ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আউট অফ প্রিন্ট : পর্ব ৩


    পৃথ্বী বসু (June 29, 2024)
     

    উলুখড়

    মাস কয়েক আগেকার কথা। কলেজ স্ট্রিটে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির তাক গোছাতে-গোছাতে একটা পত্রিকা পেয়ে চমকে উঠি। নাম ‘সবুজপত্র’, কিন্তু সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী নন। সম্পাদকের নামটা টুকে রাখা উচিত ছিল। টুকিনি। প্রকাশকাল ওই ’৫২ সালের আশেপাশে। লেখক-তালিকা যে আহামরি কিছু তা নয়, তবে একখানা নাম নিয়ে তৈরি হল রহস্য। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। ওই সংখ্যাতেই রহস্য-সৃষ্টিকারী সন্দীপনের এক উপন্যাসের কোনও-একটা কিস্তি ছাপা। বোঝা যায়, সে-উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে ছাপা চলছে তখন। কৌতূহলবশে দু-এক পাতা ওলটাই। পরিচিত সন্দীপনীয় গদ্যের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে একেবারেই কি নেই? খটকা লাগে। সন্দীপনের নিজস্ব যে-ভাষাবিশ্ব, যার ভেতরকার গলি-গলতা দিয়ে পাঠক এক সময়ে গিয়ে পৌঁছায় একেবারে ‘আধুনিকতার জরায়ু’ পর্যন্ত, তার একটা আভাস অন্তত সে-লিখনভঙ্গিমায় টের পাওয়া যায়। এমনকী ঘুরপথে-দেখতে-চাওয়া যৌন-মনস্তত্ত্বর একটা প্রচেষ্টাও ছিল সেখানে। কিন্তু ভাববার কথা এও, ১৯৫২ সালে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস? এতদিন এই তথ্য চাপা পড়ে রইল! অন্যদিকে মনে আশা জাগে, যদি সত্যি হয়েই থাকে এমন কিছু, তাহলে সন্দীপন-চর্চায় আমিই তো হব সেই কলম্বাস, যে সন্দীপনভক্তদের সামনে খুলে দেবে একটা নতুন দিগন্ত! যাই হোক, উত্তেজনা বেড়ে থিতিয়েও যায়। মাথা থেকে বিষয়টা ঝেড়ে ফেলি কিছুদিন পর। এখন যদি কেউ জানতে চান, সেই উপন্যাসের নাম কী, আমি বলতে পারব না। স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। হারায়নি যা, তা ওই রহস্যের গন্ধ; এবং যে-কারণে মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এই কথা ক-টা আমাকে বলতেই হল।


    বেলুড় বিদ্যামন্দিরের গবেষক, গ্রন্থপ্রেমী এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলন সিংহ একদিন ফোনে জানতে চায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘উলুখড়’ নামে কোনও লেখা আমি পড়েছি কি না। এতই বিস্ময়কর সেই প্রশ্ন, ‘না’ বলতে হয় তৎক্ষণাৎ। ততদিন অবধি বাংলা সাহিত্যে ‘উলুখড়’ বলতে জেনে এসেছি অরণি বসু-প্রিতম মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিনকেই। সন্দীপনেরও ‘উলুখড়’? মিলনের কাছে জানতে চাই, এই সন্দীপন সেই সন্দীপনই তো! একই নামে অনেক সময়ে একাধিক লেখক থাকেন, যেখানে সম্পাদনার সামান্য ভুলচুকে তৈরি হয় নতুন ইতিহাস। আবিষ্কারের নেশায় আমরা কখনও এর লেখা ওর ঘাড়ে করিনি কি? মিলন আরও জানায়, ‘উলুখড়’ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটা কৃশকায় বই। এবং বইয়ের গোড়ায় সন্দীপন সম্পর্কে যে এক পাতার পরিচিতি দেওয়া আছে, তাতে সন্দেহের কোনও কারণই আর থাকে না। বইটা আমাকে সে উপহার দেয়। দেখি, লেখকের সম্পর্কে লেখা আছে—

    ‘সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবন সুরু অতি অল্পদিনই। এখনো ইনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠতোরণ উত্তরণ করেন নি। তবে ছাত্র জীবনে ইনি নিতান্ত লৌকিক।

    এঁর প্রথম সার্থক গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়, ‘একটি তারকার জন্ম।’ আনন্দবাজার, লোকসেবক, সত্যযুগ, নতুন সাহিত্য ইত্যাদি এঁর সাহিত্য ক্ষেত্র। নতুন সাহিত্যে প্রকাশিত ‘রাবণের সিঁড়ি’ প্রথম সমাদৃত রচনার দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যায়। দাঙ্গা-বিরোধী ও যুদ্ধ-বিরোধী দুটি গল্প সংকলনে এঁর রচনা স্থান পেয়েছে।

    গল্পকার হিসাবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব টাইপ চরিত্রসৃষ্টিতে। মনো-বিশ্লেষণে এঁর বয়োবিরুদ্ধ পারদর্শিতা। প্রথম দিককার রচনার ভাষাচাতুর্য ‘উলুখড়ে’ প্রাঞ্জল হয়ে এসেছে। তবে, রূপকধর্মী বাক্‌ বিন্যাসে এঁর বিশেষ প্রবণতা। আর সেইখানে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষত্ব।

    গুণতিতে সংখ্যালঘু হলেও, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘রচনাগুণটি’ সাধারণ পাঠকের নজর এড়ায় না। খুব শিগগিরই ইনি সাহিত্যক্ষেত্রে স্বপ্রতিষ্ঠ হবার দাবী রাখেন। এবং আমাদেরও এবিষয়ে স্থির বিশ্বাস আছে।’

    এখানে ‘আমরা’ যে কারা, তা বোঝার কোনও উপায় নেই, কেননা বইটা যে-অবস্থায় পাওয়া গেছে তার চতুর্থ প্রচ্ছদ নেই। শুরুতেও প্রকাশক, প্রকাশকাল বা দাম— কোনও তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। ২৪ পাতার গল্পটুকুই রয়েছে কেবল। উদ্ধৃত অংশটুকু পড়ে আমার মতোই হয়তো পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গল্পসমগ্র’-র প্রথম খণ্ডের ‘গ্রন্থপরিচিতি’ অংশের কথা। সম্পাদক অদ্রীশ বিশ্বাস সেখানে উল্লেখ করেছিলেন এমন আটটি গল্পের নাম, যা সন্দীপনের ‘ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী’ কিংবা ‘বিজনের রক্তমাংস’ লেখার আগের পর্বের রচনা। সেখানে ‘রাবণের সিঁড়ি’ গল্পটার কথাও ছিল। অদ্রীশ আরও জানিয়েছিলেন, লেখক ‘ঘোর অনিচ্ছুক’ ছিলেন সেসব গল্প সংকলনভুক্ত করতে। তা সত্ত্বেও সম্পাদক হিসাবে তিনি সেই পর্বের কিছু গল্প গ্রন্থিত করেছেন বইতে। পরবর্তীতে আরও কয়েকজন অনুসন্ধিৎসু সম্পাদকের নিপুণ ডুবুরিবৃত্তিতে সুযোগ হয়েছে সন্দীপনের হারিয়-যাওয়া কয়েকটি গল্প পাঠ করার। কিন্তু পাঠকের কাছে ‘উলুখড়’ তো কেবলমাত্র হারিয়ে-যাওয়া গল্প নয়, সন্দীপনের জীবনের প্রথম বইও বটে (যদি-না পরবর্তীতে এরকম আরও কোনও বই আচমকা বেরিয়ে পড়ে)! ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে এক নতুন সাহিত্যের ইতিহাস তৈরি হতে দেখা, এ কি কম সৌভাগ্যের!

    একই নামে অনেক সময়ে একাধিক লেখক থাকেন, যেখানে সম্পাদনার সামান্য ভুলচুকে তৈরি হয় নতুন ইতিহাস। আবিষ্কারের নেশায় আমরা কখনও এর লেখা ওর ঘাড়ে করিনি কি? মিলন আরও জানায়, ‘উলুখড়’ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটা কৃশকায় বই। এবং বইয়ের গোড়ায় সন্দীপন সম্পর্কে যে এক পাতার পরিচিতি দেওয়া আছে, তাতে সন্দেহের কোনও কারণই আর থাকে না।


    ‘মহানগর’ নামে বাংলাদেশের এক ওয়েব-সিরিজে মোশারফ করিমকে বারে বারেই বলতে শোনা গেছিল এই সংলাপ— ‘যদি থাকে নসিবে, আপনা-আপনি আসিবে।’ তেমনই এই বই পাওয়ার পর পরই আমার হাতে আসে এমন এক চিঠি, যাতে ‘উলুখড়’-সহ এ-লেখার শুরুতে বলা উপন্যাসের কথা জানাচ্ছেন স্বয়ং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়! ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি লিখছেন—

    ‘প্রিয়বরেষু

    অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই। তাই অসাক্ষাতের পাঁচিল ডিঙিয়ে চিঠির এই ঢিল ছুঁড়ে মারা।

    ‘সবুজপত্র’ বলে একটা কাগজ ষ্টলে-ষ্টলে মাসিক কিস্তিতে পচ্‌চে আজকাল, খবর রাখেন? কাগজটার সঙ্গে আস্তে আস্তে জড়িয় পড়েছি। এখন সম্পাদকমণ্ডলীতে। লেখা ছাপিয়ে বন্ধুকৃত্য করছি আজকাল— নিজে লিখতে পারছি না বলে। লেখা পাঠান। আগামী সংখ্যা বেরুচ্ছে ১লা অগাষ্ট। বিশেষ সংখ্যা : প্রমথ চৌধুরী স্মরণে। সুতরাং প্রেসে যাবার সময় থাকতে আপনার রচনাশৈলীর প্রতিনিধিস্থানীয় লেখা পাচ্ছি।

    ‘উলুখড়’ কেমন পড়লেন? উপন্যাসটা পড়ছেন? ইতিমধ্যে এদিক-সেদিক কিছু হাত মক্স করেছি।…’

    এই চিঠি ছাপা হয় প্রশান্ত মাজী সম্পাদিত ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায় (জানুয়ারি ২০২৪)। দুটো তথ্য এখান থেকে পাচ্ছি— ১. ‘উলুখড়’ ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসের আগেই প্রকাশিত। ২. সন্দীপন, তাঁর ওই সময়পর্বের লেখালিখিকে ‘হাত মক্স’ বলছেন। এই কারণেই কি ওই পর্বের লেখালিখি সম্পর্কে এত অনীহা তাঁর? নইলে একটা বইয়ের কথা কেনই-বা তিনি বেমালুম চেপে যাবেন পরবর্তীকালে?


    ‘উলুখড়’ বীরেন নামের এক লেখকের গল্প। বীরেন বেলেঘাটায় যে-বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকে, সেখানেই একদিন রাতে তার সঙ্গে দেখা হয় এক আধপাগলা লোকের, যাঁর পরিচয় বীরেনের কাছে দীর্ঘদিন অজ্ঞাত থাকবে। এমনকী সে এও জানতে পারবে না না, কেন ওই লোক সে-বাড়িতে থাকে। ওই বাড়ির কর্ত্রী, মনুদি, তিনিও জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলতেন না। পাগল-গোছের লোকটা থাকতেন বীরেনের পাশের ঘরেই। তিনি ছবি আঁকতেন; কিন্তু অশ্লীল সমস্ত ছবি। নানান ধরনের সঙ্গমদৃশ্য। এবং তিনি বারংবার বীরেনকে বলতেন, তাঁর স্ত্রী চরিত্রহীন। একদিন জানা যায়, ওই লোকটি, যাঁর নাম সুধীর— তিনি আসলে মনুদির স্বামী। যুদ্ধ থেকে ফিরে তাঁর এই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা। আরও আশ্চর্যের বিষয় যা, মনুদির ছেলেমেয়েরা (দেবু ও মঞ্জু) জানে না, ওই লোকটি সম্পর্কে তাদের বাবা। বীরেন যেহেতু লেখক, একদিন সুধীর তাকে অনুরোধ করেন তাঁর জীবন নিয়ে গল্প লিখতে। একই অনুরোধ আসে মনুদির থেকেও। তবে মনুদি এবং সুধীর, দুজনের বয়ান যেহেতু আলাদা, এবং দুজনেই যেহেতু দাবি করেন তাঁরা সত্যি কথা বলছেন— এক মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয় বীরেনের ভেতরে। কোন বয়ানকে সে সত্যি বলে ধরবে— এই নিয়ে দোলাচলে ভোগে সে। রাতের অন্ধকারের মতো জটিল দুজন মানুষ, আরও জটিল তাঁদের মনের গড়ন— বীরেন ওই আলো-আঁধারির গোলকধাঁধায় চক্কর কাটতে থাকে। এই হল মোটের ওপর গল্পের প্লট।

    রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এই গল্পে মনুদি এবং তাঁর স্বামীর যে-দ্বন্দ্বযুদ্ধ, তাতে দিশেহারা হয়ে যায় বীরেন। ‘উলুখড়’ এখানে বীরেনের প্রতীক।


    দেবেশ রায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সন্দীপন আমাদের সময়ের এমনই একজন লেখক, যাঁর যে কোনও দেড়-দু লাইনের লেখাও আমার কাছে শিক্ষণীয় একটি বাচ্য নির্মাণ।’ আমিও এ-কথা সন্দীপন সম্পর্কে মানি। তাঁর কোনও লেখাই ফেলে দেওয়ার নয়। সন্দীপনের একটা পর্বের ভাবনাকেই আমরা যদি শুধু গুরুত্ব দিই, তাহলে হারিয়ে যাবে সন্দীপনের অন্য একটা দিক। সেটা কি উচিত হবে খুব একটা?

    পুনশ্চ : এই কলামে আগে যে-দুটো বইয়ের কথা লিখেছিলাম, তা পড়ে অনেকেই আমাকে বলেছেন, আমিই কেন সেসব বই নতুন করে করছি না! আমি নিজে যেহেতু একটা ছোট প্রকাশনা চালাই, তাই তাঁদের ওই দাবি। সব বই সবাই যে করতে পারে না, এ আর কাকে বোঝাব! তবে হ্যাঁ, ‘উলুখড়’ আবার নতুন করে ছাপা হবে একদিন এবং সন্দীপনের একজন অনুরাগী হিসেবে তার প্রকাশক আমিই থাকব। কথা দিলাম।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook