ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সাক্ষাৎকার : রতন কাহার


    ডাকবাংলা.কম (June 21, 2024)
     

    সিউড়ী শহরের মধ্যে ছোট একটা পাড়া। তার মধ্যে ছোট একটা বাড়ি। সেখানেই থাকেন লোকসংগীতশিল্পী রতন কাহার। ২০২৪ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। তাতে অবশ্য খুব একটা বিচলিত নন তিনি। সাধারণ মানুষের মতোই দিনযাপন করেন এখনও। অনুষ্ঠান করেন প্রায়শই। নব্বই ছুঁই-ছুঁই বয়সেও সম্বল একমাত্র সুর। জীবনের নিঃসঙ্গতাকে ভুলিয়ে রাখেন গান দিয়ে। বিশ্ব সংগীত দিবস উপলক্ষ্যে ডাকবাংলা.কম পত্রিকার পক্ষ থেকে শিল্পীর সঙ্গে কথা বললেন গৌরবকেতন লাহিড়ী এবং নীলাঞ্জন মিশ্র

    ভাদু, ঝুমুর, আলকাপ— এই ধরনের গানের সঙ্গে আপনি দীর্ঘকাল জড়িয়ে। নিজে গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন সেসব গান। আপনার অন্য এক সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারছি, ছেলেবেলায় আপনি মেয়ে সেজে অভিনয় করতেন। সেই প্রসঙ্গটা শুরুতে যদি একটু বলেন…

    এককালে যখন কমবয়স ছিল আমার, এসব করেছি অনেক। যাত্রা করেছি, লেটোতে নেচেছি। একদিন নয়, দিনের পর দিন। তখন তো আর মেয়েরা অভিনয় করত না, ছেলেরাই নারী সেজে সেসব করত। ওটাই সে-সময়ে প্রচলিত ছিল। এখন যুগ পরিবর্তন হয়েছে, মেয়েরা অভিনয় করছে; তবে দেখবেন, এখনও কোনও-কোনও অঞ্চলে ছেলেরা মেয়ে সেজে যাত্রা করে, গান গায়। এখন মনে হয়, সেই মেয়ে সেজে গান করা কিংবা অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই আমি আসলে সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে মিশে যেতে পেরেছিলাম। আমার বাড়িতে কোনও কালচার ছিল না, কালচার ছিল শুধু মামাদের। তাঁরা গানবাজনা করতেন, এবং তাঁদের একটা লেটোর দলও ছিল। মামাদের দেখেই আমি প্রথম গান করতে শিখি। তারপর বড়-বড় রেকর্ড দেখতাম, যেখানে গীতিকার-সুরকার সব আলাদা করে লেখা থাকত। ওই দেখে আগ্রহ হত খুব। মনে হত, নিজেও এরকম গান লিখব। এইভাবে সাধনা করতে-করতে, একদিন মা সরস্বতী আমায় কৃপা করেছেন। এখন তো ‘অভাব’ শব্দটার সেই অর্থে কোনও মানে নেই, কিন্তু আমি ছিলাম সত্যি-সত্যিই একজন অভাবী ঘরের ছেলে। তা সত্ত্বেও আমি এইদিকেই মন দিয়েছি। বাড়ির অবাধ্য ছিলাম, সেভাবে কোনও কাজ করতাম না। মামারা বিড়ি বাঁধতেন যেহেতু, আমিও সে-কাজ করেছি অল্পস্বল্প। কিন্তু সবসময়ে কেবল গানের জন্যই চতুর্দিকে ঘুরে-ঘুরে বেড়িয়েছি…

    আপনার যে-সময়ে গান গাওয়ার শুরু, সে-সময়ে কি সারা বছরই অনুষ্ঠান থাকত?

    সারা বছর তো অনুষ্ঠান হত না, যখন বায়না-টায়না থাকত, তখন যেতাম। বিভিন্ন পুজো-পার্বণে ডাক পড়ত আমাদের। আসলে কী জানেন, লোকসংগীত তখন ভদ্রলোকেরা শুনত না। ঝুমুরগান, লেটোগান— এসবের কদরও অত ছিল না। তখন রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলগীতি— এসবই লোকে বেশি শুনত। আমরাও তো ছেলেবেলা থেকে তাই শুনেই বড় হয়েছি!

    আপনার জন্ম কেঁদুলিতে, বড় হয়েছেন মামার বাড়ি সিউড়ীতে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, যে-বীরভূম অঞ্চল বাউলগানের জন্য খ্যাত, তার সঙ্গে আপনার কোনও যোগসূত্র কখনও গড়ে ওঠেনি?

    মিশেছি, কিন্তু সেই ভাবে কোনও যোগসূত্র কখনওই তৈরি হয়নি। আমি তো লোকসংগীতের লোক! চারপাশে যা ঘটনা ঘটছে, সেটাকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরাই হচ্ছে আমাদের কাজ। এবং ওই গানের মধ্যে দিয়ে মানুষকে আরও একটু সচেতন করা। যা বিবেকে লাগত, তাই নিয়েই আমরা গান তৈরি করতাম। সেই স্বাধীনতা আমাদের ছিল। বাউলদের ব্যাপারটাই আলাদা। বাউলগান একটা ধর্মমূলক গান। ওদের গানে অনেক কথা লুকানো থাকে। এখন যে-ধরনের রং-রস দেখা যায়, ওটা কিন্তু বাউলগান নয়। মহাপ্রভু যখন রাঢ় বাংলা ছেড়ে চলে যান, তখন নিত্যানন্দকে দায়িত্ব দিয়ে যান সংসারধর্ম পালনের। নিত্যানন্দ-র পুত্র বীরভদ্রর হাতেই এই বাউলগানের প্রতিষ্ঠা। বাউলদের অনেক নিয়মকানুন রয়েছে। এখন যেসব বাউল দেখা যায়, তাদের বেশির ভাগই ফ্যাশন নিয়ে ব্যস্ত। গানের মধ্যে কোনও প্রেম নেই। গান করতে উঠে নানা ধরনের গানই তো করে ওরা! এটা কি বাউলের ধর্ম?

    লেটোগান থেকে ভাদুগানের সঙ্গে পরিচয় হল কীভাবে?

    পরিচয়টা মামার বাড়ির সূত্রেই। আমাদের সিউড়ীতে একটা গানের দল ছিল, ‘মুর্শিদি লোকসংগীত’ নামে। দলের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তিনি একদিন আমাকে ওই দলে যোগ দিতে বললেন। তখন তো অত ভাবনার কিছু নেই, গানের জন্য সবেতেই এগিয়ে থাকি। আমি সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক তখন এখানকার তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তরে কাজ করতেন। ১৯৬০-’৬৫ সালের কথা বলছি। সেভাবে দেখতে গেলে, ভাদুগান কিন্তু ওইখান থেকেই আমি প্রথম গাওয়া শুরু করি। নিজের যা ভুলত্রুটি ছিল, ওই দলে যাওয়ার পর সেগুলো ঠিক করে নিয়েছিলাম অনেকটাই। এবং এটাও বলতে চাই, যদি আমি কিছুটা শিল্পী হয়ে থাকি, তবে তা ভাদুগানের মধ্যে দিয়েই হয়েছি।

    রেডিয়োয় কবে থেকে গান গাইছেন?

    সে অনেকদিন আগেকার কথা। একটা সময়ে মানুষ যখন আধুনিক গান শুনতে-শুনতে ক্লান্ত, তখন খানিক স্বাদবদলের জন্যই আমাদের ডাকা হয়েছিল। আমাকে, স্বপ্না চক্রবর্তীকে— এরকম আরও অনেককে। লোকের থেকে দু-দশ টাকা চেয়ে নিয়ে আকাশবাণী যেতাম। যাওয়ার পয়সাটুকুও তখন আমার ছিল না। সে-সময়ে পাহাড়ী সান্যালের মতো মানুষজনের সঙ্গে আমার খুবই যোগাযোগ ছিল। এই যে ‘বড়লোকের বিটি লো’ গানটা নিয়ে এত সমস্যা তৈরি হল পরবর্তীকালে, এটা হওয়ারই কথা না— কারণ আগেকার লোকেরা সবাই জানত যে ওই গান আমার তৈরি!

    এখনও পর্যন্ত আপনি তো প্রায় হাজার দুয়েক গান লিখেছেন, এই মুহূর্তে কত গান আপনার কাছে একত্র করা আছে?      

    সব নেই, তবে অনেকটাই আছে। আমার আগে যখন মাটির বাড়ি ছিল, তখন একবার তার ওপর বটগাছ পড়ে যায়। সে-সময়ে অনেক গানের খাতা নষ্ট হয়। কিছু চুরিও যায়। গানের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা কথা বলি, আমার এই যে এত বয়স হয়ে গেছে, এখনও কিন্তু গান করার সময়ে কোনও খাতা লাগে না আমার। পুরোটাই মাথার ভেতরে থাকে…

    স্বরলিপি-সহ সংরক্ষণ করার কথা ভাবেননি কখনও?

    কিছু আছে। অনেক প্রকাশক বলেন বই করব, কিন্তু আমার ইচ্ছে করে না। ঘরপোড়া গরু বলে না? আমি হচ্ছে সেরকম! চারপাশে এখন আর কাউকেই ভাল লাগে না। মানুষের কাছে আঘাত ছাড়া সারাজীবন অন্য কিছু পাইনি। প্রত্যেকের কাছে অবিচার পেয়েছি। তবে এও ভাবি, এই অবিচার পেয়েছি বলেই হয়তো আজ মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছি। ছেঁড়া কাপড়কে যেভাবে সেলাই করে-করে ব্যবহার করা হয়, আমিও সেভাবেই বেঁচে রয়েছি…

    এখনও অনুষ্ঠান করেন?

    সেই বয়স কি আমার আর আছে! প্রায় নব্বই বছর হতে চলল। তবু মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করি। গানকে ভালবাসি বলেই হয়তো…

    বীরভূমের এখন যাঁরা তরুণ শিল্পী, তাঁদের ভাদুগান বা ঝুমুরগান গাওয়ার দিকে ঝোঁক কতটা?

    ঝোঁক আছে, কিন্তু ওইটুকুই যা। গানের মধ্যে কোনও মাধুর্য নেই, কোনও প্রেম নেই। ভাদুগান তো আর ছেলেখেলার গান নয়, তার একটা ইতিহাস আছে। ভাদু এক রাজার কন্যা, যে অল্পবয়সেই মারা গেছিল। সেই শোকে রাজা যখন কারোর সঙ্গে কথা বলা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন একদল মানুষ ভাদু-র মাটির মূর্তি বানিয়ে গান তৈরি করে। ভাদুগানের ওই শুরু। ভাদু বড় আদরের মেয়ে, সেই গান কি যেমন-তেমন করে গাওয়া যায় কোনওদিন?

    গান লেখা, সুরারোপ করা না কি গান গাওয়া— কোনটায় বেশি প্রশান্তি অনুভব করেন?

    গান গেয়েই আনন্দ পাই এখনও। আসলে আমার গান তো শুধু গান নয়, নেচে-নেচে গান; ফলে মন আর শরীর দুটো দিয়েই গাই। যোগটা বেশি থাকে। এটা আমার সেই লেটোর দলে থাকার সময় থেকেই অভ্যাস। মনে আছে, যখন আগে কলকাতা যেতাম বিভিন্ন কর্মশালায়, এই নেচে-নেচে গান করার জন্য খোঁজ পড়ত আমার…

    বর্তমান সময়ে যেভাবে বিভিন্ন শিল্পীদের রাজনৈতিক দলের আওতায় নিয়ে আসার একটা প্রচেষ্টা চলছে, আপনার কাছে সেরকম কোনও প্রস্তাব আসেনি?

    হ্যাঁ, এসেছিল। আমি যাইনি। কেননা রাজনীতি করলে, যে-দলে থাকি সেই দলের কথা বলতে হবে। নিজের মনের ভেতরকার যে-কথা, সেটা বলতে পারব না। যারা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তাদের আমি বলে দিয়েছিলাম— যদি ভালোবাসেন, শিল্পীভাতা দেবেন; গানের অনুষ্ঠানে ডাকলেও যাব কিন্তু দলে নাম লেখাতে পারব না। আসলে শিল্পী একটা রাজসিক ব্যাপার, যে-ঘরেই তিনি জন্মান না কেন! এইটুকু আত্মসম্মান যদি না থাকে, তাহলে সে কীসের শিল্পী? আমার যে এই এত বয়স হয়েছে, এখনও বলছি, আমার কোনও চাহিদা নেই… কোনও মান-অভিমান নেই…

    এখন কেউ গান শিখতে আসে না আপনার কাছে?

    আগে অনেকে শিখত, আমিই বন্ধ করে দিয়েছি। প্রথমত কেউ কিছু দেয় না, তার ওপর আমারই গান বাইরে নিজেদের নামে চালায়। এর পর আর কাউকে শেখাতে ইচ্ছে করে? এই সময়ের মানুষের আসলে কোনও মনুষ্যত্ব নেই। আমি মারা গেলে এই গানগুলো কি আর থাকবে? থাকবে না, জানি। তবু কাউকে শেখাতে আর ইচ্ছে হয় না। আমার ছেলে মূলত ক্লাসিক্যাল শেখে। ও যদি আমার কোনও-কোনও গান গায় পরবর্তীকালে, গাইবে…  

    একজন শিল্পী হিসেবে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ কী?

    দুঃখ আমার একটাই, শিল্পী হিসেবে সারাজীবন মানুষের কাছে অবিচারই পেয়ে গেলাম। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি— বাউলগান যখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল, সে-সময়ে পূর্ণদাস বাউল সিউড়ীর কুলেরা গ্রামে থাকতেন। সিউড়ী শহরে গান গেয়ে-গেয়ে ভিক্ষা করেছেন দিনের পর দিন। এইভাবে একদিন পূর্ণদাস এখানকার নামকরা ডাক্তার কালীগতিবাবুর (ব্যানার্জি) চোখে পড়ে যান। কালীগতিবাবু ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের খুব ভাল বন্ধু। বিধান রায়ের মাধ্যমেই পূর্ণদাস তারপর বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে গান করতে গেছিলেন। মানুষের ভাগ্য কীভাবে ফেরে! তবে শিল্পী হিসেবে এইটুকুই বুঝি, কখনও কোনও অবস্থাতেই ভেঙে পড়লে চলবে না…

    আলোকচিত্র : সন্দীপ কুমার  

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook