যা ঘটে গেল, ভারতের সংগীতজগতে তা সততই এক ইন্দ্রপতন বলা চলে। এবং খুব বিশ্বাস থেকে একটা কথা বলতে পারি, সারা পৃথিবী ঘোরার পর, ভারতীয় যে জীবিত সংগীতজ্ঞকে গোটা বিশ্ব একডাকে চিনত, যাঁর নামের জোরেই চার-পাঁচহাজার লোক হয়তো জড়ো হয়ে যেত এককথায়- তাঁর নাম এক এবং একমাত্র জাকির হুসেন। পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতীয় সংগীতকে এই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজটা আগে রবিশংকরজি-র মতো কেউ কেউ করেছেন, কিন্তু এ-বিষয়ে শেষ জীবিত স্তম্ভ ছিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। আমার মতে, সত্যিকারের একজন ভারতরত্ন ছিলেন তিনি, যিনি ভারতের সংস্কৃতিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন।
তবলাকে তো মূলত সংগতের যন্ত্রানুষঙ্গ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু তবলাকে যে সম্মান এনে দিয়েছিলেন জাকির হুসেন আবিশ্বে, তার জন্য তবলা-জগতের সকলেই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে আজীবন।
আমার সঙ্গে খুবই ভাল সখ্য ছিল। কিছুদিন আগেই আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। গত বছর আরভাইনের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দু’টি অনুষ্ঠান আমরা করি। একটি জাকিরজি-র সোলো, অন্যটি জাকিরজি-র শক্তি। তখন আমার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। উনি কত বড়মাপের শিল্পী, এবং কত বড় মনের মানুষ ছিলেন, সে-সম্পর্কে একটা ঘটনা বলি। এই অক্টোবর মাসে আমি ওঁকে যোগাযোগ করেছিলাম। চেয়েছিলাম, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তার ছাত্রদের উদ্দেশে উনি কিছু বলুন। উনি এককথায় রাজি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের জন্য তো আমার দরজা সবসময়ই খোলা, অবশ্যই আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলব। তবে শরীরটা ঠিক নেই, তাই কিছুটা সময় দাও।’ তার পরে পরেই উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতটাই ডাউন টু আর্থ ছিলেন উনি। বড় ছিলেন বলেই, আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলেই, নিজেকে এইভাবে আমাদের, ওঁর চেয়ে ছোটদের কাছে তুলে ধরতে পারতেন। মঞ্চে প্রতিটি সহশিল্পীকে কীভাবে সম্মান জানাতে হয়. তা ওঁর থেকে শেখার ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কত বয়স হল আপনার?’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর পরেই আমি, কারণ আমার ৭৩ হল।’ তখনও ভাবিনি, এতটা অকস্মাৎ হবে ওঁর মৃত্যুটা! সত্যিই তো এটা চলে যাওয়ার বয়স নয়। তবলার যে পাঞ্জাব ঘরানা, তার খলিফা ছিলেন জাকির হুসেন। খলিফা অর্থে, যে বংশ থেকে উদ্ভূত হচ্ছে সেই ঘরানা। আল্লারাখা খাঁ সাহেবের ছেলে হিসেবে সেই উত্তরাধিকার তিনি বহন করতেন। একজন খলিফা চলে গেলেন, এটা সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি। যখনই ওঁর কাছে গেছি, পাঞ্জাব ঘরানার বিভিন্ন কম্পোজিশন, তা ওঁর হোক বা ওঁর বাবার, আমাকে দিয়েছেন। আমি সেসব বাজিয়েওছি। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, তবলার জগতে এমন কেউ নেই, যিনি জাকির হুসেনকে নকল করেন না। ওঁর চেয়ে বড়রাও, ওঁর চেয়ে ছোটরাও। তবলার জগতে জীবিত সকলেই কোনও না কোনওভাবে ওঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনই। গত বছর শিকাগোতে আমি তবলা বাজাতে গেছি, তখন আমাকে ওখানে অনেকেই বলেছিলেন, ‘আপনি তো জাকির হুসেনের বাজনা বাজাচ্ছেন!’ অর্থাৎ, পৃথিবী জানত, তবলা মানেই জাকির হুসেন!
আমি ওঁকে ‘জাকিরজি’-ই বলতাম। উনি উত্তরে বারবার বলতেন, ‘গলে লাগা লে।’ আমি ওঁকে নমস্কারই করতে যেতাম। উনি বলতেন, ‘সরস্বতী তোমার ওপরেও ভর করে আছেন, আমার ওপরেও।’ আমি বলতাম, ‘আপনার ওপর একটু বেশিই।’ জাকিরজি হেসে বলতেন, ‘তোমার বয়স বাড়ুক, তোমার ওপরেও ভর বেশিই হবে!’ এতটাই নম্র ছিলেন উনি।
শাস্ত্রীয় সংগীতে কোথায় থামতে হয়, তা অনেকেই মাথায় রাখেন না। সেই পরিমিতিবোধ ছিল ওঁর অপূর্ব! জীবনেও কোথায় থামতে হয়, তা দেখিয়ে দিলেন তিনি। রাজা ছিলেন, রাজার মতোই চলে গিয়েছেন। যেমনভাবে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার বা কিশোরকুমার। শুধু আমাদের অনেক শিক্ষা আর সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)