সেই ত্রেতাযুগের কথা। জার্মানি তখনও দুটো দেশ, ইস্ট আর ওয়েস্ট, মাঝখানে সেই বিখ্যাত বার্লিন-ওয়াল। আমি যাব ইস্ট বার্লিন।
কলকাতা থেকে এরোফ্লোট-এর মস্কোগামী প্লেন ছাড়ল অনেক দেরিতে। কী সমস্যা হয়েছিল, এখন আর মনে নেই। মস্কো পৌঁছলাম তিন ঘণ্টা দেরিতে, ততক্ষণে আমার ইস্ট বার্লিনের কানেক্টিং ফ্লাইট ছেড়ে গিয়েছে। বার দশেক এক কাউন্টার থেকে আর এক কাউন্টার ঘুরে, শেষ পর্যন্ত বদলের টিকিট মিলল মস্কো থেকে ইস্ট বার্লিন যাওয়ার শেষ ফ্লাইটে। গন্তব্য আসলে লাইপজিগ শহর, ইস্ট বার্লিন থেকে ট্রেনে চেপে যেতে হবে, লাইপজিগ ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরি হয়ে। এই জুরি হওয়ার ঘটনাটা ঘটেছিল খুব অদ্ভুত ভাবে। তার আগের বছর বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছিল আমার প্রথম ছবি ‘দূরত্ব’, আদুর গোপালকৃষ্ণনের দ্বিতীয় ছবি ‘কোডিঅট্টম’, আর যতদূর মনে পড়ছে, মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’। সেবার বার্লিন ফেস্টিভ্যাল বেশ উত্তেজিত এই তিন ভারতীয় ছবি নিয়ে। ‘আকালের সন্ধানে’ তো জুরি পুরস্কারও পেয়েছিল। ‘দূরত্ব’র প্রথম স্ক্রিনিং-এর পর, প্রেস আর দর্শকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন। চিনতে পারলাম, আজ সকালেই আলাপ। একই হোটেলে উঠেছি আমরা, আর এক টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট সেরেছি। টুকটাক গল্প করতে করতে আজ সন্ধের স্ক্রিনিং-এ ওঁকে আমন্ত্রণ জানাই। নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন লাইপজিগ ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টর হিসেবে। সেই সময়ের ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলির মধ্যে যথেষ্ট নামীদামি ফেস্টিভ্যাল। ভদ্রলোক ‘দূরত্ব’ দেখে মুগ্ধ, হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর ফেস্টিভ্যালের জুরি হতে। আমি রাজি হলাম, ঠিকানা দিলাম, আর তারপর দেশে ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কাজে। এক সময় ভুলেও গেলাম সেই আমন্ত্রণের কথা। প্রায় আট-ন’মাস পর এক এয়ারমেল এসে হাজির, সঙ্গে লাইপজিগ যাওয়ার টিকিট।
লাইপজিগ বেশ প্রাচীন শহর। সংস্কৃতির পীঠস্থান। জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর শহর। সেই চার্চ, যেখানে বাখ পিয়ানো বাজাতেন, এবং বাখের সেই পিয়ানো— দুটিই সুন্দর ভাবে রয়েছে আজও। পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতের ঠেক এই শহর। স্টেশন থেকে শহরের ভেতর দিয়ে হোটেলে যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছিলাম, তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধংসচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পথের চারপাশে। সব মিলিয়ে একটা ঝিম-ধরা অবস্থা আমার।
হোটেলে পৌঁছে দেখি, বাকি জুরিরাও এসে গিয়েছেন এবং আমাদের অফিসিয়াল ব্রেকফাস্ট শুরু হতে চলেছে। ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর, বার্লিনের পথে হাত জড়িয়ে ধরা মানুষটি, আবার এগিয়ে এসে হাত ধরলেন। সবার সঙ্গে আলাপ হল। নানান দেশের প্রায় জনা ছয়েক জুরি মেম্বার। আমি একাই ভারতীয়, আমাকে এবং আমার দেশকে ঘিরে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে পারলে বাঁচি। কিন্তু সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা অবধি ঠাসা স্ক্রিনিং। নানান দেশের নানান দৈর্ঘ্যের প্রচুর ছবি। পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল সেই ম্যারাথন ফিল্ম স্ক্রিনিং। এই আমার প্রথম জুরিগিরি, তায় এরকম ভারী ফেস্টিভ্যালের। ছবি-আলোচনা-আলোচনা-ছবি করতে করতে হাঁপিয়ে একশেষ। বরাবর আমি একলা-একা মানুষ। নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে না পারলে দমবন্ধ লাগে। প্রত্যেক জুরির সঙ্গেই একজন করে সেক্রেটারি থাকতেন। তাদের কাজ, জুরিদের সকাল সকাল হোটেল থেকে পাকড়িয়ে হাঁটিয়ে এনে থিয়েটারে পুরে দেওয়া। এইভাবে টানা সাতদিন চলার পর প্রত্যেকেরই আধমরা অবস্থা। ফেস্টিভ্যালের শেষে তিনদিন ছুটি জুরিদের। এই তিনদিন তাঁদের কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবে ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ, তারপর যার-যার গন্তব্যে পাড়ি দেওয়া।
দ্বিতীয় দিন আমরা গেলাম কুখ্যাত লাইপজিগ-থেকলা (thekla) কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। বলা হয়, সবচেয়ে বীভৎস নাৎসি অত্যাচারের সাক্ষী এই ক্যাম্প। দেখেছিলাম, মানুষের চামড়ার তৈরি একের পর এক ল্যাম্পশেড, চামড়ার ওপর ট্যাটু। এক জায়গায় বস্তায় করে রাখা নিহত মানুষের দেহ দিয়ে তৈরি জৈবিক সার। হিটলার চেয়েছিলেন, এই সার দিয়ে চাষ হোক আবাল জার্মানির ক্ষেত। অন্য একটি ঘরে দেখেছিলাম, স্তূপীকৃত বাচ্চাদের ছোট ছোট জুতো। হোটেলে ফিরে সেদিন সারা রাত জেগেছিলাম। পর্যাপ্ত হুইস্কিও আমাকে ঘুম পাড়াতে পারেনি।
শেষদিনের প্রোগ্রাম, যে যার মতো নিজেদের সেক্রেটারিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, কেনাকাটা করা— যা ইচ্ছে তাই। আমি আমার সেক্রেটারিকে ছুটি দিয়ে দিলাম। আগের দিনের ভার তখনও বুকে চেপে বসে আছে, আমার ইচ্ছে হল চুপচাপ ট্রামে চেপে একটা জানলার ধার বেছে নিয়ে বসতে। যতদূর ট্রাম যায় যাব, আবার ট্রামের সঙ্গেই ফিরে আসব। ট্রামের জানলার বাইরের ঝিরঝিরিয়ে বরফ পড়া শান্ত সুন্দর শহরটাকে দেখছি, আর চাপা বিষণ্ণতা ঘিরে ধরছে আমায়। বারবার আগের দিনের ছবিগুলো ভেসে উঠছে, চব্বিশ ঘণ্টার ওপর না ঘুমিয়ে জ্বলতে থাকা চোখের ওপর। হঠাৎই হালকা সুগন্ধ ভেসে এল নাকে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি, আমার পাশে কখন যেন একটি মেয়ে এসে বসেছে। হাতে একটি খোলা বই। অসামান্য মগ্নতায় খোলা পাতাদের বৃত্ত দিয়ে সাজানো অক্ষরমালায় ডুবে আছে সে। না পড়তে পারলেও, বইটি যে কবিতার তা বুঝতে অসুবিধা হল না। খুব ইচ্ছে করল মেয়েটির চোখদুটি দেখতে। আর আনমনেই হঠাৎ সে তাকাল জানলার বাইরে। নম্র উদাস দুটি চোখ আমাকে দেখেও দেখল না। আস্তে আস্তে অনেকটা নিঃশ্বাস বুক হালকা করে বেরিয়ে গেল। খুব ইচ্ছে হল বলি, চলুন এখানে নেমে পড়ি, ঝরে পড়া বরফ দেখতে দেখতে কোথাও বসে কফি খাই। বলা হল না কিছুই। তবু, সেদিন মনে মনে মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখেছিলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অবশেষে।