কোভিড-১৯’এর একেবারে গোড়ার দিকোর শিকার হল আমাদের নিতান্ত নিরীহ ঘর মোছার ন্যাতা বা ন্যাকড়া। মনে আছে, ২০১৮-র কোনও একটা সময়ে, আমাদের কাজের লোক বরুণাদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওই লাঠির ডগায় লম্বা লম্বা দড়িমতো লাগানো যে জিনিসটা কিনতে পাওয়া যায়, যেটা বালতির জলে ডুবিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘরটা মুছে ফেলা যায়, সেরকম একটা চাই কি না। স্পেন্সার্স-এ কয়েকটা দেখেছি, কিনে দিলে, বরুণাদিরই সুবিধে হবে। উবু হয়ে বসে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেভাবে আমাদের ঘর মোছা হয়, তা বন্ধ হবে, আর নিজেকে একজন মহান ও মানবিক বউদি ভেবে, আমার মাথার পেছনে জ্যোতি গজাবে। কিন্তু বরুণাদি কানই দিল না। প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে বলল, ওটা দিয়ে কাজ হবে না… আমি পারব না। এও বলল, ওসব ব্যবহার করে হদ্দ কুঁড়ে লোকেরা, কাজ করার সময় শরীর ঝোঁকাতে-বাঁকাতে যাদের জ্বর আসে। পিঠভাঙা ঝাঁকুনি ও হাড়ভাঙা খাটুনির জ্যোতি তখন বরুণাদির মাথায় গজাচ্ছিল, অগত্যা আমি ‘এ পৃথিবীতে কারও ভাল করতে নেই’ বিরক্তিটা হজম করতে করতে, ফের খবরকাগজের শব্দছকে ডুবে গেলাম।
সেই সময় ভারতে বহু কাজের মাসিই এই কথা বলত। কিন্তু ২০২০-র মার্চে, যখন লকডউন হব-হব এবং ট্রেন চলছে না বলে অনেক কাজের লোকই আসতে পারছে না, তখন এই ‘মপ’, বা লাঠির ডগায় ন্যাতা, একেবারে হইহই করে ভারতীয় ঘরকন্নায় ঢুকে পড়ল। ‘নিউ নর্মাল’ আমাদের পৃথিবীতে এন্ট্রি নিয়েছে, আর সেই বদলে যাওয়া বিশ্বের চিত্রনাট্যে, সাইড রোলে দাপিয়ে অভিনয় করছে মপ।
গত বছরের মার্চের শেষদিকে, বরুণাদি নয়, আমাকেই হামাগুড়ি দিয়ে ঘর মোছা শুরু করতে হল। কখনও অবশ্য বাড়ির কত্তা এই দায়িত্ব পেলেন, কারণ তিনি রান্নাঘরে নিজেকে পরিপূর্ণ অকর্মার ঢেঁকি হিসেবে প্রমাণ করে ছেড়েছেন, তাই অন্তত মেঝে পরিষ্কার আর ডাস্টিং-এর কাজটা তো সারতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কোম্পানি নেমে পড়ল, বিধ্বস্ত বউদি ও স্তম্ভিত দাদাদের উদ্ধার করতে। স্কচব্রাইট (যারা বাসন মাজার সহায়ক জিনিস তৈরি করত) এমন চমৎকার একটা মপ বানিয়ে ফেলল, সেটা তক্ষুনি বেস্টসেলার হয়ে গেল।
তারপর এল একটা মপ প্লাস বালতি, যেখানে আপনি বাড়তি জলটা নিংড়ে দিতে পারেন। ‘গালা’ নামে একটা কোম্পানি এটা শুরু করল, তারপর অন্য অনেক সংস্থাই ব্যাপারটা ধরে নিল। হঠাৎই, ঘর মোছা বেশ সভ্যভব্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল, আর ‘ঘর মুছতে গেলে হাত নোংরা হবে’— এই চিরকালীন অঙ্কটাও বাতিল হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, এই নতুন সরঞ্জামটা, যা ‘আর্চি’ কমিকসের চরিত্র মিস্টার স্ভেনসন-এর মপ-এর, আর হ্যারি পটারের কুইডিচ খেলার লাঠির একটা মিশেল— হাতে নিলে নিজেকে এত স্মার্ট লাগত, মনে হত ঘর মোছার মতো হড়হড়ে ব্যাপারটাও এখন বেশ ফ্যাশনদুরস্ত।
এখন অনেক কাজের লোকই আবার মধ্যবিত্ত বাড়িতে বাড়িতে ফিরে এসেছে, আর সেই গেরস্থালিগুলো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। সেই কাজের লোকেরা নিশ্চয়ই ঘরের কোণে রাখা বালতি আর ন্যাতার খোঁজ করতে গিয়ে দেখেছে, আরে, তার বদলে এটা আবার কী! আধুনিক ন্যাতা! প্রায় সকলেই এখন এই নতুন ন্যাকড়ায় অভ্যস্ত, আর হয়তো ক’দিনের মধ্যেই আমরা অবাক হয়ে ভাবব, বাপ রে, কীসব দিন ছিল, লোকে উবু হয়ে ঘর মুছত!
দুঃখের কথা, বরুণাদি লকডাউনের পর আর ফিরে আসেনি। শুনলাম ওর একটা হিপবোন ভেঙে গেছে, আর নাতিরা ঠিক করেছে, দিদাকে আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে দেবে না। তাই এটা আর জানা হল না, বরুণাদি এই আধুনিক ন্যাতাকে আদৌ মেনে নিতে পারত কি না, তবে তার বদলে যে কাজের লোক এসেছে, সে তো দিব্যি খুশি। অতিমারী নামক অতিকায় তরঙ্গ আমার বাড়িতে একটা ছোট্ট বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, আর হ্যাঁ, আমার সেই মহত্ত্বের জ্যোতিটা বেশ জ্বলজ্বল করছে!