ আখ্যা দিক না কেন, প্রাচীন বাংলায় যে ডাল খাওয়ার প্রচলন ছিল না, তা আমাদের জানিয়েছেন ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় স্বয়ং। ক্রমে উত্তর ভারত থেকে ডালের আগমন, তার উল্লেখ প্রথম আমরা দেখি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, যেখানে শিবঠাকুর পার্বতীর কাছে ফরমায়েস করছেন হরেক রকম রান্নার, যার মধ্যে আছে ‘লঘু জাল’ দিয়ে ‘মসুর সুপ’ আর ডাবের জল দিয়ে ‘মুগের সুপ’। এমনটা অসম্ভব নয় যে মাছের প্রাচুর্যের সুবাদে প্রোটিনের বিকল্প উৎস হিসেবে ডালের দিকে নজর পড়েনি মধ্যযুগে বৈষ্ণব ভক্তিযোগের প্রভাবে নিরামিষাহারের ঝোঁক বাড়ার আগে। কালক্রমে সেই ডালই হয়ে উঠল সুলভে পুষ্টিগুণ আর সাধারণের মধ্যে তৃপ্তি— এই দ্বৈত অন্বেষণের কেন্দ্রবিন্দু। ‘ভেতো’ বাঙালি স্বভাবতই ভিতু ও দুর্বল— সাহেবদের দেওয়া এই অপবাদ ঘোচানোর জন্য উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘স্বাস্থ্যবান হিন্দুস্তানি’-দের ‘ডালরুটি’-কে আদর্শ খাবার বলে ভাবা হয়েছিল। আবার অন্যদিকে উনিশ শতকে বাঙালি ভদ্রলোকের গার্হস্থ্য সংস্কৃতির শীলিত সুষমার পরিমণ্ডলেও পরিমিতি ও আড়ম্বরহীনতার মধ্যে তৃপ্তির অন্বেষণের উদাহরণ হিসেবে মানদা দেবীর (১৮৭৮-১৯৬৩) দিনলিপিতে আমরা পাচ্ছি তাঁর খুড়তুতো এক বোনের কথা, যাঁর রন্ধনপটুত্বের বিবরণ শুনে তাঁর ভাবী শ্বশুর এক গাল হেসে বলেছিলেন, ‘মা যদি আমার ঘরে যাইয়া আমাকে একটু সুক্তোর ঝোল ও পাতলা মুসুরির ডাইল ও দুটি ডাইলের বড়া রান্না করিয়া দেয় তবেই আমার পরম সার্থক জীবন মনে করিব’। বাংলায় রান্নার বইয়ের অন্যতম পথিকৃৎ বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাক-প্রণালী’তে (১৮৮৫) লিখেছিলেন যে হিন্দু বিধবারা ‘দাইল ও অন্ন এবং নিরামিষ-ব্যঞ্জন প্রভৃতি আহার করিয়া, যেরূপ স্বাস্থ্য-সুখ ভোগ করেন’, তা নাকি মাছ-মাংসভোজীদের মধ্যেও বিরল! এ হয়তো পেট্রিয়ার্কির নিজেকে চোখ ঠারা, বেশ মিসোজিনিস্টিকও নিশ্চয়ই, কিন্তু ডালের মহিমা তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না।

    উনিশ আর বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন যখন তার ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে আরূঢ়, তখন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর রান্নার বই ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’-এর প্রকাশক সগর্বে লেখেন, ‘আজ পর্যন্ত য়ুরোপীয়েরা পঞ্চবিধ উদ্ভিজ্জ মিলাইয়া অপূর্ব সংযোগ সাধন করিতে শিক্ষা করে নাই… নিরামিষের এ বিচিত্রতা শিক্ষা করিতে পাশ্চাত্যজাতিকে এখন শত শত বর্ষ অতিবাহিত করিতে হইবে’। কথাটা খুব মিথ্যে নয় অবশ্য। তার কারণ আমাদের রাঁধুনিদের হাতের গুণই শুধু নয়, বিশ্বের বিচিত্র ভাণ্ডার থেকে আমাদের নির্দ্বিধায় গ্রহণ করার ক্ষমতা। যার ফলে ১৮৩১ সালে প্রকাশিত বাংলায় প্রথম রান্নার বই ‘পাকরাজেশ্বর’-এ বার্তাকু ঘন্টের রেসিপিতে ‘তপ্তাঙ্গারে দগ্ধ’ ‘দলিতবার্তাকু’-তে (অর্থাৎ চটকে মাখা বেগুনপোড়ায়) দই ও মশলা মাখানোর উপদেশের মধ্যে ছায়া পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের লেভান্ট অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার বাবা ঘানুশ (baba ghanoush) অথবা মুটাবাল (moutabal)-এর। একই কায়দায় ‘বেগুনের বিরিঞ্চি’ শিখিয়েছেন বিপ্রদাসও, যাঁর হাতে ‘ম্লেচ্ছ বা যবনের’ ভোগ্য পেঁয়াজের সংস্পর্শে ঘরোয়া রান্না হয়ে ওঠে ‘ইংলিশ ভুনি খিচুড়ি’, ঠিক যেমন প্রজ্ঞাসুন্দরী পেঁয়াজ সহযোগে রাঁধেন ‘ইংরাজি অড়হর ডাল’। এই ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ বিশ্বদর্শনেই আমাদের নিরামিষ হেঁসেলের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তার তুলনা আর কার সঙ্গেই বা চলতে পারে? এককালে বাঙালি পুরুষের রসিকতা শুনেছি, বউ বিধবা হলে না নাকি তার নিরামিষ রান্না খেয়ে সুখ নেই— আজ হোয়াটসঅ্যাপের যুগে বেরোলে ভাইরাল হত নিশ্চয়ই। এর স্ট্যাটিস্টিক্যাল অসত্যতা বাদ দিয়েই বলছি, সেই নির্দয় পিতৃয়ার্কির মধ্যে না-ই বা গেলাম।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook