গিরিশ কারনাড (১৯ মে, ১৯৩৮-১০ জুন, ২০১৯) সেসময়ে থাকেন তাঁর বেঙ্গালুরুর জে পি নগরের বসতবাড়িতে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রধানত জে পি নগরের বাড়িতে বসেই অধ্যাপক কারনাডের কাছে বহু প্রশ্ন নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল বর্তমান প্রতিবেদকের। সাক্ষাৎকারের অধিকাংশই একটি ছোট ক্যামেরায় রেকর্ড করা। বাকিটা গৃহীত হয়েছিল নোটস্ আকারে। তার ভিত্তিতেই এই বার্তালাপটির নির্মাণ। গিরিশ কারনাডের আপন ভাষ্যের তর্জমা করেছেন সুদেব সিংহ।
আপনি বুঝতেই পারছেন, থিয়েটার কথাটা আমরা ব্যবহার করছি আধুনিক বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। আমাদের দেশে উত্তর-উপনিবেশ পর্বে এই মাধ্যমের বিশেষ প্রচার ও প্রসার। এটা উনিশ শতকের বিষয় (emergence)। আর আজকে একুশ শতকে প্রযুক্তির দুর্ধর্ষ গতিবেগের চাপে থিয়েটার ঈষৎ কোণঠাসা। আমরা কি থিয়েটার বিষয়টিকে মূলত শহুরে বিনোদন বলব? আমরা মোটামুটি বলতে পারি, একজন দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষও বিনোদনমুখী হন। ‘খেয়ে-পরে বাঁচা’ কথাটা বলি বটে, তবে শুধু ওভাবে মানুষ বোধহয় টিকে থাকতে (exist করতে) পারে না। এই পরিস্থিতিতে থিয়েটার মাধ্যমটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইংরেজি ‘থিয়েটার’ শব্দটি এখন মোটামুটি আমাদের দেশীয় ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। আমরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই ‘থিয়েটার দেখতে যাব’ বা ‘ভাল থিয়েটার চলছে’ ইত্যাদি বলে থাকি। কিন্তু নাগরিক পরিসরে থিয়েটার বিষয়টি এক অর্থে নতুন। কারণ আমাদের ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রান্তে গ্রামীণ লোকনাট্যের নানা ধারা দীর্ঘকাল ধরেই গৃহীত হয়েছে মানুষের মধ্যে (performative tradition)। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটাল এবং ঔপনিবেশিকতার যুগে শহুরে থিয়েটার বিষয়টির পত্তন হল। প্রসেনিয়াম পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হল। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চে, এবং দর্শককে সম্পূর্ণ পৃথক আসন দেওয়া হল। দর্শক যে উপস্থিত, এই বিষয়টি আপাত-বিস্মরণের আয়োজন করতে দর্শকদের জন্য নির্মিত তথা নির্দিষ্ট স্থান, মুড়ে ফেলা হল গাঢ় অন্ধকারে। অর্থাৎ, মঞ্চায়ন শুরু হলে দর্শকরা থাকবেন আড়ালে। এই নিয়ে বাদলদার (বাদল সরকার) গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার কথা আমরা জানি। আলো-আঁধারির আধুনিক বিন্যাস লোকনাট্যের ক্ষেত্রে একেবারেই অচল।
আরও পড়ুন : পথনাটকের রাজনীতির নির্মাণ কীভাবে ঘটেছে এই দেশে? প্রলয়নের সঙ্গে কথোপকথনে রাজর্ষি ধাড়া…
ঔপনিবেশিক যুগে সাহেব-মেমসাহেবদের জন্যে থিয়েটার খোলা শুরু হল। প্রধানত তিনটি বন্দরনগরী, অর্থাৎ কলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বেতে বিদেশিদের মনোরঞ্জনের জন্য এই ব্যবস্থা। প্রথম পর্যায়ে তাঁরা নিজেরাই করে নিতেন থিয়েটারের বন্দোবস্ত। আমরা শুনেছি, সাহেবরা যেখানে যান, সেখানেই ক্যাফে এবং থিয়েটার গড়ে তোলার ব্যবস্থাও করেন। আমাদের দেশের কিছু ধনী ব্যক্তিও প্রধানত ইংরেজদের প্রভাবে পুঁজি বিনিয়োগ শুরু করলেন থিয়েটারে। ক্রমশ থিয়েটার একটি পণ্য হয়ে উঠল। ব্রিটিশ থিয়েটারের দেখাদেখি যেমন প্রসেনিয়াম গড়ে উঠল, ক্রমশ টিকিট বিক্রির ব্যবস্থাও শুরু হল। আমার মতে, শহুরে (urban) থিয়েটারের এই দুটো বিষয়কেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এদেশে বিনোদনের প্রচলিত ধারণা বদলে গেল। আমাদের গ্রামীণ লোকনাট্যের বা ঐতিহ্যগত পরম্পরায় গোটা ব্যাপারটাই অন্যরকম ছিল। প্রধানত, রাজা-জমিদাররা নানা উৎসবে-পার্বণ উপলক্ষে লোকনাট্যের জন্য অর্থ বরাদ্দ করতেন। কেবল পালা-পার্বণেই নয়, লোকপরম্পরার সহায় হওয়া তাঁরা তাঁদের কার্যসূচির অংশ মনে করতেন। These were very much a part of their official duties, so to speak। এঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘকাল সজীব ছিল এদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত লোকনাট্যের ধারা। পালা-পার্বণে যাত্রা, রামলীলা, যক্ষগান, কীর্তন প্রভৃতি দেখার জন্য সাধারণ দর্শকদের অর্থ খরচ করতে হত না। বিভিন্ন উৎসবের অঙ্গ হিসেবেই ডানা মেলত আমাদের লোকশিল্পীদের বিবিধ প্রবর্তনা।
টিকিট থাকত না। অর্থাৎ, দর্শকদের অর্থ খরচ করতে হত না। কাজেই, নাটকে improvisation-এর সুযোগ থাকত বিস্তর। অনেকটা আমাদের মার্গসংগীতের কনফারেন্সগুলোর মতো, যেখানে আজও improvisation-কে ভিত্তি করে শো-র সাফল্য বিচার করা হয়। আমি ধারওয়াড়ে থাকার সময় এবং পরেও গাঙ্গুবাই হাঙ্গল, ভীমসেন যোশীকে সামনে বসে শুনেছি। শুদ্ধকল্যাণ বা ইমন ভীমসেন যোশী যে কতভাবে গেয়েছেন, তা বলে শেষ করতে পারব না। মনে রাখতে হবে, রাগের বিশুদ্ধতা সম্পূর্ণ বজায় রাখতে হত। কিন্তু তাও ঘটে যেত আশ্চর্য সব ঘটনা!
লোকনাট্যের ক্ষেত্রেও কোনও একদিন একটা প্রযোজনা সফল না হলেও দর্শকের মনে তেমন কিছু হতাশা জাগার কারণ ছিল না। কারণ দুটো। তাঁদের তো কিছু টাকাকড়ি খরচ করতে হয়নি। দ্বিতীয়ত, পরের সন্ধ্যায় হয়তো ঘটে যেত ম্যাজিক। যাঁরা অর্থ বিনিয়োগ করতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যথেষ্ট সমঝদার। আর দর্শক— অর্থ না খরচ করলেও তাঁদের নান্দনিক বোধ প্রযুক্ত হত যথাযথভাবে। এটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। You see if you’ve got an audience that is learned and prepared, it makes a lot of difference! What happens then is that the performers also become alert that they must put on their best show।
শহুরে থিয়েটারে মূল তফাত গড়ে দিল টিকিটের প্রচলন। দর্শক যখন টাকা দিয়ে থিয়েটার দেখতে শুরু করে, নাট্যপ্রযোজনা তখন স্বাভাবিকভাবেই হয়ে ওঠে পণ্য। প্রসেনিয়াম মঞ্চে যাঁরা থিয়েটার দেখতে আসতেন, তাঁদের সকলকেই টিকিট কাটতে হত। কেউ হয়তো তাঁর বন্ধুর কাছে শুনলেন, অমুক নাটকে চারটি নৃত্যের দৃশ্য আছে এবং ছয়টি গান আছে। সংশ্লিষ্ট দর্শক যখন বন্ধুর মুখে শুনে নাটকটি দেখতে গেলেন, তিনি হয়তো দেখছেন, নৃত্যের দৃশ্য রয়েছে তিনটি, গান আছে দু’টি, উপরন্তু নায়িকাকে দেখতেও ততটা ভাল নয়। অথচ, তিনি একই দাম দিয়ে টিকিট কেটেছেন। এবার তিনি কুপিত হচ্ছেন। তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি ঠকে গেছেন। টাকা জলে গেল। এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা নান্দনিক দিকের মান উন্নত করার যাবতীয় অভিপ্রায় উপেক্ষা তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে করতেই হয়। অর্থাৎ, নাট্য-প্রযোজনাকারী সংস্থাকে সব দর্শকের জন্য একই রকম বিনোদনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হচ্ছে। প্রত্যেকটি শো ঠিক আগেরটার মতো হতে হবে। একটা চেনের মতো। ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি। আমার মনে হয়েছে, টিকিটের বিষয়টা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওইটাই শর্ত— You have to repeat, you can’t improvise. This is the basic fallacy. In order for a production to remain lively and vibrant, you have to allow the performers to improvise. It is theatre after all— a live performance।
ইংরেজদের দেখাদেখি গড়ে উঠেছিল এই বাণিজ্যিক থিয়েটার। তবে সেটা কলকাতায় একরকম। অন্যদিকে entire South-Western coastal belt, যার মধ্যে বম্বে, পুনা, আজকের বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের বাণিজ্যিক নাট্যধারা অনেকটাই আলাদা। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে বিভিন্ন কোম্পানি এগিয়ে এসেছিল থিয়েটারের শ্রীবৃদ্ধির জন্য। অন্যদিকে কলকাতায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো নাট্য-মহারথীদের সহায়তা করেছিলেন বিভিন্ন ধনী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ (group of people)।
বাণিজ্যিক থিয়েটার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি সকলে। বিকল্প প্রস্তাবও গড়ে উঠতে দেখেছি আমরা, যেমন গণনাট্য আন্দোলন।
গণনাট্যের কথায় আসছি। তার আগে আর-একটা কথা বলে নিই। টিকিট ব্যবস্থার আরেকটা বড় সমস্যা দেখা গেল কাহিনিবিন্যাস বা story intrigue-এর ক্ষেত্রে। লোকনাট্যের দর্শকরা একেবারে ভিন্ন নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ ছিলেন। ধরো, রামায়ণ, মহাভারত কি ভাগবত পুরাণ… একই কাহিনির হাজারও উপস্থাপন। রাম বনে যাবে, মায়ামৃগ, রাবণের সীতা-হরণ, তারপর রাম-রাবণের যুদ্ধ। এই কাহিনি কে না জানে! কিংবা, ভক্ত ধ্রুব কিংবা প্রহ্লাদের কাহিনি। আবার দক্ষিণ ভারতে বাসবান্নার কথা। কাহিনিতে বিশেষ অদলবদল নেই। যিনি অভিনয় করছেন, তাঁকে নিজের অভিনয়শক্তিকে দর্শকের সামনে উজাড় করে নিজেকে মেলে ধরতে হচ্ছে। পরের দিন তাঁকে অবলম্বন করতে হবে আঙ্গিকগত নতুন কৌশলের। এই দেশে literacy এবং education— বিষয়টা খুব জটিল। আমি এমন একাধিক মানুষ দেখেছি, যাঁরা তেমন লিখতে-পড়তে জানেন না অথচ ভাগবত পুরাণ জানেন। রামায়ণ-মহাভারত জানেন। অতএব, অভিনেতা দর্শককে ফাঁকি দিতে পারবেন না। হিন্দুস্তানি মার্গসংগীতের ক্ষেত্রে আমরা যেমন ভাস্কর বুয়া বাখ্লেকে নিয়ে নানা কাহিনি শুনেছি, তেমনই অতীতেও হয়তো দিকপাল সব নির্দেশক-অভিনেতারা ছিলেন। তাঁরা একের পর এক রজনী মোহিত করতেন সকলকে। কাজটা খুব সহজ নয়। এক্ষেত্রে সংগীতেরও বড় ভূমিকা ছিল। আমাদের কম বয়সে ‘সংগীত-নাটক ট্র্যাডিশন’-এ সাংঘাতিক সব গায়কদের দেখেছি। এক মিনিট থেকে দেড় মিনিট সময়ের মধ্যে তোমাকে দর্শকদের মন জয় করতে হবে। কী দমদার তানকারী! এখন ভাবাও যায় না। কোম্পানি নাটক, পার্শি থিয়েটারেও এরকম দাপুটে অভিনেতা এবং গায়কদের হদিশ মিলত। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের মনে পড়বে বাল গন্ধর্বের কথা। এই সুযোগ ছিল না শহুরে মঞ্চে। হাজারও গল্পের চমকে দর্শককে কুপোকাত করার উপায় ভাবতেন প্রযোজকরা। ফলে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচ তৈরি হয়ে গিয়েছিল— কিছু দারুণ থ্রিল বা কোনও নতুন টুইস্ট ভাবতে হবে, যাতে টিকিট কেটে আসা দর্শকরা মনে করেন, পয়সা উসুল হয়েছে।
গণনাট্যের কথায় আসছি। তার আগে আর-একটা কথা বলে নিই। টিকিট ব্যবস্থার আরেকটা বড় সমস্যা দেখা গেল কাহিনিবিন্যাস বা story intrigue-এর ক্ষেত্রে। লোকনাট্যের দর্শকরা একেবারে ভিন্ন নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ ছিলেন। ধরো, রামায়ণ, মহাভারত কি ভাগবত পুরাণ… একই কাহিনির হাজারও উপস্থাপন।
তুমি IPTA-র কথা বলছিলে। আমি কখনওই IPTA-র খুব বেশি প্রভাব বোধ করিনি। যখন কমিউনিস্ট পার্টির বম্বে কনফারেন্স (IPTA-র প্রথম কনফারেন্স) হচ্ছে, তখন তো আমি নিতান্তই শিশু। বা ধরো, ‘নবান্ন’ প্রযোজনা। এগুলোর কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি আমার সঙ্গে। Having said that, সেই দিনগুলো তো ঐতিহাসিক। অতজন বড় আর্টিস্ট এক মঞ্চে— এ তো অবিশ্বাস্য! তাবড় তাবড় সব লোকশিল্পীরা একদিকে, অন্যদিকে শাস্ত্রীয় সংগীতের শিল্পীরা।
আপনি যখন বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন, সেই সময়ে IPTA-র প্রভাব কীরকম?
IPTA-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এরকম নানাজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। আমি রাশিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম। আমার সামনে কিন্তু তখন বিশাল ঘটনা ইব্রাহিম আলকাজি। তিনি ইতিমধ্যে ‘রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্ট’ বা RADA-তে পড়াশোনা শেষ করে, বিবিসি-র জন্য প্রযোজনা করে, ১৯৫২ সালের শেষের দিকে বম্বেতে এসেছেন। আর আমি বম্বে গেছি late 50’s-এ। আলকাজি তখন জ্যঁ আন্যুই, স্ট্রিন্ডবার্গ, গার্সিয়া লোরকা, চেকভ, ইবসেন— এইসব প্রযোজনা করছেন। তার আগে British pedagogy-তে ইংরেজদের লেখা নাটকই পড়ানো এবং মঞ্চস্থ করার চল ছিল— যেমন বার্নার্ড শ অথবা অলিভার গোল্ডস্মিথ। ইব্রাহিম আলকাজি আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন গোটা পশ্চিম দিগন্তের মায়া। সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের উদযাপন। আমরা তখন মুখোমুখি হয়েছি মঞ্চমায়ার (Art of Illusion-এর)। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। তখন আমরা Eurocentrism— এসব কথা জানতাম না। আজও যে খুব একটা জানি, তা না। জ্যঁ আন্যুই-এর ‘আন্তিগোনে’ আজও আমাকে প্রাণিত করে। আমার প্রথম নাটক ‘যযাতি’-তে আন্যুই-এর যথেষ্ট প্রভাব। শর্মিষ্ঠা এবং দেবযানীর বাকযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রয়েছে আন্যুই-এর ‘আন্তিগোনে’। ওই যে venom-spewing women, এবং সেইসব big confrontations— আমি ভারতীয় দর্শকদের জন্য প্রস্তুত করছি। এরপর তো জানো, আমি এমএ পরীক্ষা দিইনি। ঝুঁকি নিয়ে Rhodes Scholarship-এর পরীক্ষায় বসে গেছি, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছি। আমার অন্যতম বিষয় ছিল, গণিত। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, Land of Eliot-এ ল্যান্ড করতে গেলে কবিতার চেয়ে আমার বেশি সহায়ক হবে অঙ্ক। তবে অক্সফোর্ড-এ গিয়ে আমি একান্তভাবেই, আজকের পরিভাষায় ‘Humanities’ পড়েছি। এই সময়ে Royal Shakespeare Company-র প্রযোজনায় দেখছি শেক্সপিয়রের প্রায় সব নাটক। বের্টোল্ট ব্রেখট্-সহ অন্যান্য ইউরোপীয় নাট্যকারদের মঞ্চায়ন দেখছি বিভিন্ন পাশ্চাত্যের নাট্যদলের উপস্থাপনায়। আমার আজও মনে হয়, আলকাজি বিশ্বজনীন। তাঁর প্রযোজনাগুলি পৃথিবীর যে-কোনও প্রখ্যাত নাট্যদলের মঞ্চায়নের সমকক্ষ।
দেশে ফিরে পরে আমি দেখেছি শম্ভুদা, অর্থাৎ শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা। সেও এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। শম্ভুদার সমকক্ষ কোনও নির্দেশক বা অভিনেতার কথা সারা বিশ্ব সন্ধান করেও বলা বেশ শক্ত। শম্ভুদার মতো কে পারে! Unbelievable! What range he had!
এর পর তো আর-এক ভারতীয় নাটক লেখক প্রায় বিপ্লব ঘটালেন আধুনিক ভারতীয় রঙ্গমঞ্চে। তিনি বাদল সরকার। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬৩-৬৪, হিন্দি অনুবাদ কিছু পরে)১ নাটকটি আমার কাছে বিস্ফোরণের মতো। আধুনিক ভারতীয় নাটক রচনার ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে paradigm shift ঘটে গেল। ওই যে আশ্চর্য fluidity between scenes and fluidity of structure— ইতিপূর্বে ভারতীয় নাটকে ছিল না। আমার লেখা ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ পড়ার পরে এবং মঞ্চস্থ করার পর তো বদলে গেল। ‘হয়বদন’ (১৯৭১) পড়লেই সেটা বোঝা যায়। বড় বড় সমালোচকরা বলেন, আমার ‘হয়বদন’ নাটকে নাকি আছে ‘global connection’। আমি বারবার বলেছি, একদম নয়— ওটা local connection, Calcutta connection। আমি দু’বার নাট্যনির্দেশকের ভূমিকায় কাজ করেছি। একবার, ‘Madras Players’-এর ইংরেজি প্রযোজনা, আমারই অনুবাদে ‘Evam Indrajit’। দ্বিতীয়টি অনেক পরে, আমার নিজেরই একটি নাটক।
‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় সব ভারতীয় নাটক লেখক বাদলদার ওই লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আমি নাটক ধরে ধরে আলোচনা করতে পারি। আমি মুক্ত কণ্ঠে আমার ক্ষেত্রে বাদলদার প্রভাবের কথা বলি। অন্যরা এড়িয়ে যান।
১) হিন্দি অনুবাদ করেন প্রতিভা অগরওয়াল। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর শ্যামানন্দ জালান এবং সত্যদেব দুবে নির্দেশিত প্রযোজনা দু’টি খ্যাতি লাভ করেছিল ভারতজুড়ে। তবে গিরিশ কারনাড কলকাতায় দেখেছিলেন ‘শৌভনিক’ নাট্যদলের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। গিরিশ কারনাডের মনে পড়ে— বাদলবাবুর সে কী রাগ! তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না শৌভনিক-এর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ দেখে। গিরিশ অবশ্য বলেছেন, নাটক রচনার শক্তি প্রতিফলিত হয়েছিল মঞ্চে— ‘We were bowled over by the play.’ আজও যুদ্ধবিধ্বস্ত একাধিক দেশে প্রযোজিত হচ্ছে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’।