ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হেঁশেলের হিস্‌সা: পর্ব ১


    জয়ন্ত সেনগুপ্ত (February 26, 2021)
     
    রন্ধনবিদ্যা, প্রেশার কুকার ও পাকশালের প্রবর্তন

    রান্নাঘর, হেঁশেল, পাকশালা, পাকমন্দির, রসুইঘর— আর কত নাম হতে পারে ওই ছোট্ট জায়গাটুকুর? তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে কত রকমেরই বা অনুষঙ্গ? পরিবার, সংসার, গার্হস্থ্য? যত্ন, ভালবাসা, পারিপাট্য? এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে, চলছে এখনও। সেটা আশ্চর্যের কথা নয়, কারণ রান্নাঘর শুধুই তো হরেক রকম জিনিস জোগাড় করে কেটেকুটে ধুয়ে-পাখলে ফোড়ন দিয়ে কষিয়ে সাঁতলে রেঁধে ওঠার জায়গাই নয়, তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অর্থ আর প্রতীকী তাৎপর্যের এক বিচিত্র সমারোহ। কিন্তু কী ভাবে?

    মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় পর্যটকদের লেখায় নির্ভুল ভাবে উপস্থিত বাংলার খাবারদাবারের প্রাচুর্য আর বৈচিত্র্য নিয়ে মুগ্ধতা। বিশেষ করে বার্নিয়ের তো নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, চাল-গম, শাক-সব্জি, হাঁস-মুরগি, শুয়োর, ছাগল-ভেড়া, এবং টাটকা তথা শুঁটকি মাছের অপর্যাপ্ত বৈচিত্র্য বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের প্রাচুর্যেরই ইঙ্গিতবাহী। সে নাহয় হল, কিন্তু এত সব রান্না করা হত কোথায়? মঙ্গলকাব্যে অনেক রান্নাবান্নার গল্প আছে— চণ্ডীমঙ্গলে স্ত্রী নিদয়ার জন্য স্বামী ধর্মকেতু বা স্বামী ধনপতির জন্য স্ত্রী লহনা হরেক রকম রাঁধছেন বটে, কিন্তু বাড়ির কোথায় বসে? মনে হয় রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া বাঙালি জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠলেও, রান্নাঘরের বিশেষ স্থানমাহাত্ম্য তখনও তৈরি হয়নি। আঠারো শতকের শেষে সায়েবদের লেখালিখি থেকেও দেখি যে, রান্নাঘরে হাঁকডাক খাটাখাটুনি চলছে বিস্তর, কিন্তু সে ঘর বাড়ির অংশ, অর্থাৎ এক সুনির্দিষ্ট ‘ডোমেস্টিক স্পেস’ ঠিক নয়, বরং বাইরে, মূলত চাকরবাকরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া এক ‘সার্ভিস স্পেস’। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ঝাঁকে ঝাঁকে ব্রিটিশ মহিলা ভারতে এসে এদেশে কর্মরত ব্রিটিশ পুরুষদের বিয়ে করে সংসার পাতলেন, আর তাঁদের হাতে তৈরি হল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গৃহস্থালির এক নয়া প্রকরণ। তাঁদের লেখালিখিতে অবশ্য দিশি ‘বাবুর্চিখানা’ এক নরকতুল্য জায়গা, যার আবর্জনা, দুর্গন্ধ, আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রাচ্যের সাধারণ অপরিচ্ছন্নতার প্রতীক, যেখানে একবার দাঁড়ালে আর রান্না করা খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে হয় না। 

    এর বিপরীতে উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভিঘাতে শিক্ষিত ভদ্রলোকের জীবনচর্যায় যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলি এল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গৃহস্থালি ও পারিবারিক আচরণবিধির এক আদর্শায়িত নতুন ব্যাকরণ। এই নব্য গার্হস্থ্যবিধিতে রন্ধনবিদ্যার স্থান ছিল তাৎপর্যময়, কারণ এই পরিবর্তনের ফলে রান্নাঘরটি আর শুধু ‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’-র নৈমিত্তিকতার মধ্যেই আবদ্ধ রইল না, তা হয়ে উঠল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যুগবদলের এক দিকচিহ্ন। ১৮৮৪ সালে, যার অল্প পরেই জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, ঈশানচন্দ্র বসু নামে এক পণ্ডিত লিখেছিলেন, ‘রন্ধনেই মেয়েদের বিশেষ বিদ্যা, নৈপুণ্য ও মর্যাদার প্রকাশ’ (‘নারী নীতি’, ১৮৮৪)। একই ধরনের বক্তব্য উঠে আসছিল নারীপুরুষ নির্বিশেষে ভদ্রলোক সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ থেকে। লক্ষণীয় যে, রান্নাঘরের পারদর্শিতার কদর উপযোগবাদের নৈমিত্তিকতাকে ছাপিয়ে উঠছিল, সেই কদরের মধ্যে ধরা পড়ছিল নারীত্বের সংজ্ঞারই এক নবনির্মাণ। 

    রান্নাঘরের সেই নতুন ব্যাকরণের প্রথম পাঠটিই ছিল এক অভিযোগ— ‘নবীনা’, ‘আধুনিকা’রা রন্ধনবিদ্যাটি ভুলতেই বসেছেন, কারণ অনভ্যাস এবং অনিচ্ছা। যে পত্রিকাকে উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালি মেয়েদের অবশ্যপাঠ্য মনে করা হত, সেই ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় এই অভিযোগের ছড়াছড়ি চোখে পড়ার মতো— মেয়েরা আলসেমি করছেন, নরম উলের সোয়েটার বুনে বা ‘বঙ্কিমবাবুর’ নভেল পড়ে সময় কাটাচ্ছেন, বিলিতি কেতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন, মাইনে-করা ঠাকুরের হাতে নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিচ্ছেন রান্নার ভার। উনিশ শতকের শেষে আর বিশ শতকের গোড়ার দিকে অসংখ্য লেখালিখির মধ্যে ‘ঐতিহ্যের বিপর্যয়’ নিয়ে যে উদ্বেগ লক্ষ করা যায়, তার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল রান্নাঘর। এমনকী ফেমিনিস্ট বেগম রোকেয়া অব্দি ‘সুগৃহিণী’ নামের এক প্রবন্ধে (১৯০৪) বললেন যে, রান্নাঘরের তত্ত্বতালাশ সুলুকসন্ধান না জানা থাকলে মহিলাদের সংসারধর্মের ‘বিসমিল্লায়ই গলদ’। তথাকথিত রন্ধনবিমুখ মহিলাদের অনুকরণীয় আদর্শ রন্ধনপটীয়সী নারীচরিত্রের দৃষ্টান্ত দেওয়ার ব্যাপারে এই সব উপদেষ্টা লেখকরা ছিলেন যথার্থই আন্তর্জাতিক। দ্রৌপদীর উদাহরণ যেমন দেওয়া হত, তেমনই জুতসই উদাহরণের জন্য মহারানি ভিক্টোরিয়া বা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের স্ত্রীরও দ্বারস্থ হওয়া যেত। 

    প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন, এবং যথেষ্ট আলোবাতাস সম্পন্ন রান্নাঘর বানানোর প্রয়োজনীয়তার কথা ১৮৮৭ সালে চন্দ্রনাথ বসুর লেখা ‘গার্হস্থ্যপাঠ’ থেকে শুরু করে ১৯১০ সালে রসায়নবিদ চুনীলাল বসুর ‘খাদ্য’, বা ১৯১৫ সালে দীনেশ্চন্দ্র সেনের ‘গৃহশ্রী’ পর্যন্ত শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত বাঙালির নব্য ‘হোম সায়েন্সের’ সব বইতে বারবার লেখা হয়েছে। ১৯২৮ সালে আয়ুর্বেদশাস্ত্রী কবিরাজ ইন্দুভূষণ সেন তাঁর ‘বাঙালির খাদ্য’ বইটিতে তো স্পষ্টই জানালেন, ‘রান্নাঘরকে ঠাকুরঘরেরই মত পবিত্র জ্ঞান করা উচিত’। তিরিশ চল্লিশের দশকেও এই বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার, যার মারফত আমরা দেখছি যে গৃহিণীর নিজের হাতের রান্নার অন্তর্নিহিত ‘যত্ন’, ‘মমতা’, ও ‘ভালবাসা’র পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা, পারিপাট্য, এই সবের মিশেলে তৈরি হচ্ছে সাবেক ভারতীয় ভাবাবেগ, আর ‘আধুনিক’ পাশ্চাত্যের ‘এফিশিয়েন্সি’র এক মিশ্র প্যাকেজ। ঔপনিবেশিক বাংলায় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এই সংযোগেই সম্ভব হয়েছিল বাঙালির রান্নাঘর আর তার মধ্যে ব্যয়িত মেয়েদের হাড়ভাঙা খাটুনির এক ‘সৌন্দর্যায়ন’।

    সেই রান্নাঘরের বিবর্তন ঘটেছে কয়েকশো বছর ধরে। উনিশ শতকে গরিব বাঙালির রান্নাঘরে ঠাঁই পেত দু’একটা লোহার কড়াই, আর মেটে হাঁড়িপাতিল, মালসা, কলসি, আর হয়তো মশলাপাতি রাখার জন্য দু’চারটে নারকোলের মালা। বাঙালির প্রথম রান্নার বই, ১৮৩১ সালে বর্ধমানের রাজপরিবারের আনুকূল্যে প্রকাশিত ‘পাকরাজেশ্বর’-এ দেখতে পাই বাষ্পযন্ত্র, জলযন্ত্র, বালুকাযন্ত্র, ইত্যাদির উল্লেখ, বোধ করি বাঙালির রান্নাঘরে সেই প্রথম গ্যাজেটের প্রচলন, তবে অভিজাত, উচ্চবিত্ত পরিবারের বাইরে এ-সবের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বলে মনে হয় না, মধ্যবিত্তের দৌড় হাঁড়িকড়াই কেটলি হাতাখুন্তি বঁটি শিলনোড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯২৯ সালে লেখা নীহারমালা দেবীর ‘আদর্শ রন্ধন শিক্ষা’য় দেখছি টোস্টার সসপ্যান টিপটের সঙ্গে কেরোসিন স্টোভ, স্পিরিটের বাতি, ইত্যাদির প্রশংসায় লেখিকা পঞ্চমুখ, তবে সবচেয়ে বেশি বাহবা কুড়োচ্ছে ইকমিক কুকার, ১৯১০ সালে যে অত্যাশ্চর্য যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন সর্ববিদ্যাবিশারদ ইন্দুমাধব মল্লিক। তারই হাত ধরে চলে এল রিলিফ কুকার, মন্মথ কুকার, ভাপিনী কুকার, গৃহস্থ কুকার, অবশেষে প্রেশার কুকার। বিশ শতকের গোড়াতেই দেখা যাচ্ছে বেকিং আভেনের আবির্ভাব, আর তিরিশের দশকে কেরোসিনের প্রাইমাস স্টোভের, যদিও মধ্যবিত্ত বাঙালির রান্নাঘরে জনতা স্টোভ আর প্রেশার কুকারের রমরমা সত্তরের দশকের আগে নয়, যখন সেই কুকারের সঙ্গে বিনামূল্যে বিতরিত একটি চটি রেসিপি বইয়ে ‘রোগন জোশ’ আর ‘আভিয়ালের’ বর্ণনা পড়ে প্রথম সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের গরিমায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম।

    এলপিজি গ্যাস, মাইক্রোওয়েভ, ইলেকট্রিক গ্রিল, ফুড প্রসেসর, মডিউলার কিচেনের জয়যাত্রার মধ্যে আর না-ই বা গেলাম। বাংলা রান্নার কুকারি শো মাঝেমধ্যেই দেখি, এপার-ওপার দুই বাংলারই, কখনও টেলিভিশনে, কখনও ইউটিউবে, তার অনেক জায়গাতেই রান্নাঘরের বাহার তথাকথিত ‘প্রথম বিশ্বের’ সেলেব্রিটি শেফদের কিচেনের থেকে খুব কম নয়। বিশ্বায়নের যুগে এই ভুবনডাঙার মাঠে উচ্চবিত্ত বাঙালির রান্নাঘরের জৌলুস বাড়বে, জানা কথা, রেস্টোর‍্যান্ট বিপ্লব আর ‘ইটিং আউট’ কালচারের বিস্ফোরণও যতই ঘটুক না কেন। সেই রান্নাঘরে আমরা এক বল্গাহীন স্ফূর্তিতে বাঙালি কায়দায় রাঁধব বিমিশ্র ফিউশন ফুড নিশ্চয়ই, কিন্তু লীলা মজুমদারের অবিস্মরণীয় রান্নার বইয়ের অতুলনীয় ‘আমোদিনীর নুড়নুড়ি শাকের’ আশ্চর্য সুবাস তাতে ঢাকা পড়বে না, এই বিশ্বাসও রাখি।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook