সবুজ পর্দার হয়ে গেল দিওয়ান-ই-খাস
সঙ্গীত এবং চলমান ছায়াছবির মিশেলের যে জোরলো নান্দনিক শক্তি, তার ব্যাপারে আজকালকার পৃথিবীতে আমরা বেশ ওয়াকিবহাল। কিন্তু বাস্তবে এই দুই মাধ্যমের মিলনের হাত ধরে একাধিক বাধাবিপত্তি এবং কাঁচা হাতের কাজও উপস্থিত হয়েছে, বিশেষ করে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে।
বহু দশক আগে একবার হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিখ্যাত সমালোচক ও লেখক রাঘব আর মেননের কাছ থেকে একটি টেলিফোন পাওয়ার কথা মনে আছে, সে সময়ে প্রবল আগ্রহ এবং উৎসাহের সঙ্গেই ফোন ধরেছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটি টেলিভিশন প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে আমি আগ্রহী কি না? সেখানে একটি প্রভাতী অনুষ্ঠানের জন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীরা রাগদারী গানের এক একটি চার মিনিটের রেকর্ডিং করবেন, এই বিশেষ ধারার অনুষ্ঠান নাকি এভাবে আগে হয়নি। সঙ্গীত পরিবেশনার শুটিং কীভাবে হয়, কী করতে হয় (যদিও গোটা ব্যপারটা কেবল চার মিনিটের), এ সব কিছু না জানা সত্ত্বেও আমি সানন্দে রাজি হয়ে যাই। বুদ্ধি খাটিয়ে সঙ্গীত পরিবেশনাটাকে ওই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কীভাবে কাটছাঁট করে রাখা যায়, এটাই ছিল আমার কাছে আসল চ্যালেঞ্জ। উৎসাহ এবং খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়ে ঠিক দিনে, ঠিক সময়ে লোকেশনে পৌঁছে গেলাম। অত্যন্ত পুলকিত হয়ে দেখলাম, স্টুডিওর চারপাশের বিস্তৃত মাঠে নানা সঙ্গীতশিল্পীদের মেলা বসে গেছে- নবীন, প্রবীন, কন্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সহকারী বাদক, গুরুদের আড়ালে নীরবে বসে থাকা বাধ্য এবং অনুগত শিষ্যেরা, এবং বেশ কিছু উটকো ফড়েরাও সেখানে উপস্থিত। যে কাজের জন্য এখানে আসা, অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক একটি চার মিনিটের মিউজিক ভিডিওর শুটিং, সে কাজের বিষয়ে কারওরই মনে হল তেমন হেলদোল নেই।
মাঝে মাঝে এক একদল শিল্পীদের শুটিং-এর সময় এলে স্টুডিও থেকে তাঁদের ডাক পড়ছিল, কিন্তু স্টুডিওর জঠরে তাদের প্রবেশমাত্রই বাকিরা আবার খোশমেজাজে আড্ডা-আলাপে মশগুল হয়ে যাচ্ছিলেন। স্টুডিওর ভিতরে কী কাণ্ডকারখানাই না ঘটছে, সে বিষয়ে কৌতূহল আর সামলাতে পারলাম না, প্রকল্পের পরিচালক এবং দলের অন্যন্য সদস্যরা যে কন্ট্রোল রুমে কাজে ব্যস্ত ছিলেন, সেখানে ঢুকে পড়লাম ব্যাপারস্যপার একটু জানতে-বুঝতে। ঘরের একাধিক মনিটরের মধ্যে একখানায় দেখলাম একটি স্টেজের উপর সহকারী তবলচিদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে এক সেতারবাদক বসে আছেন, স্টেজের চারিদিকে বিকট রকমের সবুজ রঙের ভারী ভারী সব পর্দা, স্টেজটিও সবুজে আবৃত। কিন্তু পরমুহূর্তেই হতবাক হয়ে দেখলাম কাছেই আর একটি মনিটরে ওই একই শিল্পীদের যেন কোনও যাদুমন্ত্রবলে (অবশ্য, কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট হয়ে) দিল্লির লাল কেল্লার পাঁচিলের উপর বসে থাকতে দেখাচ্ছে! আমার এই হতবুদ্ধি দশা, এবং পাঁচিলের সরু মিনারের উপর শিল্পীদের কোনওমতে বেসামাল হয়ে বসে থাকতে দেখে ভয় এবং সহানুভূতি, পরিচালক ভদ্রলোকের চোখে পড়েছিল। তিনি তড়িঘড়ি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে গ্রিন স্ক্রিন বা সবুজ পর্দা ব্যবহার করে তিনি প্রত্যেকজন শিল্পীর প্রেক্ষাপটগুলো পালটে পালটে দেখাচ্ছেন। ভারতের প্রতি রাজ্যের চমৎকার সব ছবিতে সমৃদ্ধ একটি কফি টেবল বুক খুলে তিনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন, আমাকে তিনি সমুদ্রের ধারে একটি পাহাড়ের একদম কিনারে দেখাতে চান। নিজের সুরক্ষা এবং স্বস্তির কথা ভেবেই এ প্রস্তাব বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমি আমার প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিলাম লাল কেল্লার অসামান্য দিওয়ান-ই-খাস।
সম্পাদিত ভিডিওর অন্তিম রূপে আমাদের সবাইকে সেভাবেই দেখানো হল- ভিডিওর খানিকটা জুড়ে আমরা রয়েছি এক একটি বিচিত্র জায়গায়, এবং সম্পাদকের মর্জিমাফিক আমাদের গানের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া হয়েছে গ্রাম্য ভারতবর্ষের অসংলগ্ন সব চিত্র। আমার মনে আছে, দিওয়ান-ই-খাসে আমার জৌনপুরী রাগে সঙ্গীতের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে এসেছিল কোথাকার এক গ্রামের নানা দৃশ্য; আমার আলাপ শুনতে শুনতে জাবর কাটতে কাটতে পরমানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু গোরু-মোষ, আর একজন উবু হয়ে বসে রুটি বেলছে আর ধূমায়িত চুলোয় সেগুলো সেঁকছে। এর বেশ কিছু বছর পরে আমার থেকে দুর্ভাগ্যবান আর এক শিল্পী এমনই আর একটি প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছিলেন, বেচারা ললিত রাগে যখন একখানা চমৎকার আলাপ গাইছিলেন, তখন তার মাথার উপর অবিরত ডানা ঝাপটাতে দেখানো হয়েছিল একটি কাককে! শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মিউজিক ভিডিও বানানোর প্রচেষ্টা যে বিশেষ সফল হয়নি, এতে আর আশ্চর্যের কী?
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিডিও বানানোর এই গোড়ার দিকের প্রচেষ্টাগুলোকে আমি অসম্মান করতে চাই না, নস্যাৎ করে দিতে চাই না তাঁদের পরিশ্রমকে। কিন্তু যে পৃথিবীতে গান শোনার চেয়ে গান “দেখা” হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেখানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে দেখার দিক থেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চাইলে এ ধরনের বেয়াড়া, অসংলগ্ন দৃশ্য দেখানোর অভ্যেসকে সর্বপ্রকারে বন্ধ করতে হবে। তা হলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনাকে ফিল্মে বা ভিডিওতে দেখতে চাইবেন, এমন আগ্রহী দর্শক তৈরি করার উপায় কী? বোঝাই যাচ্ছে, এ বিষয়ে পরামর্শ করার এবং উপায় বের করার সময় এসে গেছে।
এ বিষয়ে আমার কোনও প্রশিক্ষণ নেই, কোনও পরামর্শ দেবার অধিকারও অতএব আমি অর্জন করিনি। তবে এইটুকু বলতে পারি, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যান্য ধারার গানের ক্ষেত্রে অডিও ট্র্যাক এবং ভিডিওর যোগাযোগ ঘটানোর যাত্রায় যে যে বাধাবিপত্তি এসেছে, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা দরকার। মনে আছে, অদূর অতীতে এবং বর্তমানেও কেমন মিউজিক ভিডিও তৈরি হ’তো, যখন কোনও গানকে জনপ্রিয় করে তোলার বাজারী অস্ত্র ছিল ভিডিও? গানের সাথে সাথে মিউজিক ভিডিও প্রকাশ না করতে পারলে শ্রেষ্ঠ শিল্পীরাও, সবচেয়ে সেরা অ্যালবামগুলোও তলিয়ে যেতো। আবার অন্যদিকে, দূরদর্শনের মিউজিক চ্যানেলে চ্যানেলে ভিডিওগুলো এতবার করে চালানো হত, এবং বিনামূল্যেই সবাই দেখতে পেতেন, যে গানগুলো উপভোগ করতে অ্যালবাম কেনার দরকার কারোর থাকত না। অতএব গানকে জনপ্রিয় করার জন্য যে বাজারী মার্কেটিং অস্ত্র ব্যবহার করা হল, সেই অস্ত্রের আঘাতেই অ্যালবাম কেনা বন্ধ হয়ে গেল। যে গান ব্যবহার করে মিউজিক ভিডিও বানানো হয়েছে, সে গান তো সারাদিন ধরে প্রত্যেকটি চ্যানেলে এমনিই বাজতে শোনা যাচ্ছে! মজার কথা হচ্ছে, শেষে দেখা গেল, মিউজিক ভিডিও তৈরি করতে যে পরিমাণে টাকা ঢালা হচ্ছে, তা আসল গানটি রেকর্ড করার যা খরচ, তার চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু টুনটুনির গল্পে নাককাটা রাজা যেমন হাজার চেষ্টা করেও আর নিজের কাটা নাক জোড়া লাগাতে পারলেন না, তেমনই সমস্ত চ্যানেলে সারাদিন ধরে বেজে চলা মিউজিক ভিডিওগুলোও আর খরচ হয়ে যাওয়া পয়সা উশুল করতে পারল না। গানের কোম্পানিগুলোর কাণ্ডজ্ঞানের চরম অভাব, তাঁরা উলটে নির্মমভাবে শিল্পীদের এবং আসল গান রেকর্ড করার খরচ কমিয়ে দিলেন, এবং একটা বিপুল পরিমান পয়সা খরচ করতে লাগলেন মিউজিক ভিডিও বানানোর পিছনে।
বছরের পর বছর জনপ্রিয় ধারার সঙ্গীতের মিউজিক ভিডিওগুলো একঘেয়ে, মার্কামারা হয়ে উঠল, এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে যাবার সময়ে এক ভিডিওর থেকে অন্য ভিডিওকে আলাদা করা চেনাটাই হয়ে উঠলো কঠিন। একইরকম রঙের চিত্র, একইরকম নৃত্য পরিকল্পনা, এমনকী ভিডিওর কাহিনীগুলোও একরকম। সঙ্গীতশিল্পীদের ফিল্মের তারকাদের মত দেখতে হবে, এই চাহিদাটাও বিপুল হয়ে উঠল। ফলে অনেক অ-সাঙ্গীতিক শিল্পী এই রথের মেলায় কলা বেচতে ঢুকে পড়লেন, অল্প কিছু সময়ের জন্য এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ নামও করেছিলেন।
ভিডিও বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে পরিবেশন করতেই হয়, তবে এ’রকম কিছু ভুলত্রুটি আমাদের করলে চলবে না। সঙ্গীতটাই যেন সেখানে প্রাধান্য পায়, ঝাঁ-চকচকে ল্যাম্বর্গিনি গাড়ি থেকে সমস্ত শিল্পীরা চাকচিক্য এবং তুলির টানে সুন্দর পুতুলের মত নামছেন এবং তানপুরা, তবলা, সেতার-সরোদ তুলে নিচ্ছেন- এ জিনিসকে বেশি গুরুত্ব না দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সঙ্গীতের পাশাপাশি ভিডিওতে কাহিনী বা সিনেমার মত একটি গল্প বলার যে ধারা, জনপ্রিয় গানের জগতে যা মিউজিক ভিডিওর একটি অসীম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা আমাকে বড়ই আশঙ্কায় ফেলে দেয়। শ্বাশুড়ী-ননদের সাবেকি, প্রথাগত যে কাহিনী, তা নায়ক-নায়িকারা অভিনয় করে দেখাচ্ছেন, এ দৃশ্য কল্পনা করতে পারেন? বিদেশি জামাকাপড়ের ব্যাপারে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের শুধুমাত্র “কুল” এবং আধুনিকমনস্ক দেখানোর জন্য যদি কুর্তা-পায়জামা বা শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক পরানো হয়, তবে সেটাও সমানভাবে বেঢপ লাগবে, সে তাঁরা ওই ধরনের পোষাকে সাবলীল হন বা না হন।
এবং শেষ কথা হচ্ছে, বাস্তব জীবনে যেভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনের যাদু ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়, ক্যামেরাকেও নিষ্ঠার সাথে সেটাকে দেখাতে হবে। লাইভ অনুষ্ঠানে সঙ্গীত শোনার যে অভিজ্ঞতা, দৃশ্যমান মাধ্যম যেন তাকে বর্ধিত করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়, তাকে ক্যারিকেচার না বানিয়ে ফেলে। এই অতিমারী, এবং আমাদের জীবনযাত্রার উপর তার মরণকামড়, আমাদের বাধ্য করছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অডিও-ভিডিও পরিবেশনা নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করতে, সে চিন্তায় যেন আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত সৃজনশীলতা ঢেলে দিই।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র