ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিজ্ঞান লিখতে বাংলা ভাষা


    মুহম্মদ জাফর ইকবাল (February 20, 2021)
     

    আমি যেহেতু বেশির ভাগ সময়েই কমবয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য লিখি, তাই মাঝে মাঝেই আমাকে ছেলেমেয়েদের স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কিংবা একেবারেই বিনা কারণে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তখন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলি, নানা ধরনের কাজকর্মে তাদের উৎসাহ দিই। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষা নিয়েও কথা বলি, আমাদের ভাষাটা যে কত চমৎকার সেটা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। আমাদের ভাষা যে কত ‘নমনীয়’, সেটা বোঝানোর জন্যে আমি তাদের মাঝে মাঝেই ছোট একটা বাক্যের উদাহরণ দিই। বাক্যটি হচ্ছে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে দিই, বাক্যের এই তিনটি শব্দকে আগে-পিছে করে সব মিলিয়ে ছ’ভাবে সাজানো যায় (আমি ভালবাসি তোমাকে, তোমাকে আমি ভালবাসি… ইত্যাদি)। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ছ’ভাবেই কিন্তু বাক্যটি বলা যেতে পারে। এক-দুটিকে হয়তো একটুখানি কবিতা-কবিতা মনে হবে, কিন্তু ভুল বলে কেউ ফেলে দেবে না। তখন আমি তুলনা করার জন্য এই বাক্যটির ইংরেজি রূপ নিয়ে কথা বলি: ‘আই লাভ ইউ’। এবং তাদের মনে করিয়ে দিই, এখানে শব্দগুলোকে কিন্তু বিন্দুমাত্র নাড়াচাড়া করা যাবে না, ‘আই ইউ লাভ’ কিংবা ‘লাভ ইউ আই’ কিংবা অন্য কোনওটিই কেউ ভুলেও কখনও বলার চেষ্টা করবে না, কারণ  সেগুলো অশুদ্ধ। আমার কথা শুনে ছেলেমেয়েরা আনন্দে হেসে কুটিকুটি হয়! তখন আমি তাদের বলি, আমাদের ভাষাটা এত নমনীয় এবং একটা বাক্যই এত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলতে পারি বলে বাঙালি সব তরুণ-তরুণী জীবনের একটা বয়সে কবিতা লেখে। সেজন্যে আমাদের মাঝে এত কবি। আমাদের বইমেলাতে তাই কবিতার বইয়ের এত ছড়াছড়ি!

    আমি ভাষাবিদ নই, কাজেই আমার উদাহরণটির আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কি না আমি জানি না, কিন্তু যেহেতু এটি কোনও জার্নালের প্রকাশনা নয়, তাই আমি তথ্য-উপাত্ত, সত্য-মিথ্যা কিংবা যুক্তি-তর্ক নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছি না। কিছু একটা দেখে কিছু একটা মনে হয়েছে সেটা অন্যদের বলছি— এর বেশি কিছু নয়। নিজের ভাষাকে ভালবাসার জন্য যদি একটুখানি বাড়িয়ে-চাড়িয়েও বলি, সেটা এমন কিছু গুরুতর অপরাধ নয়! 

    তবে ছেলেমেয়েদের আমি যে কথাটি কখনও বলি না, সেটি হচ্ছে, বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা হয়তো সহজ, কিন্তু বিজ্ঞান লেখা এত সহজ নয়, বেশ কঠিন! কে জানে, হয়তো এর জন্য দায়ী আমি নিজেই— আমি সবসময় সবকিছু খুব সহজ করে লিখতে চেষ্টা করি! (আমার কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা, আমার লেখার সঙ্গে অন্য লেখকের লেখার তুলনা করে আমাকে জানিয়েছে, আমি সবচেয়ে কম সংখ্যক শব্দ ব্যবহার করে লিখি। চাঁচাছোলা ভাষায় যার অর্থ: আমার শব্দভাণ্ডার সীমিত)! বেশি শব্দ ব্যবহার করে, একটু লম্বা লম্বা বাক্যে কঠিন ভাবে লিখতে চাইলে, কিংবা ঠিক অর্থ বোঝালেই সেটা শুনতে কেমন লাগছে সেটা নিয়ে মাথা না ঘামালে, সম্ভবত বাংলায় বিজ্ঞানের কিছু লেখা এমন কিছু কঠিন নয়। কিন্তু একজন শিক্ষক হিসেবে আমার সবসময়েই মনে হয়েছে, বিষয়টুকু যত জটিলই হোক, একজন শিক্ষকের চেষ্টা করা উচিত সেটা সহজ ভাবে বলার।

    সবাই হয়তো আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু এই বিষয়টা আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কোনও একটা বিশেষ কারণে আমি প্রায় নিয়ম করে বিজ্ঞানের উপর বই লিখি। শুধু তাই নয়, আমাকে স্কুল-কলেজের সরকারি পাঠ্যবইও লিখতে হয়েছে, কাজেই আমি দাবি করতে পারি, মোটামুটি ভাবে আমি বাংলায় যথেষ্ট বিজ্ঞানের বই লিখেছি। আমি লক্ষ করেছি যে, যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানের একটা তথ্য ইংরেজিতে একটা বাক্যেই সহজে লিখতে পারি, বাংলায় লেখার সময় সেটি সুন্দর ভাবে লিখতে হলে অনেক সময়েই একটি বাক্যে লেখা যায় না, ভাষাটুকু সহজ রাখতে হলে ভেঙে দুটি ভিন্ন বাক্যে লিখতে হয়। ভাষাবিদেরা তার কারণটা হয়তো ঠিকভাবে ব্যাখা করতে পারবেন, আমার মনে হয়েছে অনেক সময়েই সেটা ঘটে বাংলা ভাষায় বাক্যের গঠনের জন্যে। বাংলায় বেশির ভাগ সময় আমরা ক্রিয়াপদ দিয়ে বাক্যটি শেষ করি, কাজেই অন্য সবকিছু বাক্যের প্রথমে রাখতে হয়। সেখানে বেশি তথ্য চলে এলে, বাক্যটা খানিকটা কঠিন এবং খানিকটা দুর্বোধ্য হয়ে যায়। ইংরেজিতে সেটা সমস্যা নয়, ক্রিয়াপদের সামনে কিছু তথ্য এবং শেষে কিছু তথ্য দিয়ে বাক্যটাকে সুন্দর করে মিলিয়ে দেওয়া যায়।

    আমি লক্ষ করেছি যে, যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানের একটা তথ্য ইংরেজিতে একটা বাক্যেই সহজে লিখতে পারি, বাংলায় লেখার সময় সেটি সুন্দর ভাবে লিখতে হলে অনেক সময়েই একটি বাক্যে লেখা যায় না, ভাষাটুকু সহজ রাখতে হলে ভেঙে দুটি ভিন্ন বাক্যে লিখতে হয়। ভাষাবিদেরা তার কারণটা হয়তো ঠিকভাবে ব্যাখা করতে পারবেন, আমার মনে হয়েছে অনেক সময়েই সেটা ঘটে বাংলা ভাষায় বাক্যের গঠনের জন্যে।

    তবে গুরুতর সমস্যাটি আসলে অন্য জায়গায়। বাংলায় ক্রিয়াপদ খুব কম। বিশেষ করে বিজ্ঞানে ব্যবহার হয়, সেরকম ক্রিয়াপদের খুবই অভাব। তাই একটা শব্দের সঙ্গে ‘করা’ যুক্ত করে (এই মাত্র যেটা করলাম!) আলাদা ভাবে ক্রিয়াপদ তৈরি করে নিতে হয়। তাই বিজ্ঞানের স্বাভাবিক একটা বাক্যে যেখানে যুক্তি এবং তথ্যগুলো প্রকাশ করার জন্যে কয়েকটি ক্রিয়াপদ থাকে— সেগুলো বাংলায় লেখার জন্য ক্রিয়াপদের অভাবে অনেক সময়েই শব্দের সঙ্গে ‘করা’ যুক্ত করে কাজ চালাতে হয়। একটা বাক্যে এরকম অনেকগুলো ‘করা’ থাকলে, বাক্যটার শুধু সৌন্দর্যটাই মাটি হয় তা নয়, কোনটি আগে কোনটি পরে— সেটাও গুলিয়ে যায়। কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন, তাঁকে বলব মোটামুটি মানসম্মত একটা ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞানের বই নিয়ে, তার একটি-দুটি বাক্য বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করতে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলায় বিজ্ঞান লেখার সমস্যাটা বুঝতে পারবেন!

    সেজন্যে মাঝে মাঝে দুঃসাহস নিয়ে আমি বলে ফেলি, বাংলায় খুব বেশি বিজ্ঞান লেখা হয়নি বলে ভাষাটা এখনও বিজ্ঞানের জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি!

    বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান লিখতে গিয়ে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন আরও একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, যেটার সমাধান আমি জানি না। ভাষা সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি (কিংবা চোখের সামনে দেখেছি) সেটা হচ্ছে, ভাষা এটা জীবন্ত প্রাণীর মতো— এর ক্রমাগত পরিবর্তন হয়। নূতন নূতন শব্দ এসে ঢুকে, উচ্চারণের ধরন পাল্টে যায়। কবি-লেখকরা লেখালেখিতে নিয়ম ভেঙে ফেলেন, নাটক সিনেমাতে আঞ্চলিক ভাষাকে প্রমিত ভাষার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়। শুধু তাই না, আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক মানুষ যেভাবে খুশি সেভাবে বাংলা লিখে নূতন একটা বানানের ধারার প্রচলন করে ফেলেন। আমি ভাষাবিদদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, কেউ কেউ এটাকে খুব সহজেই মেনে নেন এবং বলে থাকেন এটাই নিয়ম, ভাষা যে জীবন্ত এটা তার প্রমাণ— শুধু মৃত ভাষারই কোনও পরিবর্তন হয় না। আবার অনেক ভাষাবিদ খুবই কঠিন ভাবে বিশ্বাস করেন, ভাষার একটা প্রমিত রূপকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বিশৃঙ্খল এবং উচ্ছৃঙ্খল পরিবর্তনকে যতটুকু সম্ভব ঠেকিয়ে রাখতে হবে। আমরা, যারা ভাষাকে শুধু ব্যবহার করি, তারা দর্শক হিসেবে ভাষার এই বিবর্তনকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।

    তবে বিজ্ঞান লেখার সময় হঠাৎ করে আমাদের একটা বড় চাপের মাঝে ফেলে দেওয়া হয়। যেহেতু বিজ্ঞানের অনেক কিছুই ইউরোপ থেকে এসেছে, তাদের শব্দগুলো ইউরোপীয়। আমাদের ভাষাবিদেরা যত্ন করে তার পরিভাষা তৈরি করেছেন এবং আশা করেন আমরা সেগুলো ব্যবহার করব। আমরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র, তারা ইউরোপীয় শব্দগুলো ব্যবহার করে অভ্যস্ত, সেগুলো শুধু আমাদের পরিচিত শব্দ নয়, সেগুলো আমাদের প্রিয় শব্দ, আমাদের ভালবাসার শব্দ! আমরা বরং পরিভাষা দেখে চমকে উঠি, সেগুলোকে শুধু যে অপরিচিত মনে হয় তা নয়, অনেক সময় কৃত্রিম, আরোপিত, এমনকী মাঝে মাঝে বিদঘুটে মনে হয়। কাজেই লেখালেখি করার সময় আমরা অনেকেই বাংলা পরিভাষা না লিখে সরাসরি ইউরোপীয় কিংবা ইংরেজি শব্দ লিখি। আমি নিজে ‘কৃষ্ণ বিবর’ না লিখে ‘ব্ল্যাক হোল’ লিখি, ‘আধান’ না লিখে ‘চার্জ’ লিখি, ‘লক্ষ-কোটি’ না লিখে ‘মিলিওন-বিলিওন’ লিখি, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ না লিখে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ লিখি, ‘বিভব’ না লিখে ‘পটেনশিয়াল’ লিখি এবং সেজন্য অনেকের রক্তচক্ষু এবং গালমন্দ সহ্য করি! বাংলা ভাষার জন্য আমার ভালবাসা নেই, আমি ভাষার অবমাননা করছি— এরকম অনেক সমালোচনা শুনতে হয়, প্রতিবাদ না করে মাথা নিচু করে সেগুলো শুনে যাই। নিজেকে বোঝাই, জর্জ বুশকে যদি জর্জ ‘ঝোপ’ না লিখে পার পেয়ে যাই, এখানে সেটা কেন অন্যায় হবে? এগুলো তো একটা নাম ছাড়া কিছু নয়, ক’দিন পরে যখন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের পাঠ্যবই পড়বে তখন তো এই ইংরেজি নামগুলোতেই অভ্যস্ত হতে হবে, একটু আগে অভ্যস্ত হলে ক্ষতি কী?

    যাই হোক, এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়ে কথা বলে শেষ করি। সবাই লক্ষ করেছেন কি না জানি না, আমরা কিন্তু এখন খুবই জটিল একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই প্রথম, প্রযুক্তির জগতে তিনটি ভিন্ন উপাদান একসঙ্গে পাওয়া গেছে: ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নামে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, সেখানে ব্যবহারের জন্যে সুবিশাল তথ্যভাণ্ডার এবং সেগুলো প্রক্রিয়া করার উপযুক্ত শক্তিশালী কম্পিউটার। এখন আমাদের অজান্তে পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর ক্ষমতা চলে যাচ্ছে দৈত্যাকার তথ্য-প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোর হাতে। শুধু যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য আর রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে তা নয়, এই প্রথমবার আমাদের ভাষাকেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে প্রক্রিয়া করা সম্ভব হচ্ছে। আমাকে লিখতে হয় না, আমি কথা বললে লেখা হয়ে যায়। আমাকে পড়তে হয় না, লেখা থাকলে আমাকে পড়ে শোনায়। আমাকে অন্য ভাষা শিখতে হয় না, নিজের ভাষায় অনুবাদ করে দেয়। আমাকে শুদ্ধ করে কিছু করতে হয় না, আমি ভুল করলে শুদ্ধ করে দেয়। কী লিখব আমাকে সেটাও চিন্তা করতে হয় না, অন্যরা কী শুনতে চায় সেটা পর্যন্ত আমাকে বলে দেয়! 

    আমরা এখন কী করব? উদার হয়ে ভাষাকে মুক্ত করে দেব, না কি রক্ষণশীল হয়ে ভাষাকে অবিকৃত রাখব? কে জানে, কিছুদিনের ভেতর হয়তো দেখব সেগুলো নিয়ে সিদ্ধান্তও আমাদের নিতে হবে না, কোনও একটা যন্ত্র এবং যান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেই সিদ্ধান্তটি নিয়ে বসে আছে।

    সমস্যা হচ্ছে, আমি কি খুশি হব না দুর্ভাবনা করব, সেটাই বুঝতে পারছি না!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook