চা ভারতবর্ষীয় কোনও পানীয় নয়। চীন থেকে ইউরোপে যাওয়া চা এক সময়ে ইংরেজ-শাসিত ভারতবর্ষে আসে। প্রথম-প্রথম, মূলত স্বদেশি অন্দোলনের আবহে চায়ের বিরুদ্ধে বাঙালির একটা প্রতিরোধ, হয়তো-বা একটা সন্দেহ এবং সংশয়মিশ্রিত অনীহা গড়ে উঠেছিল। তার একটা কারণ হিসেবে যেমন ধরে নেওয়া যায়, চা-কে এক ক্ষতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত নেশা হিসেবে দেখার প্রবণতা, তেমনই হয়তো-বা আর একটা কারণ ছিল স্বদেশের চা-বাগানগুলোয়, ইংরেজের হাতে চা-শ্রমিকদের অসহনীয় শোষণের একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিক্রিয়া।
আরও পড়ুন: হিন্দু সমাজের রীতিনীতির বাইরে গিয়ে, মহিলাদের চা খাওয়ার নজির পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু তা সাধারণ জনজীবনে ছিল একবারে বিরল ঘটনা! লিখছেন সম্প্রীতি চক্রবর্তী…
ওই সময়ে বহু শিক্ষিত বাঙালি চা পানকে বিষ পান বলে মনে করছিলেন, চা বর্জন করার কথা বলছিলেন, চা পানের অভ্যাসকে সস্তা এবং হীন একটা অভ্যাস বলে মনে করছিলেন। প্রশ্ন থাকেই, চীনে প্রসার লাভ করা চা পানের এই সুপ্রাচীন ধারাকে একেবারে বর্জন করার কথা না ভেবে, যেভাবে চীন চা খায়, জাপান চা খায়, সেইভাবে বাংলা অথবা ভারতবর্ষ চা-এর অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা তাঁদের কেউ করেছিলেন কি না! এক কথায় এর উত্তর সম্ভবত, না। যদিও চীন-জাপান ঘুরে এসে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এক চীনা চা চক্র প্রবর্তন করেছিলেন, এবং পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে জাপানি চা উৎসব শেখাতে জাপানি শিক্ষিকাকে শান্তিনিকেতনে গ্রহণ করেছিলেন, সেই চা উৎসব শান্তিনিকেতনে খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। সম্ভবত তার শক্তি এবং আত্মাকে বোঝার ক্ষমতা ওই সময় এদেশে কারও তৈরি হয়নি এবং প্রক্রিয়াগতভাবে জটিল চা উৎসবের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং উপকরণের জোগানও চীন-জাপান থেকে নিয়মিতভাবে শান্তিনিকেতনে নিশ্চিত করা যায়নি।
আমাদের দেশে মূলত দু’ধরনের চায়ের ধারা দেখা যায়। দুধ চা এবং দুধ ছাড়া চা। কিন্তু চা করা এবং চা খাওয়ার পদ্ধতির ভিতর চীন বা জাপানের মতো কোনও অভিনবত্ব চোখে পড়ে না। জাপানে ‘সাদো’ বা চা উৎসব বলে যে-অনুষ্ঠান প্রচলিত, তার সঙ্গে ওই দেশে প্রতিদিনের চা পানের অভ্যাসের কিছু ফারাক রয়েছে। আমাদের দেশে চা করা এবং চা খাওয়াটা কেন চীন বা জাপানের মতো নান্দনিক আভিজাত্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে না, ভাবতে-ভাবতে আমি এক ভারতবর্ষীয় চা উৎসবের প্রবর্তন করেছিলাম, যার নাম দিয়েছিলাম ‘বোধি চা উৎসব’।
শান্তিনিকেতনে জাপানি স্থপতির নকশায় এক চা-গৃহকে কেন্দ্রে রেখে আমার একটা ছোট্ট বাড়ি রয়েছে, যার নাম ‘কোকোরো’ অর্থাৎ হৃদয়। এই বাড়িই বোধি চা উৎসবের জন্মস্থান। এই ভারতবর্ষীয় চা উৎসব আমি রচনা করেছি মূলত চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতবর্ষের চা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণে। কিছু নির্দিষ্ট সরঞ্জাম এবং উপকরণ ব্যবহার করে, সুন্দর পরিবেশে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এক সহজ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় এই বোধি চা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
ফুল সাজিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে প্রথমে মনকে জাগিয়ে তোলা; চায়ের সরঞ্জাম গরম জলে ধুয়ে তাদের জাগিয়ে তোলা; এরপর কিছু নির্দিষ্ট প্রথায় চায়ের পাতা গরম জলে ভিজিয়ে চা করা, হাতলবিহীন ছোট্ট-ছোট্ট পেয়ালায় অতিথিদের চা পরিবেশনের আগে এক অতি ক্ষুদ্র পেয়ালায় (আমি যার নাম দিয়েছি মানবতার পেয়ালা) আমাদের পূর্বপুরুষ এবং চা-সংস্কৃতিতে অবদান রেখে যাওয়া পরিচিত এবং অপরিচিত অগণিত মানুষের উদ্দেশে কয়েক বিন্দু চা উৎসর্গ করে তারপর নিজে চা পরীক্ষা করে দেখে অতিথিদের বিশ্বাস অর্জন করে তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে চা পরিবেশন করাই বোধি চা উৎসবের ভিত্তি রচনা করে।
এই চা উৎসবের সঙ্গে, চীন বা জাপানের মতোই জড়িয়ে থাকে ছোট্ট-ছোট্ট কবিতা, ফুল সাজানোর শিল্প, ক্যালিগ্রাফি, সেরামিক শিল্পের মতো নানা শিল্পকলা। অপূর্ণাঙ্গতা, সহজতা, অনিত্যতা, অসম্পূর্ণতার সৌন্দর্য এবং আনন্দই, বলা চলে, এই ভারতবর্ষীয় বোধি চা উৎসবের আত্মা। এই বোধি চা উৎসবের প্রয়োজন, সার্থকতা, সাফল্য নিয়ে যাঁরা আমাকে প্রশ্ন করেন, তাঁদের আমি অনেক সময়ে একটা জেন উপাখ্যানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে থাকি। এক মন্দিরে এক সাধক চা-আচার্য এক নবাগত সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আগে এখানে কখনও এসেছেন?’ সন্ন্যাসী বললেন, ‘না।’ সাধক বললেন ‘এই নিন, চা।’ এরপর আর এক সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আগে এখানে কখনও এসেছেন?’ সন্ন্যাসী বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সাধক বললেন ‘এই নিন, চা।’ এই দেখে ওই মন্দিরের পরিচালক, সাধককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচার্য, যিনি এখানে আসেননি তাঁকেও, যিনি আগে এখানে এসেছেন তাঁকেও বললেন ‘এই নিন, চা’, ব্যাপারটা কী?’ এই প্রশ্নের উত্তরে বিদগ্ধ মন্থরতায় আচার্য ওই মন্দির-পরিচালককে একটি পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন, চা।’
শান্তিনিকেতনের এক প্রকৃতি-ঘেরা, শান্ত, ছোট্ট কুটিরে শুরু হওয়া ‘বোধি চা উৎসব’ আমার জীবনপথের নিত্যসঙ্গী। এই ভারতবর্ষীয় চা উৎসব কি একদিন চীন-জাপানের চা উৎসবের মতো আদৃত হবে? এই চা উৎসব কি একদিন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, না কি তা আমার মতো এক তুচ্ছাত্মার ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক্ষণকালের ছন্দ হয়ে অনন্ত মহাবিশ্বের আনন্দধারায় বিলীন হবে? আমার দরজায় আজ কেউ এসে এই প্রশ্ন রেখে গেলে আমি শুধু তাঁকে বলে যেতে পারি, ‘এই নিন, চা!’
ছবি সৌজন্যে: লেখক