সময় ১৮৯৭। স্থান কুম্বকোনম, মাদ্রাজ। সেখানে বিগ স্ট্রিটের ওপর ইংরেজি মাধ্যম স্কুল টাউন হাই-এ চলছে বাচ্চাদের অঙ্কের ক্লাস। সেদিন স্বয়ং হেডস্যর এসেছেন ক্লাস নিতে। হেডমাস্টার কৃষ্ণস্বামীকে দেখে ছোটরা ভয় পেল। কৃষ্ণস্বামী তাই বললেন, আজ প্রথমেই তোমাদের একটা মজার অঙ্ক শেখাব। সেই অঙ্কটা একটা ম্যাজিক। তোমরা কি জানো, কোনও সংখ্যাকে যদি সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করো, তাহলে ভাগফল সব সময়ে হবে ১?
এই কথা শুনে বাচ্চারা তো অবাক। তারা বেশ মজাও পেল। এবং তাদের ভয় কাটল। কিন্তু তারা কৃষ্ণস্বামীকে ঠিক বিশ্বাস করছে বলে মনে হল না। তখন কৃষ্ণস্বামী গল্প করে বুঝিয়ে বললেন, ধরো, কারও কাছে আছে ৬টা কলা। সেটা সে ৬ বন্ধুকে সমান ভাগে ভাগ করে দিল। তাহলে তো প্রত্যেকে পেল একটা করে কলা। আবার যদি ৪ জন বন্ধুকে ৪টে কলা ভাগ করে দাও, তাহলেও সবাই পেল ১টা করে কলা। তাহলে ৬-কে ৬ দিয়ে ভাগ করলেও ১। আবার ৪-কে ৪ দিয়ে ভাগ করলেও সেই ১।
এবার বাচ্চারা ভারি অবাক। এ তো ম্যাজিক! এবার কৃষ্ণস্বামী যেন ভগবান। সেই ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, পৃথিবীর যে কোনও সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল সব সময়ে ১ হবেই। অন্য কিছু কখনও হবে না। বাচ্চাদের মনে এই ধারণা জন্মাল, হেডমাস্টার গড!
আরও পড়ুন : কম্পিউটারকেও অঙ্কে হার মানিয়েছিলেন শকুন্তলা দেবী! লিখছেন অর্পণ গুপ্ত…
একটি ছেলে উঠে দাঁড়াল। হাত তুলল। অর্থাৎ, সে প্রশ্ন করতে চায়! ছেলেটা নিরেট বোকা। এখনও বুঝতে পারেনি? বলো, কী জানতে চাও, বললেন কৃষ্ণস্বামী।
ছেলেটি বলল, শূন্যকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলেও কি ভাগফল ১ হবে স্যর? ‘Suppose Sir, I divide no fruits for no one, still each gets one? Is zero divided by zero also 1?’
কৃষ্ণস্বামীর মনে হল, তাঁর পায়ের তলায় মাটি নেই। কী বেয়াড়া প্রশ্ন! এর প্রতিশোধ তিনি নেবেন। তিনি ছড়ি ঘুরিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি নিশ্চিত, এই বেয়াদব ছেলেটাকে বেশিদিন স্কুলে রাখা ঠিক হবে না। খোঁজ নিলেন, ছেলেটা কে?
নাম, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার রামানুজন। বয়স ১০। বাপ-মা অতি গরিব। বাপ একটা কাপড়ের দোকানে খাতা লেখে। হিসেব রাখে। তাহলে, ওই ছেলে কী করে এই দামি স্কুলে পড়ছে? হেডমাস্টার জানলেন, ওই ছেলে সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে স্কলারশিপ পেয়ে এই স্কুলে এসেছে। তার মানে স্কলারশিপ বন্ধ করতে পারলেই রামানুজন বিদায় নিতে বাধ্য হবে। হেডমাস্টার কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন।
কিন্তু দু-বছরের মধ্যে হেডমাস্টার বুঝতে পারলেন, রামানুজনের বৃত্তি কেড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ১২ বছরের রামানুজন শিখছে এসএল লোনে-র ট্রিগনোমেট্রি। বছরখানেকের মধ্যে ত্রিকোণমিতির সমস্ত সূত্র সে শিখে ফেলল। তাকে ভয় পেতে লাগল অঙ্কের মাস্টারমশাইরা। যে ১৩ বছরের ছেলে কিউবিক ইকুয়েশনস-এর সমাধান করে মুখে মুখে, সে তো গণিতের দানব। অঙ্কের শিক্ষকরাও তাকে এড়িয়ে চলে।
১৯০৪ সাল। রামানুজন এই বছর টাউন হাই স্কুল ছেড়ে কলেজে ভর্তি হবে। হেডমাস্টার কৃষ্ণস্বামী রামানুজন-কে অনেক উপহার দিয়ে বললেন, অঙ্কে রামানুজন ১০০-তে ১০০ পেয়েছে। বেশি দিতে পারলাম না বলে আমরা দুঃখিত।
এইসময় ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রামানুজন হাতে পেল এক হারিয়ে যাওয়া বই। ‘লীলাবতী’। ভাস্করাচার্য-র ‘লীলাবতী’। এক আশ্চর্য গণিত-শাস্ত্র। ১৭ বছরের রামানুজন প্রবিষ্ট হল বৈদিক জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, বীজগণিতে। সে ভেদ করল nested radicals-এর রহস্য। বর্গমূলের বর্গমূলের বর্গমূল— এইভাবে ভাঙতে ভাঙতে অনন্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়।
রামানুজন ১৭। তার হাতে এল জর্জ শুব্রিজ কার-এর ‘আ সিনপসিস অফ এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স’। এবং তার চোখের সামনে উঠে গেল একটা পর্দা। তার চেতনায় নতুন সম্পর্ক-সূত্রে যুক্ত হল ‘ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস’ বা অন্তরকলন, ত্রিকোণমিতি, বীজগণিত, সমীকরণ! রামানুজন বুঝতে পারল, কেউ বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছু মিশিয়ে তৈরি হয়েছে গণিতের অথৈ সমুদ্র। সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। নিজের কাছে প্রতিশ্রুত হল ১৭ বছরের রামানুজন।
ঠিক এইসময় ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রামানুজন হাতে পেল এক হারিয়ে যাওয়া বই। ‘লীলাবতী’। ভাস্করাচার্য-র ‘লীলাবতী’। এক আশ্চর্য গণিত-শাস্ত্র। ১৭ বছরের রামানুজন প্রবিষ্ট হল বৈদিক জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, বীজগণিতে। সে ভেদ করল nested radicals-এর রহস্য। বর্গমূলের বর্গমূলের বর্গমূল— এইভাবে ভাঙতে ভাঙতে অনন্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। There is no last number. Only continued fractions— ক্রমানন্বিত ভগ্নাংশ।
১৯১৩। এক বরফ-পড়া জানুয়ারির সকালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গণিতের অধ্যাপক জিএইচ হার্ডির কাছে এল রামানুজনের চিঠি। রামানুজন লিখেছে, সে খুঁজে পেয়েছে সেই সমীকরণ, যা আমাদের পৌঁছে দিতে পারে অনন্তে। সে জানিয়েছে, an equation for me has no meaning unless it expresses a thought of God.
এরপর পাতার পর পাতায় শুধু গণিত। হার্ডি সব বুঝতে পারেন কি? না। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারেন, এই গভীর গণিতের তিনি অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন না, কারণ এই গণিতের পদ্ধতি তাঁর অজানা। তিনি ছুটে যান কেমব্রিজের আর-এক ব্রিলিয়ান্ট গণিতের অধ্যাপক লিটলউডের কাছে । লিটলউড অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন সমীকরণগুলির দিকে। তারপর বলেন, অঙ্ক করেছে ঈশ্বর স্বয়ং। রামানুজন-কে এখুনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি-তে নিয়ে এসো।
হার্ডি বলেন, অসম্ভব, ওর কোনও ডিগ্রি নেই।
লিটলউড বলেন, গণিতের ভগবান, ডিগ্রির দরকার নেই।
শেষ পর্যন্ত সেই অসম্ভব সম্ভব হল। রামানুজন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। এবং বসলেন গণিতের ঈশ্বরের আসনে।
কিন্তু যক্ষ্মা হল তাঁর। ফিরে আসতে হল দেশে। মারা গেলেন ৩২ বছর বয়সে। তাঁর গণিতের নোটবইগুলি আজও কেমব্রিজ-এ সুরক্ষিত। ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি’-র ওপর রিসার্চ চলছে আজও।