ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • এলেবেলে: পর্ব ১

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (February 15, 2021)
     
    কথা বলে সুখ নাই

    তখন স্কুলে পড়ি, ক্লাস সিক্স-সেভেন হবে। বাড়িতে বাবা, মা, ভাইবোনেরা ছাড়াও থাকত যমুনা। আরও একজন থাকত, আমার ডাক্তার বাবার হেল্পার দুখিরাম। দুখিরামের গল্প পরে বলব, আজ যমুনার গল্প। যমুনা সকালবেলা উঠে আগের রাত্তিরে করা ছ’খানা রুটি আর এক বড় বাটি দুধ-চা নিয়ে বসত। বেশ সময় নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে রুটি আর দুধ-চা খেত যমুনা। যমুনা মাঝবয়সি, ওই পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে, গায়ের রং মাজা, সামনের দুটো দাঁত তলার ঠোঁটের ওপর বসে সব সময় তাকিয়ে থাকে। যমুনার সাতকুলে কেউ নেই, যদি মা’র খুড়তুতো বোনের পিসতুতো দাদার মেয়ের কথা বাদ দেওয়া যায়। যমুনার সরলা মাসি। সে-ই দিয়ে গেছিল যমুনাকে আমাদের বাড়ি। সে অনেক বছর আগেকার কথা। যমুনার কাজ ছিল মা’কে রান্নাবান্নায় সাহায্য করা, কুটনো কুটে দেওয়া, মশলা বেটে দেওয়া। রান্না হয়ে গেলে মা স্নান করতে চলে যেতেন। স্নানের পর বারান্দায় মা’র চুল শুকোনো, চুল আঁচড়ে খোঁপা বেঁধে দেওয়া, সব যমুনা করত। কথাবার্তা খুব একটা বলত না যমুনা। যখন আরও অনেক ছোট ছিলাম, ‘গল্প বলো, গল্প বলো’ করে বেড়াতাম সবার কাছে, তখন যমুনার কাছে গল্প শোনার জন্য পেটে কিল অবধি মেরে দেখেছি, উঁ-উঁ-উঁ ছাড়া বিশেষ কোনও শব্দ বেরোয় না। যেটুকু সামান্য কথা বলার, তা ঘ্যানঘ্যানে নাকি সুরে মা’র সঙ্গেই বলত। মা মাঝে মাঝে বলতেন, তুই বিয়ে করবি না যমুনা? যমুনা কখনও লজ্জা পেত, কখনও হাসত, কখনও বলত, ‘আমারে যে বিয়ে করবে সে এখনও জন্মায়নি গো মা।’

    এভাবেই দিন কাটছিল। গ্রীষ্মকালে আমার পিঠে খুব ঘামাচি হত, যমুনা সময় পেলেই পুটপুট করে ঘামাচি মেরে দিত। শীতকালে ভাইবোনদের বুকে-পিঠে সর্ষের তেল ঘষে ঘষে মালিশ করে দিত। সবই চলছিল ঠিকঠাক, এরই মধ্যে একদিন সকালবেলা যমুনার সরলা মাসি এসে হাজির। যমুনা সবে ছ’নম্বর রুটিটা চায়ে ভিজিয়ে শেষ করেছে। মা বললেন, ‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে?’ সরলা বলল, ‘আগে কিছু খেতে দাও, তারপর বলছি।’ মা একবাটি মুড়ি-আলুভাজা দিলেন, আর বাটি ভরা চা। খেতে খেতে সরলা বলল, ‘যম্‌নার একখানা সম্মন্দ এসেচে গো। আমাদের পাল্টিঘর। যম্‌নাকে পাকা দেখবে, তাপর বিয়ে। সব ঠিক হয়ে গেলে তোমার কাছে যম্‌নার মাইনার টাকা যা জমানো আছে তা নিয়ে যাব।’ মা বলল, ‘খুব ভাল খবর তো। কী যমুনা, খুশি তো?’ যমুনা সত্যিই খুশি! মা বললেন, ‘ছেলে কী করে?’
    — ছেলে কী গো, চার ছেলের বাপ। আগের দুটো বউ মারা গেছে। এটা তিন নম্বর বিয়ে।
    মা বললেন, অ! তা সে করে কী?
    — কী আর করবে! দুটো গাই আছে, দুধ দুইয়ে বেচে, তা দিয়েই সংসার চলে! তা বাদে বিঘে খানেক জমি আছে, তাতে আলু চাষ করে। সে কী বড় বড় আলু গো মা! তুমি দেখলে ভির্মি খাবে। ভাল পাত্র।
    — হুম। তা পাত্রের বয়স কত?
    — এই সবে একাশি।
    — সে কী! কত আর বাঁচবে? কদ্দিন আর যমুনা স্বামীর ঘর করবে?
    — সে-ই তো! তবে আমাদের কথা দিয়েছে, বিয়ের পর জমিজমা, গাই, সব বউয়ের নামে করে দেবে।

    সে দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যমুনা তার টিনের সুটকেস থেকে একখানা নতুন শাড়ি পরে, মা-বাবাকে প্রণাম করে, তার সরলা মাসির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে মা যমুনাকে বলল, ‘তোর জন্য নাকছাবি না কানের দুল, কোনটা গড়িয়ে রাখব?’ সরলা বলল, ‘দুটোই দিও গো মা। তোমরা ছাড়া ওর দেওয়ার কে আছে? আমার তো হাত উলটোলে ধুলোও পড়ে না।’ 

    এর পর দশ-বারো দিন কেটে গেল। আমাদেরও দিন কাটতে লাগল। মা যমুনার আশা ছেড়ে দিলেন। আমরাও ভাবতে শুরু করলাম, যমুনার সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না। ওর নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে গেছে, যমুনা এখন দুটো গাই আর বিশাল বড় বড় আলুর খেতের মালিক! মা কাজের লোকের খোঁজ শুরু করলেন, আর অমনি একদিন সকাল বেলা সরলা মাসি এসে হাজির, সঙ্গে যমুনা। মা তো অবাক, বললেন, ‘কী ব্যাপার? কবে বিয়ে?’ সরলা বলল, ‘আগে কিছু খেতে দাও মা, তারপর সব বলছি। পেট জ্বলছে আমাদের।’ মা তাড়াতাড়ি রুটি-আলুভাজা করে দিল, সঙ্গে বড় বড় দু’বাটি ধোঁয়া-ওঠা চা। খেয়েদেয়ে সরলা বলল, ‘এখানে বিয়ে হবে না গো মা।’ মা বললেন, ‘সে কী! কেন?’ 

    — কী কেলেংকারি মা! আমরা তো যমুনাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে উঠোনে বসে বুড়োর জন্য অপেক্ষা করছি, এ সময়ে হন্তদন্ত হয়ে বুড়ো এল, পেছনে তার চার ছেলে। ছেলেগুলোকে দেখলে মনে হয় বাপের চেয়েও বড়! বুড়ো এসে হাঁক পাড়ল, ‘মেয়ে কই?’ আমরা তো হকচকিয়ে গেছি! বললাম, ঘরে আছে। বুড়ো বলল, ‘কোন ঘর?’ ঘাবড়ে গিয়ে ছোটবোনের মেয়েটা ঘর দেখিয়ে দিল, আর অমনি বুড়ো সেই ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তার আগে আবার বলল, ‘আমি যতক্ষণ আছি এই ঘরে কেউ ঢুকবে না!’ কী কাণ্ড! ভয়ে তো সিঁটিয়ে গেচি গো মা, তায় মুশকো ছেলেগুলো আমাদের পাহারা দিচ্চে। আর ওদিকে ঘরে যে কী হচ্চে কে জানে! ছেলেগুলোকে ওরই মধ্যে নিমকি-সিঙাড়া দিলাম। তা ঢ্যামনাগুলো বলে, ‘আর কিছু নেই?’ আমরা তো এদিকে কাল গুনছি, আর ছেলেগুলো সিঙাড়া খেয়ে চলেছে। তা চা শেষ করার পর বুড়ো দরজা খুলে বেরোল, লাঠি হাতে গটগটিয়ে যেতে যেতে ছেলেদের বলল ‘চল’, ছেলেরাও অমনি বাপের পিছু নিল। আমরা বললাম, ‘কী হল বলে যাও?’ বুড়ো হনহনিয়ে যেতে যেতে লাঠি নেড়ে বলল, ‘নাঃ। কথা বলে সুখ নাই!’

    দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সরলা চলে গেল। বাইরে তখন হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়েছে গ্রীষ্ম। ঘরে ঘড়ঘড় করে ফ্যান চলছে। ছোটভাই ঘুমিয়ে আছে, তার পিঠ ভর্তি ঘামাচি। যমুনা পুটপুট করে ঘামাচিগুলো মারতে লাগল। দিদি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই যমুনাদি, কী হয়েছিল রে ঘরের মধ্যে?’ যমুনা একটু লজ্জা পেয়ে বলল ‘উঁ’। দিদি বলল, ‘বল্ না। বুড়ো তোর হাত ধরেছিল?’ যমুনা বলল, ‘উঁ’। দুপুর ভরে গেল ঘামাচি মারার শব্দে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook