ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • আমার শিক্ষক

    শেখর সমাদ্দার (March 2, 2025)
     

                                    
    এ এক অদ্ভুত সময়, যখন আমার চারপাশ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি, এখন আমি সিনিয়র সিটিজেন, প্রাক্তন। এমনিতে আমি খুব স্মৃতিকাতর মানুষ নই, কিন্তু বয়স হয়ে গেছে— এই কথা মানতে এখনও মন রাজি নয়। এখনও সময় আমাকে সেই বৃদ্ধ চেহারাটি উপহার দেয়নি যে, অপু থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়— এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে আমি দেখতে পাব, আমার যৌবন আর আমার এই আমি-র মাঝখানে নির্বিবাদে কোনও পঞ্চাশ বছর শুয়ে আছে। কিন্তু সে আর কতদিন আগে, এই তো সেদিন যাদবপুরে এমএ পড়তে-পড়তে বহুরূপী-তে গেলাম। সেখানে সবেমাত্র মিত্র সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত গেছে, তার দীর্ঘ ছায়া রয়ে গেছে অনুগামীদের মধ্যে এবং ড্রামা অ্যান্ড সং ডিভিশনের বড় অফিসার অমর গঙ্গোপাধ্যায় দিল্লি থেকে গোলপার্কের সাদা বাড়ির অফিসে এসে বসেছেন, আছেন ইনচেক টায়ারের জেনারেল ম্যানেজার কালীপ্রসাদ ঘোষ, ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার দেবতোষ ঘোষ, সেন্ট্রাল এক্সসাইজের অফিসার, আমার বাবার সহকর্মী শান্তি দাস এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের অধ্যাপক কুমার রায়। ২০১০-এ ৮৪ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর প্রয়াণ দিবস ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি, আবার আজ, ২ মার্চ তাঁর জন্মদিন। এবং,আরও বিস্ময়কর এই যে, আর-এক বছর পরে, ২০২৬-এ তাঁর শতবর্ষ হবে! 

    ওই পাঁচজনের মধ্যে কুমার রায়কেই বহুরূপী-র নাট্য নির্দেশনা এবং ‘বহুরূপী’ পত্রিকা সম্পাদনা এবং অন্যান্য কাজের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ফলত তিনিই ছিলেন আমার এবং আমার মতো আরও অনেকের প্রথাগত নাট্যশিক্ষার গুরু। তিনি খুব ভাল ছবি আঁকতেন [তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইন্দ্রপ্রমিত রায় যে ছবির জগতে এক বিখ্যাত নাম, তাতে তাঁর পিতার অবদান নিশ্চয় আছে], অত্যন্ত ভাল মেক-আপ করতেন, অর্থাৎ নাট্যকলার সঙ্গে যুক্ত যে যে চারুকলা, তার সব ক’টি বিভাগে তাঁর স্বাভাবিক পটুত্ব ছিল। বন্ধু সুরেন চক্রবর্তীকে দিয়ে ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের মঞ্চে প্রাসাদের নিম্নভাগে যে থার্মোকলের হাতির মোটিফগুলি বানিয়েছিলেন, তার ডিজাইন তিনি নিজে করিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক পরে কোনারকের সূর্যমন্দিরে গিয়ে সেই হাতির উৎস খুঁজে পেয়েছি।

    আরও পড়ুন : বাংলা থিয়েটারে চ্যারিটি নাইট করেছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ! লিখছেন আশিস পাঠক…

    ইত্যবসরে জানিয়ে রাখি, আজকের দিনের মঞ্চশিল্পীরা অনায়াসে ডিজিটাল প্রিন্ট বা ফাইভার গ্লাস মেটেরিয়াল ব্যবহার করেন, খালেদ চৌধুরী, যাকে কুমারকাকা বলতেন ‘খালেদ সাহেব’, তাঁর অকৃত্রিম অনুরাগী কুমার রায় আজকের পরিভাষায়, যাকে ‘অর্গানিক’ বলে, সেই মঞ্চেই বিশ্বাসী ছিলেন। খালেদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকের পরে আর বহুরূপী-র জন্য কাজ করেননি, করলেন বহু বছর পর, কুমার রায়ের নির্দেশনায়, গিরিশ কারনাডের ‘যযাতি’ নাটকে। সেই খালেদ চৌধুরী ‘রক্তকরবী’ নাটকে যে শক্ত কাগজে রং করে শ্রমিকদের পাড়া আর সর্দারদের পাড়া আলাদা করতেন, সেগুলি কয়েকটি অভিনয়ের পরে খারাপ হয়ে গেলে নিজে হাতে সেগুলি বদল করতেন। খানিক ‘রক্তকরবী’-র আদলেই বসন্তসেনার প্রাসাদ ভেবেছিলেন কুমারকাকা, এবং সেখানে এবং চারুদত্তর বাড়ির প্যানেলে আমাদের ওই হাতিগুলো সাবধানে কাঁটা-পেরেক দিয়ে লাগাতে হত, যাতে খোলার সময়ে সেগুলো ছিঁড়ে না যায়। বার বার লাগানো-খোলাতে তারা ছিঁড়ে যেতই এবং কিছুদিন পরে তাদের বদলানো হত।

    প্রকৃত সুভদ্র বলতে যা বোঝায়, কুমার রায় ছিলেন তাই। ‘মৃচ্ছকটিক’-এর একটি অভিনয়ে আমি একটি ছেলেমানুষের মতো ভুল করায় তাঁকে যে বিভ্রাটে পড়তে হয়, তার জন্য যারপরনাই রেগে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আমার গায়ে হাত না তুলে, তিনি নিজের দু’গালে চড় মেরেছিলেন, মনে আছে, যা দেখে আমি যাকে বলে, মরমে মরে গিয়েছিলাম।

    কুমার রায়ের অভিনেতা-জীবনের শ্রেষ্ঠ দু’টি কাজ শুনেছি, ‘বিসর্জন’-এর গোবিন্দমাণিক্য এবং ‘পুতুল খেলা’-র ড. রায়। দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমি তাঁর অভিনয়ের অসম্ভব ভক্ত ছিলাম, ‘মৃচ্ছকটিক’-এ চারুদত্ত, ‘গালিলেও’-তে গালিলেও [যে চরিত্রে তিনি পরে করতেন,আগে করতেন অমর গাঙ্গুলি], ‘রাজদর্শন’-এ লম্বোদর ভট্ট ছাড়াও বেশ কিছু নাটকে তাঁর অভিনয় দেখেছি। সত্যজিৎ রায়-তপন সিনহার ছবিতেও তিনি অভিনয় করেন, কিন্তু ফিল্মে তাঁর শ্রেষ্ঠ অভিনয় সম্ভবত পীযূষ বসু পরিচালিত ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ ছবিটি, যেখানে উত্তমকুমারের সঙ্গে একটি দীর্ঘ আদালত দৃশ্যে অসম্ভব ভাল অভিনয় করেছিলেন তিনি। 

    পীযূষ বসু পরিচালিত ‘জীবন জিজ্ঞাসা’-র এক দৃশ্যে

    প্রকৃত সুভদ্র বলতে যা বোঝায়, কুমার রায় ছিলেন তাই। ‘মৃচ্ছকটিক’-এর একটি অভিনয়ে আমি একটি ছেলেমানুষের মতো ভুল করায় তাঁকে যে-বিভ্রাটে পড়তে হয়, তার জন্য যারপরনাই রেগে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আমার গায়ে হাত না তুলে, তিনি নিজের দু’গালে চড় মেরেছিলেন, মনে আছে, যা দেখে আমি যাকে বলে, মরমে মরে গিয়েছিলাম। আবার সেই একই ভদ্রতার কারণে আমার সামান্য অন্যায়কে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে যখন আমাকে হেনস্থা হতে হয়, যার পরিণামে আমি দল ছেড়ে দিই, তখনও সব জেনেও চুপ করে থেকেছিলেন তিনি। 

    দল ছেড়ে দিলেও আজীবন আমার শিক্ষকের সঙ্গে আমার শ্রদ্ধার সম্পর্ক বজায় ছিল। কয়েকবার তিনি অভিমান ছেড়ে ফিরে যেতে বলেছেন, আমারই আর ফিরে যাওয়া হয়নি। দলে থাকতে যেমন নাটকের স্ক্রিপ্ট কপি করতে দিয়েছেন, তেমনই শম্ভু মিত্রের আশি বছর পূর্তি সংখ্যায় ‘রাজা’ নাটকের শম্ভু মিত্র-কৃত স্ক্রিপ্ট কপি করতে দিয়েছেন। বার বার ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় লিখিয়েছেন, কোনও লেখা পড়ে ভাল লাগলে ফোন করে বা দেখা হলে মুক্ত গলায় প্রশংসাসূচক কথা বলেছেন।

    প্রাক্‌-শতবর্ষে আমার শিক্ষককে তাঁর জন্মদিনের প্রণাম জানাই।     

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook