বাবা
শাফিকার কোলাজ প্রদর্শনীর উদ্বোধনে এসেছি, এটি তার দ্বিতীয় একক। ঘন্টাখানেক আগেই এসেছি, কারণ প্রেস এসে গেলে ছবিগুলো তখন মন দিয়ে দেখা দায়। আগে আগে শহরতলি ছাড়িয়ে আধা-গ্রামের পথ পার করে তার বাড়ি পৌঁছে যেতাম; সেখানে শাফিকার পরিবারের নিষ্ঠ আদরযত্নে কাটিয়ে আসতে ভালই লাগত আমার। শাফিকাকে দেখতাম; দেখতাম তার ছবি এবং সংসার। এটা তো সত্যিই আমার মেয়ের বাড়ি। প্রথম থেকেই তো সে আমাকে ‘বাবা’ বলেই ডাকে। সেখানেই একটা একানে ঘরে তার স্টুডিয়ো। বাকি ঘরগুলো টালি ছাওয়া হলেও ওই কাজের ঘরখানি এখন পাকা হয়েছে। শাফিকাকে দিয়ে লক্ষ্মী ছাপিয়ে এখন কুবের লাভ হয়েছে সংসারে। ফলে এটুকু পরিসর সে প্রাপ্য হিসেবেই পেয়েছে। শাফিকা কিন্তু একটুও টলে যায়নি। একই রকম সরল আর অকপট মন নিয়ে অক্লান্ত শ্রমে ছবি তৈরি করে চলেছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়ায় অত দূরের পথে এখন আর যেতে চাই না; অসাব্যস্ত অবস্থায় বড় বেশি পরনির্ভর হতে হয়। তাই আগে থেকে ওর ছবিগুলো আর দেখা হয়ে ওঠে না। শাফিকাও যে বড় একটা কলকাতায় এসে উঠতে পারে তা নয়; তবে ওর স্বামী ইসমাইল শেখ এখানে নিয়মিত যাওয়া আসা করে এবং আমার খোঁজ নিয়ে যায়। ওর কাছে জানতে পারি যে শাফিকা এখন দেওয়াল জোড়া ছবিও করছে, মানে ১২/১৪ মাপের।
শাফিকার এই নতুন কাজগুলো আজ এই প্রদর্শনীতেই দেখছি। স্তম্ভিত হয়ে গেছি তার ভাবনার প্রকাশে। বুঝতে পারছি যে সময় একদিকে যেমন ন্যুব্জ করেছে আমাকে, অন্যদিকে শাফিকাকে দিয়েছে পরিণতি এবং বোধ। কর্মশক্তি তার বরাবরই প্রবল। ওই শান্ত চেহারার আড়ালে যে তীব্রতা লুকিয়ে আছে, সেটাই গলগল করে বেরিয়ে এসেছে ছবিতে। তার আগের ছবির বিষয় ছাপিয়ে সে যেন আন্তর্জাতিক চেতন-জগৎকে মুঠোয় ধরেছে। না জানে সে নারীবাদ, না তার চলাচল শিক্ষিত সমাজে! অথচ ছবিতে যে নারীকে আঁকছে সে তো তারই নিভৃত রূপ। অকপট নগ্নতা যা ধ্বস্ত হয়ে চলেছে পুরুষের ক্রমাগত পেষণে। বাদামি রঙের নগ্ন নিতম্বে সে পিষে ফেলছে তার বিছানা, বালিশ, ঘুলঘুলি এবং পুরুষ সঙ্গীটিকেও। অথচ বিদ্বেষ নেই। তীব্র অভিমান আর বিমুখ হয়ে পাশ ফেরা। উদাসীন বৈভব।
আমার সাক্ষাৎকার নিতে যে মেয়েটি এখানে এসেছিল, শাফিকা সম্পর্কে তাকে বলতে গিয়ে আজ যেন সব আবার নতুন করে মনে পড়ল…
ওয়েলিংটনের ওই তালতলা এলাকায় প্রায় সকলেই আপনাকে ‘ডিমবাবু’ বলে কেন ডাকে?
ওহ্! ফুটপাতের বাচ্ছাদের সেদ্ধ ডিম খাওয়াই তো, সেই জন্যই হয়তো!
শাফিকা কিন্তু ‘ডিমবাবু’ না বলে, ‘বাবা’ বলে ডাকে! এর কারণ কী মনে হয়?
হ্যাঁ, ওই-ই শুধু ‘বাবা’ বলে; ওর বাকি পাঁচ ভাইবোন সকলেই ‘ডিমবাবু’ বলে। আর শাফিকাকে দেখে ওর মা তো আমাকে ডাকে ‘বাবা বাবু’ বলে!
শাফিকা কী করে আপনার এত কাছে চলে এল?
ওর মুখে যেন আমার মায়ের ছায়া দেখতে পেলাম; আর একবছর বয়সে বাবাকে হারানো শাফিকা হয়তো আমার মধ্যেই তার শিকড় খুঁজে পেল। তাই হয়তো…
শাফিকা তো আপনাকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে কোলাজ শুরু করে?
সে অনেক বছর পর। বিয়ের পর তিন সন্তান নিয়ে সংসার যখন চলছে না তখন আবার আমার কাছে আসে, ওর স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে। কিছু খবরের কাগজ দিয়ে বলি ঠোঙা বানিয়ে বাজারে বেচতে; ওর মা সু্র্মাবিবি এবং স্বামী ইসমাইল সকলেই সবজি বেচে। ওই তালতলার ফুটপাতেই তো তাদের প্রতিদিনের কারবার, ঘরেই ঠোঙা বানালে তা আর কিনতে হবে না! জ্বাল দেওয়া আঠাটা ঘরেই বানিয়ে নিত শাফিকা।
কিন্তু ঠোঙা থেকে এই কোলাজে কী করে এল শাকিলা? আর এমন নজিরবিহীন দক্ষতা নিয়ে!
একেবারে শৈশব থেকে তো আমার ঘরে আসা-যাওয়া করত। বছর সাত হলে ঝাঁট দিয়ে দিত ঘরটা; আমার ক্যানভাসের নীচে পড়ে থাকা কুচিকুচি কাগজগুলো নিজেও ছবি বানাতে চেষ্টা করত, ফেলে দেওয়া বোর্ডের টুকরোগুলোর ওপর। খুব শান্ত ছিল। তুলি ধুয়ে গুছিয়ে রাখত, রঙের শিশি নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখত; রং, ক্যানভাস, তুলির এই জগৎটা হয়তো এ ভাবেই ওর অস্তিত্বে চারিয়ে গেছে।
শাফিকার কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল যে ও আসলে ছিল এক মগ্ন শিশু। আর ছিল ওর প্রখর আত্মসম্মান। আমাকে দেখতে পেলেই রাস্তায় খেলে বেড়ানো অন্য বাচ্ছারা যখন দৌড়ে আসত, সেই দলে মিশে শাফিকা কখনও আসেনি। ওর মা ওকে যেখানে বসে থাকতে বলত, সেখানেই বসে থাকত। ভাঁড়, ছিপি, শিশি, বোতল নিয়ে নিজের মনে খেলত; ডিমসেদ্ধ, লজেন্স, বিস্কুট নিয়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও হাত পেতে নিতে চাইত না। ওর মা বলত, ‘বাবু ওকে ভিক্ষা নিতে শেখাবেন না।’ ওর সঙ্গে কথা বললেও ওর মা ভয় পেত; কারণ ওদের গ্রামের বহু মেয়ে-সন্তান এ ভাবে লোপাট হয়ে গেছে। ভাল ব্যবহার করে, ভাবসাব জমিয়ে, তাদের যে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে তারাও নাকি ভদ্রলোকের মতোই দেখতে সব লোকজন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আবার ‘মেয়েছেলে’।
আর একটু বড় হলে তার মা-কে সবজি বিক্রি করাতে সাহায্য করতে শুরু করে শাফিকা। আমার ঘরে এসে, বসে বসে ডিম-বিস্কুট খেত আর তাকিয়ে থাকত বড় বড় ক্যানভাসগুলোর দিকে। কুচনো কাগজ, তুলি, রং, আঠা, কার্ডবোর্ড এসবও দেখত অবাক চাহনিতে; কোনও জিনিসে হাত দিত না, প্রশ্নও করত না আমাকে। মায়া আর বিষাদের সঙ্গে, ওর চোখে আমি দেখতে পেতাম এক কুচি ঔৎসুক্য। সকালবেলা আমার কাছ থেকে ডিম বিস্কুট নেবার কড়ারে শাফিকার তেজি-মা প্রস্তাব দিল যে, আমি যদি আমার ঘর পরিষ্কারের দায়িত্ব ওকে দিই, তবেই সে মেয়েকে পাঠাবে। বুঝতে পারি যে আশপাশের দশজনের দশরকম কু-চাহনি থেকে উঠতি বয়সের মেয়েকে আড়াল করার এটাই একমাত্র ব্যবস্থা; সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। ভাবি যে সুর্মাবিবিরই বা কী বয়স! নিজেকে বাঁচাবে না মেয়েকে! ছ’টি সন্তানের মা— এই সুর্মাকে ফেলে তার স্বামী নাকি বাংলাদেশে পালায়। শাফিকার বয়স তখন এক বছরও হয়নি। ছেলে চারজন ছোট হলেও যেমন পারে রোজগারে নেমেছে। বড়মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে গ্রামেরই কোনও ঘরে; সমস্যা হয়েছে এই ছোটটাকে নিয়েই। না হয়েছে তার বিয়ের বয়স, না তাকে ঘরে একলা রেখে আসতে পারে। রাত থাকতেই সবজি নিয়ে ট্রেন ধরে এই বাজারে আসা আর বেলা গড়িয়ে ঘরে ফেরা। নিজে না হয় মুড়ির ওপর দু’ঘটি জল খেয়ে পেট ভরিয়ে নিল, কিন্তু বাচ্ছা মেয়েটাকে কি ওই ভাবে দিনের পর দিন রাখা যায়! সবজির ঝুড়ির পাশে চট পেতে ঘুমিয়েও পড়ে অভুক্ত মেয়েটা।
সুর্মাবিবির ওই নতুন কড়ারে সকাল হতে না হতেই শাফিকা এসে দাঁড়ায়; লিকলিকে শরীরে খালি পা, রুখু চুল, ফাটা-ফাটা শুকনো ঠোঁট নিয়ে। তার আগে পার্ক সার্কাস স্টেশন থেকে এই তালতলা অবধি মায়ের সঙ্গে হেঁটে এসে, মায়ের মাথা থেকে সবজির বস্তাটা নামায়; সবজিগুলো হাতে-হাতে সাজিয়ে দিয়ে তবে সে আমার ঘরে আসে। দরজা খোলা থাকলেও বেল বাজিয়ে, আমার সাড়া নিয়ে ঘরে ঢোকে। ওকে দেখে মনে হয় যেন বাড়ি ফিরে এল। এটা কোনও মেস বা ভাড়া ঘর নয়। অবিবাহিত পুরুষদের হস্টেল। অন্যান্য ঘরগুলোয় তুলনায় অল্পবয়সি ছেলেরা থাকে; মূলত পড়ুয়া। এখানে একমাত্র আমিই এক অবসর নেওয়া প্রৌঢ়। কোনও দিকে না তাকিয়ে সে সোজা চলে আসে আমার ঘরে। ভোরবেলা নীচে নেমে চা খেয়ে, এক ফ্লাস্ক নিয়েও আসি। শাফিকা এসে আগে দেখে যে আমার কাজের টেবিলে নতুন কোনও রং বেরিয়েছে কি না; বা বোর্ডের ওপর নতুন কী নকশা এঁকে রেখেছি। ও জানে যে এটাকে বলে লে-আউট, পেন্সিলে আঁকি; যে সব পেন্সিলে আঁকি, তার নম্বরগুলোও সে শিখে নিয়েছে। যদিও পড়তে পারে না এখনও। কিন্তু আমার ঘরে আসা ইংরেজি নিউজপেপারটা খুলে-খুলে দেখে। ও যে সমাজ থেকে উঠে এসেছে, সেখানে ঠোঙা বানানো ছাড়া খবরের কাগজের আর কোনও মূল্য আছে কি? কিন্তু এই ঘরে আসা-যাওয়া করতে করতে, ক্রমে ও জেনেছে যে খবরের কাগজের কোন অংশগুলো দিয়ে ছবি হবে, অনেক সময় নিজেই সেগুলো কেটে-কেটে আলাদা করে রাখে। ওর ভিস্যুয়াল-সেন্স দেখে মুগ্ধ হই। আর ভাল লাগে ছবির মধ্যে ওর মগ্ন ডুবে যাওয়া দেখে। তখন ওর গায়ে মশা বা মাছি বসলেও নড়ে না। নিজের ছবি আঁকা ছেড়ে তখন আমি তো ওকেই দেখি।
শাফিকার এই মগ্নতায় আমার মাকেই মনে পড়ে। এমনই মগ্ন হয়ে রান্না করতেন, উল বুনতেন, বড় বড় বিছানার চাদরে ফুল তুলতেন নানা রঙের রেশমি সুতো ছুঁচে পরিয়ে। চায়ের পাতা ফুটিয়ে সেই জল ছেঁকে নিতেন। সাদা চাদরগুলো তাতে ডুবিয়ে কী সুন্দর যে একটা সিপিয়া রং আনতেন! সেই চাদর যখন ফুলের নকশায় ভরে উঠত, তখন মনে হত ক্ষেত-অঙ্গনের হররঙ্গী সব ফুল যেন এখানেই ফুটেছে; এটাই আমার দেখা প্রথম ছবি। শাফিকাও ঠিক এমনভাবে রোজ একটু-একটু করে ওর মনটাকে বিছিয়ে দিতে থাকে তার ছবিতে। ক্রমে শাফিকাই হয়ে ওঠে আমার প্রতিদিনের অপেক্ষা। বেশ বুঝতে পারি যে এই ব্যবস্থাটা মা এবং মেয়ে দু’জনের কাছেই হয়ে উঠেছে এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়। ওদের কাছে এই আস্থাটুকু অর্জন করতে পেরে আমিও বেশ আনন্দ পেয়েছি।
এ ভাবেই শাফিকা বড় হচ্ছে। ছবি আঁকাটা রপ্ত করলেও অক্ষর পরিচয় হয়নি তার। আমার নামে আসা চিঠিপত্রে হাত বুলিয়ে জানতে চায় আমার নামটা কোথায় লেখা আছে, জানতে চায় যে পোস্টম্যান কী করে সবাইকে চেনে, বাড়ির ঠিকানা কাকে বলে! মিতভাষী শাফিকার উৎসুক চোখদুটো দৌড়ে বেড়ায়, ছাপা কাগজগুলোর পাতায়-পাতায়; টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার আগে, বুঝে নিতে চায় যে দরকারি কি না। একসময় আমি মেতে উঠি ডাকে আসা ইনল্যান্ড লেটারের কুচি দিয়ে একটা ছবি বানাতে, যেখানে এক টুকরো সবুজ জমির ওপর সবটাই আকাশ। ইনল্যান্ড লেটারের নানা রকম আকাশিকে সাজিয়ে-সাজিয়ে সাঁটছি। একদিন দেখি কাগজ কম পড়ে যাচ্ছে। হাতের কাছে থাকা ওই সপ্তাহে আসা ইনল্যান্ড লেটারগুলো খুঁজতে গিয়ে দেখি যে শাফিকা আগেই সেগুলো সরিয়ে রেখেছে, কারণ সে লক্ষ্য করেছে যে ওগুলোর উত্তর দেওয়া তখনও বাকি। আমার চোখ ভিজে ওঠে। পরদিন সে একটু দেরি করে ঘরে ঢোকে। জানলা দিয়ে দেখলাম যে ওর মা কিন্তু এসে গেছে, এমনকী সবজি সাজিয়ে তার বেচাবেচিও শুরু হয়ে গেছে; শাফিকা আসেনি? এ কথা জিজ্ঞেস করাতে বলল, কী সব যেন নীল চিঠি জোগাড় করতে গেছে; আজ তাই একটু দেরি হবে। বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ সে এল, হাতে একটা বড়সড় পুরনো প্যাকেট। আর তাতে ঠাসা ফেলে দেওয়া ইনল্যান্ডের রাশি, মায়াময় চোখ দুটি নামিয়ে বলেছিল, ‘পোস্টম্যানকে বলে রেখেছিলাম যে বাবুর লাগবে…’। বুঝলাম যে পোস্ট অফিসে ডাঁই হয়ে জমে থাকা undelivered letter-গুলো থেকে নীল কাগজের চিঠিগুলো সে নিজে বেছে-বেছে নিয়ে এসেছে।
এ ঘটনার পরেই, ওর মা-কে রাজি করিয়ে, এ পাড়ারই সরকারি ফ্রি-স্কুলে ওকে ভর্তি করে দিই। মাস খানেক ইশকুল যাতায়াত করলেও এটা তার মা এবং অন্যান্য ভাই-বোনেদের বেশ অপছন্দ এবং অসন্তোষেরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে কিছু না জানিয়েই অনিয়মিত হয়ে যেতে থাকে তার কলকাতায় আসা। অজুহাত দেখায় যে, শাফিকার দুর্বল শরীরে নাকি এই চাপ সহ্য হচ্ছে না। ওর বড়ভাই শাকিলের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলি যে গ্রামের ইশকুলেই তাকে ভর্তি করে দিতে। সেই থেকে তার সেই বড়দা শাকিলকেও আর দেখিনি। পরে শুনেছি যে, আমার দেওয়া সেই টাকা শাফিকাকে না দিয়ে সে নিজেই হজম করে ফেলেছিল। তারপর থেকে ওর মা-ও আর আমাকে দেখেও দেখে না। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে! আমার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল শাফিকা। কিছু কার্ডবোর্ড, একটু আঠা আর কুচিকুচি কাগজের থলে নিয়ে আনমনে মগ্ন হয়ে থাকা মেয়েটা, তবু যেন এই ঘরে রোজই আসে এবং ফিরে যায় পরদিন আবার আসব বলে।
হঠাৎ একদিন ওর মা সুর্মাবিবি, নিজে থেকেই আমাকে ডেকে একজন বয়স্ক ছেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলে যে, ‘এই হল আমার ছোট জামাই— ইসমেল শেখ’, ওধারের ফুটপাথে সবজি বেচে। স্তম্ভিত হয়ে শুনি আর ভেতরে-ভেতরে রাগে যেন চুরমার হতে থাকি। কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা হেঁট করে ফিরে আসি। সত্যিই তাহলে হারিয়ে গেল বছর বারোর শাফিকা!
এর প্রায় পাঁচ বছর পর, দরজায় দাঁড়ানো শাড়ি পরা একটি পরিণত বয়সের যুবতীকে দেখে চমকে উঠি। একমাত্র চেনা তার সেই চোখ দুটি— আনত… দীঘল… মায়াময়। দ্বিধান্বিত শাফিকাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে এসে ঢোকে সেই ইসমাইল। বাক্রুদ্ধ শাফিকা তখনও দরজায়। সপ্রতিভ ইসমাইল যেন তার হয়েই বলতে শুরু করে, ‘কিছু সাহায্য করলে ভাল হয়, সংসার তো চলছে না’। কোনও কথা না বলে কয়েক দিন পরে তাদের আসতে বলি। ইসমাইল আগে বেরিয়ে শাফিকাকে বলে, ‘চল’। বাধ্য পোষ্যের মতো শাফিকাও তাকে অনুসরণ করে। যাবার সময়ে একবার সে তাকায় আমার দিকে— করুণা ভিক্ষা নয়, ব্যথায় ভেজা তার দু’চোখ। ওরা চলে গেলে অস্থির হয়ে জানলার দিকে গিয়ে স্থির তাকিয়ে দেখি, তাদের সেই দীর্ণ ফিরে চাওয়া। ভাবি, আমিও কি মুখ ফিরিয়ে নিলাম!
দিন দু’য়েক পরে শাফিকা আবার আসে, তবে একা— শাড়ি পরে বড় হয়ে যাওয়া শাফিকা। ওকে দেখেই মনটা কেমন ছটফট করে উঠল। দেখলাম যে ওর ওপর আর রাগ নেই; বিয়ের কথা শুনে সেই যে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল সে ভাবটাও কমে গেছে। ওর মা-ভাইদের দোষে শাফিকাকে কেন দূরে করে দেব! আমার চাহনিতে আস্থা-জাগানো আলো দেখতে পেয়ে এবার সে ঘরে এসে দাঁড়াল। চেয়ারে বসা আমার পায়ের কাছে বসে, অঝোরে শুরু হল তার কান্না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ওর মাথায় হাত রাখতেই কান্নার ঢল নামল তার সমস্ত শরীরে। ফোঁপানি কিছুটা স্তিমিত হলে, কথা শুরু করল শাফিকা। জানলাম যে ওই ইসমাইল শেখের আগের একটি সংসার আছে, সেই বৌ এবং তিনটি ছেলে-মেয়ের সঙ্গেই শাফিকাকে ঘরে তুলেছে সে। ইতিমধ্যে শাফিকাও দুটি সন্তানের মা হয়েছে, ফলে সংসার আর চলছে না। মনটা কেমন ভারী হয়ে গেল। ভাবলাম, যে মেয়ে ওই শৈশবেও ভিক্ষা মনে করে ডিম, বিস্কুট নিতে চাইত না, আজ সে সরাসরি টাকা সাহায্য চাইতে এসেছে? বুঝলাম যে শাফিকা নয়, সাহায্য চাইছে সুর্মাবিবি, তার ছেলে শাকিল এবং তার জামাই ইসমাইল। এরা সবাই মিলে একজোট হয়েই শাফিকাকে পাঠিয়েছে অর্থ সাহায্য চাইতে; আর শাফিকা চাইতে এসেছে একটা নতুন পথ। টাকার কথা সে মুখেও আনেনি, ফিরেও চায়নি এই ঘরের সেই কোনটার দিকে। যেখানে বসে স্বপ্নগুলোকে প্রতিদিন জোড়া লাগাত সে, মগ্ন-শ্রমে কাটিয়ে দিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
খানিক চুপ করে থেকে বললাম, ‘দানের টাকা তো কোনও নিয়মিত আয় নয়। আমিই বা দান করবার কে!’ আমার যে সামান্য অর্থ তাই আমি ভাগ করে খাই। ওটা তাই দান বা দয়া নয়, মিলেমিশে খাওয়ার আনন্দ। শাফিকাকে বললাম যে, যেটা আমি করতে পারি তা হল নিয়মিত আয় করার একটা পথ-সন্ধানের চেষ্টা। বললাম যে ইসমাইলকে আমার কাছে পাঠালে আমি কিছু খবরের কাগজ দেব, আঠার পয়সা তোমরা যোগাড় করবে। সপ্তাহান্তে যে ঠোঙা হবে সেগুলো বেচেও পয়সা আসবে। আমার কথা শুনে চমকে উঠল শাফিকা। বলল, ‘বাবা! ওগুলো তো আপনার ছবি বানাতে লাগে, কম পড়ে যাবে।’ ওর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘যেগুলো দিয়ে তুমি ছবি বানাতে, সেগুলোই না হয় তোমায় ঠোঙা বানাতে দেব। এ ক’বছরে তো বিস্তর কাগজ বেঁচেছে, তুমি আর ছবি বানাওনি বলে!’ ‘বাবা’— বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল শাকিলা। শান্ত হয়ে প্রথম দফার কাগজের বান্ডিল নিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
আমি বুঝতে পারলাম যে, আসলে সে নিয়ে গেল কুচিকুচি স্বপ্নের স্পর্শ— যেগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে ছবির পর ছবি আর তার মনের তোলপাড় উচ্ছ্বাস।
সংসারে থিতু হল শাফিকা।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র