ভূতেশ – ৩
ডালহৌসি অঞ্চলে যাতায়াত করার অভ্যাসটা বেশ রপ্ত করে ফেলল ভূতেশ। মাস খানেকের বেশি হয়ে গেল সোদপুর-কলকাতায় তার এই নিত্য যাতায়াত। শিয়ালদা থেকে হেঁটেই সে চলে আসে আরও অনেকের সঙ্গে পায়ে পায়ে। লালবাজার পুলিশ-চৌকির পাশের বাড়িটাই তো তার অফিস। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের এই লালবাড়িটাকে সবাই রাইটার্স বলে। এ সব অঞ্চলের বেশির ভাগ রাস্তাই সাহেবদের নামে। তার মধ্যেই অবশ্য রয়ে গেছে ‘কুলিবাজার’, ‘খেংরাপট্টি’, ‘ছাতাওয়ালা গলি’, ‘হাড়কাটা গলি’। ভূতেশ মনে মনে তারিফ করে ভাবে, যদুবাবু, ছাতুবাবু, লাটুবাবু এসব নামের জায়গা বা রাস্তাঘাটের থেকে ঢের ঢের ভাল নাম হল, অফিসের হাতায় থাকা এই হেস্টিংস স্ট্রিট, লায়ন্স রেঞ্জ, ডেকারস্ লেন, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট এবং ডালহৌসি। তেমনই ভূতেশের ভাল লাগে ‘বাজার’ আর ‘মার্কেটের’ তফাতটাও। রাধাবাজার, বড়বাজার, রাজাবাজার– এসবের বদলে ‘হগ মার্কেট’; বাবার কাছে কথায় কথায় ভূতেশ জেনেছে যে, অনেক আগে তার এই অফিস পাড়ার নাম ছিল, ‘ট্যাঙ্ক স্কোয়ার’। সামনের ওই পুকুরটার জন্যই এই নাম; পরে রাইটার্স, বাড়িটার লাল ছায়া পড়ে থাকায় এর নাম হয় লালদিঘি; আর ডালহৌসি সাহেব এই অঞ্চলে থাকার সুবাদে এর নাম হয় ‘ডালহৌসি স্কোয়ার’। ডালহৌসি স্কোয়ারটাই তাক লাগিয়ে দিয়েছে ভূতেশকে; প্রশাসনের সুবিধের জন্য একই অঞ্চলে কেমন অফিস, আদালত, পোস্ট অফিস এবং থানা! আবার তাদের নিজেদের পছন্দের রেসকোর্সও! সাধে কী আর এই অঞ্চলটা বানিয়ে সাহেবরা এর নাম দেয় ‘হোয়াইট টাউন’! সাহেবসুবোদের দোকানগুলোর সাইন বোর্ড পড়তে পড়তেই ভূতেশ বুঝতে পারে যে, সাহেবরা ঠিক কী কী জিনিস হাতের কাছে পেতে চায়। ঘড়ি, জুয়েলারির মতোই পছন্দ করে নিজেদের ফটো তুলতে। ‘Bourne and Shepherd’; এরা বলে স্টুডিয়ো। এমন সব দোকান দেখতে দেখতে তার মনেও একটু-আধটু লোভ হয়; টুক করে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে যে করে না, তা-ও নয়। মনে মনে ভাবে, কলকাতার বাইরে শহরতলিতে পোস্টিং হওয়ার আগে, কেনাকাটার এসব সুবিধাগুলো কিছুটা অন্তত জেনে নিতেই হবে। হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়াতেই ভূতেশের খেয়াল হল যে, রাস্তাঘাটের স্থানীয় নাম বদলে নিজেদের পছন্দমতো সাহেবি নাম বসালেও, গঙ্গার নামটা কিন্তু পুরো বদলায়নি; যুক্তাক্ষরটা জিভে ভাল আসে না বলে ‘গ্যাঞ্জেস’ করে নিয়েছে। খিদিরপুর ডক থেকে মস্ত মস্ত জাহাজ বেরিয়ে ভেসে চলেছে সাগর পাড়ি দিতে। জাহাজ আসতে দেখলেই ঢেউ খাবার ভয়ে, একটু একপাশ হয়ে পাড় ঘেঁষে চলতে থাকে ডিঙি নৌকোগুলো। কথায় কথায় বড়বাবুর কাছে এ কথা শুনে আরও মজা লেগেছে ভূতেশের যে, রাজভবনের পিছনে, এক কালে নাকি একটা কাঁদরও ছিল; যার নাম হয়েছিল ‘হেস্টিংস নদী’। বউবাজার এলাকা থেকে তার অফিসের দিকে এগোলেই যে টেরিটি বাজার, সেখানে আবার চিনেরা থাকে। বাঁ দিক ঘেঁষে আরও একটু পুব দিকে গেলেই মুসলমান বসতি। বৌদ্ধ মন্দির, ফিরিঙ্গি কালীমন্দির এবং মসজিদ— এ সবই বেশ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। সেইসঙ্গে আছে বেশ কিছু চার্চও। পুকুরে পুকুরে ছয়লাপ এই অঞ্চলটায় এত মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মের মন্দির থাকার জন্যই কি এ জায়গাটার নাম ধর্ম-তালাও !
খবর-পড়ুয়া ভূতেশ বেশ গর্বের সঙ্গেই ভাবে যে, এই ইংরেজরা জাত বটে একটা! শুধু যে মুসলমান শাসনকে পর্যুদস্ত করল তা-ই নয়, ফরাসি, ওলন্দাজদেরও কেমন তাড়িয়ে দিল! এখন যে দিকেই তাকাও শুধু ইংরেজ আর ইংরেজি। এ দেশের মানুষরা একজোট হয়ে যেটা পারল না, সেটাই করে দেখাল ইংরেজরা। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে এই যে ইউনিফিকেশন ঘটল, এর জন্য কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবে, না ‘বন্দে মাতরম’ হেঁকে, এই কর্মবীর সাহেবদের ‘বিদেশী’ বলে দেগে দিচ্ছে; রীতিমতো চড়াও হয়ে, তাদের সব কিছুকে বয়কট করার ডাক দিয়েছে! তবে ভূতেশের দৃঢ় বিশ্বাস যে এদেরও অচিরেই পেড়ে ফেলবে এই ধুরন্ধর ইংরেজ। মনে মনে আউড়ে নিল, স্বদেশিদের সম্পর্কে কার্জনের সেই উক্তি ‘Incapable of setting the fire on Ganges’!
একই সঙ্গে ভূতেশের বুক ফুলে উঠল এই ভেবে যে, এ হেন ইংরেজ সরকারের অধীনে সে একটা চাকরি পেয়ে গেল, একেবারে অ্যাকাউন্টস দপ্তরে! আর্মিদের প্রয়োজনে লাগে এমন সব জিনিসপত্র জোগানের কেনাবেচার হিসেব রাখতে হবে তাকে। খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিতে হবে যে, এই হিসেব রাখা ব্যাপারটা ঠিক কী। বড়বাবু বলেছেন যে, সব হিসেবের অডিট হবে। সেই অডিট-অ্যাকাউন্টস নাকি বড়সাহেবের খাস দপ্তর খুঁটিয়ে পড়ে, নোট দেয়; তারপর আসল সাহেবের নজরদারিতে পাশ হয়ে, তবে তার ওপর ছাপ্পা পড়বে ‘আপ্রুভড’। ফলে ভূতেশ আপাতত মরিয়া হয়ে উঠেছে, ‘অ্যাকাউন্টস’ ব্যাপারটাই আগাপাশতলা বুঝে নিতে। ভূতেশের মনে আছে এক রবিবার নিশানাথ আর তার দুজনেরই অফিস ছুটি থাকায়, পেনিটির গঙ্গার পাড়ে বসে তাদের সেই আলোচনাটা।
‘এই যে কটাভুতো! কী ব্যাপার! চাকরি পেয়েই যে একেবারে ডুমুরের ফুল!’
‘কোথায়? বিকেলবেলা তোকে বেরোতে দেখেই, তো বেরিয়ে এলাম!’
‘পোস্টিং পেয়েছিস? কোথায় হল!’
‘না, এখনও এ্যাপ্রেন্টিস হয়ে কাজই শিখে চলেছি।’
‘হাতে ধরে শেখায় নাকি? আমাদের সেকশনে তো কাজ দিয়েই ভুল ধরতে শুরু করে।’
‘দপ্তরের বড়বাবু তার সামনের টেবিলে বসতে দিয়েছেন; উনি কাজ করেন আর আমি দেখি।’
‘বাহ্! তাহলে তো তোর পোয়াবারো ‘রে! টিফিন? সেটাও কি একসঙ্গে বসে!’
‘তা কেন! একঘণ্টা ছাড়। তবে মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমি এসে যাই।
‘তোর অফিসের পিছনে তো কেনা খাবারের রাজত্ব; চা খেয়েছিস ডেকারস্ লেনে!’
‘খেয়েছি; মানে ওটাই খাই। তার সঙ্গে স্যাঁকা পাউরুটি আর ডিম; ওমলেট বা বয়েল্ড।’
‘ভাগ্যিস চাকরি পেয়ে কলকাতা চিনলাম! না হলে তো সেই চিঁড়ে, মুড়ি আর চালভাজা।’
‘আমার অবশ্য নারকেল কোরা দিয়ে ঘি-মুড়ি খেতে ভালই লাগে।’
‘তুই হলি কনভারটেড ব্রিটিশ; ওই কোট পরলেই গাঞ্জেস; কিন্তু আসলে বাবা-গঙ্গা।’
‘কেন ‘ফ্যান্সি লেন’! সেটাও তো আসলে ‘ফাঁসি’; কিন্তু হয়ে গেল ‘ফ্যান্সি’!’
‘তবে একটা কথা মনে রাখিস যে, তোর ওই ডিপার্টমেন্ট কিন্তু পুকুরচুরির জায়গা।’
‘জানি; অনেক নেটিভই এর আগে চাকরিও খুইয়েছে। ওই জন্যই নেটিভদের দেয়; ইনকম্পিটেন্সের কারণে চাকরি গেলে শোরগোল হবে না; সাহেবের চাকরি গেলে, কমন্স সভা অবধিও দৌড় হতে পারে!’
২
সন্ধে লেগে গেছে; এ দিকটায় সাধারণ মানুষের বাস কম; লোকালয় নেই বলেই হয়তো বড় বড় বাগানবাড়ি। বাবু, জমিদার, দেওয়ান— এদেরই সম্পত্তি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে, ভেতরটা কত বড়! তবে, দারোয়ান-চাকর-খানসামা এদেরই রাজত্ব। আর আছে মালি; সারাদিন গাছ সাজিয়ে-সাজিয়ে, ফুল ফুটিয়েই চলেছে। অনেক বাড়িতে ময়ূর, ধনেশ, কাকাতুয়া এসবও আছে; কিছু ছাড়া, কিছু দাঁড়ে বাঁধা। ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শৌখিন নিশানাথ সেসবে চোখ বোলালেও, ভূতেশের ওসবে কোনও আকর্ষণই নেই। দুজনের যে একটাই ‘কমন’ নেশা, তা হল থেকে থেকেই এক টিপ নস্যি। নিজেদের পকেট থেকে রুপোর ছোট্ট ছোট্ট ডিবে বের করে, তা থেকে এক টিপ করে নিয়ে যে যার নাকে গুঁজে এবং নাক ডলে উঠে পড়ল তারা। নিশানাথ খেয়াল করল যে, ভুতোর দু-পকেটে দুটো আলাদা আলাদা রুমাল। যেটাতে লাল লাল দাগ, সেটা বার করে নাক থেকে গড়ানো নস্যিটা মুছে ওই পকেটেই রেখে দিল; এরপর প্যান্টের অন্যদিকের পকেট থেকে যেটা বার করল সেটায় কোনও দাগ নেই; ওটা দিয়েই নস্যি লাগা আঙুলগুলো মুছে নিল ভূতেশ। নিশানাথ যে খেয়াল করেছে সেটা বুঝেই, বেশ মজা পেল ভূতেশ। কেউ কোনও কথা না বলে, যে যার মতো হাঁটা লাগাল নিজেদের বাড়ির দিকে। নিশানাথের বাড়ির পরে, আরও কিছুটা হেঁটেই ভূতেশদের বাড়ি। দূর থেকে ভূতেশ দেখতে পেল যে, কৃপানাথের থানে প্রদীপ দেখিয়ে, ছোটখুকি এবার এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের গোয়ালঘরের দিকে আলো দেখাতে।
গোয়ালঘরের কথাটা মনে আসতেই মুখের ভেতরটা যেন বিস্বাদ হয়ে গেল। এই গোয়ালঘরটাই হয়েছে জয়নারায়ণ আর বড়খুকির গুজগুজ-ফুসফুসের জায়গা। বিকেলবেলা বাড়ির মধ্যেই উঠোনে বসে বড়খুকি যখন চুল বেঁধে দেয় পাড়ার মেয়েদের বা মায়ের ঘরে বসে মা-কে নভেল পড়ে শোনায়, তখন তার একেবারে অন্য রূপ; কিন্তু জয়নারায়ণের সঙ্গে কথাবার্তার সময় সে যেন একেবারে এক টগবগে কিশোরী। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে ঢুকলেও, জয়নারায়ণের পায়ের শব্দ সে ঠিক শুনতে পায়। আর এত ফিসফিস স্বরে বলা-কওয়া করে যে, সেসব কথা তারা দুজন ছাড়া আর কারোর কানে যাবার উপায় নেই। ওদের মধ্যে কাগজ আর বইপত্রের এত যে কিসের চালাচালি তা শুধু ওরা-ই জানে। যে একটা ব্যাপারেই ভূতেশ একটু দম ফেলতে পেরেছে তা হল, হরশঙ্করের গা-ঢাকা দেওয়াটা। চোখের ওপর যে হরুকে আর দেখতে হয় না, এটাই এক বড় শান্তি। হরশঙ্করের কথা ভাবতেই একটু হাসিও পেল ভূতেশের। না সে ভাল চাকরি জোটাতে পারবে, না হতে পারবে দাঙ্গাবাজ বিপ্লবী! এমন দোআঁশলা বুদ্ধির জোরে নিজেই তাই নিজেকে বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে, গা ঢাকা দিয়েছে; ভূতেশের মনে হল যে হরু শুধু হতচ্ছাড়াই নয়, ধূর্ত এবং কুঁড়েও। তার দৌড়ও তাই, কুয়োর ব্যাং ওই জয়নারায়ণ এবং বড়খুকি অবধিই। হরশঙ্করের ভবিষ্যৎ যে একেবারেই অন্ধকার এ কথা ভেবেই বেশ আরাম পেল ভূতেশ। সেইসঙ্গে এ-ও বুঝল যে, নিশানাথের উন্নতিরও আশা কম। যে চাকরিটা একবার নিশা পেয়ে গেছে, সেখানেই কোনও রকমে টিকে গেলেই সে খুশি। আর তা ছাড়াও নিশা জানে যে, সংসার টানার কোনও তো হ্যাপাই নেই তার ওপর! নিশানাথ যে বেজায় সাবধানী, আরও একবার আজ সেটা বুঝতে পারল ভূতেশ; কারণ, কোনও প্রসঙ্গেই সে না তুলল তার দাদা হরশঙ্করের কথা, না একটা কথা বলল তনুদার বিষয়েও। ভূতেশও কৌতূহল চেপে রেখে, তাকে কিন্তু একটাও প্রশ্ন করল না সদ্য ঘটে যাওয়া তনুদার বিয়ের ব্যাপারে।
বাড়ি ফেরাটা এখন বেশ অন্য রকম হয়ে গেছে। অফিস থেকে ফেরা বা ছুটির দিন পাড়া থেকে বেড়িয়ে ফেরা, সে যেখান থেকেই হোক না কেন, ঘরে পা রাখা মাত্র সবাই বেশ তটস্থ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে এক ঘটি জল, ‘কিছু খাবে কি না’- এমন প্রশ্ন, পা ধোয়ার পর পা মোছার গামছাটাও হাতের কাছে এগিয়ে দেওয়া— এমন সব নানা আদিখ্যেতা। মনে হয় মায়ের নির্দেশেই এসব। তবে একটা ভাল এই যে, ছোটখুকির বরের ওই যখন-তখন এ বাড়িতে এসে, শুয়ে-বসে কাটানোটা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে; সেটা ভাল না খারাপ ভূতেশ বোঝে না; তবে দিনের পর দিন, বাড়তি একজনের গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াটা অন্তত কমেছে। ছোটখুকি অবশ্য আবার গর্ভবতী। বড়বউ এখন আবার এক নতুন পথ ধরেছে। রাতে খাওয়ার আগে তেল মালিশ; পেতলের বাটিতে রসুন তেল এনে ভূতেশের ঘাড়ে, কাঁধে, পিঠে নরম মালিশ; মাঝরাতে তার ঘরে বড়বউয়ের ওই হানা দেওয়াটা যে তা বলে কমেছে, তা কিন্তু মোটেই নয়; মালিশটা প্রকাশ্যে যত্ন, আর মাঝরাতে আসাটা তার সুখভোগের দাবি; ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছে ভূতেশ, কিন্তু এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসবার কোনও সংগত যুক্তিও তো সে খুঁজে পায়নি। আর এমনটা যে এ পৃথিবীতে এই প্রথম ঘটছে তা-ও তো নয়! তবে তার ক্ষেত্রে একটাই যা ব্যতিক্রম তা হল, ফাঁক-ফোকরের ইশারায় ছোটজামাই অবরে সবরে থাকলেও, এ বাড়িতে হাতের কাছে সে বই আর দ্বিতীয় পুরুষ নেই!
৩
লর্ড কার্জন থাকতেই, এ দেশে এসে পড়েছিলেন লর্ড কিচনার। এই যুদ্ধবাজ লোকটা বিয়ে–থা করেনি। কার্জনের মতো নানা দিক নিয়ে সে ভাবতেও চায় না। আর্মি প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতেই সে এসেছে। ফলে সে চায়, আর্মিকে এক স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে হাতে পেতে। কার্জনই বা ছাড়বে কেন! সিভিলিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তার তাঁবেই রাখবে সে। কিচনার ছক কষছে, কার্জনকে হটিয়ে ভাইসরয় হয়ে বসবার। বেঙ্গল পার্টিশন এবং তিব্বত মিশন— এ দুটো ক্ষেত্রেই কার্জন-পলিসিতে খুশি নয় রাজা-সহ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট; তাতে আবার ধুয়ো দিয়েছে দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তাদের বয়কট নীতি। যদিও এখানকার ইংরেজি সংবাদপত্র এবং সরকারি বুলেটিন সেসব খবর খুব সাবধানেই উল্লেখ করেছে; বাকিটা ভূতেশের একাগ্র মনোযোগ এবং নিজস্ব বিচারবোধ; আর বাকিটা বড়বাবুর কথা থেকে অনুমান। অচিরেই ভূতেশ জানল যে, লর্ড সভার কনজারভেটিভ দলের সদস্য লর্ড কার্জনের ইস্তফাপত্র গ্রহণ করলেও, ধুরন্ধর ব্রিটিশ প্রশাসন কিন্তু ভাইসরয় হিসেবে কিচনারের নামও মনে আনেনি। নতুন ভাইসরয় হিসেবে এসেছে লর্ড মিন্টো। এ-ও আর এক যুদ্ধবাজ, তবে রাজনীতিটা বোঝে এবং কেম্ব্রিজ-পাশ শিক্ষিতও বটে। এর আগে সে ছিল কানাডার গভর্নর জেনারেল। মাথাটা ঠান্ডা কারণ, এই লোকটার দাদু প্রথম মিন্টো ছিল গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া। ১৮০৭-১৮১৩ পর্যন্ত এ দেশটাকে শাসন করার সঙ্গে তার দাদু জুড়ে ছিল এক সর্বময় কর্তা হিসেবে। ফলে এই ‘ইন্ডিয়া’ দেশটার চালচলন সম্পর্কে তার যে বেশ জবরদস্ত জ্ঞানগম্যি থাকবে, এমনটাই ভূতেশের ধারণা। ভূতেশ বেশ বুঝতে পারল যে, তার কৌতূহল এবং ধ্যান এবার কার্জন থেকে সরিয়ে মিন্টোতে নিয়ে যেতে হবে। একদিকে যেমন স্বদেশিদের দিকে হেললেই বিপদ, তেমনই শিরে সংক্রান্তি, ভুলেও কার্জন বা তার নীতির প্রতি কোনও দুর্বলতা দেখিয়ে ফেললে। কার্জন-কিচনার-মিন্টো এই পুরো ব্যাপারটাই হল রাজায় রাজায় যুদ্ধ; ফলে তার মতো উলুখাগড়াদের প্রাণ গেলে কার লাভ!
ছুটির পর অফিস থেকে বেরিয়ে ভূতেশ এসে ঢুকল ‘Army and Navy Stores’-এ। ঘটা করে উদ্বোধন হবার সময়ে সে অতটা খেয়াল করেনি। ১৯০১ সাল নাগাদ এই দোকানটা হয়েছে, আর্মির সাহেব-কর্তাদের উদ্যোগেই। বড়বাবুর কাছে হদিশ জেনে নিয়ে, আগেও দু-একবার সে ঢুঁ মেরেছে এখানে। আজ ভূতেশ এসেছে নিজের জন্য একটা কোট এবং রিস্টওয়াচ কিনতে। এর আগে সে ঘুরে এসেছে ‘Whiteway, Laidlaw and Co’ নামের এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটায়; কী না পাওয়া যায় সেখানে! এসপ্ল্যানেড যেতে বাঁ দিকের কর্নার প্লটের ওপর ‘Macintosh Burn & Co’ নামে কন্ট্রাক্টটারদের করা এ বাড়িটাও দেখবার মতো। এখানেও বসানো আছে একটা মস্ত ঘড়ি। সাহেবরা ছাড়াও বিত্তবান বাঙালি বাবুরাও এসব দোকানেই আসে। ঝকঝকে চেহারার সুপুরুষ ভূতেশকে দেখেও সেই গোত্রের বলেই মনে হয়।
লালবাজারের পিছনেই, ঘড়ি কেনা-বেচার আড়ত, রাধাবাজারে গিয়েও দরদাম করে এসেছে ভূতেশ; কিন্তু বড়বাবুর কথা অনুযায়ী ‘Army and Navy Stores’-এর দিকেই এগোল ভূতেশ। কেতা ছাড়াও, দামও নাকি কিছু কম। তার ওপর অল্পদিন হয়েছে তো! তবে এ দোকানটা পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে আর একটু এগিয়ে। রাস্তার ওপরেই মস্ত একটা দোতলা লাল বাড়ি। অনেক দেখেশুনে সে একটা Favre Leuba সুইস ঘড়ি কিনল। বাবার কোমরে একটা ট্যাঁক ঘড়ি থাকে। এই প্রথম রিস্টওয়াচ কিনল কেউ তাদের বাড়িতে। কয়েকবার নাড়াচাড়া করেও তুলনায় দাম বেশি Omega কোম্পানির ঘড়িটা সরিয়েই রাখল ভূতেশ; তার ডানহাতের কটা রং, নির্লোম হেড়ো কবজিতে কালো ব্যান্ডের সাদা ঘড়িটা দেখে তারিফ করল অ্যাংলো সেলসম্যান। অর্ডার দেওয়া টুইলের কোটটাও একই সঙ্গে ডেলিভারি নিয়ে, দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এল ভূতেশ। আজ তার ইচ্ছে হল পায়ে হেঁটে না গিয়ে, ঘোড়ার গাড়ি চড়ে শেয়ালদায় পৌঁছতে। ভূতেশকে সাহেব জাতের মনে করে, বাবু না বলে ‘সাহাব’ সম্বোধন করল সহিস। টকাস করে গাড়িতে উঠেই, একটিপ নস্যি নিয়ে আরাম করে হেলান দিয়ে বসল ভূতেশ। এই প্রথম ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দের সঙ্গে, টিক টিক করে তাল মেলাতে লাগল তার নিজস্ব হাতঘড়ি এবং হৃৎপিণ্ডও।
৪
ছাদে খানিক পায়চারি করে, একটু ভারী রাতেই শুতে এল ভূতেশ; এই ভেবে কিছুটা হয়তো নিশ্চিন্তও ছিল যে, ভূতেশের দেরি দেখে বড়বউ বোধহয় সে রাতে আর তার ঘরে আসবে না। কিন্তু অন্ধকার ঘরে নিচু করা লণ্ঠনের পলতেতে যে সামান্য আলো, তাতেই সে দেখতে পেল অদ্ভুত এক দৃশ্য। বড়বউকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল ভূতেশ; তার সাদা থানের ওপর হ্যাঙারে ঝোলানো ভূতেশের সেই নতুন কালো-রঙা কোটখানি গায়ে চড়িয়ে, বাঁ হাতের কবজিতে ঘড়ি এঁটে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, একটা কোণে ঘর জাগিয়ে বসে আছে বড়বউ। ভূতেশকে দেখে সে বলল, ‘আমার কর্তার তো এসব আর পরা হল না; তাই তোমারগুলো গায়ে চড়িয়েই তার স্বাদ মেটাচ্ছি’
‘দাদার শখ ছিল! নাকি আমার জিনিসের ওপর অধিকার ফলিয়ে তুমি নিজের সাধ মেটাচ্ছ?’
‘সেটা তো বটেই; তোমার আনা খেলনাপাতিগুলো তো সব আমারই; আমিই তো গুছিয়ে রাখি!’
‘আমি নিজেই পারি; সকলের সামনে তোমাকে ছোট করতে চাই না বলে নিষেধ করি না!’
‘বলো না গো, কেমন দেখাচ্ছে আমাকে? মেম যেন মনে হচ্ছে না!’
গায়ের জামাটা না খুলেই পা দুখানা লম্বা করে, অন্যদিকে ফিরে শুলো ভূতেশ। বিধবা বউদির চুড়িবিহীন হাতে, নড়াচড়ার টুংটাং শব্দ না হলেও ভূতেশ বুঝল যে, কোট এবং ঘড়ি— এ দুটোই গা থেকে খুলে, জায়গা মতো রেখে দিয়ে, ভুতেশের ঘর থেকে আজ রাতের মতো বেরিয়ে গেল বউদি; বড়বউদির সেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা ঠিক যেন কোনও অতৃপ্ত প্রেতিনীর। ভূতেশ তার সামনে এই প্রথম কাঁদতে শুনল বড়বউকে।
আমি ভূতেশ মানে কটাভুতো। সাহেবরা ঘড়ি ভীষণ ভালবাসে। ট্যাঁকঘড়ি বাদ করে, এই যে রিস্টওয়াচ পরে দুটো হাতকেই খালি রাখা, এটাই তো এক মস্ত মুক্তি। আর কোট মানেই বাড়তি চাপানোর সম্মান। তবে কেরানি বাবুদের মতো পাম্প-শু পরে, ধুতির ওপর ছাতার কাপড়ের কোট এঁটে, বগলে লম্বা বাঁটের ছাতা নিয়ে ট্রেন ধরতে দৌড়লে ব্যাপারটা মোটেই জমবে না; ফলে পরের মাসেই ভাল শু এবং দামি কাপড়ের কয়েকটা ফুল-হাতা শার্ট এবং ট্রাউজারসও কিনে নিতে হবে। তবে একটাই চিন্তা যে টাই-ও পরতে হবে নাকি; আর সেটা বাঁধাই বা শেখাবে কে?
খুচরো ভাবনার মধ্যেই ভেসে উঠল সেই কবে দেখা, বড়বউদির সধবা চেহারাটা; যেন নিজের ঘরে দোর দিয়ে দাদার সঙ্গে সোহাগ করছে; দাদার কোট আর ঘড়ি গায়ে চাপিয়ে রং-ঢং করতে করতে, খুব হাসছে খিল খিল করে! দাদাও যেন মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার রূপের আধার বউকে!
বারে বারে জিতে গিয়েও আজ কি নিজের কাছেই হেরে গেলাম আমি?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র