আমি, অনির্বাণ আর এগ চাউমিন
আমি আর অনির্বাণ, অনির্বাণ আর আমি, অর্থাৎ আমরা চারজন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে লাইন ধার চেয়ে ‘নিখিলেশ’-কে সরিয়ে অনির্বাণকে আমি বসাতেই পারি, তার সঙ্গে এমনই দিনরাত কাটত আমার। এ-কথা ঠিক যে, পাঁচের দশকের কবিবন্ধুদের মধ্যেকার দামালপনা আমাদের সময়ে অনেকটাই মিইয়ে এসেছে, যেটুকু পড়ে আছে, তার বেশিরভাগটাই যাপন নয়, যাপনের অনুকরণ। আমার মধ্যে যেহেতু কবিতা লেখা নিয়ে একটা শঙ্কা বা সংশয় চিরকালই ছিল, নিজেকে কবি বলে জাহির করাটা ধাতে ছিল না। অনির্বাণও লিখত কবিতা, আমি একশোটা লিখলে ও একটা। সেসব লেখা পড়ে শোনানো চলত, হয় আমাদের বাড়ির কোনও একটা ঘরে, নয়তো অনির্বাণদের বারান্দায়। আমাদের কবিতাযাপন বলতে ছিল কেবল এই। সুনীল-শক্তির ওই আগুনখেকো রাংতা ওড়ানো দিনকাল আমরা কেবল দূর থেকে দেখতাম, দেখতাম জয়-সুবোধের রাণাঘাট আর কৃষ্ণনগর, সে-ও দূর থেকে। আমাদের কেবল ছিল পড়ন্ত আর মধ্যবিত্ত দক্ষিণ কলকাতার পাড়াতুতো কিছু সন্ধে, যারা জানত আমাদের কবিতার কথা। আর জানত আমাদের লাজুক স্বভাবও।
তা আমরা করতাম কী, স্কুল থেকে ফেরার পর, হপ্তায় এক কি দু’দিন নিজেদের আড্ডায় বসতাম। কিছুই না, মুড়িমাখা আর চা সহযোগে নিজেদের কাঁচা হাতের কবিতা একে অপরকে পড়ে শোনানো। আমাদের দু’বাড়িতেই মুড়িটা মাখা হত জম্পেশ করে। সে-সময়ে অবশ্য বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বাড়িতে মুড়িমাখাই ছিল সান্ধ্য-জলখাবার। তার পরে কত দশক পার করে এসেছি, দুনিয়া বদলে গেছে কতদূর, ওই এক সন্ধেবেলা মুড়ি খাবার অভ্যেসটা আজও ছাড়তে পারলাম না। সে যা হোক, কবিতা সহযোগে চা ও মুড়ি চলত। কিন্তু যে-কারণে এই গপ্পো ফাঁদা, সে তো নিজেদের কাব্যকীর্তির গুণগান করবার জন্য নয়, বরং আমরাও যে কখনও পাঁচের দশকের মতো, যাকে বলে, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ হয়ে উঠতাম, সেইটা বলবার জন্য। সেই উচ্ছৃঙ্খলতা কী? না, মুড়ি রিফিউজ করে, চাউমিন খেতে রাস্তায় নামা।
অনির্বাণদের বাড়ি ছিল বাঁশদ্রোণীতে। ছিল কেন, এখনও আছে। আমরাই পুরনো পাড়া থেকে বদলি হয়ে চলে এসেছি অন্যত্র। যাই হোক, বাঁশদ্রোণী মোড় থেকে কিছুটা ঢুকে এসে আদিগঙ্গার উপরকার পুল পেরিয়ে একটু ডানদিক ঘুরলেই ওদের অনেকদিনকার আস্তানা। শহরের মধ্যিখানে হলেও বেশ নিরিবিলি পাড়া। মনে রাখতে হবে, তখনও বিশ্বায়ন হয়নি, ইন্টারনেট আসেনি। ফলে বাড়িতে বসে ফোনে অর্ডার দিয়ে খাবার আনিয়ে খাওয়া ব্যাপারটা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসে থাকলেও, জীবনে নেই। তা ছাড়া সারা পৃথিবীর নামিদামি যেসব খাবারের ব্র্যান্ড, তাদেরও এ-দেশে বা এ-শহরে কোনও অস্তিত্ব নেই। গ্লোবাল বলতে শুধু চিন্তাভাবনা, খাদ্য সবই অতি-লোকাল।
এক-একদিন, যেদিন নিজেদের কবিতা শুনে নিজেদেরই মনে হত, বাহ্! বেড়ে হয়েছে! সেসব দিনে আমরা ঠিক করতাম বিলাসিতা করব। পয়সা ওড়াব। বাবু হব। উচ্ছৃঙ্খল তো হতেই হবে। তা এসব একসঙ্গে কীভাবে হওয়া যায়? কেন? সহজ সমাধান। ব্রিজ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে বাঁশদ্রোণী বাজারে গিয়ে চাউমিন কিনে খাওয়া। এর চেয়ে বড় বাবুগিরি আর হয় না কি? অন্তত আমাদের জীবনে ছিল না।
বেরিয়ে পড়তাম দুজন মিলে। তার আগে দেখে নিতে হত, দুজনের পকেটে হাতখরচ মিলিয়ে এক প্লেট চাউমিন খাবার রেস্ত আছে কি না। আমার পকেটে তার একটু বেশিই থাকতে হবে, কেননা আমাকে অটো ধরে বাড়ি ফিরতে হত। হিসেব মিলে গেলে আমরা ‘কুছ পরোয়া নেহি’ ভাব মুখে টাঙিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বাজারের উদ্দেশে, চাউমিন খাব বলে। এক প্লেট এগ চাউমিন কিনে দুজনে ভাগ করে খাওয়া। চিকেন চাউমিনের সংগতি আমরা কল্পনাতেও আনতে পারতাম না, কিন্তু একেবারে ভেজ চাউমিন খেলে পরে আত্মজীবনীতে লিখতে লজ্জা লাগবে বলে এগ অর্ডার করতাম। এই স্বপ্ন চোখে নিয়ে রাস্তায় নামার পর নিজেদের শাহেনশাহ মনে হত, যেন সন্ধেবেলা ছদ্মবেশে সাম্রাজ্য পরিদর্শনে বেরিয়েছেন দুজন।
বাঁশদ্রোণী বাজারে ঢুকে, লোকজনের বেমক্কা ভিড়, সবজির ঠেলা, মাছের পাটাতন, মুরগির খাঁচা পেরিয়ে এক কোণে সেই মহার্ঘ ‘স্ন্যাক্স বার’। কথাটা তখন খুব চালু ছিল। চারটে ছোট চাকার ওপর দাঁড় করানো চলমান ঠেলাগাড়িতে একপাশে স্টোভে তাওয়া চাপানো, অন্যদিকে থরে-থরে খাওয়ার সরঞ্জাম। দূর থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ আর ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ। এই হচ্ছে স্ন্যাক্স বারের রাজকীয়তা। অনির্বাণদের পাড়ায় যে-ভদ্রলোক এই ঠেলার মালিক ছিলেন, তাঁর মতন গম্ভীর ও ব্যস্ত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। একা হাতেই সামনের ভিড় সামলাচ্ছেন, হরেক খদ্দেরের আলাদা রকমের অর্ডার নিমেষে বানিয়ে গরমাগরম হাতে তুলে দিচ্ছেন। টাকাপয়সার লেনাদেনাও চলছে তারই মাঝে।
ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি বলতে ছোটবেলায় আমি এসব লোকজনকেই বুঝতাম। তা সেই ওয়ান ম্যানের দোকানের সামনে গিয়ে আমরা একটু পিছন দিকে দাঁড়াতাম। সামনের দিকে সম্পন্ন খদ্দেরদের জমায়েত, যাঁরা একজনের জন্য এক প্লেট চাউ বা একটা গোটা রোল কিনতে পারে। আমাদের সেই পেট বা পকেট, কোনওটাই নেই। সে-কথা দোকানদার ভদ্রলোকও জানতেন, কেননা আমরা বেশ কিছুদিন যাবৎ মাঝেমধ্যেই তাঁর দোকানে আসছি। সামনের দিকটা একটু হালকা হলে তাওয়ার কানায় খুন্তি দিয়ে একখানা ‘টং টং’ ধ্বনি তুলে আমাদের দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বলতেন, ‘কী, এক প্লেট এগ চাউ?’ আমরা নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে তিনি তাঁর হাতের ম্যাজিক শুরু করতেন। একটা ফাঁকা তাওয়া কীভাবে একের পর এক উপাদানের মিশ্রণে টাটকা এগ চাউমিন হয়ে উঠত, এ-জিনিস পাহাড়ের বুকে সূর্যোদয়ের চেয়ে কিছু কম বিস্ময়কর ছিল না, অন্তত আমার কাছে।
যেটা মজার ব্যাপার, তৈরি হয়ে গেলে ব্যাপারটা ‘সার্ভ’ করা হত একটা তোবড়ানো স্টিলের গোলাকৃতি প্লেটে, উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হত কিছু কুচো শসা আর পেঁয়াজ, তার ওপর রগরগে টম্যাটো সস আর ঝালঝাল চিলি সসের কয়েক বিন্দু স্পর্শ এবং চাউমিনের উলের জঙ্গলে একটি হারানো কাঁটা গুঁজে দেওয়া। আমরা প্রতিবারই খুব আমতা-আমতা করে আর একটা কাঁটা চেয়ে নিতাম, কেননা এক প্লেটের জন্য দুটো কাঁটা বরাদ্দ করাটা নেহাতই বিলাসিতা ওঁর পক্ষে, সেটাও বুঝতাম।
যা বলার জন্য এত কিছু লেখা, তা হল এই যে, আমাদের এই ছোট-ছোট ঘুপচি তেলচিটে স্ন্যাক্স বারগুলো ছাড়া, পৃথিবীর আর কোনও তাবড় রেস্তোরাঁরও ক্ষমতা নেই ওই স্বাদ এনে দিতে পারে পাঁচ টাকার চাউমিনে (তখন ওরকমই দাম ছিল)। কারও সাহসও হবে না তার ওপর শসা-পেঁয়াজ ছড়িয়ে নিজের মর্জিমতো সস ঢেলে দেবার। এর জন্য কলিজা চাই, প্রেম চাই, বেপরোয়াপনা চাই। ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে, আশেপাশের ভিড়ের ধাক্কা সামলে আমরা দুজন বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একই প্লেট থেকে এগ চাউ ভাগ করে যে-স্বাদ লুটেপুটে খেয়েছি, তা আর পরে পাইনি। পাবার কথাও নয়। কেননা সামর্থ্য সব কিনতে পারে। ছোটবেলা ছাড়া।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র