কিছু কিছু টেস্ট ম্যাচ ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতির মণিকোঠায় বহুদিনের জন্য খোদাই হয়ে থাকে। গত মাসে ভারতের ব্রিসবেন জয় সেরকমই একটা টেস্ট ম্যাচ। ঠিক যেমন ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকের বিখ্যাত অ্যাশেজ জয়গুলো। বা, ২০০১ সালে এবং ২০০৪-এ অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফর। তেমনই, এবারের ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ আর গাব্বার চূড়ান্ত রোমাঞ্চকর ক্লাইম্যাক্স চিরকাল মনে থাকবে। সেই জয়গুলোর মতোই, এই ব্রিসবেন টেস্টও, গৌরবময়, অবিশ্বাস্য এবং চমকপ্রদ হয়ে উঠেছিল। ওঃ, টেস্ট ক্রিকেট… এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে, যখন শেষে সেই লড়াকু দলটা জেতে— যারা সমস্ত বিশেষজ্ঞের মতামতের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, স্রেফ নিজেদের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখে। মাঝের কয়েকটা সপ্তাহ জুড়ে ভারতীয় দলের রিজার্ভ বেঞ্চের শক্তি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, ভারত কীভাবে তাদের আইকনিক অধিনায়ক আর অন্তত পাঁচজন নিয়মিত টেস্ট ক্রিকেটারকে ছাড়াই ব্রিসবেনে লড়েছে। সত্যিই, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে, পূর্ণশক্তির অজিদের বিরুদ্ধে একঝাঁক অজানা-অচেনা ক্রিকেটার কী করে সিরিজ জিতে নিলেন?
মাসদুই ধরে ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়ায় এমন চমৎকার ফল করল কী করে, তার দুটো ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি। বড় মঞ্চে নেমে ভারতীয় ক্রিকেটারদের ঘাবড়ে না যাওয়ার দুটো পরিষ্কার কারণ— ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) এবং ইন্ডিয়া ‘এ’-র বিদেশ সফরগুলো।
আইপিএলে ছ’টা মরশুম কাটিয়েছি আমি। তখন দেখেছি, নানা টিমের ড্রেসিংরুমগুলো তরুণ ক্রিকেটারদের বেড়ে উঠতে, গড়ে উঠতে কতটা সাহায্য করে। কথাটা যদিও আইপিএলে খেলা অন্য দেশের ক্রিকেটারদের বেলাতেও খাটে। কিন্তু সত্যি বলতে, এর প্রভাবটা ভারতীয় খেলোয়াড়দের ওপর ব্যাপক। এই লিগটা ভারতীয় ক্রিকেটের তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। সারা ভারত জুড়ে এখন অনেকগুলো লিগ হয়, নতুন নতুন প্রতিভার খোঁজে প্রতিভাসন্ধানীরা সেই সমস্ত লিগ দেখে বেড়ান। সেই ভাবেই, টি নটরাজন এবং বরুণ চক্রবর্তীকে ‘তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগ’ থেকে তুলে আনা হয়েছে। যে-দুই খেলোয়াড় আইপিএলে হায়দ্রাবাদ আর কলকাতার হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে, শেষমেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঢুকে পড়েছেন।
আইপিএলের আর একটা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব হল, এই সব তরুণ ক্রিকেটাররা প্রত্যেক বছর কয়েকজন বিশ্বসেরা ক্রিকেটারের সঙ্গে একই ডাগআউট ও চেঞ্জরুম ভাগাভাগি করার সুযোগ পান। যেমন বছরের অন্তত দু’মাস নটরাজন ওঁর অধিনায়ক হিসেবে পান ডেভিড ওয়ার্নারকে। যখন পরে, আন্তর্জাতিক খেলায়, এই তরুণ ভারতীয় পেসার ওয়ার্নারকে বল করবেন, তখন তো আইপিএলের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগবে। আবার, কলকাতা নাইট রাইডার্সের নেটে শুভমান গিল ব্যাট করেন প্যাট কামিন্সের ফাস্ট বোলিং-এর বিরুদ্ধে। যখন কোনও টেস্ট ম্যাচ বা সাদা বলের ম্যাচে তিনি কামিন্সের বলের মোকাবিলা করবেন, তখন তো আইপিএলের সেই রসদ একেবারে অমূল্য হয়ে দাঁড়াবে।
নিজে আইপিএল খেলার সুবাদে এই ইতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে আমি সরাসরি পরিচিত। আর ইন্ডিয়া ‘এ’ দলের সিস্টেম কীভাবে ভারতীয় তরুণ ক্রিকেটারদের বিদেশি পরিবেশের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে, সেটা জেনেছি ভারতীয় টিভি-ধারাভাষ্যকারদের কাছে। গিল, পন্থ, মহম্মদ সিরাজ এবং আরও কয়েকজন গাব্বা-নায়ক, এর আগে ইন্ডিয়া ‘এ’-র হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে চুটিয়ে খেলেছেন। সেজন্য ওঁদের বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া, পিচ, গতি, বাউন্স সম্পর্কে ধারণা তো আছেই, প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারদের সম্পর্কেও দিব্যি ধারণা আছে।
ইন্ডিয়া ‘এ’ এবং আইপিএল খেলতে খেলতে, একজন তরুণ ভারতীয় ক্রিকেটার একদিকে পেয়ে যান সেরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড চাপের পরিস্থিতি আর মরণবাঁচন মুহূর্ত সামলানোর স্বাদ। আর একদিকে পান বিবিধ পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান, এও বোঝেন— সব পরিবেশে সফল হওয়ার জন্য নিজের টেকনিক-কে সযত্নে গড়ে তোলার গুরুত্ব কতখানি। কয়েক বছরের মধ্যে ওঁরা এক এক জন ‘কমপ্লিট’ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন, আর ওঁদের নৈপুণ্যও হয়ে ওঠে অন্য দেশের সমকালীন ক্রিকেটারদের তুলনায় উঁচু মানের।
দু’জনের উদাহরণ দিই— শার্দূল ঠাকুর আর ওয়াশিংটন সুন্দর। ব্রিসবেনের দুর্ভেদ্য দুর্গে হানা দিতে এই দুই নতুন রক্তের (ঠাকুরের অভিষেক আগে ঘটলেও, সেই টেস্টে ওঁর চোট লাগে) আমদানি করা হয়েছিল ভারতীয় দলে। এবং ওঁরা দু’জনেই সেই কাজের জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলেন। আমি ঠাকুরকে আইপিএলের কিছু ম্যাচে দেখেছি। লক্ষ করেছি, উনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের চোখে চোখ রেখে খেলতে পারেন। কাউকে ভয় পান না। কারও সামনে গুটিয়ে যান না। টেস্ট ম্যাচ খেলতে এসেও এই ক্ষমতাগুলো অক্ষুণ্ণ রেখেছেন ঠাকুর। এবং দুর্দান্ত বোলিং করে নিশ্চিত করেছেন, নিয়মিত বোলাররা না খেললেও, এই ভারতীয় দল বিপক্ষের কুড়িটা উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
ওযাশিংটন সুন্দর সাদা বলের একজন দক্ষ ক্রিকেটার। তবে টেস্টে ধ্রুপদী অফস্পিনার হওয়ার চেষ্টা না করে, নিজের শক্তির ওপর ভরসা রেখে, উনি ঠিক সেই ধরনের বোলিংটাই করলেন, যেটা উনি সবচেয়ে ভাল জানেন। এটা দেখে আমি মুগ্ধ। আর ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে ঠাকুরের সঙ্গে পার্টনারশিপে, ওঁর আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছিল।
তবে এত উচ্ছ্বাসের মধ্যে, ভারতের ভয়ের ব্যাপার একটাই— কোটি কোটি কট্টর ফ্যান। এই ফ্যানদের প্রত্যাশার প্রকাণ্ড চাপ, একটা ম্যাচ ভাল খেললেই তাদের কাছে চটজলদি বিশাল খ্যাতি পেয়ে যাওয়া, আবার একটা ম্যাচ খারাপ খেললেই ঝপ করে বাতিলের খাতায় নির্বাসিত হওয়া— এসব একজন তরুণ ক্রিকেটারের পক্ষে সর্বনাশা হতে পারে।
এ ব্যাপারে আমি ঋষভ পন্থকে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানদের সম্পর্কে আমার এমনিতেই দুর্বলতা আছে। আর পন্থকে তো আমার অপ্রতিরোধ্য লাগে। নিশ্চয়ই এখনই ওঁর হাজার হাজার উত্তেজিত ভক্তের দল তৈরি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই তরুণের ভাল খেলা ও খারাপ খেলার সময় এই ফ্যানদের প্রতিক্রিয়ার একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সেটাই প্রকৃত সমর্থন। সেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ওঁর ওপরে চাপ, আর ওঁকে নিয়ে কাটাছেঁড়া, প্রায়ই একটা ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। আশা করব, পন্থের সাম্প্রতিক ধারাবাহিক পারফরম্যান্সগুলো দেখে, তাঁর ভক্ত ও সমালোচক দুই তরফই, একটা ‘ব্যালান্সড’ দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারবেন।