দিল্লি কয় প্রকার ও কী কী? গত দু’বছরে রাজধানীর কোভিড সংস্করণ বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে চোখে পড়েছে। তবে ডিসেম্বরের দিল্লি আর জানুয়ারির দিল্লিতে যেন বিস্তর ফারাক। গত বছরের অন্তিম মাসে শুরুর দিকে সবার চোখে স্বপ্ন, প্রাণে আশা, রেস্তোরাঁ উপছে পড়ছে, যানজট, মেট্রোভর্তি যাত্রী, দোকানপাট খোলা, মলেও ভিড় (যদিও কেনাকাটা আগের তুলনায় কম, তার কারণ বলা বাহুল্য), রেলস্টেশনে-বিমানবন্দরে লোক উপচে পড়ছে। আর তার এক মাসের মধ্যেই নানা নিষেধাজ্ঞা, রোজ রাতে এবং শনি-রবি সারাদিন কারফিউ, আবার সবাই যে যার গর্তে সেঁধিয়ে গেছে। তার ওপর বাড়ি-বাড়ি সর্দিকাশি, জ্বর, গা ব্যথা। সর্বোপরি অসম্ভব ক্লান্তি। গোদের উপর বিষফোঁড়া হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা। আর বৃষ্টি। সব মিলিয়ে জানুয়ারির দিল্লি ছিল ছোটখাট বিভীষিকা।
জানুয়ারি মাসে দিল্লির যেসব আকর্ষণ থাকে, তাদের মধ্যে দুটো হল বিশ্ব বইমেলা এবং গণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ। প্রথমটা বাতিল হওয়া এক রকম অনিবার্যই ছিল, বইমেলার গিজগিজে ভিড় মানে ওমিক্রনের পোয়া বারো। কিন্তু এ-বছরও গণতন্ত্র দিবসে কম লোক, নিয়মের কড়াকড়ি, তার ওপর মেঘলা আকাশ, কনকনে হাওয়া— সব মিলিয়ে বিরক্তিকর পরিস্থিতি। এমনিতে এই মাসে রাজধানীর বহু পার্কে কিংবা ঐতিহাসিক সমাধিতে সবাই হানা দেয়, কিন্তু এবারে তো সে গুড়ে বালি। সিনেমা হল খুলেও বন্ধ হয়ে গেল, বাচ্চারা এখনও বাড়িতে, মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় কবে পুরোপুরি খুলবে কেউ জানে না (দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি ছাড়াই অনলাইন সেমেস্টার আগের মতোই চলছে), সুতরাং দিল্লিকে চেনাই দায়।
আর একটা বড় কারণ হল, রাজা-মহারাজারা রাজধানীর ভোল পাল্টে দিচ্ছেন। সেই যে বিখ্যাত রাষ্ট্রপতি ভবন, তার দু’পাশে নর্থ ব্লক-সাউথ ব্লক, প্রশস্ত রাজপথ ইন্ডিয়া গেট থেকে তিরের মতো সোজা গিয়ে রাইসিনা হিলে উঠে গেছে, দু’পাশে খোলা মাঠে দিল্লির জনতা ভেঙে পড়ে রোদ পোহাতে, কমলালেবু খেতে, বাচ্চারা ছুটোছুটি করে, প্রবল ঠান্ডায়ও আইসক্রিম চায়— এসবের দিন ঘনিয়ে এসেছে। খোলা জায়গায় নতুন ইমারত উঠছে, সরকারি দপ্তর, মায় প্রধানমন্ত্রীর নিবাস পর্যন্ত এই স্থানে তৈরি হচ্ছে। কোভিডের দৌলতে আর যাই থেমে যাক, এই নির্মাণকার্যে একদিনও বাধা পড়েনি। বলা হয় দিল্লি এমনিতেই একটি শহর নয়, নানা সময়ে নানা শহর ছিল এখানে, সাত-সাতটি। এখন আট নম্বরের কাজ শুরু হয়েছে।
দিল্লি অবশ্য শুধু দেশের হর্তাকর্তাদের সৃষ্টি নয়। আরও অনেক দিল্লি আছে বা ছিল, যেমন বইয়ের দিল্লি। অবশ্য এর নাম একটু পাল্টে বোধহয় বইয়ের এন সি আর বলা উচিত, কারণ এই শহরটির ব্যাপ্তি নয়ডা থেকে গুড়গাঁও পর্যন্ত। পাঠ্যপুস্তক বাদ দিলে দেশের সব না হলেও বেশির ভাগ ইংরেজি ভাষার প্রকাশনীর প্রধান দপ্তর, বহুজাতিক সংস্থাগুলির তো বটেই, এই দিল্লি এন সি আরেই। তাদের ঝাঁ-চকচকে আপিসগুলি অবশ্য প্রায় দু’বছর ফাঁকাই পরে ছিল। অন্যান্য শিল্পের মতো প্রকাশন ব্যবসাতেও বাড়ি থেকে কাজটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। এমনকী অনেক সংস্থাই বড়-বড় দপ্তরের বদলে এখন ছোট আপিস দিয়েই কাজ চালাবেন মনস্থির করেছেন, কারণ আর তো রোজ-রোজ সবার আপিস গিয়ে কাজ করার প্রয়োজন নেই, বাড়ি থেকেই দিব্যি চলে। সে যাই হোক, বইয়ের দিল্লির বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। বুক লঞ্চ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। পাঁচতারা হোটেল থেকে আরম্ভ করে বাগ-বাগিচা, শৌখিন রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে দূতাবাস বা ক্লাব, নামকরা লোক আর পুস্তকপ্রেমী, সব মিলিয়ে হইহই ব্যাপার। এছাড়া অসাধারণ কিছু বইয়ের দোকান— যেমন, জোড়বাগের ‘দ্য বুকশপ’, খান মার্কেটের ‘বাহরিসন্স’ বা ‘ফকিরচাঁদ’, অরবিন্দ মার্কেটের ‘মিডল্যান্ড’। আর সেই বিখ্যাত দরিয়াগঞ্জের পুরনো বইয়ের বাজার, যা কিনা এখন সেখান থেকে সরে গেছে অন্য একস্থানে। দরিয়াগঞ্জ এককালে হিন্দি প্রকাশকের ডেরা ছিল। বইয়ের এতই কদর এই দিল্লিতে— যা কিনা এই শহর সম্বন্ধে সাধারণ ধারণার মধ্যে পড়ে না— শাহিন বাগে সিএএ-র বিরুদ্ধে অবস্থানে অথবা সিঙ্গু সীমান্তে কৃষকদের আন্দোলনে শুরুর দিকেই তৈরি হয়েছিল অস্থায়ী পাঠাগার, সেখানে অনেকেই চুপচাপ বসে বই পড়তেন। লাইব্রেরি তৈরির বহু উদ্যোগ বেঁচে আছে এই দিল্লিতে। এমনিতে বইমেলার জন্য জানুয়ারি এদের সবার জন্য সরগরম থাকে, এবার অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই অন্য কথা।
শুধু এই নয়। শহর দিল্লির আনাচে-কানাচে আছে আরেক জায়গা, তার নাম দেওয়া যেতে পারে জঙ্গলদিল্লি। এই জঙ্গল কোনও-কোনও স্থানে আক্ষরিক অর্থেই জঙ্গল, অনেকটা জায়গা ছড়িয়ে। কিন্তু এছাড়াও আছে গাছের দিল্লি, বাগানের দিল্লি, এমনকী পাড়ায়-পাড়ায় পার্কের দিল্লি। এবং যমুনা নদীর দু’পাশের জমি। এই দিল্লির বিশেষত্ব ফুল-ফল-পাতা-পাখি এবং কোনও-কোনও ক্ষেত্রে মাছসমেত নানা জন্তুজানোয়ার। এই শহুরে জঙ্গল নিয়ে বই লিখছেন নেহা সিংহ, পেশায় একাধারে লেখক ও সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী। নেহা ঘুরে বেড়ান শহরের ভেতরে জঙ্গল ও তার বাসিন্দাদের খোঁজে, আর এই ভাবেই তাঁর চোখে (এবং কানে) ফুটে উঠেছে অন্য এক দিল্লি, যার সহাবস্থান রোজকার বাড়ি-গাড়ি-তাড়াতাড়ির দিল্লির সঙ্গেই। লকডাউনের সময়ে এই অন্য দিল্লি আমাদের আর একটু কাছাকাছি এসে পড়েছিল, এবং কিছু লোক চান এই বন্য শহর যেন নিজেকে গুটিয়ে না নেয়। তাঁদের মধ্যে নেহা একজন।
পুরনো। নতুন। নব। কেতাবি। লুকোনো। এদের সাথে যে-দিল্লি যুক্ত করা দরকার, তা হল ভোজনরসিকের রাজধানী। কিন্তু সে-গল্প পরের বার। আপাতত বাঙালির দিল্লির একটি দুঃখের কাহিনি দিয়ে শেষ করি। এই জানুয়ারি মাসেই আট কোটি টাকার ধার শোধ করতে না পারায় চিত্তরঞ্জন পার্কের ঐতিহ্যবাহী রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুল নিলামে বিক্রি করার বন্দোবস্ত করা হয়, যেখানে পড়ানো হত বাংলা মাধ্যমে। কিন্তু কিনবে কে? এখনও অবধি কোনও খরিদ্দার পাওয়া যায়নি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র