আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, আমি আর গার্গী বসে অনেক কথা বলেছিলাম রণেনকাকাকে নিয়ে। গার্গী, অর্থাৎ, গার্গী গুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্তর কন্যা। এই মার্চের গোড়ায় আবার মনে পড়ছে সেসব। রণেনকাকা তখন খুবই অসুস্থ। তবু আশা করেছিলাম, করে চলেছিলাম আমরা, ওই আড্ডায়— হয়তো আবার নতুন করে শুরু হবে সব কিছু। কিন্তু তার কিছুই যে হয়নি, এ-কথা আজ কে না জানে! ’২৪ সালের ৩ মার্চ, রণেন আয়ন দত্ত চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। শরীরেই অবশ্য, স্মৃতি থেকে নয়। বাবা ও রণেনকাকার আড্ডার গল্প… ভোলা কি যায়! গার্গী রাধাপ্রসাদ গুপ্তর অল্পবয়সের ছবি জড়ো করছিল, সেই কর্মকাণ্ডর সৌজন্যে আরও একটা ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, অল্পবয়সি রাধাপ্রসাদের সঙ্গে অল্পবয়সি রণেন। টাটা স্টিলের কোনও স্টল ডিজাইন করেছিলেন বোধহয় রণেনকাকা, সেখানে বসে তোলা। দু’জনের দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। ডোভার রোড (রণেনকাকা) আর ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সে (আর পি) যদি দুই বন্ধুর বাড়ি হয়, বন্ধুত্বের সমীকরণ অনুমান করে নিতে আশা করি কারওরই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়!
ছোটবেলায় রণেনকাকাকে দেখেছি তো বটেই, কিন্তু সেভাবে দেখেছি কি? মনে পড়ে না! রণেনকাকার সঙ্গে ‘সেভাবে’ আলাপ হল, গত শতাব্দীর শেষদিকে। ১৯৯৯ সালে। যোগাযোগের কারণ, সেবারে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বসন্ত চৌধুরী, রণেন আয়ন দত্ত, মৃণাল সেন এবং গিরিজা দেবীর সাম্মানিক ডক্টরেট প্রাপ্তি। এই তালিকায় আরও কেউ-কেউ থাকতে পারেন হয়তো, স্মৃতিতে নেই। বাবার সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানেও আমি গেছিলাম, ফলে সেদিন রণেনকাকার সঙ্গে অনেক কথা হয় নানা বিষয়ে।
আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে রণেন আয়ন দত্ত-র ছিল তুই-তোকারির সম্পর্ক। হাতে-গোনা কয়েকজনকেই বাবা ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। রণেনকাকা সেরকমই একজন। উনিও বাবাকে ‘তুই’ করেই বলতেন। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়ে, যখন ওঁদের বন্ধুত্ব জমে উঠেছে বেশ, বাবা রণেনকাকার বাড়ি থেকে একটা ছবি তুলে নিয়ে চলে এসেছিলেন। ফেরত দেননি। এই ঘটনা আমি জানতে পারি ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে। রণেনকাকা মজার ছলে বাবাকে বলছিলেন আমার সামনেই। সেই ছবি রণেনকাকা তখন উপহার দেন আমাকে। বহু বছর ধরে আমার বেডরুমে যে-ছবি রয়েছে, তার ইতিহাস যে এত বিচিত্র, কে জানত!
আরও পড়ুন : কলকাতা নয়, ‘ক্যালকাটা’-র লোক ছিলেন প্রীতীশ নন্দী!
লিখছেন অঞ্জন দত্ত…
বাবা ২০০০ সালে মারা যান। তারও অনেক পরে আমি একদিন রণেনকাকার ছবি তুলতে চাইলে উনি রাজি হয়েছিলেন। ওঁর অনেক ছবি তুলে নিয়ে এসেছিলাম। ছবিগুলো আমার বিচারে বেশ একটু অন্যরকম হয়েছিল বলে, কয়েকটা প্রিন্ট করিয়ে রণেনকাকাকে দিতে যাই একদিন। মনে আছে, উনি আমায় অসংখ্য প্রশ্ন করেছিলেন। লেন্স, ডাইমেনশন— এই সবকিছু নিয়েই। প্রায় একটা টেকনিক্যাল ডিসকোর্স বলা চলে। কবুল করি, ওই বয়সেও এত ঔৎসুক্য যারপরনাই অবাক করেছিল আমায়।
‘তপন একদিন রাতে বাড়িতে এল। ততদিনে ‘কাবুলিওয়ালা’র শুটিং শেষ। এসে বলল, পরশুদিন সকালে পোস্টারটা নিয়ে যাব। আমি পড়লাম মুশকিলে! সাইজ জানা, ডিজাইনটাও মোটামুটি ভেবে রেখেছি, কিন্তু একদিনের মধ্যে করব কী করে!’
চাকরির বাইরেও উনি প্রচুর ডিজাইনের কাজ করতেন। এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি, ওঁর মুখেই শোনা। ওয়াল্টার থম্পসনে উনি তখন কর্মরত। সাহেবি কোম্পানি, সাহেব বস। তো একবার সাড়াজাগানো একটা বিজ্ঞাপনের কাজ দেখিয়ে রণেনকাকার বস ওঁকে বলেছিলেন, ‘আরে, বাহ্! এই কাজটা যিনি করেছেন, তিনি তো পুরো তোমার মতোই করেছেন দেখছি!’ আসলে বুঝিয়ে দেওয়া, কাজটা কার, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সাহেবি কায়দায়, ভদ্রভাবে ঘুরিয়ে বলা। এই গল্পগুলো বলার সময়ে রণেনকাকার চোখমুখ কীরকম শিশুর মতো হয়ে যেত।
আরও একদিন, রণেনকাকা আর আমি গল্প করছি বসে, কথা উঠল ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমার পোস্টার নিয়ে। উনি প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি পোস্টারটা দেখেছি কি না! আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই আলোচনা অন্যদিকে মোড় নেয়। সেদিন ওঁকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম যে, ওই স্টাইলটাই কেন! তখন উনি গল্পটা বললেন, ‘তপন একদিন রাতে বাড়িতে এল। ততদিনে ‘কাবুলিওয়ালা’র শুটিং শেষ। এসে বলল, পরশুদিন সকালে পোস্টারটা নিয়ে যাব। আমি পড়লাম মুশকিলে! সাইজ জানা, ডিজাইনটাও মোটামুটি ভেবে রেখেছি, কিন্তু একদিনের মধ্যে করব কী করে! অয়েল মিডিয়ামে যেভাবে ভেবে রাখা, সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করলে তো শুকোতেই সময় চলে যাবে অনেকটা! অনেক ভেবেচিন্তে শেষে কাগজ কেটে-কেটে পোস্টারটা করি।’
এই যে দ্রুত একটা মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে সরে গিয়ে কোনও শিল্পকর্মকে অসামান্য করে তোলা— এই গুণটা রণেনকাকার মধ্যে ছিল। আজীবন তিনি তা লালন করে গেছেন।