চাঁদ থেকে ফেরা

Apollo 10

‘কঠিন বিষয় আমি কখনো মানিনি।
এই অপরাধ হোক জ্যোৎস্নার ভেতরে জানাজানি।’

পৃথিবীবিখ্যাত ‘অ্যাপোলো ১১’ অভিযানের কথা আমরা সকলেই জানি, যে অভিযানের মাধ্যমেই ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই (ইউটিসি সময় অনুযায়ী) প্রথমবার চাঁদের মাটিতে মানুষের পা পড়ে। প্রথমে নীল আর্মস্ট্রং এবং তারপরে এডুইন অলড্রিন পা রাখেন চাঁদের মাটিতে। ১৯৬১র ২৫ মে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন.এফ.কেনেডি যে লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন, ‘অ্যাপোলো-১১’র অভিযান ছিল তার বাস্তবায়ন। মানুষের পৃথিবীতে এক রূপকথার দিন।

কিন্তু কোনও রূপকথাই তো আসলে রূপকথা নয়, তার নেপথ্যে জুড়ে থাকে বহু মানুষের যোগদান, শ্রম; এমনকী প্রচারের মূল আলোটুকু গায়ে মাখতে পারবেন না জেনেও অনেকেই তাতে যোগদান করেন হাসিমুখে। ‘অ্যাপোলো ১১’-র আগেও তেমন‌ই একাধিক মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে, একটু-একটু করে পরীক্ষা করা হয়েছে মানুষকে চাঁদে পাঠানো এবং তাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার বিভিন্ন পদ্ধতির কার্যকারিতা। ‘অ্যাপোলো ১’ থেকে শুরু করে ‘অ্যাপোলো ১০’ পর্যন্ত প্রতিটি অভিযানেই এই পরীক্ষা চালু থেকেছে।

আরও পড়ুন: কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিতে ভিনগ্রহের প্রাণীকে বরাবর আঁকা হয়েছে ‘সবুজ মানুষ হিসেবে’ লিখছেন: জয়দীপ ঘোষ

অ্যাপোলো ১০ অভিযান ছিল আক্ষরিক অর্থেই dress rehearsal for the lunar landing. এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন থমাস পি. স্ট্যাফোর্ড(কমান্ডার), জন ইয়ং (কমান্ড মডিউল পাইলট), ইউজিন সারনান (লুনার মডিউল পাইলট)। এর উদ্দেশ্য ছিল লুনার মডিউল ‘স্নুপি’কে প্রথমবার চাঁদের কক্ষপথে সচল অবস্থায় ব্যবহার করা এবং চাঁদের পরিবেশে লুনার মডিউলের সমস্ত সিস্টেম যেমন ইঞ্জিন, নেভিগেশন, কমিউনিকেশন, রাডার ইত্যাদি ঠিকঠাক কাজ করতে পারে কিনা তা পরীক্ষা করা। তাছাড়া, চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের অবতরণের পর তাকে সফলভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য যা-যা দরকার, যেমন: লুনার মডিউলটিকে কমান্ড মডিউলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে চাঁদের কাছাকাছি নামিয়ে আনার পর আবার কমান্ড মডিউলের (চার্লি ব্রাউন) সঙ্গে সফলভাবে ডক করা— তাও পরীক্ষা করা হয়েছিল। ‘অ্যাপোলো ১০’-এর লুনার মডিউলটিই প্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠের সবচেয়ে কাছে, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৯ মাইলের(১৪.৫ কিলোমিটার) মধ্যে নেমে আসে এবং মহাকাশচারীরা চাঁদে অবতরণস্থলটি (বিশেষত ‘অ্যাপোলো ১১’-এর জন্য নির্বাচিত Sea of Tranquility) পর্যবেক্ষণ করেন ও ছবি তোলেন।

অ্যাপোলো ১০’ অভিযানের তিন মূর্তি

এতসব কথা যত সহজে লেখা হয়ে গেল, বলাই বাহুল্য যে গোটা প্রক্রিয়াটি তত সহজ ছিল না। এ-কথাও সত্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার ফলে এই মহাকাশ অভিযানগুলিও রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। তবে এ তো জানা কথাই যে বিজ্ঞান চলবে বিজ্ঞানের মত, তাকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করছে মানুষের ওপর। তাছাড়া পৃথিবীতে খারাপের সংখ্যা যদি তেতাল্লিশ হয় ভালর সংখ্যাও সাতান্ন বটে। ‘অ্যাপোলো ১০’-এর অভিযানের ফলেই চন্দ্রপৃষ্ঠের অত্যন্ত বিশদ ছবি এবং তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই তথ্য চাঁদের ভূতাত্ত্বিক গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং সম্ভাব্য অবতরণস্থল সম্পর্কে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। বিশেষত, ‘সি অফ ট্রাঙ্কুইলিটি’-র মতো সমতল অঞ্চলের নির্ভুল ম্যাপিং ভবিষ্যতের চন্দ্র অভিযানগুলির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাছাড়া আটদিনের এই মহাকাশযাত্রা এবং চাঁদের কাছাকাছি চরম পরিস্থিতি মহাকাশচারীদের মন এবং শরীরস্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলে তাও আন্দাজ করা গিয়েছিল এই অভিযানের ফলে। আজ মহাকাশচারীদের জন্য যে-সমস্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তার‌ও পথিকৃৎ এই অভিযান‌ই।

তবে এই অভিযান যে একেবারেই নির্বিঘ্নে সমাধা‌ হয়েছিল এমনটা কিন্তু নয়। আমরা সকলেই জানি, সে-সময়ে মহাকাশচারীদের জীবনের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল। এমনকী কোনও জীবনবিমা কোম্পানিও মহাকাশচারীদের জীবনবিমা করতে চাইত না।

‘অ্যাপোলো ১১’-র অভিযানের সময়েও মিশনের আগে নীল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স তাদের পরিবারের জন্য জীবনবিমার বিকল্প হিসেবে অটোগ্রাফ দেওয়া খাম রেখে গিয়েছিলেন। ফলত, ঝুঁকির সম্ভাবনা সহজেই আন্দাজ করা যায়।

তবে এই অভিযান যে একেবারেই নির্বিঘ্নে সমাধা‌ হয়েছিল এমনটা কিন্তু নয়। আমরা সকলেই জানি, সে-সময়ে মহাকাশচারীদের জীবনের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল। এমনকী কোনও জীবনবিমা কোম্পানিও মহাকাশচারীদের জীবনবিমা করতে চাইত না।

‘অ্যাপোলো ১০’-এর তিন অভিযাত্রীর একজন, ইউজিন সারনানের আত্মজীবনী ‘The Last Man on the Moon’ (১৯৯৯ সালে প্রকাশিত, ডন ডেভিস-এর সঙ্গে সহ-লিখিত)-এমন একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। লুনার মডিউল ‘স্নুপি’তে করে চন্দ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি নেমে আসার সময়ে মহড়ার অংশ হিসেবে, তারা লুনার মডিউলের ডিসেন্ট স্টেজ (যে অংশটি অবতরণের জন্য ব্যবহৃত হয়) বিচ্ছিন্ন করেন এবং অ্যাসেন্ড স্টেজ (যে-অংশটি মহাকাশচারীদেরকে কমান্ড মডিউলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়) চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁরা খেয়াল করেননি এই সময়ে তাঁদের abort guidance সুইচ engage পজিশনে থাকার বদলে armed পজিশনে ছিল। এই সামান্য ভুলের কারণে যখন অ্যাসেন্ড ইঞ্জিন চালু করা হয়, তখন লুনার মডিউলটি অপ্রত্যাশিতভাবে তার অক্ষের উপর অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘুরতে শুরু করে এবং কমান্ডার থমাস স্ট্যাফোর্ড এবং ইউজিন সারনানের সামনে চাঁদের দৃশ্য দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে, যার ফলে দিকনির্দেশনা বোঝা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদিও কমান্ডার স্ট্যাফোর্ড দ্রুত ম্যানুয়াল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেন কিন্তু এই অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে মডিউলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হতে পারত।

মাটির পৃথিবীতে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে বহুদিন‌ই। সেই শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্যই কখনও-কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, মানুষ যখন ধর্মভেদে, জাতিভেদে, বর্ণভেদে, আর্থসামাজিক অবস্থাভেদে একে অন্যকে বঞ্চিত করেছে, যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেই শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্যই প্রশ্নের মুখে পড়েছে কিন্তু মানুষ‌ই তাকে কাটিয়ে উঠেছে আবার। নিজেকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকা এবং নিজের সীমাবদ্ধতাকে প্রাণপণে অতিক্রম করতে চাওয়াই তাকে আরো বড় করে তুলেছে। সমস্ত বিপদ মাথায় নিয়েও সে অজানাকে জানতে চায়, অচেনাকে চিনতে চায়। এই অপরিসীম আগ্রহ‌ই তার ধর্ম। আজ ২৬ মে সেরকমই একটি দিনের ৫৬ বছর পূর্তি। এ-দিনেই ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল ‘অ্যাপোলো ১০’।