অমিতকুমারের থেকে একটা গল্প শুনেছিলাম। ‘পথের পাঁচালী’ তখন রিলিজ করেছে, সে-সময়ে কিশোরকুমার কোনও একটি স্টুডিও থেকে রেকর্ডিং সেরে বেরিয়ে দেখেছিলেন, রাজ কাপুর তাঁর গোটা টিম নিয়ে শুটিং বন্ধ করে বসে আছেন। কিশোরকুমার ‘কী ব্যাপার’ জানতে চাইলে রাজ কাপুর বলেছিলেন, ‘কী আর ছবি বানাব? একজন বাঙালি পরিচালক আমাদের তো একেবারে বোকা বানিয়ে দিলেন!’ এতটাই আলোড়িত করেছিল ওঁকে ‘পথের পাঁচালী’। কিশোরদাকে সরাসরি বলেছিলেন তিনি, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন রায়সাহেব।
এ তো সেই পাঁচের দশকের কথা। এরপর মুম্বইয়ে বেশ কয়েকবার যাতায়াতের সূত্রে বাবার সঙ্গে রাজ কাপুরের একরকমের একটা সখ্য তৈরি হয়ে যায়। এ-কথাও মনে আছে, ‘মেরা নাম জোকার’-এর স্পেশাল স্ক্রিনিংয়ের আয়োজন করেছিলেন রাজ কাপুর। বাবা তখন মুম্বইয়েই, ফলে দেখতেও গিয়েছিলেন সেই ছবি। বাবার খুবই ভাল লেগেছিল, বিশেষত ফার্স্ট হাফটা। তাছাড়াও ‘ববি’ যখন কলকাতায় রিলিজ করে, তখন আমাদের সপরিবার আমন্ত্রণ ছিল সেখানে। আমরা হইহই করে মেট্রো সিনেমায় সেই ছবি দেখেছিলাম। রাজ কাপুরের পরিচালিত ছবি হিসেবে প্রথমে ‘ববি’-ই দেখেছিলাম, তার আগের ছবিগুলো তখন রি-রিলিজ করত। বাড়ির পাশেই মেনকা সিনেমাহলে সেগুলো দেখতে যেতাম আমরা। এত কারিগরি নিপুণতায় ছবিগুলো বানানো, দেখে একটা অদ্ভুত আরাম পাওয়া যেত। এও মনে আছে, বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ির পাশে, এখন যেখানে টাটা টি, সেখানে আগে ছিল রাশিয়ান কনস্যুলেট, সেখানকার মাঠে দেখানো হত নানাবিধ ছবি। আমরা বারান্দা থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে সেসব ছবি দেখতাম। তেমনই একবার, শুনছি রাশিয়ানে সংলাপ চলছে, তারপরেই হয়তো ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ বেজে উঠছে। মানে ছবিটা ডাবড হয়েছে, কিন্তু আদত গানটা রয়ে গেছে।
আমার পরিষ্কার মনে আছে, পৃথ্বীরাজ কাপুর একবার আমাদের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে এসেছিলেন। কাপুর পরিবারের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই থেকেই। রাজ কাপুর অসম্ভব ভাল বাংলা জানতেন, বুঝতেনও। শশী কাপুরের জন্মও কলকাতায়। ফলে কলকাতার সঙ্গে একটা যোগাযোগ ছিলই ওঁদের। তারপরে শাম্মি কাপুরের সঙ্গে বাবার একটা অদ্ভুত যোগাযোগ হয়, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র শুটিংয়ের সময়ে। তখন দার্জিলিংয়েই শাম্মি কাপুরের ‘প্রোফেসর’ ছবির শুটিং চলছে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র শুটিংয়ে কালার স্টক ফুরিয়ে যায়, শাম্মি কাপুর এক কথায় তখন ইস্টম্যানকালার স্টক জোগান দেন। বস্তুত, শাম্মিজির জন্যই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র শুটিং বাজেট ও সময়ের মধ্যে শেষ করা গিয়েছিল। তাছাড়া শশীজি আর জেনিফার কাপুরের সঙ্গে তো খুবই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল তখন। রাজ কাপুর প্রায়শই ফোন করতেন বাবাকে, আমার ছবি তো কলকাতায় রিলিজ করছে, আপনি দেখতে আসবেন তো?
এসবের মাঝে আরও একটা ঘটনা ঘটে। ১৯৬৬ সাল থেকে তো বাবা ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তখন ছবিটা হয়নি। কিন্তু খবরটা কাগজে প্রকাশিত হয়। তাছাড়াও আমার যতদূর মনে হয়, কলকাতার কোনও একটা অনুষ্ঠানে রাজ কাপুর এসেছিলেন। তখন, যেমন হয়, বাবাকে প্রশ্ন করেন পরবর্তী ছবি কী। তখন বাবা জানান, আমারই ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর উপন্যাস নিয়ে একটা মিউজিক্যালের পরিকল্পনা আছে। রাজ কাপুর ঘন-ঘন কলকাতায় আসতেন তখন, মওকা পেলেই চলে আসতেন। সেরকম কোনও একবার, সম্ভবত আমাদের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতেই এসেছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন, হিন্দি ভাষায় এই ছবিটা করুন বাবা, তাতে একটা ওয়াইডার অডিয়েন্সও পাওয়া যাবে। শশী কাপুর গুপির চরিত্র করুন, এটাই ইচ্ছে ছিল তাঁর। বাবা তখন সেই প্রস্তাবে অতটা আগ্রহী হন না। বাবা বলেছিলেন, প্রথমত তিনি হিন্দিতে ছবি করতে চান না। দ্বিতীয়ত, এই গল্পটার মধ্যে এমনই একটা বাঙালিয়ানা রয়েছে, যা হিন্দিতে ধরা যাবে না। ফলে কথা রাখতে পারবেন না।
১৯৮৭ সালে কিশোরকুমারের প্রয়াণের পরের বছর, কিশোরদাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র করেছিলাম আমি। তখন চেয়েছিলাম শাম্মি কাপুর কিছু বলুন কিশোরকুমারকে নিয়ে, এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শাম্মিজি তখন সততই স্বামীজি, দাড়ি ইত্যাদি মিলিয়ে। ঋষি কাপুর, রণধীর কাপুরের সঙ্গেও সেই সম্পর্কটা আমাদের থেকে গিয়েছিল। অনেক পরে, যখন মুম্বইয়ে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-র শুটিং করতে যাই, তখন আর কে স্টুডিওজের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছিলেন ওঁরা। বাবা যখন অসুস্থ, তখন শশীজি কলকাতায় এসে বেলভিউতে বাবাকে দেখেও গিয়েছেন।
দ্য গ্রেটেস্ট শো-ম্যান হিসেবে তিনি পরিচিত তো বটেই, একইসঙ্গে পরিচালক হিসেবে ওঁর মুনশিয়ানা ছিল প্রশ্নাতীত। বাবা-র কাছে পরিচালক রাজ কাপুর হয়তো একটু এগিয়েই ছিলেন। অস্বীকার করে লাভ নেই, আমারও খুব প্রিয় পরিচালকদের একজন রাজ কাপুর।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)