টানা অ্যালার্ম বাজছে। হালকা ছেঁড়া ঘুম ধীরে-ধীরে চেতনায় ফিরে আসছে। কী একটা স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। একটা কনফারেন্স টেবিলের একদিকে একটা কালো চেকার্ড ব্লেজারের কলারের ভাঁজ, একটা হাত প্রসারিত, নানা গ্রাফে ভরা একটা হোয়াইটবোর্ডের দিকে। ছবি পালটাচ্ছে। হাতের মুদ্রাও। চোখ খোলার সঙ্গে-সঙ্গে ছিঁড়তে থাকা সুতোর আঁশের মতো ছিঁড়ে যাচ্ছে দৃশ্যটা। ঘরে নীলাভ অন্ধকার। অন্ধের মতো হাত বাড়াতেই বেডসাইড টেবিলে ফোনের বিশাল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সময়। সকাল ৫.৫০। গত পনেরো বছর ধরে যে-সময়ে অ্যালার্ম বেজে গেছে। এখন তো অ্যালার্ম দেননি তিনি, কীসে বাজল তবে? খুব গরম লাগছে, ডুভেটা টেনে গা থেকে সরিয়ে দিলেন। ভীষণ নরম সুন্দর ফেব্রিকের ব্লাইন্ড দেওয়াল জোড়া। খুলতেই বিশাল জানলার ওপারে সান হোসের পাহাড়ের ওপর তার বাড়ির নীচে বিছিয়ে আছে উপত্যকা। দীপাবলির রাতের মতো। আকাশে খুব নরম গোলাপি আঁচড় পড়তে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন: ‘যাত্রাপথে আমাদের নিত্য আবিষ্কৃত সংস্কৃতিচর্চার ঠেলায় ভুল করে কোনও উটকো লোক একদিন সেখানে উঠলে ভবিষ্যতে ওই কম্পার্টমেন্টের ছায়া পর্যন্ত এড়িয়ে চলত।’ গল্প ‘জহুরি’, লিখছেন অরুণ কর…
এ-বাড়ির প্রত্যেক কোণ, জানলা, সিঁড়ি, ডেক, রান্নাঘরের কাউন্টার থেকে সামনের ম্যানিকিওর্ড লনে দুটো কমলালেবু গাছ— সব কিছুই কোনও ম্যাগাজিনের ছবির মতো। কেউ ব্যবহার করে না। কেউ অপরিষ্কার করে না। বেশির ভাগ সময়ে কেউ থাকে না। তবে থাকে না বললে ভুল হবে। এখন থাকেন মালবিকা। কয়েক সপ্তাহ আগে, তিনি তার অতীব দামি কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের চাকরিটা খুইয়েছেন। ততোধিক বড় কোম্পানির সাথে মার্জ হবার পর থেকেই আশঙ্কা ছিল। আশঙ্কাটা সত্যি হয়ে গেল। পনেরো বছর ধরে ধীরে-ধীরে এই সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি। তাঁর দিন-রাত্রি, তাড়াহুড়ো-করে-করা সংসার পাক খেয়েছে চাকরির চারদিকে। যতদূর মনে পড়ে ছোটা আর ছোটা, কাজে শুধু নয়— ছুটিতেও। দেশে যাওয়া, আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা, পৃথিবীর অন্য কোথাও অথবা আমেরিকার বিখ্যাত জায়গায় বেড়ানোর চেকলিস্ট। সব কিছু ছুটে-ছুটে। এক মুহূর্ত যেন বসেননি। আর শুধু কি প্রফেশনাল কাজ? বাড়ির অথবা বাইরের অনুষ্ঠানে খাবারের মেনু থেকে শুরু করে পরিকল্পনার মৌলিকত্ব, গাড়ি থেকে সানগ্লাস, শাড়ি থেকে সুগন্ধ— সব কিছুতে ব্র্যান্ডনেমের চমক, এই সব কিছুকে নিখুঁতভাবে পরিবেশন করাটা কাজ নয়? ঘরে আর বাইরে, চাকরি আর জীবনে— সব কিছু হতে হবে পারফেক্ট। মেয়ে আলোলিকাও তো! পড়াশোনা, গান, ব্যালে, সকার, কমিউনিটি ওয়ার্ক সব কিছুতেই আগ্রহ, পরিশ্রম করা। তাকে নিয়ে কখনওই মাথা ঘামাতে হয়নি। কখন যে বড় হয়ে গেছে, বুঝদার হয়ে গেছে! তবে সব পারফেক্ট নয়। স্বামী অম্বরীশের সঙ্গে তার সম্পর্কটা একদম আলগা হয়ে গেছে। বড় কোম্পানি থেকে বেরিয়ে স্টার্ট-আপ শুরু করেছিল, সেটা দাঁড়ায়নি তেমনভাবে। পড়ানোর ইচ্ছে ছিল ফ্লোরিডার একটা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে গেল। তাও প্রায় বছর ছয়েক হল।
এলোমেলো ভাবনার মধ্যে কখন নীচে নেমে এসেছেন, পর পর কাজগুলো করছেন টের পাননি। গত দু’সপ্তাহে তিনি খেয়াল করেছেন, কলেজ থেকে মেয়ে প্রায় নিশ্চুপ। টেক্সটের জবাব দেয় খুব কম, ফোন প্রায় ধরেই না। মেয়ের কলেজ এই বিশাল দেশের অন্যদিকে। কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর তিনি ভেতর-ভেতর আতঙ্কিত হয়ে অম্বরীশকে জানান। সে এই সময়ে আয়ারল্যান্ডে। সেখানে সেমেস্টারে রিসার্চে কাজ করছে। সেও একই কথা বলল। উপরন্তু বলল, আলো পড়াশোনা নিয়ে আলোচনাও বন্ধ করে দিয়েছে। স্কুল থেকেই পড়াশোনার বিষয়ে বিশেষত আলো তার বাবার সাথেই অনেক বেশি কথা বলে। দুই উদ্বিগ্ন বাবা-মা আলোচনা করে পরশুদিন আলোকে তিনি মেসেজ করেন যে, এখন তার হাতে সময় আছে, তিনি আলোর কাছ থেকে ঘুরে আসবেন। কাল রাত্রে তার উত্তর এসেছে, ‘একদম না। আলোর সময় হলে সে ফোন করবে। সে খুব ব্যস্ত। সে একদম ঠিক আছে।’
গরম কফিতে জিভ পুড়ে গেল। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। কফিটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলেন। গোলাকৃতি দেওয়ালে পারিবারিক ছবি। সিলিং থেকে আসা লুকোনো আলোতে জ্বলজ্বলে আলোর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, ছোট্ট ব্যালেরিনার তুলতুলে আদুরে মুখ, মায়ের মুখে মুখ লাগিয়ে সদ্যোজাত আলো… বাড়ির এই ছবিগুলো সারা পৃথিবী থেকে আনা আর্টিফেক্টগুলোর মতো হয়ে গেছে। সাজানো। বাড়ির মানুষরা পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। খেয়াল করে না। এই অসহ্য একা বাড়িতে কী মনে করবেন তিনি? বাড়ি তার সঙ্গে কথা বলে না তো!
‘নিজের ইচ্ছেয় তুই দেশের অন্য প্রান্তে প্রেস্টিজিয়াস প্রাইভেট কলেজে ইংরেজি পড়তে গেলি… একবারও বলেছি তোকে বায়োটেক পড়তে হবে, কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে হবে? তোর যা ইচ্ছে তাই পড়। ক’জন দেশি বাবা-মা করবে?’ মনে-মনে মেয়ের সাথে কথা বলছেন তিনি, আশঙ্কায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। ড্রাগস? বয়ফ্রেন্ড? ডিপ্রেশন? কাপটা কাউন্টারে নামিয়ে দিলেন। নাহ্, বেরোতে হবে। রানিং জুতোজোড়া গলিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন দৌড়োতে।
২
বিল্ডিংটা এত পুরনো, এরকম কোনও বিল্ডিং-এ মালবিকা তাঁর দীর্ঘ প্রবাসজীবনে কখনও গেছেন বলে মনে পড়ল না। ঈষৎ রংচটা দরজার ওপর একটা বড় সাইনবোর্ড। দুটো জড়ো করা হাতের ছবি, প্রণামের ভঙ্গিতে, লেখা আছে ‘গিভিং হ্যান্ড’। ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, কেন এলেন? ভিকির কথায়। ভিকি, কেন যে তুমি আমাকে এরকম পরীক্ষায় ফেললে! কী করবেন? ফিরে যাবেন?
ভিকি, ভিক্টোরিয়া তাঁর প্রতিবেশিনী। আলোর স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। ভিকি তাঁর পরিচিত পৃথিবীর মানুষগুলোর থেকে একদম আলাদা। ক্যালিফোর্নিয়ার অনাবিল আলো-হাওয়া আর জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর রোদে-পোড়া মুখে বলিরেখার আঁচড়। শর্টস আর টি-শার্ট ছাড়া আর কোনও পোশাকে দেখেননি। সবসময়ে ব্যস্ত— চার্চ গ্রুপে, অ্যানিমাল শেলটারে, ফুড-প্যান্ট্রিতে, অসুস্থ আত্মীয়বন্ধুদের নীরব সাহায্যে, আর নিজের হাইকিং-ক্যাম্পিং এইসবে। আলো যখন মিডল স্কুলে, হাই স্কুলে, তখন অনেক কাজ করেছে ভিকির সাথে। অ্যানিমাল শেলটার, হোমলেস শেলটারে, সুপ কিচেনে। তখন অনেক বেশি দেখা হত। তবে ভিকি এমন মানুষ, তার সঙ্গে দেখা না হলেও কিছু যায় আসে না। গতকাল ওই টালমাটাল ভোরে তিন মাইল হাঁটার পর, ভিকির সঙ্গে দেখা হল তাঁর।
‘হাই মাই গর্জাস নেবার!’ বলে জড়িয়ে ধরল ভিকি। ‘কেমন আছ? আমাদের সানশাইন কেমন আছে?’ আলোকে সবসময়ে আদর করে সানশাইন ডাকেন ভিকি। কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই, তাঁর পঞ্চাশজন বন্ধু, যাঁদের সঙ্গে গত দশ বছরে হাজার-হাজার ছবির পোজ দিয়েছেন, কিন্তু তাদের একজনকেও যে-কথা বলতে পারেননি, বেরিয়ে এল। সবটা। তাঁর দুশ্চিন্তা, অভিমান, রাগ, মেয়ের সঙ্গে দূরত্ব। রাস্তার ধারে কালভার্টে বসলেন দুজনে। চোখ থেকে অনর্গল জল পড়ছে। বেশ খানিকক্ষণ কথার পর দুজনেই চুপ। ভিকি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে কেটে মালবিকা বললেন, ‘জানো ভিকি, ওকে যখন ছেড়ে আসছি কলেজে গত বছর, আমি-ওর বাবা দুজনে গাড়িতে উঠে গেছি, গাড়ি ছেড়ে দিল। ও অন্য দুটো মেয়ের সঙ্গে, প্রাণপণ হাত নাড়ছে, মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার বুকটা খালি। প্রথম বুঝতে পারছি, ও এত বড় দেশের অন্য প্রান্তে থাকবে। কতটা দূরে! গাড়িটা বাঁক নিতে আমি পিছন ফিরে তাকালাম। আলো ফিরে যাচ্ছে। দূর থেকে ওর ওই কোঁকড়ানো চুলভরা মাথাটা আর তার নীচে ঢোলা শার্ট আর শর্টস পরা রোগা চেহারাটা। কেন ভিকি? আর কিচ্ছু মনে পড়ছে না? শুধু আমি ওর চলে যাওয়া চেহারাটা…।’
ভিকি ওঁর হাত নিজের হাতে নিয়ে একটু বসে রইলেন। তারপর বললেন, ‘মালা, এক জায়গায় ভলেন্টিয়ারিং করবে? এমন জায়গা যেখানে তুমি কখনও যাওনি?’ এর মধ্যে ভলেন্টিয়ারিং কোথা থেকে এল? ‘কোথায়?’ ‘একটা জায়গায় খুব সাহায্য দরকার। গিভিং হ্যান্ড। প্রত্যেক মঙ্গলবার সকালে। কাল চলে যাও। ঠিকানা টেক্সট করে দেব’। ভিকিকে না বলার প্রশ্নই আসে না। সে শুধু দেয়। কিছু চায় না। সত্যি বলতে, তিনি সোলো ট্রিপ, উইকেন্ড স্পা এসব ভেবেছিলেন। যাবেন কি না। কিন্তু নিজের সঙ্গে থাকতে চান না তিনি। পারবেন না। ‘বেশ। পাঠিয়ে দিয়ো।’ ‘তুমি একদম ভেবো না মালা। দেখো, আমাদের আলো ঠিক থাকবে।’ ধীরে-ধীরে নক করলেন জীর্ণ দরজাটায়। দরজাটা খোলা।
৩
ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেছে। মার্লিন আর তার দাদা ব্রায়ানের সাথে আলাপ হয়েছে। এরা দুজনই চালায় এই ফুড-প্যান্ট্রিটা। দুজনেই রিটায়ার্ড, দুজনেরই স্বেচ্ছাশ্রম। বেসমেন্টের ধূসর রং করা ঘরে সারি-সারি শেল্ফে নানা ধরনের খাবার সাজানো। মূলত যা চট করে নষ্ট হবে না। এখন মালবিকা একের পর এক কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে বের করছেন সুপের ক্যান, টুনা ফিশ, গ্রিন বিন, পিচ, এপ্রিকট। সাজিয়ে রাখছেন। প্রায় যন্ত্রের মতো হাত চলছে তার। এমনিই তিনি কাজ করতে ভালবাসেন। এই কাজটা কেমন একটা ভোঁতা অনুভূতি দিয়ে ঘিরে ফেলেছে তাকে। স্বস্তি। ঘরের উলটোদিকে ভারী আলু-পেঁয়াজের বস্তা থেকে ছোট-ছোট ব্যাগে ভাগ করে রাখছে নীনা। নীনাই ষাটোর্ধ্ব, হালকা চেহারা এবং এই সকালবেলায় তার মুখে অনেকটা মেক-আপ, আর পোশাকও বেশ ফিটফাট। বাইরে কোথাও ওকে দেখলে ভাবতে পারতেন না এরকম ভারী কাজ করতে পারে। কাজের সঙ্গে প্রচুর কথা বলে। ভাগ্যিস ঘরের উলটোদিকে!
তার আর মার্লিনের কথা গুঞ্জনের মতো পৌঁছচ্ছে তাঁর কানে। আর এসেছে একটা ছোট দল। মনে হয় বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। সঙ্গে একজন শিক্ষিকা বা কোচ। দেখে মনে হয়েছে ভারতীয় মহিলা, তাই বিশেষ তাকাননি তিনি। কোনও অচেনা ভারতীয় মহিলার সঙ্গে আলাপ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তাঁর। দলের দুটো ছেলে মনে হল এখানে কাজ করে অভ্যস্ত, তারা মার্লিনকে জিজ্ঞাসা করে আর একটা ঘরে চলে গেল। ওই ঘরে বিরাট-বিরাট ফ্রিজারে মাংস, সি ফুড রাখা আছে। মার্লিন দেখিয়েছে। ভারতীয় মহিলাটির কাছে বসে ভীষণ রোগা আর ছোটখাট চেহারার মেয়ে, চোখে খুব পাওয়ারের চশমা, ঠোঁটদুটো একটু খোলা। আগত ইস্টারের জন্য বোধহয় রংবেরঙের প্লাস্টিকের ডিমের খোলায় ছোট-ছোট চকোলেট ভর্তি করছে। খুব আস্তে-আস্তে। খুব মমতায় তাকে সাহায্য করছেন ওই শিক্ষিকা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটির মুখের পাশ থেকে বেরিয়ে আসা লালা সযত্নে মুছে দিলেন। হাতে ঢেলে দিলেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। চোখ সরিয়ে নিলেন তিনি।
মার্লিনের কাছে শুনেছেন, ডোনেট করা খাবার তাঁরা সকালে এসে গুছিয়ে রেখে যাবেন আর বিকেলে আসবেন সেই সব মানুষেরা, যাঁদের খাবার প্রয়োজন। এক ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি, বারবার আলোর কথা মনে হচ্ছে। কবে কথা বলতে পারবেন মেয়ের সঙ্গে! তাহলে তাকে বলতেন, ফুড-প্যান্ট্রির কথা। কতবার যে মেয়েকে এরকম কত অর্গানাইজেশনের দরজায় ছেড়ে গেছেন! কত জায়গায় স্বেচ্ছাশ্রম করত মেয়েটা। তিনি জানতেন, কলেজ অ্যাপ্লিকেশনের সময়ে এগুলো কলেজ কর্তৃপক্ষ দেখে, শুধু পড়াশোনা করলে এদেশে হয় না। তোমার চারপাশের সঙ্গে কতটা যুক্ত তুমি সেটাও দ্যাখে। তবে মেয়ের বাড়াবাড়ি রকম কাজে বিরক্ত হতেন, কিন্তু নিজের সার্কেলে কথা বলার সময়ে ‘উফ! মেয়েটা যে কী পরিমাণ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়, সারাক্ষণ আজ অ্যানিম্যাল শেলটারে, কাল হাউজিং প্রজেক্টে…’ গুঁজে দিতেন; যাতে সবাই জানে তাঁর মেয়ে কতটা সহানুভূতিসম্পন্ন, সমাজসচেতন।
মেয়েকে ছেড়ে গেছেন এমন কত দরজায়, কখনও ভেতরে আসেননি তো! ভেতরটা আবার যেন মেঘে ভরে যাচ্ছে। আলো, তুই কোথায়? চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বন্ধ চোখের পাতায় সেই কলেজে ছেড়ে আসার সময়ে… কোঁকড়ানো চুলে ভরা মেয়ের মাথাটা, পিছন ফিরে চলে যাচ্ছে। কেন? তারপর তো আলোর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে! আলো এসেছিল ক্রিস্টমাসের ছুটিতে, ছিল। ক্রিস্টমাস থেকে নিউ ইয়ার। পার্টির পর পার্টি। হলিডে পার্টিস। ঝলমলে। মাঝরাত পেরনো। সুখাদ্য, মহার্ঘ পানীয়। বাড়িতে দূর শহর থেকে আসা অতিথিরা। সান ফ্রান্সিসকোর দামি রেস্তোরাঁ। মেয়েকে দেখলেন কোথায়? পেলেন কখন? জানুয়ারির প্রথমেই মেয়ে বাবার কাছে ফ্লোরিডা চলে গেল। কেন সে-সময়ে বাড়িতে থাকা মেয়েটার মুখ একদম মনে পড়ছে না? শুধু পেছন ফিরে মেয়ের চলে যাওয়াটা…
কাজ করতে-করতে তিনি আড়চোখে দেখলেন সে ঢুকেছে, যার প্রতীক্ষা তিনি করছিলেন। করেন। হাতে ঝাড়ুটাকে মাইকের মতো করে ধরে কী যেন গাইতে-গাইতে ঢুকল মাইক। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক আকাশ হাসি ছড়িয়ে মাইক বলল, ‘হ্যালো মাই ফ্রেন্ডস!’ তিনি স্পষ্ট দেখলেন, ধূসর ঘরের আলো একটু যেন বেড়ে গেল। সবাই হাসছে। সবার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে তাদের কাছে এসে দাঁড়াল সে। তিনি হাত বাড়লেন। আশ্চর্য নরম হাত বাড়িয়ে মালবিকার সঙ্গে ফিস্ট বাম্প করল। ছেলেদুটোর সঙ্গেও। ওই হাতের স্পর্শে পৃথিবীর সব কাঠিন্য যেন নরম হয়ে যায়।
৪
হঠাৎ ওই ধূসর ঘরে এক ঝলক আলো, তার সঙ্গে যেন বসন্তের হাওয়া— দরজা খুলে গেল। একটু জড়ানো উচ্চারণে, ‘হাই মার্লিন, হাই ব্র্যান্ডন’। এক মুখ হাসি আর যেন আলো ছেনে বানানো… কী তাজা মুখটা! ছোট, গোলগাল, মাথায় উলটো করে বেসবল টুপি পরা। অল্প বয়স। ডাউন সিনড্রোমের মানুষ। দেখেই বোঝা যায়। হাতে একটা ঝাড়ু, ঢুকেই পরিষ্কার করতে লাগল এক অদ্ভুত ছন্দে; তার সাথে চলতে লাগল কথা, ঘরের সকলের সঙ্গে।
‘কেমন আছ? কেমন ছিল আজকের দিন?’ ভারতীয় মহিলার মুখে যেন বালব জ্বলে উঠেছে। চেয়ার থেকে উঠে এসে আলতো হাতে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন। ওই রোগা ছোট্ট চেহারার মেয়ের মুখেও হাসির ছটা, ‘হাই কোর্টনি!’ বাকি ছেলেদুটো পেছনের ঘর থেকে এসে হাই ফাইভ করল। ‘দারুন কাটুক তোমাদের দিন, ঈশ্বর তোমাদেরকে অনেক আশীর্বাদ করুন।’ এভাবেই সে এল তাঁর কাছে। মালবিকা নিজের থেকেই বলে উঠলেন, ‘হাই আমি মালা আর তুমি?’ ‘আমি মাইক, মাইটি মাইক।’ একটা হাত দিয়ে এক বিশেষ মজার ভঙ্গি করল। ‘তোমার সপ্তাহের বাকিটা খুব ভাল কাটুক। পরে দেখা হবে।’ বলতে-বলতে সে চলে যাচ্ছে, আলো ছড়াতে-ছড়াতে। মালবিকা তাকিয়ে আছেন। কী যেন একটা হল। গাড়ি করে ফিরছেন যখন, কোন জাদুতে যেন তাঁর মন থেকে মেঘ উড়ে গেছে। ফোন বেজে উঠল, আলোর ফোন।
‘হ্যালো মা, কেমন আছ?’
‘ভাল আছি রে। তুই বল!’
‘তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
ভেতরটা কেমন শান্ত হয়ে এল। কথা তো বলতে চাইছে মেয়ে। তিনি প্রস্তুত।
৫
দু’মাস কেটে গেছে। বেশ কিছু জিনিস পালটে গেছে। এর মধ্যে তিনি নতুন একটি চাকরি পেয়েছেন। এখনও তিনি সপ্তাহে একদিন ফুড ব্যাংকে যান আর সপ্তাহান্তে আর একটি সংস্থায় অ-ইংরেজিভাষী একজন ইমিগ্র্যান্টকে ইংরাজি শেখান। দু’মাস আগে যেদিন আলোর ফোনটা আসে, উদ্বেগ-অভিমান কোনওটাই বাইরে আসেনি। স্বাভাবিক গলায় বলেছিলেন—
‘কী হয়েছে তোর? কোনও বিপদে পড়েছিস?’
‘কী বিপদ?’
‘আমি জানি না। তুই বল? ড্রাগ বা অন্য কিছু? তোর মনখারাপ?’ ডিপ্রেশন কথাটা কেন যে বলে উঠতে পারলেন না!
‘আর কিছু আছে, না তোমার লিস্ট শেষ মা?’
‘টাকা দরকার? গাড়ি ছাড়া অসুবিধা হচ্ছে?’
‘মা!’ আলোর গলাটা ঝনঝনে।
‘তুমি আমাকে কতটা চেনো বলো তো? আমি কীসে খরচ করব?’
‘আমি কী করে জানব আলো?’
‘আমি, আমি স্পোর্টস শু ছাড়া কবে কী দামি কিনি?’
সত্যি তো! মেয়ে কলেজে গেল, ডর্মের ঘর নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি, ইন্সটাতে কত যে লাইক পেয়েছেন! ‘মালবিকা আমার মেয়ে কলেজ যাবার আগে তোকে কনসাল্ট করব। ডর্মরুম কে বলবে? কী করেছিস!’ মেয়ের গ্র্যাজুয়েশন পার্টি, সুইট সিক্সটিন, তেরো বছরের জন্মদিন প্ল্যানিং, এক্সিকিউশন সব তাঁর। মালবিকার। এক ঝলকে যেন তাঁর অর্ধেক জীবন চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল। তাঁর আর আলোর।
‘মা আমি কলেজ কন্টিনিউ করতে চাই না। এই মুহূর্তে তো নয়ই!’
‘মানে?’
‘তোমার মনে আছে, লাস্ট সামারে জ্যামাইকা গেলাম? ওখানে একটা গ্রামে একটা স্কুল বিল্ডিং তৈরি করতে সাহায্য করতে? তিন-চার সপ্তাহে ওই প্রজেক্ট শেষ হয়নি, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। সেটা শেষ করা, তাছাড়া চারটে ওরকম স্কুল বানাতে হবে আশেপাশের কয়েকটা জায়গায়। তাছাড়া বাচ্চাদের বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপ, অন্য কয়েকটা আইল্যান্ডে আরও কাজ। খুব লম্বা প্ল্যানিং মা। এক বছরের ওপর তো বটেই, তার বেশিও হতে পারে!’
চুপ করে মেয়ের কথা শুনছেন তিনি। ভেতরটা নিস্তব্ধ। তারপর সাড়া ফিরে এল। হুড়মুড় করে। তাঁর বন্ধুদের কথা। ‘আলো এরপর কী করবে?’ ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং? আইওয়া? এন ওয়াই ইউ? বাডিং রাইটার আমাদের মধ্যে?’ অম্বরীশকে নিয়েও তো করেছে! তার চাকরিতে কী সমস্যা, কেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে একাডেমিয়া, তাঁদের সম্পর্ক। প্রশ্ন থাকবেই সারাজীবন। যতদিন বাঁচবেন। তবে কোথাও যেন ধীরে-ধীরে এই প্রশ্নোত্তরের পর্বটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। শরীর যেন জলোচ্ছ্বাস, চলে যাবার পর নির্জন নদীতট। শান্ত।
‘মা চুপ করে গেলে তো?’
‘আলো, পরে যখন তোমার পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করবে? তখন?’
‘মা, তখন আমি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ব না। স্টেট ইউনিভার্সিটি বা কমিউনিটি কলেজে পড়ার চেষ্টা করব। স্কলারশিপ নিয়ে।’
মালবিকার গলাটা ভেঙে গেল প্রথমবার। ‘আলো, আমি ভাবতাম কলেজ অ্যাপ্লিকেশনে ক্রেডিট পাবার জন্য তুই ওগুলো করিস। অত কমিউনিটি ওয়ার্ক। আমি তো…’ গলা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর।
‘মা, ক্যামেরা অন করবে? তোমাকে দেখাতাম।’
ফোনের ওপারে একটা খালি ঘরে ছড়ানো অনেক প্যাকিং বাক্স, জিনিস। একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, বাক্স তৈরি করছে। তাঁকে পুরো চমকে দিয়ে ক্যামেরাজুড়ে আলো। বড়-বড় চোখ। চোখের নীচে কালো ছাপ, এক মুখ হাসি। মাথার কোঁকড়ানো চুলে উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা। ‘মা এই দ্যাখো, জ্যামাইকা যাবার প্যাকিং প্রায় হয়ে এসেছে।’ আঠেরো বছরের আলোর ওই মুখখানা যেন এক লহমায় শুষে নিল মায়ের হৃদয়। অনু-পরমাণু সাইজ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল শরীরে, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে।
৬
আজ দু’মাস বাদে ওই মুখটাকে চোখের পাতায় ধরে রেখে ঢুকে পড়লেন ‘গিভিং হ্যান্ডে’। ছ’সপ্তাহ আগে জ্যামাইকা চলে গেছে আলো। কখনও তার টেক্সট পান, ফোন করে সে; কখনও দিনের পর দিন কেটে যায় যোগাযোগহীন। আজ গিভিং হ্যান্ডে ঢুকতেই, অমৃতা তার ছাত্রী কোর্টনিকে দিয়ে একটা-একটা করে আপেল সসের প্যাক সাজিয়ে রাখছেন তাকে। তিনি এখন জানেন, কোর্টনির দুরারোগ্য মাসেল উইকনেস আছে, অনেক ক্ষেত্রে সে বড্ড দুর্বল। সে স্কুলে আসে। কমিউনিটির জন্য কাজ করতে আসে। নিজের জন্যও। অমৃতা তাকে সমস্ত দিনটাতে গাইড করেন অসীম ধৈর্যে। ওদের সঙ্গে একটু কথা বলতে-না-বলতেই, পিছনের ঘর থেকে মার্লিন ডাকল তাঁকে।
‘মালবিকা, আজ তুমি অমৃতার দুই স্টুডেন্টের সঙ্গে ফ্রেশ ফ্রুটসগুলো খুলে ক্রেটে সাজিয়ে ফেলবে প্লিজ? আজ নীনা আসেনি।’ ‘সিওর মার্লিন। নীনা তো বোনের কাছে ফ্লোরিডা গেছে। কাম অন বাডিস।’ ছেলেদুটোকে নিয়ে লেগে গেলেন কাজে। টাটকা ফল তেমন আসে না ফুড-প্যান্ট্রিতে। বেশির ভাগ ক্যানে। তাই যেদিনই টাটকা ফল আসে, মালবিকার মন ভাল হয়ে যায়। ক্রেটে কমলালেবু সাজাতে-সাজাতে তিনি যেন দেখতে পান, বিকেলে দুটি বাচ্চাকে নিয়ে আসা কোনও মা ব্যাগে করে চার-পাঁচটা টাটকা লেবু নিয়ে যাচ্ছেন, আপেল নিয়ে যাচ্ছেন, তার মুখ আলোয় ভরা। মালবিকার ভেতরটাও কেমন উষ্ণ হয়ে যায়।
কাজ করতে-করতে তিনি আড়চোখে দেখলেন সে ঢুকেছে, যার প্রতীক্ষা তিনি করছিলেন। করেন। হাতে ঝাড়ুটাকে মাইকের মতো করে ধরে কী যেন গাইতে-গাইতে ঢুকল মাইক। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক আকাশ হাসি ছড়িয়ে মাইক বলল, ‘হ্যালো মাই ফ্রেন্ডস!’ তিনি স্পষ্ট দেখলেন, ধূসর ঘরের আলো একটু যেন বেড়ে গেল। সবাই হাসছে। সবার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে তাদের কাছে এসে দাঁড়াল সে। তিনি হাত বাড়লেন। আশ্চর্য নরম হাত বাড়িয়ে মালবিকার সঙ্গে ফিস্ট বাম্প করল। ছেলেদুটোর সঙ্গেও। ওই হাতের স্পর্শে পৃথিবীর সব কাঠিন্য যেন নরম হয়ে যায়।
তিনি অপেক্ষা করছেন, যদি সে বলে ‘তোমার সপ্তাহের বাকিটা ভাল যাক’, ‘তোমার বাকি দিনটা ভাল যাক’।
সেই প্রথমদিনের মতো। একবার বলো মাইক। একবার। আজ চারদিন হল সেন্ট লুসিয়া দ্বীপে পৌঁছনোর পর থেকে কোনও খবর পাননি আলোর। একটা ঝড় এসেছিলো বেশ কয়েকটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপে, তারপর থেকে কোনও খবর নেই। ইন্টারনেট-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। না, বলল না মাইক। হেসে চলে গেল। তবে তার চারপাশে ছড়ানো আলোটুকু একটুও কমল না। ক্ষীণ হয়ে গেলেও মালবিকার মুখেও থেকে গেল হাসিটা। বারবার কি তার করুণা নেমে আসে? একবারই হয়তো।
আজকাল তাঁর আর কোনও তাড়া নেই। কাজ তাঁর অনেক কম। এখন তিনি অনেক কম মাইনের, অনেক কম দায়িত্বের চাকরি করেন। নিজেকে প্রমাণ করার চাপ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। আজ বিকেলে তিনি তাঁর এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবেন। গল্প করবেন। এখন তাই করেন। অনেকদিন দেখা না হওয়া কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একজন বন্ধুকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কথা শোনেন, কথা বলেন। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন, বুঝতে পারেন, পার্টির চাকচিক্যের বাইরে তাদের সকলের শরীর-মন আস্তে-আস্তে কত ভঙ্গুর হয়ে আসছে। বন্ধুর সঙ্গে কফিতে চুমুক দিতে-দিতে, বিকেলে অকারণ চেনা-অচেনা দীর্ঘ পথ হাঁটতে-হাঁটতে, দেশে ভিডিও কলে বহুদিন যোগাযোগ না-থাকা কোনও প্রিয়জনের আনন্দে ভরা মুখটা দেখতে-দেখতে মনে হয় পারবেন তিনি— অপেক্ষা করতে, আলোর। আর কিছু না হোক, এখন চাইলেই ফোনে দেখা তাঁর মেয়ের সেই হাসিভরা মুখটুকু তো রয়ে গেছে তাঁর সঙ্গে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র