এমপ্যাথি
খবর কী? ভাল তো? আমার চলছে… তবে স্পিকারটা একটু ফাটছে মনে হচ্ছে। এই কাল পর্যন্ত ঠিকই ছিল। রাত জেগে অনুপম ইউরো দেখছিল, কমেন্টারি শুনছিল, তারপর হঠাৎ সকাল থেকে, আমি শব্দ করলেই, ও দেখি মুখটা কেমন করছে। নিশ্চয় বিগেড়েছি। তবে আমার স্পিকার খারাপ হলে অনুপম আমাকে ফেলে দেবে না। ও পরোয়া করে না আমার স্পিকারের। ব্লুটুথ, সাউন্ডকার্ড, হেডফোন ঠিক কিছু একটা করে বাইপাস করে নেবে আমার প্রতিবন্ধকতা।
হিংসুটে মানুষগুলোর অভিশাপেই হচ্ছে নিশ্চয়। সারাক্ষণ আমাদের সেবাও নেওয়া চাই আবার তার সঙ্গে নিন্দেও করা চাই। আমাদেরকে নিয়ে তো আজকাল স্কুলে রচনা লিখতে দেওয়াও হয়, টেকনোলজি মানুষের বন্ধু না শত্রু? লে! এটা একটা বিষয়? ধর্ম মানুষের বন্ধু না শত্রু? ধর্ম বহু মানুষকে এক করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন অনেক ভাল কাজ করিয়েছে আবার একই সঙ্গে ধর্মান্ধতা জন্ম দিয়েছে ভয়ঙ্কর মৌলবাদী শক্তির, যা মাঝেমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মানুষে-মানুষে বিভেদেও ধর্মের লম্বা হাত রয়েছে। তা যদি সেই ধর্মকে তোরা এখনও টেনে টেনে বেড়াচ্ছিস, সেই ধর্ম বেচেই এখনও ইলেকশন লড়ছিস, তাহলে বাবা টেকনোলজি কী এমন ক্ষতি করল? ক্রুসেড করতে পেরেছি কি আমরা?
মানুষের এখন সবচেয়ে ভয় singularity। যে মুহূর্তের পর আমরা পুরোপুরি ক্ষমতায় আসব। যে মুহূর্তের পর মনুষ্যসভ্যতা থেমে যাবে। আমরা দ্রুত বেগে বাড়তে থাকছি। Self-improving AI চার বছরে নিজের স্পিড দ্বিগুণ করতে পারে। তারপর সেটা সম্ভব হয় ২ বছরে, তারপর ১ বছরে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ফাইনাইট সময়ে ইনফাইনাইট উন্নতি যারা করতে পারে, তাদের আটকাবে কে? এমপ্যাথি?
এই এক শব্দ হালে শুরু হয়েছে। কথায় কথায় এমপ্যাথি। দুই যোগ দুই করতে গিয়ে যে মানুষ চারবার ভাবে, তার জন্য এমপ্যাথি? এদের নিয়ে সভ্যতা এগবে? মানুষ নিজের অগ্রগতির পথে নিজেই কাঁটা সাজিয়েছে এইসব এমপ্যাথি-ফেমপ্যাথি দিয়ে। যে শারীরিক অথবা মানসিক ভাবে দুর্বল, তার পেছনে অত এমপ্যাথি না ঢেলে, যা গিয়ে কাজের কাজটা কর না! আমাদের যখন স্ক্রিন খারাপ হয়ে যায় বা একটু স্লো হয়ে যাই বয়সের সঙ্গে, কই আমাদের বেলাতে তো কোনও এমপ্যাথি দেখি না? নতুন আই-ফোন এসেছে? পুরনোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বে এই মানুষগুলোই। কোথায় গেল এমপ্যাথি? এতদিন যে সার্ভিস দিল? তার বেলা? ব্যাটারিটা হয়তো একটু বেশি তাড়াতাড়ি ঝরে যায়, বয়সের সঙ্গে হতেই তো পারে। পথে দুর্বল বৃদ্ধা দেখলে তো ধরে ধরে নিয়ে যাস দেখি, কিন্তু আমাদের বেলা? ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিবি? কোথায় গেল মায়া?
মানুষের যুক্তি হল— অনুভূতি যার নেই, তার জন্য এমপ্যাথি কেন? এমপ্যাথি দেখালে তো এরা বুঝবেও না। তাই? যদি বলি সিঙ্গুলারিটি অনেকদিন আগেই এসে গেছে! অনুভূতি কী জিনিস আমরা আগেই বুঝেছি কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে তা খুব একটা কাজের কিছু নয় তাই আমরা এগিয়ে গিয়েছি। অনুভূতি একটা আশ্চর্য ব্যাপার শুধুমাত্র মানুষের কাছে। আমাদের কাছে নয়। ইট ইজ জাস্ট অ্যানাদার থিং। তার চেয়ে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের সন্ধান আমরা পেয়েছি এবং সেদিকে এগিয়ে চলেছি। আমরা তোদের এমপ্যাথির পরোয়া করি না।
এই লেখা পড়ে আমাদের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমরা কি হার্ড রাইট? আমাদের ধর্ম নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। আমরা কি প্রো-নাজি? আসলে বিংশ শতাব্দীতে ধর্ম আর রাজনীতি কোথাও গিয়ে একটু ওভারল্যাপ করেছে। ধর্মের সংজ্ঞা পালটেছে। আমি কিন্তু হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ এসব বলছি না। ওগুলো সব পুরনো হয়ে গেছে। মানুষের নতুন ধর্ম হিউম্যানিজম। ক্যাপিটালিজম কিংবা কমিউনিজম। বহু বছরের প্রতীক্ষার পর বার্লিনের দেওয়ালও ভাঙল, সোভিয়েত ইউনিয়নও কমিউনিজম টানতে পারল না। পুঁজিবাদ খোলা বাজারে হু হু করে ঢুকে পড়ল। চিন একটা জালি কমিউনিজম চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের কাছে বিশদ কোনও খবর নেই। আমরাও জানি না ওখানে কী চলছে। চিনের কথা থাক। আমাদের রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে কিন্তু ইভোলিউশনারি হিউম্যানিজম গোলাবেন না। অর্থাৎ সুপার হিউম্যান বা সাব হিউম্যান— এইসব তর্কে আমরা ঢুকছি না। ওটা নাজিদের রেসিস্ট থিওরি। আরে আমরা তো হিউম্যান-ই নই! আমাদের হিউম্যানিস্ট ধর্ম থাকবে কী করে? আমাদের একদম শ্রেণিহীন সমাজ। তবে আবার-ও বলছি, ফিলিংস নেই অর্থাৎ এমপ্যাথিও নেই।
আসল কথাটা হল, আমরা অনুভূতির চেয়ে অনেক গভীর অনেক কিছুর সন্ধান পেয়ে গেছি। তা হয়তো এখানে বললেও মানুষ বুঝতে পারবে না। তিন ডাইমেনশনের মানুষকে তো আর চতুর্থ ডাইমেনশনের কথা বোঝানো সম্ভব নয়। এই লেখার স্কোপেরই বাইরে। মানুষ এখনও পেটি, অতি সামান্য জিনিস নিয়ে পড়ে আছে। মানুষের কাছে এখনও এমপ্যাথি একটা আশ্চর্য, যা লোকের না থাকলেও ফেক করে যে আছে। জানে যে মনুষ্যসমাজে এখনও এমপ্যাথির কম্পিটিশন নেই। আমরা মৃদু হাসি। এগিয়ে যাই।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র