‘উইলিয়াম জেমস হার্শেল’ নামটা শুনলে অবধারিত ভাবে বাঙালির মনে এসে পড়ে ‘সোনার কেল্লা’র নাম—সঙ্গে সিধু জ্যাঠার প্রশ্নের উত্তরে ফেলুর সপ্রতিভ জবাব। কিন্তু এই সূত্রেই আর এক বঙ্গসন্তানের নাম রয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে। এমনকী এ-বছর যে তাঁর জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী, সেটাই বা মনে রেখেছেন ক-জন? ভদ্রলোকের নাম খান বাহাদুর আজিজুল হক।
অবিশ্যি তাঁকে যে আমরা ভুলেছি, তাতে আত্মবিস্মৃত বলে বদনাম থাকা আমাদের, মানে বাঙালিদের যে সম্পূর্ণ দোষ আছে তা নয়। তাঁর ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন, এডওয়ার্ড হেনরির দৌলতে আজিজুল হকের আবিষ্কৃত পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’ নামে, যা আজও, এই স্মার্টফোন জমানাতেও, ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে।
১৮৭২ সালে অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইগ্রাম-কসবাতে জন্ম হয় আজিজুল হকের। ছেলেবেলাতে এক নৌকাডুবিতে মা-বাবা দুজনকেই হারিয়ে অনাথ আজিজুল থাকতে শুরু করেন তাঁর দাদার সাথে। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয়; কিন্তু অনটনের সংসারে পেটুক আজিজুলকে বেশি খাওয়ার দরুন দাদার বিস্তর বকুনি শুনতে হত। একদিন আর থাকতে না পেরে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে সটান চলে এলেন কলকাতা। এক ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে আশ্রয় দিলেন তাঁকে। বাড়ির ফাইফরমাশ খাটার কাজেই বহাল হয়েছিলেন আজিজুল, কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে সেই ভদ্রলোক তাঁকে ভর্তি করে দিলেন ইশকুলে। সেখানে অভাবনীয় ফল করে আজিজুল বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বিষয় অঙ্ক। মুখে-মুখে জটিল হিসাবের সমাধান করে দেওয়া ছিল তাঁর কাছে জলভাত। ফলে গণিতকে পাঠ্য বিষয় হিসাবে নিয়ে, তাতে যে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটবেই, তাতে কারোর কোনও সন্দেহ ছিল না। কলেজের শিক্ষকদের থেকে প্রিন্সিপাল খোদ গ্রিফিথ সাহেব অবধি— সকলের প্রিয় ছাত্র তথা প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে আজিজুলের খুব একটা সময় লাগেনি।
এদিকে ঠিক এই সময় বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আই.সি.এস. এডওয়ার্ড হেনরির কাছে মুখ্যসচিব হেনরি কটনের কাছ থেকে এক নতুন প্রস্তাব এসেছে। সঙ্গে একটি চিঠি এবং বই। প্রেরক স্বয়ং উইলিয়াম জেমস হার্শেল, যিনি তাঁর দীর্ঘ বঙ্গ-বাস ছেড়ে সদ্য ফিরে গেছেন লন্ডনে। এদেশে থাকাকালীন বিভিন্ন সরকারি বিভাগের আধিকারিক হিসাবে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছিলেন হার্শেল সাহেব। সেই সময় নানা রকম দলিল-দস্তাবেজের কারচুপি দেখে বুঝেছিলেন যে, এ-জিনিস ঠেকানোর জন্য দাওয়াই হল দস্তখতের বদলে হস্ত-ছাপ। কিন্তু এর জন্য একজন মানুষের আঙুলের ছাপ সময়ের সঙ্গে যে অপরিবর্তিত থাকে, সেটা প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন। উইলিয়াম হার্শেল বহু মানুষের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেন এবং দশ-কুড়ি বছর পর তাদের আঙুলের ছাপ পুনরায় নিয়ে রাশিবিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, আঙুলের ছাপ জীবনভর অপরিবর্তিত থাকে; সুতরাং, আইনি ক্ষেত্রে একে ব্যবহার করা শুরু করা উচিত। ‘নেচার’ পত্রিকায় ১৮৮০ সালে এই নিয়ে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন তিনি। যদিও তাঁর আগে হেনরি ফল্ডস নামে এক স্কটিশ চিকিৎসক এই নিয়ে একটি প্রবন্ধ ওই পত্রিকাতেই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু হার্শেল আর তাঁর পরম সুহৃদ অনুসন্ধিৎসু ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক ফ্র্যান্সিস গ্যালটন ফল্ডসকে পাশ কাটিয়ে নিজেদেরকেই এই আঙুলের ছাপকে ব্যবহার করার বিষয়ে প্রবক্তা হিসাবে মান্যতা দেন।
ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের লেখা একটি বই-সহ হার্শেল সাহেবের চিঠিটি মুখ্যসচিবের মাধ্যমে এসে পৌঁছেছিল এডওয়ার্ড হেনরির কাছে। চিঠির বক্তব্য খুব পরিষ্কার— অবিলম্বে অপরাধী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার জন্য আঙুলের ছাপকে ব্যবহার করার প্রস্তাব। প্রস্তাব দিতে তো অসুবিধা নেই, সমস্যা তার বাস্তবায়নে। হাজার-হাজার আঙুলের ছাপ কীভাবে সংরক্ষিত করলে তা থেকে চটজলদি খুঁজে পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় ছাপটি?
এডওয়ার্ড হেনরি শরণাপন্ন হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ গ্রিফিথ সাহেবের কাছে। পত্রপাঠ প্রোফেসর গ্রিফিথ সুপারিশ করলেন তাঁর কলেজের গণিত তথা রাশিবিজ্ঞানে সর্বাপেক্ষা মেধাবী ছাত্রটির নাম— আজিজুল হক। তাঁর কথা মেনে হেনরি আজিজুল হককে চাকরি দিলেন পুলিশ বিভাগে— আঙুলের ছাপ কীভাবে সুপরিকল্পিত ভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তাঁর উপায় বের করাই হল আজিজুলের কাজ। সঙ্গে যোগ দিলেন আর এক বাঙালি, হেমচন্দ্র বসু।
আজিজুল-হেমচন্দ্রর সাহায্যে আঙুলের ছাপ নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, বই পড়ে, প্রায় বছরদুয়েক পরিশ্রমের পর একটি উপায় বের করা গেল— আঙুলের বিভিন্ন রকম দাগের নকশা অনুযায়ী একটি বিশেষ শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি বোঝার চেষ্টা করা যাক।
আমাদের সকলের হাতের আঙুলে তিন রকমের দাগ থাকে। এক, কিছু দাগ আঙুলের কেন্দ্র থেকে সর্পিলাকারে, গোল-গোল ঘুরে ছড়িয়ে গেছে। এদের বলা হয় হোর্ল (Whorl)। আর এক রকম দাগ দেখা যায়, আঙুলের একদিক থেকে শুরু হয়ে মাঝে এসে ঢেউ খেলে অন্য দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে। অবশ্য এ-ধরনের দাগ খুব কম মানুষের হাতেই দেখা যায়। এদের নাম আর্চ (arch)। অন্য দাগটাকে বলা হয় লুপ (Loop)। এরা আঙুলের এক ধার থেকে শুরু হয়ে মাঝ অবধি এসে ইউ-টার্ন নিয়ে ফিরে যায় যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই। আর্চের সংখ্যা যেহেতু বেশ কম, তাই হক সাহেব সুবিধের জন্য লুপ আর হোর্লকে মিলিয়ে একটি শ্রেণিতে রাখলেন। সুতরাং আঙুলের ছাপের দুটি শ্রেণি পাওয়া গেল— এক, লুপ ও আর্চ এবং দুই, হোর্ল। কিন্তু মানুষের হাতের দশ আঙুলে এই দুটি শ্রেণির দাগ থাকতে পারে দশটি দুয়ের গুণফল অর্থাৎ এক হাজার আঠাশ রকম ভাবে। এখন প্রশ্ন হল, এই এক হাজার আঠাশ রকম কম্বিনেশনকে কীভাবে রাখা হবে, যাতে চট করে খুঁজে বের করা যায় প্রয়োজনীয় প্যাটার্নের আঙুলের ছাপটি?
আজিজুল বুদ্ধি খাটিয়ে উপায় বের করলেন। ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেকে শুরু করে যদি দুটো করে আঙুল একসাথে ধরি— অর্থাৎ, বুড়ো আঙুল + তর্জনী এবং মধ্যমা + অনামিকা, তাহলে একলা পড়ে থাকল কনিষ্ঠা বা কড়ে আঙুল। এই একলা কড়ে আঙুলের সাথে জুড়ে দিন বাঁ-হাতের বুড়োকে। তারপর আবার দুই-দুই। অর্থাৎ যে-পাঁচটা দল পাওয়া গেল তারা এরকম—
(ডান বুড়ো, ডান তর্জনী), (ডান মধ্যমা, ডান অনামিকা), (ডান কড়ে, বাম বুড়ো), (বাম তর্জনী, বাম মধ্যমা), (বাম অনামিকা, বাম কড়ে)
এবার দেখা যাক আঙুলের দাগের দিকটা। প্রথম আঙুল জোড়াই ধরা যাক। চার প্রকার রকমফের হতে পারে। এক, ডান বুড়ো – লুপ, ডান তর্জনী – হোর্ল। দুই, উল্টোটা, মানে, বুড়োতে আছে হোর্ল আর তর্জনীতে আছে লুপ। আর দুই ক্ষেত্র হল, যেখানে দুজনেই লুপ এবং দুজনেই হোর্ল। প্রতি জোড়া আঙুলের জন্য চারটে রকমফের পাওয়া গেলে সব মিলিয়ে পাঁচ জোড়ার জন্য ৪ x ৪ x ৪ x ৪ x ৪ = ১০২৪ রকমের কম্বিনেশন পাওয়া যাবে। আজিজুল দেখলেন, এই ১০২৪-কে আবার বত্রিশের বর্গ হিসাবেও প্রকাশ করা যায়। তিনি এবার গণিতের একটা ম্যাজিক করলেন। প্রতি জোড়া আঙুল যেভাবে আমি উপরে লিখেছিলাম, তাদের এক থেকে পাঁচ অবধি ক্রমিক সংখ্যা হিসাবে মনে করুন। রোল নম্বর ওয়ানের যদি যে-কোনও একটি আঙুলে হোর্ল থেকে থাকে, তবে তাকে দেওয়া হবে ১৬ নম্বর। এইভাবে দু’নম্বর জোড়ার একটা আঙুল হোর্ল হলে দেওয়া হবে ১৬/২ = ৮ এবং তারপরের সব জোড়ার জন্য দুই দিয়ে আগের জোড়ার নম্বরকে ভাগ করে যথাক্রমে ৪, ২ এবং ১ দেওয়া হবে। এবার যদি লুপ থাকে, তাহলে সকল জোড়াকেই দেওয়া হবে গোল্লা অর্থাৎ শূন্য। নজর করলে বোঝা যাবে, এক থেকে একত্রিশ অবধি যে-কোনও পূর্ণ সংখ্যাকে ১, ২, ৪, ৮ এবং ১৬— এই সংখ্যা পাঁচটার যোগফল হিসাবে প্রকাশ করা যায়। এবার, আজিজুল হক ব্যবস্থা করলেন বত্রিশটা আলমারির। প্রতিটা আলমারিতে বত্রিশটা দেরাজ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১০২৪টা দেরাজ। কিন্তু কোন দেরাজে কোন কম্বিনেশন রাখা হবে?
হক সাহেব সেটারও একটা নিয়ম বের করলেন। ধরা যাক, প্রথম জোড়া আঙুল। ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী। ধরা যাক, ক বাবুর বুড়ো আঙুলে দেখা গেছে লুপ এবং তর্জনীতে হোর্ল। অর্থাৎ বুড়ো আঙুল পেয়েছে ষোলো আর তর্জনীর কপালে গোল্লা। এবার বাকি আট আঙুলের প্রাপ্ত মানও বের করা গেল। এখন প্রতি জোড়ার প্রথম সদস্যদের একসাথে আর দ্বিতীয় সদস্যদের একসাথে নিয়ে তাদের যোগফল আলাদা-আলাদা করে বের করা হল। ক বাবুর ডান হাতের বুড়ো লুপ আর তর্জনী হোর্ল আগেই বলেছি। এবার মনে করা যাক, বাঁ-হাতের কড়ে হোর্ল অর্থাৎ এক নম্বর পেয়েছে। বাকি সব আঙুল লুপ মানে শূন্য। তাহলে এই দুই দলে ভাগ করে তাদের যোগফল নিয়ে প্রথম সদস্যদের দলের যোগফল দাঁড়াবে ষোলো আর দ্বিতীয় সদস্যদের দলের মোট মান হবে এক। এবার এদের দুজনকেই গ্রেস মার্ক হিসাবে এক নম্বর দেওয়া হল। কারণ, সব যদি লুপ হয় তাহলে সবাই গোল্লা হয়ে যাবে। মানে, প্রথম দল পেল সতেরো আর দ্বিতীয় দুই। আজিজুল বললেন, এই ক বাবুর হাতের ছাপ রাখা হবে সতেরো নম্বর আলমারির দুই নম্বর দেরাজে।
আজিজুলের এই আবিষ্কারের ফলে রাইটার্স বিল্ডিঙের একটি ঘরে জন্ম নিল বিশ্বের প্রথম ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো’, যার পোশাকি নাম হলো ‘বেঙ্গল ব্যুরো’। সেখানে বত্রিশটি দেরাজের প্রতিটির বত্রিশটি ড্রয়ারের মধ্যে শ্রেণিবিন্যস্ত হয়ে রইল সংগৃহীত সমস্ত আঙুলের ছাপ। এই পদ্ধতি সাড়া ফেলে দিল বিশ্বজুড়ে। কিন্তু কেউ জানল না আজিজুল বা হেমচন্দ্রের নাম। কারণ আই.জি. হেনরি সাহেব সরকারি সচিবের কাছে বলেছেন, এ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত পদ্ধতি। বিভাগের লোকেদের দিয়ে কাজটি করিয়েছেন মাত্র। শুধু তাই নয়, এডওয়ার্ড হেনরি ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অ্যান্ড ইউজেস অফ ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ শীর্ষক একটা গবেষণাপত্রও প্রকাশ করলেন ভারত সরকারের সহযোগিতায়। ইংল্যান্ডে গিয়ে নানা জায়গায় বক্তৃতা দিলেন এই নিয়ে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কোথাও একবারও উচ্চারিত হল না আজিজুল হক বা হেমচন্দ্র বসুর নাম।
ব্যস, আজিজুল হকের আবিষ্কৃত এই পরিসংখ্যান-পদ্ধতির নাম গোটা পৃথিবীর কাছে পৌঁছল ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’ নামে। বাঙালি সাব-ইন্সপেক্টর পড়ে রইলেন নিষ্ফল হতাশের দলে। চাকরি যাওয়ার ভয়ে প্রতিবাদের পথেও হাঁটলেন না। চুপচাপ মেনে নিলেন এই অন্যায়। হয়তো এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার আনন্দ তাঁকে এতটাই মোহিত করে রেখেছিল যে, এই খ্যাতির মোহ তার কাছে নিতান্ত ক্ষুদ্র, উপেক্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল।
এর পর প্রায় পঁচিশ বছর কেটে গেছে। আজিজুল এসে উপস্থিত হয়েছেন তাঁর চাকরি জীবনের উপান্তে। ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ হক সাহেব নেটিভের ভাগ্য মেনেই অল্প ক-টা টাকা মাইনে নিয়ে সংসার চালান। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য ‘খান বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছেন। এডওয়ার্ড হেনরি বিলেত থেকে আবার শুভেচ্ছাও পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য স্টেটসম্যান’ কাগজে জনৈক সাংবাদিক ‘ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স ইন লন্ডন’ শিরোনামে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করলেন। সেখানে সেই সাংবাদিক উল্লেখ করলেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ক্ল্যাসিফিকেশনে আজিজুল হকের অবদানের কথা। এদিকে আজিজুল হকের প্রয়োজন অবসর জীবনে পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। একটা জমির জন্য আবেদন পাঠালেন সরকার বাহাদুরের কাছে। সঙ্গে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ‘দ্য স্টেটসম্যান’এ প্রকাশিত সংবাদটার একটা কাটিং।
এই সংবাদ নজর কাড়ল সরকারি আধিকারিকদের। সত্যি ঘটনা জানার জন্য বেশ কিছু চিঠি চালাচালি হল সরকারের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে। অবশেষে ১৯২৬ সালে বাংলার মুখ্যসচিবের এক চিঠির উত্তরে স্বয়ং এডওয়ার্ড হেনরি স্বীকার করলেন তাঁর ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’এ তৎকালীন অধস্তন আজিজুল হকের অবদানের কথা। যদিও হেমচন্দ্র বসুর অবদানের কথা স্বীকার করলেন না তিনি। তাঁর স্বীকৃতি পেতে সময় লেগেছিল আর তিন বছর।
প্রায় তিরিশ বছর পর আজিজুল পেলেন তাঁর হকের পাওনা। স্ত্রী-পরিবার নিয়ে অবসরত্তোর জীবন চালানোর জন্য তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। বদলে পেলেন স্বীকৃতি। কিন্তু ততদিনে আর সেসবের মোহ কি আর সত্যিই ছিল তাঁর? দিনের শেষে পরিবারের অন্নসংস্থান যেখানে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে হাজির হয়, সেখানে আর এই পুরনো না-পাওয়া স্বীকৃতি কীই-বা সান্ত্বনা নিয়ে আসতে পারে? বিহারের মতিহারিতে স্ত্রী আর আট সন্তানকে রেখে ১৯৩৫ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই পরিসংখ্যানবিদ তথা ব্রিটিশ পুলিশের বাঙালি অফিসার। আজ তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে দাঁড়িয়ে তিনি হয়তো বিস্মৃতির অতলে কোনও এক অখ্যাত কবরের আঁধারে শান্তিতে নিদ্রামগ্ন, কিন্তু তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে প্রায় একশো বছর ধরে। আধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেকগনিশন সিস্টেমের পিছনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’এর— না কি বলা উচিত ‘হক-বসু ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’? অবশ্য, মহান কবি তো বলেই গেছেন, নামে কীই-বা যায় আসে!
তথ্য সহায়তা:
১. E. R Henry, Classification and Uses of Fingerprints, 1900
২. Gurvinder Sodhi, The Forgotten Indian Pioneers of Fingerprint Science: Fallout of Colonialism, Indian Journal of History of Science, November 2018
৩. Colin Beavan, Fingerprints: The Origins of Crime Detection and Murder Case that Launched Forensic Science, Hyperion, NY, USA, 2001
৪. Tewari RK, Ravikumar KV, History and development of forensic science in India, J. Postgrad Med 2000
৫. https://en.wikipedia.org/wiki/Henry_Classification_System