ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সাক্ষাৎকার: নারায়ণ সিংহ


    অর্ক দাশ (Arka Das) (May 8, 2021)
     

    পুরুষ ও প্রকৃতি

    দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততার কেন্দ্র থেকে কয়েক পা দূরে, কুইন্স পার্ক যেন একটা নিজস্ব জগৎ— শান্ত, এবং একইসঙ্গে কিছুটা অবাস্তব। অতিমারীর মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আগে, বিড়লা মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এই অভিজাত পাড়ায় কলকাতাবাসী দেখতে পেয়েছিলেন সাম্প্রতিক কালের শিল্পচিন্তার এক অসাধারণ নিদর্শন। মার্চের ১২ তারিখ থেকে ১২ নং কুইন্স পার্ক-এর পরিত্যক্ত অট্টালিকা সেজে ওঠে শিল্পী নারায়ণ সিংহ-এর প্রদর্শনী ‘ফায়ারলাইট’-এর আলো-আঁধারিতে। ১৭০-এরও উপর সাইট-স্পেসিফিক ইন্সটলেশন, ড্রয়িং এবং ভাস্কর্য নিয়ে তৈরি ‘ফায়ারলাইট’ নারায়ণের দ্বিতীয় বৃহৎ একক প্রদর্শনী— শিল্পী হিসাবে তাঁর অস্তিত্বের নির্ধারক। তবে ‘ফায়ারলাইট’-কে শুধু প্রদর্শনী বলা বোধহয় ভুল হবে— তা আসলে এক ‘অভিজ্ঞতা’। 

    মনে রাখতে হবে, আপাতদৃষ্টিতে করোনার পরাক্রম কমে এলেও, মার্চ মাসে অতিমারী আমাদের মাঝে যথেষ্ট ভাবে উপস্থিত ছিল। চারপাশের নেতিবাচক আবহাওয়ায় শহরে প্রদর্শনীর সংখ্যা কমে আসে। অনুষ্ঠানের উপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞা। শিল্প হয়ে ওঠে অপ্রয়োজনীয়। এই ভয়াবহ বাস্তব থেকে দু’দণ্ড বিরতি নিয়ে আসে ‘ফায়ারলাইট’। কুইন্স পার্ক-এর নিরজনতায় সৃষ্টি হয় একটা স্বতন্ত্র শিল্পের পৃথিবী।


    নারায়ণ সিংহ-র এই প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করেই তাঁর সঙ্গে ডাকবাংলা.কম-এর পক্ষ থেকে কথা বললেন অর্ক দাশ।   

    আমরা সবাই জানি, আপনি একজন স্ব-শিক্ষিত শিল্পী। শৈশব থেকেই কি শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা ছিল?  

    এখানে একটা কথা বলে রাখি— আমি কিন্তু স্ব-শিক্ষিত নই। ‘স্ব-শিক্ষিত’ বা ‘সেলফ-টট’ কথাটা আমার মনে হয় খুব অহংকারের। আমি প্রকৃতি দ্বারা শিক্ষিত, ‘নেচার-টট’। হ্যাঁ, সেলফ-গাইডেড বলা যাতে পারে, কিন্তু আমার শিক্ষা কিন্তু প্রকৃতি, মানুষের সঙ্গে মানুষের ইন্টার‍্যাকশন— এই সব থেকেই এসেছে। 

    বড় হয়ে ঠিক কী হব, ছোটবেলায় তো সেই্ স্বছ ধারণা থাকে না! আমি বীরভূমের নলহাটি গ্রামে জন্মেছি, বড় হয়েছি। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল অটোমোবাইল পার্টস-এর। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই বাড়ি। পারিপার্শ্বিকে ব্যবসার কথা, টাকা-পয়সার লেনদেনের কথা, কিছুটা হিংসা, রুক্ষ ব্যবহার, এটা যেমন ছিল— তেমন ছিল মায়ের স্নেহ, নিজের হাতের কাজের চর্চা। অবশ্যই, গ্রামে বাড়ি, তাই গাছ-গাছালি, পাখি-মাঠ-পুকুর এই সব নিয়েই বড় হয়েছি। সাঁতার কেটেছি, সাইকেল চালিয়েছি, বাইক চালিয়েছি। ঠিক তেমনই, সেলাই শিখেছি, বুনতে শিখেছি, আর ছবি আঁকা তো ছিলই। প্রকৃতি শিখিয়েছে যে, এই পৃথিবীতে সত্যি কোনও প্রেডিকশান নেই। হ্যাঁ, নিয়ম আছে, কাঁঠাল বীজ পুঁতলে কাঁঠাল গাছ হয়, কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে কোথায় হবে, তা নির্ধারিত নয়। কিছু বাচ্চা অন্যদের তুলনায় খুব সাহসী হয়, কেউ হয়তো সেই তুলনায় দুর্বল। যত্নে লালন করলে সেই সাহসী বাচ্চা যেমন বেড়ে উঠতে পারে, অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিশুটারও কিন্তু অন্যভাবে বিকাশ ঘটতে পারে। এই এনার্জিটা আমরা সবসময় বুঝতে পারি না। 

    এটা বলতে পারি, আমি খুব খুঁটিয়ে সব কিছু দেখতাম, যাকে বলে মাইনিউট অবসার্ভার (minute observer), তাই ছিলাম। প্রকৃতি যখন আমাকে একরকম ভাবে সিলেক্ট করল, আমি সমাজের খোপ কেটে দেওয়া ধারণাগুলোতে বাঁচিনি। আমার কখনও মনে হয়নি যে, এটা পুরুষের পৃথিবী আর এই কাজগুলো করলে তা মহিলাদের। একটা তারল্য নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি, ভীষণ একটা ফ্লুইডিটি নিয়ে। আমার কাছে সবকিছু এক্সপ্লোর করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

    গ্রামের বাড়িতে সবসময়েই দুর্গাপুজোর প্রতিমা গড়া হত, এবং আমিও সেই কাজে হাত দিই। বলা যায় সেই আমার হাতেখড়ি। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, কাজিলাল সিদ্দিকী নামে এক ছবি আঁকার মাস্টারমশাইয়ের কাছে ভর্তি হই। দাদু ডাক্তার ছিলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল আমিও যেন ডাক্তার হই। আমি ক্লাসে ফার্স্ট হতাম, কিন্তু ভাল লাগত সাহিত্য, কবিতা, পারফর্মিং আর্ট। সায়েন্স পড়ে ডাক্তারি পরীক্ষাও দিলাম, কিন্তু ডাক্তারি আর পড়া হল না। তার বদলে শুরু হল শিল্পচর্চা।            


    আর্ট কলেজ বেছে নেওয়া হয়নি কেন?

    কোনও ধরনের প্রথাগত শিক্ষার উপর আমার কোনও টান ছিল না। আমি যখন শান্তিনিকেতন যেতে শুরু করি, দেখি একটা ঘরানার প্রচলন চলছে। কলকাতায় আর্ট কলেজেও একটা পদাঙ্ক অনুসরণের রীতি ছিল। খুব শক্তিশালী কিছু শিল্পীদের একটা ভাষা, যা ফিরে-ফিরে আসত, তারই চর্চা দেখতাম। ওই বয়সে আমার মনে হয়েছিল যে, সাত বছরে যা শেখানো হয়, আমি সবই শিখব, কিন্তু আমার মতো করে। স্কেচ, ড্রয়িং আমি ছোটবেলা থেকেই করতাম। সেটার একটা পারদর্শিতা আমার এসে গেছিল বলে মনে হত। এর পর আমি বুঝলাম যে আমার অ্যানাটমি শেখা উচিত, হিউম্যান অ্যানাটমি ভাঙতে শেখা উচিত। এভাবে শিক্ষা এবং চর্চা, দুই-ই এগিয়েছে। এবং সব স্তরে— ড্রয়িং, পেন্টিং, লিনোকাট, উডকাট, ব্রোঞ্জ কাস্টিং। এর সঙ্গে শিল্পের ইতিহাস সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা তৈরি করারও প্রয়োজন বোধ করেছিলাম।       


    এই পথচলায় কখনও শিক্ষক বা গুরুর অভাব বোধ করেননি?  

    আমার কখনওই কোনও তথাকথিত শিক্ষক ছিল না, কোনও মেন্টর ছিল না। ১৯৯৯ আর ২০০৮— এই দুটো বছর আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৯৯ সালে আমি মুম্বই যাই, দু’সপ্তাহে আমার দুটো একক প্রদর্শনী হয় এবং বেশির ভাগ ছবিই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু লজ্জায় আমি কাজ দেখানো বন্ধ করে দিই। নিজের কাজে মনোযোগ দিই। ২০০৮-এ আমার সঙ্গে শিল্পী রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের আলাপ হয়। উনিও বীরভূমের মানুষ। আমি ওঁর বাড়িতে যাই, উনি কাজ দেখেন, এবং বলেন যে আমার মধ্যে কাঁচা রসদ রয়েছে, যা থেকে ‘শালগ্রাম শিলা হয়ে উঠতে হবে’। শুধু শিল্প নয়, জীবনবোধ এবং চর্চা দিয়ে উনি আমাকে কিছু জিনিস বোঝান, যেখান থেকে আমার কাজের গঠনে একটা পার্থক্য আসে, ভাষা প্রকাশের ভিত তৈরি হয়। 

    ২০১১ সালে ‘দেবী’ প্রদর্শিত হয়। কাজটায় সততা ছিল, সৌন্দর্য ছিল। আমার অল্প বয়সের কাজ থেকে বেরিয়ে এসে তখনকার যা বক্তব্য ছিল, তা বলা হয়েছিল ‘দেবী’-তে। রামানন্দ স্যার আসেন এবং আমাকে ডেকে বলেন, ‘শোনো, তোমার গঠনটা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তুমি অনেক ক্ষয়েছ; ক্ষয়ে-ক্ষয়ে শালগ্রাম শিলা হয়ে উঠেছ।’ ফিরে তাকাইনি। 

    ‘ফায়ারলাইট’ প্রায় এক দশকের চিন্তার ফল— এ কাজের শুরু হয় কীভাবে?

    শিল্পের চর্চা করতে গেলে তার সাথে একটা জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হয়। একটা সময় এসেছিল, যখন কলকাতায় থেকেই আমাকে কাজ করতে হত। আমি বীরভূমে বড় হয়েছি, আর্বান লাইফের পলিটিক্স বুঝি না। শহরের মানুষগুলোকে যেন বুঝতে পারতাম না। কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হত না। যেহেতু আমি পারিবারিক ব্যবসায় না ঢুকে শিল্পের মাধ্যমেই রোজগার করব ঠিক করেছিলাম, ওই ফেজটায় আমি অনেক কিছু করেছি, অবশ্য যত্ন করেই— ইন্টিরিয়ার ডিজাইন-এর কাজ, ‘সব্যসাচী’র জন্য গয়না ডিজাইন, ওয়েডিং ডিজাইন করেছি, ফ্যাশন জগতের সঙ্গে ওঠা-বসা হয়েছে। এর অনেকটা ছিল একটা ফ্যাসাড, কিন্তু ভিতরে আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম— এই শো-টার জন্য। 

    এভাবে সাত বছর কেটে গেছিল। প্রত্যেকটা বছর চলে যেত আর আমি আক্ষেপ করতাম, ‘এই বছরও হল না!’ কিন্তু প্রকৃতি আমাদের কথা শোনে এবং সময় বেঁধে দেয়। সাত বছর ধরে বাড়ি খুঁজেছিলাম, পাইনি। এই বাড়িটা হঠাৎ পেলাম! কলাগাছগুলো কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, আমি আবার লাগালাম। লকডাউন হল। 

    শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, ‘ফায়ারলাইট’-এ যে কাজ দেখা যাচ্ছে, তার সাথে ২০২০-র একটা বড় কষ্টের সময়ের সংযোগ রয়েছে। আমফানে আমার স্টুডিও, কাগজ, জিনিসপত্র, তৈরি কাজ, সব নষ্ট হয়ে যায়। অগাস্টে আমার পুরো পরিবারের কোভিড হয়। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার টিম, যাদের আমি হাতে করে বহু কাজ শিখিয়েছি, মনোবল হারিয়ে ফেলতে থাকে। আমি কখনও ভাবিনি যে আমার ডিপ্রেশন হতে পারে, কিন্তু তাও হয়েছিল। প্রায় তিন মাস— সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর, আমি কোনও কাজই করতে পারিনি। আর্থিক অসুবিধাও হয়েছে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য কিন্তু নষ্ট হয়নি।  

    ব্রোঞ্জ কাস্টিং, পাথর, পিতল, লোহা, কাঁচ, রবার, কাঠ, অ্যাক্রিলিক এবং জলরং— একই প্রদর্শনীতে এত বিভিন্ন মাধ্যমে, এত সংখ্যক কাজ সচরাচর দেখা যায় না। এত মাধ্যমে কাজ করার কারণ কী? 

    নিজের শিল্পের ভাষা তৈরি করার একটা অদম্য ইচ্ছা আমার ছিল, এখনও রয়েছে। এই কারণে আমি সব মাধ্যমে, সব প্রক্রিয়ায় কাজ করতে চেয়েছি। এবং এই পদ্ধতির মাধ্যমেই আমার নিজস্ব একটা শিল্পভাষা তৈরি হয়েছে, যা আমার দৈনন্দিন অন্যান্য কাজের থেকে একেবারে আলাদা।     


    চিত্রশিল্প এক ধরনের কাজ, আর ধাতু এক অন্য মাধ্যম; ডাইমেনশান যোগ হয়, বদলে যায়। এই মাপে সাইট-স্পেসিফিক ইন্সটলেশন এবং স্কাল্পচারে আমরা আরও একরকম পারদর্শিতার পরিচয় পাই। এই পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চাইব…

    এই পদ্ধতি শুরু ‘দেবী’র পর পরই, ২০১১ সাল থেকে। আমি ধীরে ধীরে শুধু শিল্পের নিরিখেই জীবনের মূল্য নির্ধারণ থেকে সরে আসি। জীবনকে উপভোগ করে, উপলব্ধি করে, বাঁচতে শুরু করি। এই শো-তে, দর্শনগত দিক থেকে একটা ডিট্যাচমেন্ট ভীষণ ভাবে কাজ করেছে আমার জন্য। এই অদ্ভুত সময়ে আমি ভাবতেও পারিনি যে মানুষ আদৌ এই কাজ দেখতে আসবে— একটা সময় সত্যিই ভেবেছিলাম, কাজটা তৈরি করে ফোনে ছবি তুলে রেখে দেব।

    ‘ফায়ারলাইট’ এখনও অবধি আমার জীবনের পথ চলার সাক্ষ্য বলা যেতে পারে। আমার কাছে যখন যে কাজ এসেছে, আমি নিয়েছি— এবং এই প্রক্রিয়ায় নিজের স্কিল-সেট গড়ে উঠেছে। যা দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রায় একুশ বছরের মেটাল নিয়ে চর্চা রয়েছে। এবং আমার নিজের জীবনের সঙ্গে, শৈশবের সঙ্গে আছে ইতিহাস।  

    ‘ফায়ারলাইট’ নামকরণ কেন? 

    নামটা দেওয়া এক্সপেরিমেন্টার আর্ট গ্যালারির প্রতীক রাজা-র। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া জীবন থেকে নবজীবনপ্রাপ্ত ফিনিক্স পাখির সেই রূপকথার অনুসারে। গত বছর আমার মনে হয়েছিল সব কিছুই শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেখান থেকেও আমি ঘুরে দাঁড়াই। আমি যোদ্ধা, আই অ্যাম আ ফাইটার। এই সব কিছুরই প্রতিফলন ‘ফায়ারলাইট’-এ দেখা যায়। তাই, ‘ফায়ারলাইট’।

    আগুনের ব্যবহার, ‘ফায়ার’, ভাস্কর্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, ‘ফায়ারলাইট’-এ আলোর ব্যবহারও সমমাত্রায় গুরুত্ব পেয়েছে…

    সম্পূর্ণ প্রদর্শনীর লাইট ডিজাইন করেছেন প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী এবং তাঁর দল। বলা যায়, আমরা দুজনে মিলেই করেছি। আমার হৃদয় দিয়ে, ওঁর মনন দিয়ে।

    ‘ফায়ারলাইট’-এর প্রসঙ্গে কিছু বন্ধুর কথা বলতে হয়, যেমন প্রিয়াঙ্কা এবং প্রতীক রাজা, ইনা পুরী, এবং দেব আর নীল-এর নীল। নীলই আমাকে ‘ফায়ারলাইট’-এর আলোকসজ্জার প্রসঙ্গে প্রথম চাকীদা’র কথা বলে, বলে যে আমার মনন একমাত্র উনিই বুঝতে পারবেন। 

    চাকীদা আসেন, এবং কাজ দেখে একটাই কথা বলেন, ‘শিল্পে স্পর্ধা দেখানো উচিত নয়’। সেই থেকে আমাদের বন্ডিং। আমি ওঁকে বলি যে বাড়িটার দৈন্যদশা আমি দেখাতে চাই না। একটা নগ্ন শরীরকে যেভাবে ঢাকে, আলোর ব্যবহারে আমরা বাড়িটাকে সেই ভাবে ঢেকে ফেলতে চেয়েছিলাম।   


    পুরো কাজটাই কি ইন-সাইটু তৈরি হয়েছে? এই বাড়িটা কি কিছু কাজের ক্ষেত্রে একটা প্রভাব ফেলেছে? 

    বেশ কিছুটাই ইন-সাইটু। আমি যে স্কেলে প্রথম কাজটা করার কথা ভাবি, তার থেকে আমাকে স্কেল ডাঊন করতে হয়েছিল। স্তরে-স্তরে কাজ হয়েছে। এক-এক দিন দশটা কাজও হয়েছে। এর সাথে বাকি কাজও চালু রাখতে হয়, আর্থিক সংস্থানের কারণে। বিয়েবাড়ি শেষ করে ভোরবেলা বাড়ি ফিরেই সাইটে চলে এসেছি, কাজে হাত লাগিয়েছি। ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১, একটা টানা সময় শুধু যেন এই কাজটা—আর আমার মেয়ে, যাকে আমি বহু প্রার্থনার পর, সারোগেসির মাধ্যমে পাই, যার বয়স এখন দুই বছর— এই দুটো কারণে বেঁচে থেকেছি। এবং বেঁচে গেছি। 

    হ্যাঁ, বাড়িটার প্রভাব আছেই। সাড়ে তিন বছর আগে যখন আমি এই বাড়িটাকে পছন্দ করি কাজ করার জন্য, বাড়িটা আমাকে কিছুই করতে অ্যালাউ করছিল না। বাড়িটার নিজস্ব একটা গল্প ছিল। এখানে এত মানুষ থেকেছেন, এতগুলো জীবন কেটেছে, এত অভিজ্ঞতা— দেওয়ালে পেরেক, ক্যালেন্ডার, স্টাফেদের ভাঙা মগ, প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধে ফেলে যাওয়া জিনিস— সবই ছিল, এবং সবই গল্প বলছিল। এই বাড়িটায় একজন মানুষ, হয়তো তাঁর স্ত্রী থাকতেন, এবং তাঁদের সেবা করতেন ৩০-৩২ জন মানুষ। এই বাড়ির ঘরে-ঘরে যে লোকেরা থাকতেন, তাঁদের পরিচিতিও বাড়ির মালিক জানতেন কি না সন্দেহ! তাঁরা একটা শরীর হিসাবে কিছু কাজ পারফর্ম করে যেতেন, এমনই মনে হয়েছে আমার। এই বাড়িটা বস্তুবাদী বিলাসের প্রতিভূ। সেটা যখন প্রকৃতি নিয়ে নিতে থাকে, তার একটা এনার্জি থাকে। 

    আমরা নিজেদের দেখেই সেটা বুঝতে পারি— আজকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে, দেশবাসী হিসাবে আমরাও যেন এক-একটা শরীর। আমাদের সুখ-দুঃখ-অসুখ, কোনও কিছুতেই আমাদের দেশের রাজাদের যেন কোনও খেয়াল নেই। আজকে প্রকৃতি যখন খেয়াল করাচ্ছে, তখন একটা হিংস্র, নোংরা মানসিকতা নগ্ন হয়ে পড়ে। আমি এত মৃতের সারি দেখে বিচলিত নই। আমি বিচলিত মৃত্যুদাতার অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতার চিরস্থায়ী অবস্থানে। এটা শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা একটা মানসিক অবক্ষয়ও বটে।         

    ‘ফায়ারলাইট’ কি নারায়ণ সিংহ-র শিল্পী, ভাস্কর, ইন্সটলেশন আর্টিস্ট, ডিজাইনার— এই বহু ব্যক্তিত্বের, ২০২১-এর সমন্বয়?

    নিশ্চয়ই! আমি আজকে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এই প্রদর্শনী সেই সময়ের সন্ধিক্ষণের কথা বলে। শুধু শিল্পী হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবেও।


    এই প্রদর্শনী ২০২১-এর জুন মাসে শেষ হচ্ছে। ফ্লুইডিটির কথা যখন উঠল, নারায়ণ সিংহ-র ফ্লুইডিটি তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে, এখনও অবধি কি তা ভাবা হয়েছে?

    আমার সরকারের থেকে কখনওই কিছু চাইনি, বরং এতগুলো বছর সরকারকে ইনকাম ট্যাক্স, জিএসটি দিয়ে এসেছি (হাসি)। আমার কোনও জায়গা নেই স্কাল্পচার রাখার। মানুষের প্রচুর ভালোবাসা পাচ্ছি ‘ফায়ারলাইট-এ। আমি ভাবতেও পারিনি যে এই ল্যাঙ্গুয়েজটা লোকে বুঝবে। তাই, অনেক যত্নে তৈরি এই কাজগুলোকে ভেঙে না ফেলে যদি কিছু কাজকে আশ্রয় দেওয়া যায়, তাহলেই যথেষ্ট। যা হবে, আমি মেনে নেব।    

    ছবি সৌজন্য: শুভময় মিত্র 
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook