গোড়ায় বুঝতে হবে তুমি তৃণমূল না বিজেপি। না কি, এমনিতে তৃণমূল নয়, কিন্তু বিজেপিকে ঠেকাতে গেলে আর উপায় নেই বলেই তৃণমূল? তাহলে তুমি কি বুনিয়াদি বাম? কিন্তু বামফ্রন্ট আমলের কথা ভাবলেও তো বিবমিষা ও ক্রোধে রগ ঝমঝম। তবে তুমি অতিবাম, মাওবাদী? এদিকে রোববার মাংস-কালে নকশালদের মিথ টাকনা দিয়ে মেজোমামা যদি-বা রোমাঞ্চ-সজারু, মুন্ডু লয়ে গেন্ডুয়া খেলার সিন ধোঁয়ালেই তোমার ছোবল-শিউরানি ঘটে। তাহলে তুমি কি সব গোষ্ঠীবাজিকেই ঘেন্না পাও? এই ‘নই জুতো-নই ছাতা’ অবস্থানটাকে যদি দাবড়ে ঘোষণা করো, তবে তা কি আসলে দায়িত্ব এড়িয়ে পোঁ-পাঁ চম্পট, না সেইটিই তোমার নিজের সত্য? কোনটা বেশি কাম্য: সততা, না বাস্তব-সই হয়ে ওঠা? একটেরে থাকলে তোমার ভাল লাগত কিন্তু বন্ধুদের চোখে মেরুদণ্ডহীন প্রতিভাত হবে বলেই এখন সমাজ-ঘাগু স্টান্স নেবে? তা কি অধিক ভীরুতা নয়? আত্ম-বেইমানি নয়? আবার, হিটলার ভোটে জিততে পারেন জেনেও যে জার্মানটি ‘ধুর এ গণতন্ত্রের মুখে ছাই’ বলে ভোট দিতে গেলেন না, তিনি ঠিক কাজ করলেন, না বৃহত্তর নকশা অবলোকনান্তে নিশ্চিত উপসংহার: কুশ্রী অন্যায় করলেন? কার কাছে তুমি দায়বদ্ধ, ইতিহাসের কাছে, না নিজের কাছে? না কি তুমি ইতিহাসেরই অংশমাত্র, একলা-ফোকলা বলে কিছু হয় না? সব মানুষের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ, আর একটা মুহূর্তে একটা কণা-প্রজাপতি মাড়িয়ে দিলে তার শৃঙ্খল-ক্রিয়ায় সমগ্র মহাবিশ্ব আমূল ডিগবাজি খায়? কিন্তু এই জীবন নামক বৃহৎ গ্যাঁড়াকলটিকে তুমি তো চিনছ শুষছ নিংড়োচ্ছ স্রেফ একটিই অবস্থান থেকে, তা তোমার। নিজের। তোমার চোখে যে রংটা ঘেরটা ডৌলটা দেখছ, আর একটা প্রাণীও অবিকল হুবহু তা নেহারিছে না। তাহলে ইতিহাস সমাজ সমষ্টি বলে এত রইরই করে ওঠার মানে কী?
ভুরুটুরু কুঁচকে তুমি ঠিক করলে, গোটাগুটি অবস্থান জানাবার তো দরকার নেই, নিজেকে বাতলাও নিরপেক্ষ নর, এক পিস করে ঘটনা তুলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দ্যাখো, মন্তব্য হানো। অ বাবা, প্রকাণ্ড হ্যাপা। কৃষক-আন্দোলনে চাষিদের সাপোর্ট করছ কেন? সে কি এই জন্য: মোদীর বিরুদ্ধে যে-অশান্তি হবে, তাকেই তুমি সমর্থন করো, কারণ মোদীকে সহ্য হয় না, তোমার মতে তিনি সাম্প্রদায়িক ও প্রগতিরোধী চিন্তার চ্যাম্পিয়ন? তাহলে তো তুমি নিতান্ত শিবির-বাজ। পক্ষ নেওয়ার আগে, নতুন কৃষি বিলে কী কী বলা হয়েছে, খতিয়ে দেখেছিলে? কৃষকের দাবিগুলো ঠিক কী, খুঁটিয়ে পড়েছিলে? না কি ব্যাপারটা খুব সোজা: ক্ষমতাবান যা করছে, তা বাধ্যতামূলক ভাবে ভুল, এবং ক্ষমতাহীনের (বা অপেক্ষাকৃত কম-ক্ষমতাধারীর) পক্ষ নেওয়া সব সময়, বাই ডিফল্ট ঠিক? যে-কারণে রিকশাওলাকে দামি গাড়ি ধাক্কা দিলে তা আবশ্যিক ভাবে ড্রাইভারের দোষ? অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন কিন্তু, কৃষকদের এই দাবিগুলো আধুনিকতা-বিরোধী, পরিবেশ-বিরোধী। কেউ বলছেন, এখানে বহু সম্পন্ন মানুষ, সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধে আদায়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চাইছেন, কিন্তু তা তো নিঃসহায়দের জন্য বরাদ্দ থাকাই কাঙ্ক্ষণীয়। এখন বিস্তর পড়েশুনে যদি মনে করো কৃষকেরাই ঠিক বলছেন, তখন নয় মোদীকে থুড়ে ধুয়ে দিলে, কিন্তু যদি দ্যাখো এই ক্ষেত্রে মোদী সরকারের সংস্কার-প্রয়াসই ঠিক বলে মনে হচ্ছে, তাহলে কি জোর গলায় সেটা সর্বসমক্ষে বলবে? না কি তখন আবার সাম্প্রদায়িক শক্তির কব্জি দৃঢ় হয়ে যাবে (এবং তোমায় সেই লোকগুলো নিজ-খোপে ঢুকিয়ে নাচবে, যাদের প্রাণ দিয়ে ঘেন্না করো) এই ভয়ে চেপে যাবে? তাহলে কি তুমি ‘ভক্ত্’-দের চেয়ে কিছু কম গেলে? কারণ তারাও, যদি দ্যাখে কন্যাশ্রী ভাল, চুপ মেরে যায়, কারণ তা পুকারিলে শত্রু বেমক্কা পয়েন্ট পাবে।
তাহলে বরং সামাজিক (মানে, প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনৈতিক নয়) ব্যাপার নিয়ে মথিত হওয়া যাক। এই যে জোড়াবাগানে আট বছরের মেয়েটা রাস্তায় খেলছিল, তাকে ফুসলে, ধর্ষণ ও খুন করল কারা যেন, সেই অসহ বেদনাদায়ক ঘটনাটা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ উগরে দাও। কিন্তু সেক্ষেত্রে শুধু এইটুকু বলে চুপ করা ঠিক, না কি পাশেই মনে রাখতে হবে কাশ্মীরের আসিফা-র কথা, যে ছিল আট বছরের বালিকা, যাকে গণধর্ষণ ও খুন করা হয়েছিল? আর তখুনি বৃত্তে ফের তড়াক লম্ফ দেবে রাজনীতি, কারণ তা ছিল এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে শায়েস্তা করার জন্য পরিকল্পিত শয়তানি, এবং কয়েকজনকে আসিফার ধর্ষক সন্দেহে গ্রেফতার করা হলে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছিল আর তাদের সমর্থনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপির দু’জন মন্ত্রী। নিরুদ্দেশ আসিফার মা-বাবা যখন পুলিশে রিপোর্ট করতে যান, পুলিশ আদৌ সাহায্য করেনি, এক পুলিশ বলেছিল, দেখুন গে, নির্ঘাত কারও সঙ্গে ইলোপ করেছে। এবার তোমার ভাবনা-বুনটে হয়তো জুড়ে নিতে হবে ভোপালের সেই ঘটনাও, যেখানে দলিত নারী ধর্ষিতা এবং খুন হলে পুলিশ সাততাড়াতাড়ি মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয় পরিবারের অনুমতি না নিয়েই, আর পুলিশের এক পান্ডা তড়িঘড়ি বলে দেয় মেয়েটির দেহে কোনও বীর্যের চিহ্ন মেলেনি, আর ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মেয়েটির বাড়ি গিয়ে পরিবারের লোককে বলে আসেন, বয়ান বদলে ফেলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এরকম অন্তত হাজারটা হেডলাইন এ-ওর ঘাড়ে হুমড়ি খাবে, নানা স্রোত খোঁচ মোচড় ঝিকোবে, এমনকী শেষে যখন পুরুষ, উচ্চবর্ণ ও রাষ্ট্রকে এক হাতকড়ায় ঠুসে গনগনে পাঁচ-সাত বাক্য মাথায় নকশা কাটছে, ফট করে ভাবতে হবে সেই ৩১ দিন বয়সি ছোট্ট মেয়েটার কথাও, যার মা তাকে জলের ড্রামে জ্যান্ত ডুবিয়ে ভাল করে ঢাকনাটা সেঁটে দেয়, আর পুলিশকে বলে, ছেলে চেয়েছিলাম, মেয়েটাকে পছন্দ হচ্ছিল না। দিনমান পেট্রিয়ার্কির খস্টা খয়েরি নিয়ে রগড়ালে, ইয়ার্কি দেওয়ার সময় ও ইচ্ছে ক্রমে কমে আসবে, ফাইলের ধুলো ও বিষাদে ওয়েব-সিরিজ মাথায় উঠবে। তখন প্রাথমিক প্রসন্নতাটাই যদি খিঁচড়ে যায়, সামাজিক দায়বদ্ধতাও গেব্লে যাবে না কি?
তার চেয়ে স্রেফ প্রিয়া রামানিকে অভিনন্দন জানানো যাক, মিটু আন্দোলনের এক ভারতীয় মাইলফলক হিসেবে? কারণ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে এম জে আকবরের করা মানহানির মোকদ্দমা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। সর্বোপরি বলেছে, এক নারী তাঁর যৌন নিগ্রহের অভিযোগ জানাতেই পারেন বহুদিন পর, এমনকী বহু দশক পর (পিতৃতন্ত্রের সর্বাধিক চলতি প্রশ্ন, ‘অ্যাদ্দিন চুপ করে ছিলে কেন বোনটি?’-র টুঁটি টিপে)। বহু মিটু-লড়াকু নারী বলছেন, এ জয় তাঁদের সবার জয়। মুশকিল: আদালতের নথি জেরক্স করে সমাজ চলে না। ‘ওই মেয়েটা মিটু দিয়েছিল না? বহুত ঝঞ্ঝাটের পাবলিক। এট্টু এড়িয়ে চলাই ভাল।’— এ জিনিস তো অস্তমিত নহে। অনেক মিটু-অভিযোগকারিণী আছেন, গায়িকা, অভিনেত্রী, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, যাঁদের সবাই মেগা-অভিনন্দন জানায় সাহসী ও নাছোড় মানসিকতার জন্য, কিন্তু সব কাজ অন্য গায়িকার কাছে চলে যায়, অন্য চিত্রনাট্যকারকে ডেকে নেওয়া হয়। তাঁরা কাঠ-বেকার হয়ে কান্না গেলেন, বছরের পর বছর। এঁদের প্রতি সমাজের নিজস্ব স্বতন্ত্র আদালতের ভিন্ন রায় (ও সপাট শাস্তির বিধান) জানার পর, তোমার মগজ যদি হয় যথেষ্ট তেএঁটে, এও ঘাই মারবে: মিটু-বিদ্ধদেরও কি বহু সময়ে একই দশা হয় না? যাঁরা নির্দোষ, কিন্তু অভিযুক্ত, তাঁদের পিঠেও সমাজমাধ্যম তক্ষুনি ‘নিশ্চিত বিকৃত পুং’-এর দগদগে ছাপ্পা দেগে দেয় না? তাঁদেরও কি কাজ চলে যায় না, বন্ধুবান্ধব বিরল হয়ে আসে না? রিয়া চক্রবর্তীকে যখন এই সমাজ কাঠগড়ায় তুলে কোপাচ্ছিল, তখন সঙ্গত প্রতিরোধের মর্ম ছিল: আরে ভাই, তদন্ত হতে দিন, দোষ প্রমাণিত হতে দিন, নিজ সিদ্ধান্তে আনতাবড়ি ল্যান্ড করছেন কেন? মিটু-আহত পুরুষদের ক্ষেত্রে, এই প্রতিবাদীরাই, ডাইনি-মৃগয়ায় তোল্লাই দিচ্ছে না তো?
সাতাত্তর ঝঞ্ঝাট এড়াতে টোটাল চুপ মেরে গেলে, দায় অতটা থাকে না। বখেড়া হল, তুমি আবার এট্টু-আধটু লেখো। শিল্পীর সামাজিক দায় সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি: সভ্যতার প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু এ ধারণার ভিত্তি কী? কেন বুদ্ধিজীবীকে ব্যঙ্গ করে বলা হবে, ‘কৃষককেও তো বুদ্ধি খাটিয়ে লাঙল টানতে হয়, তুমি কাব্য লেখো বলে এক্সট্রা সমীহ পাবে কেন?’, আর রাজনৈতিক সঙ্কটে কৃষক চুপ করে থাকলে কেউ রাগ করবে না অথচ কবি চুপ করে থাকলে বেহদ্দ কাঁইমাই মচাবে? শিল্পীর সর্বোচ্চ দায় কার কাছে? সমাজের কাছে, না তাঁর শিল্পের কাছে? তাঁর মূল ম্যানিফেস্টো কি অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ শানানো, না তাঁর শিল্পকাজটা প্রাণ টাটিয়ে করে যাওয়া? বুদ্ধদেব বসু তো লিখছেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।…/… যীশু কি পরোপকারী/ ছিলেন, তোমরা ভাবো? না কি বুদ্ধ কোনো সমিতির/ মাননীয়, বাচাল, পরিশ্রমী, অশীতির/ মোহগ্রস্ত সভাপতি? উদ্ধারের স্বত্বাধিকারী/ ব্যতিব্যস্ত পাণ্ডাদের জগঝম্প, চামর, পাহারা/ এড়িয়ে আছেন তাঁরা উদাসীন, শান্ত, ছন্নছাড়া।/ তাই বলি, জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে;/ হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম, আর পুলকে বধির/…’ এই বুদ্ধদেব ‘মহাভারতের কথা’ লিখেছেন, আর তাঁকে সহস্রবার ‘ব্যাটা সমাজ-অসচেতন’ আলপিনে খামচে মহানন্দ পাওয়া ইস্তাহার-বাজেরা কোথায় মিলিয়ে গেছে। নগরী দাউদাউ পোড়ার কালে বেহালা বাজাবার অধিকার কারও নেই কেন, (যদি সে দমকলকে যথাযথ ট্যাক্সো দিয়ে থাকে এবং) যদি তার সাধনা ও প্রতিভার প্রভায় খেলা করে এক অসামান্য নতুন গৎ, যা হয়তো এই ভয়াল অগ্নি নির্বাপিত হওয়ার বহু যুগ পরেও মানুষের অনিঃশেষ দহনে অলৌকিক উপশম দেবে? বা, স্রেফ তাকেই, তার স্ব-ভাবকেই, দেবে উত্তাল উড়ান?
তোমার, মাইরি, এই আতসকাচ-বাজিতে, মাথা ঘোরে, সবই গুলিয়ে যায়। ধুত্তোর বলে গ্লসি পত্রিকা টেনে নিতে ভাল লাগে। তাইলে বরং যেরম চলছে চলুক, ‘বিটস অ্যান্ড পিসেস’ কেতায়? এক খাবলা ফুচকা, এক খাবলা সমাজচেতনা? দুটো আবার বদলাবদলি না করে, এই টিক্রমবাজ যুগে।