ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মেগা ম্যাগাজিন : পর্ব ৬


    সুস্নাত চৌধুরী (April 13, 2024)
     

    পান্‌চ

    একটি সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকার আয়ু কত বছর হতে পারে? সত্তর, আশি, নব্বই? এমনকী শতাধিক বছর রমরমিয়ে চলার রেকর্ডও সারা দুনিয়ায় নেহাত কম পত্রিকার নেই। কিন্তু ধরা যাক, কোনও পত্রিকা শুরু হয়েছিল ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ ঘটারও দেড় দশক আগে। আর সেই পত্রিকা যখন উঠে গেল, আমাদের হাতে ততদিনে মোবাইল ফোন! এও তেমন বড় কথা নয় হয়তো, কারণ দ্বিশতাধিক বছর সক্রিয় থাকার ইতিহাসও প্রতিবেদনধর্মী পত্রপত্রিকার জগতে বিরল না; কিন্তু সেই পত্রিকা যদি অলংকরণে ঠাসা হয় কিংবা ব্যঙ্গবিদ্রূপ যদি হয়ে থাকে সেই শুরুয়াতি দিনগুলো থেকেই তার প্রাণভোমরা, তখন বিস্ময় জাগে বইকি!

    ব্রিটেনের মহারানির মুকুট তখন সবে বছর কয়েক হল শোভা পাচ্ছে ভিক্টোরিয়ার মাথায়। ১৮৪১ সাল। জুলাই মাসের ১৭ তারিখ লন্ডনের ওয়েলিংটন স্ট্রিট থেকে প্রকাশ পেল বিচিত্র এক সাপ্তাহিক পত্রিকা। হাস্যরস, ব্যঙ্গ আর তুখোড় বুদ্ধিমত্তার ছাপ ফুটে উঠল প্রথম সংখ্যাতেই। প্রচ্ছদের উপর দিকে প্যাঁচানো লিপিতে বড় করে লেখা পত্রিকার নাম— ‘পান্‌চ’। যেন একইসঙ্গে পত্রিকার অবিচল লক্ষ্য আর উদ্ভট কাণ্ডকারখানার আগাম বিজ্ঞপ্তি! পত্রিকার নামের নীচে সাবটাইটেলেও উচ্চতর সমাজকে হ্যাটা করার প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি— ‘দ্য লন্ডন শারিভারি’। এমন পত্রিকা যে ইউরোপে, এমনকী ইংল্যান্ডেও তার আগে ছিল না, তা নয়। কিন্তু গুণমানে, অভিঘাতে, অচিরেই তাদের টেক্কা দিয়ে গেল ‘পান্‌চ’।

    প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ১৭ জুলাই ১৮৪১

    এই পত্রিকার শুরু কীভাবে, কিংবা তার নামকরণের উৎসই-বা কী, এ নিয়ে একাধিক মত চালু আছে। মোটামুটি ভাবে মনে করা হয়, উনিশ শতকের ফ্রান্সে ব্যঙ্গাত্মক লেখা ও অলংকরণে ভরা যে ‘লে শারিভারি’ পত্রিকা বেরোত, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ‘পান্‌চ’-এর জন্ম। শুরুর কয়েকটি সংখ্যায় সাবটাইটেল হিসেবে ‘লন্ডন শারিভারি’ কথাটির ব্যবহারও সেই অনুমানই জোরদার করে। ব্রিটিশ সাংবাদিক ও নাট্যকার হেনরি মেহিউ (১৮১২-১৮৮৭) ও কাঠখোদাই শিল্পী এবেনজার ল্যান্ডেলস (১৮০৮-১৮৬০) এই পত্রিকার পরিকল্পনা করেন। যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে মেহিউ-এর সঙ্গে যুক্ত হন ব্রিটিশ লেখক মার্ক লেমন (১৮০৯-১৮৭০)। শুরু থেকেই তাঁরা চেয়েছিলেন এই ধাঁচের অন্যান্য ইংরেজি পত্রিকার তুলনায় ‘পান্‌চ’-এর ভাবভঙ্গি আর কথাবার্তায় কটু স্বাদের ভাগ কম রাখতে, বদলে কাজের গুণমানে যথাসম্ভব জোর দিতে। শোনা যায়, প্রাথমিক পরিকল্পনাপর্বের এক আড্ডায় কে নাকি বলেছিলেন— এই ম্যাগাজিনটা পান্‌চ পানীয়ের একটা খাসা মিক্সচারের মতো হওয়া দরকার! (মার্ক লেমন-এর সূত্র ধরে) এর পরের উক্তিটি ছিল— ‘nothing without Lemon!’ ব্যাস, এইটুকু শুনেই উল্লাসে চিৎকার ওঠেন হেনরি মেহিউ— ‘A capital idea! Let us call the paper Punch!’

    সেই ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপের অতিপরিচিত পাপেট শো— ‘পান্‌চ ও জুডি’। এই পালার মুখ্য দুই কুশীলব-পুতুল মিস্টার পান্‌চ ও তার স্ত্রী জুডি। নামের মিলই শুধু নয়, শুরু থেকে ‘পান্‌চ’ পত্রিকার প্রধান মুখও করে তোলা হল তাদেরই। কথায়, ছবিতে রম্যরসের উচ্ছলতা আর ব্যঙ্গের হুল ফোটানোর কাজটি পেয়ে গেল এক ভিন্ন মাত্রা। শুরুর ভূমিকাতেই খোলসা করে দেওয়া হয়, আগামী দিনে কোন ক্ষেত্রগুলিতে ‘পান্‌চ’ তার তেরছা নজর রাখতে চায়— রাজনীতি, ফ্যাশন, পুলিশ, রিভিউ, শিল্পকলা, সংগীত ও নাটকের মতো বিবিধ দিকের কথা উঠে আসে। কিন্তু ‘পান্‌চ’-এর লক্ষ্য কি ছিল শুধুই হাস্যরসের স্রোত বইয়ে দেওয়া? সে-কথাও স্পষ্ট ব্যক্ত হয় প্রারম্ভিক বয়ানে। প্রথম সংখ্যার ‘The Moral of Punch’ শীর্ষক লেখাটিতে বলা হয়— ‘Our title, at a first glance, may have misled you into a belief that we have no other intention than the amusement of a thoughtless crowd, and the collection of pence. We have a higher object.’ শুধু ইংল্যান্ড নয়; গোটা ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকী তার বাইরে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিও কালক্রমে প্রত্যক্ষ করেছিল ভালো-মন্দে মেশানো ‘পান্‌চ’-এর সেই উচ্চতর লক্ষ্য।

    যে-কোনও উত্তীর্ণ শিল্পকর্মের মতোই ‘পান্‌চ’-ও তার বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি— দু-দিকেই সমান গুরুত্ব দিয়েছিল। লেখার গুণমানের সঙ্গে অসামান্য সব ক্যারিকেচারধর্মী অলংকরণের সহাবস্থান ‘পান্‌চ’ পত্রিকার গৌরবময় অতীতকে আজও অমলিন করে রেখেছে। শুধু অত্যাবশ্যক ক্ষেত্রগুলিতেই নয়, আপাতসামান্য সব অংশের জন্যও তাঁদের শৈল্পিক সচেতনতা ছিল লক্ষণীয়। ধরা যাক, এর অর্ধ-বার্ষিক খণ্ডগুলির ‘ইন্ডেক্স’ অংশের কথাই। কেবল বর্ণানুক্রমে লেখার শিরোনাম আর পৃষ্ঠাসংখ্যার সেই কেজো তালিকাও অলংকরণের প্রয়োগে হয়ে উঠছে আকর্ষক। পত্রিকার ভাবনার সঙ্গে সংগতি রেখে রোমান হরফের (A, B, C, D ইত্যাদি) আদলে আঁকা ছবি দিয়ে সেখানে ভাগ করা হচ্ছে এক-একটা অংশ।

    প্রথম খণ্ডের ‘ইন্ডেক্স’-এর একটি পাতায় চিত্রলিপিতে A, B, C

    শুধু পত্রিকার পরিচালনগোষ্ঠী নয়, এই উৎকর্ষের নেপথ্যে ছিলেন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরাও। জন লিচ, চার্লস কিনে, জন টেনিয়েল-এর মতো বহু গুণী শিল্পীর অবদান ছড়িয়ে ছিল ‘পান্‌চ’-এর পাতায়-পাতায়। সাপ্তাহিক কাগজে এই পরিমাণ অলংকরণকে জায়গা দেওয়া সে-যুগে সহজ কথা ছিল না। আবার কাঠখোদাইয়ের পর ড্রয়িং-এর চূড়ান্ত মুদ্রিত রূপটি কখনও-কখনও সন্তোষজনক হত না, এই নিয়ে ক্ষোভের উদ্রেক হত। সেই কারণে অনেক চিত্রশিল্পীও কাঠখোদাইয়ের কাজ রপ্ত করে নিয়েছিলেন। ১৮৪০ সাল নাগাদ ইউরোপে উড ব্লকে কাজের ক্ষেত্রে একটি ছবিকে একাধিক ব্লকে ভেঙে, একাধিক খোদাইকরকে দিয়ে কাজ করানোর চল ভালমতোই দেখা যেত। এতে কম সময়ে ছবির কাজ উতরে দেওয়া সম্ভব হত। কিন্তু ‘পান্‌চ’-এর ক্ষেত্রে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি— যাবতীয় ছাপার কাজ হয়েছে একক ব্লকেই। আবার ধাতব ব্লকের ব্যবহার থেকেও বহুদিন সরে থেকেছে ‘পান্‌চ’। ১৯০০ সালের আগে পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলি প্রধানত কাঠের ব্লকেই ছাপা হয়েছে।

    ছবির ব্যবহার তো বটেই, তার পরিভাষার ক্ষেত্রেও ‘পান্‌চ’ আরেকটি বিশেষ কারণে ইতিহাসের শরিক। ‘কার্টুন’ বলতে আজ আমরা যা বুঝি, সেই হাস্যাস্পদ বিকৃত অবয়ব বা ক্যারিকেচারধর্মী অলংকরণ অর্থে ‘কার্টুন’ শব্দটির প্রয়োগ প্রথম করে ‘পান্‌চ’। ইতালীয় ‘cartone’ শব্দ মারফত ইংরেজিতে এসে ‘cartoon’ কথাটি ততদিন বোঝাত বৃহদাকার কোনও ছবির প্রাথমিক খসড়াকে। কিন্তু ১৮৪৩ সালের জুলাই মাসে জন লিচ-এর আঁকা ‘Substance and Shadow’ ছবিটির সঙ্গে ‘কার্টুন’ শব্দটি নতুনতর অর্থে প্রথম ব্যবহৃত হল। সে-সময়ে ব্রিটেনের নবগঠিত সংসদ ভবনের বাইরের দেওয়াল তাদের ইতিহাসের নানা গৌরবময় অধ্যায়ের মুরাল দিয়ে সাজানো হয়েছিল। সেই প্রদর্শন আর তা নিরীক্ষণরত দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে বৈপরীত্য তুলে ধরাই ছিল এই প্রথম কার্টুনের উদ্দেশ্য।

    প্রথম ‘কার্টুন’, জুলাই ১৮৪৩

    ছবি ব্যবহারের মতো লেখাপত্রের ক্ষেত্রেও ‘পান্‌চ’ তার অবস্থান নির্দিষ্ট করে নিতে সফল হয়েছিল। তীব্র শ্লেষ কিংবা প্রখর ব্যঙ্গ থাকলেও কখনওই তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেনি, আক্রমণের দাঁত-নখে ভর করেনি কদর্যতার বিষ। এই মাত্রাবোধ আর সমসময়কে বুঝতে পারার ক্ষমতা আর-পাঁচটা ব্যঙ্গধর্মী পত্রিকার চেয়ে তাকে ঢের এগিয়ে দেয়। তার অবস্থান নিয়ে হয়তো সময় বিশেষে প্রশ্ন উঠেছে, চড়েছে বিতর্কের পারদ; কিন্তু বিশ্বজুড়ে সে প্রভাবও বিস্তার করেছে বিপুল। ১৮৪১ সালের মুখড়ায় যে-কথা লেখা হয়েছিল, কালক্রমে তা পরিণত হয়েছে প্রবাদে— ‘Punch hangs the devil: this is as it should be. Destroy the principle of evil by increasing the means of cultivating the good, and the gallows will then become as much a wonder as it is now a jest.’

    ভাবলে অবাকই লাগে— প্রথম থেকে গুণমানে ব্যতিক্রমী, আবার সার্ধশতকেরও বেশি টিকে থাকবে যে-পত্রিকা— অথচ তার শুরুর দিনগুলো আদপেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। আর্থিক সংকটে শুরুর বছর কয়েকের মধ্যেই বাণিজ্যিক হাতবদল হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু পরিচালনগোষ্ঠীর নাছোড় মনোভাব আর কর্মদক্ষতা শেষমেশ তাদের জিতিয়ে দিয়েছিল। আরও একটি অভ্যাস এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল— জীবনের উদযাপন। নিজেদের মধ্যে হাসি-মজার মধ্যে দিয়েই তাঁরা মেতে থাকতেন পত্রিকার কাজে। সচরাচর পত্রিকা-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় মিটিং-এর ব্যবস্থা হত ডিনারের টেবিলেই। পানাহারের মাঝেই কথার পিঠে কথায় সরগরম হয়ে উঠত আশপাশ। প্রথমদিকে বাইরের কোনও পাবে এই নৈশকালীন আড্ডার বন্দোবস্ত হলেও, ১৮৫৫ নাগাদ ‘পান্‌চ’-এর ফ্লিট স্ট্রিটের অফিসেই নিয়ে আসা হয় সুবিশাল এক কাঠের টেবিল। লম্বা, ওভাল আকৃতির। নানাবিধ খাদ্যাখাদ্য, খানিক ওয়াইন আর সিগারে টান— এই টেবিলকে কেন্দ্র করেই চলত রাজা-উজির মারার পরিকল্পনা! বিচিত্র এই রীতি নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও কম হয়নি, কিন্তু লান্‌চ আর ডিনারের সময়েই আগামী সংখ্যা নিয়ে আলোচনার আয়োজন পরিণত হয়েছিল ‘পান্‌চ’-এর দীর্ঘকালীন রেওয়াজে। ২০০২ সালে ‘পান্‌চ’ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর বিখ্যাত এই টেবিলটিও হয়ে যায় বর্ণময় এক ইতিহাসের অংশ।

    বিখ্যাত পান্‌চ টেবিল

    ‘পান্‌চ’-এ প্রকাশিত লেখায়, ছবিতে প্রায়শ উঠে আসত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির প্রসঙ্গ। বিশেষত ভারতের কথা যেমন আসত, তেমনই ভারতের মাটিতে ‘পান্‌চ’-এর পরিচিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য রকমের। অনেক সময়ে তা উস্‌কে দিত ব্রিটিশের প্রতি ক্রোধও। যেমন, ১৮৫৭ সালের ২২ আগস্ট সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতায় ছাপা হয় দু-পাতা জোড়া ‘The British Lion’s Vengeance on the Bengal Tiger’ কার্টুনটি। স্বাভাবিক কারণে ভারতে তা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়।

    সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা, ২২ আগস্ট ১৮৫৭

    এসব সত্ত্বেও মজার ব্যাপার হল, ওই উনিশ শতকেই ‘পান্‌চ’ পত্রিকার আদলে ভারতে একাধিক পত্রিকার জন্ম হয়। শুধু বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা নয়, নামকরণের ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট প্রভাব চোখে পড়ে। কখনও সেসবের নেপথ্যে ছিল বিদেশি উদ্যোগ, আবার কখনও একেবারেই দেশীয় প্রয়াস। ১৮৮৮-তে বম্বে থেকে বেরিয়েছিল গুজরাতি-ইংরেজি দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘হিন্দি পান্‌চ’। উর্দু মাসিক পত্রিকা ‘আউধ পান্‌চ’ বেরোয় ১৮৭৭ সালে। ‘ভারতকোষ’-এ অন্তর্ভুক্ত কমল সরকার ও প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ীর বয়ান অনুযায়ী—“‘আউধ পাঞ্চ’-এর শিল্পী গঙ্গাসহায় ‘শাক্’ ছদ্মনামে ব্যঙ্গচিত্র আঁকিতেন। ‘হিন্দী পাঞ্চ’ জনৈক পার্শী সাংবাদিকের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। ইহার শিল্পীরা সকলেই ভারতীয় ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরোজ শাহ্ মেহ্‌তা, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, বালগঙ্গাধর টিলক, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিদের সম্পর্কে অঙ্কিত বিপুলসংখ্যক কার্টুন ‘হিন্দী পাঞ্চ’-এর অমূল্য সম্পদ। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে লর্ড কার্জনের প্রতি কটাক্ষ করিয়া অঙ্কিত ‘ভ্যান্‌ডালিজ্‌ম’ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজীর প্রথম কারাবাস উপলক্ষে অঙ্কিত ‘দি ট্র্যান্‌সভাল বোর’ ‘হিন্দী পাঞ্চ’-এর দুইখানি প্রসিদ্ধ চিত্র।”

    ‘হিন্দি পান্‌চ’, ১৮৮৮

    এসবের আগেই অবশ্য বিদেশি উদ্যোগে ১৮৫৯ সালে দিল্লি থেকে বেরোয় ‘ইন্ডিয়ান পান্‌চ’। কলকাতার ডেকার্স লেন থেকে ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয় সে-সময়ের জনপ্রিয় কার্টুন পত্রিকা ‘ইন্ডিয়ান শারিভারি’। এর প্রথম খণ্ডের প্রচ্ছদের ছবিতেও ‘পান্চ’-এর উল্লেখ লক্ষ করা যায়। এরও পাঁচ বছর পূর্বে জে এইচ গ্রান্ট-এর সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছিল সাপ্তাহিক ব্যঙ্গপত্রিকা ‘বেঙ্গল পান্‌চ’। ‘বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ’-এ এই ‘বেঙ্গল পান্‌চ’ প্রসঙ্গে স্পষ্টত জানানো হয়— ‘an imitation of Punch in England’।

    ‘ইন্ডিয়ান শারিভারি’, ১৮৭২
    ‘হরবোলা ভাঁড়’, ১৮৭৪

    ২০০৭ সালে ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’-র ‘সাময়িকপত্র বিশেষ সংখ্যা’-য় স্বপন বসু দেখিয়েছেন, ‘পান্‌চ’ কীভাবে বাংলা পত্রপত্রিকাতেও প্রভাব ফেলেছিল। ১৮৭০ সালে ‘বিদূষক’ পত্রিকায় সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকায় লেখা হচ্ছে—‘ইউরোপ খণ্ডে পঞ্চ নামে রহস্যপত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষে সেরূপ পত্রিকার সমাদর দেখা যায় না। দেখা যায় না বলিয়াই খ্রীষ্টিয় ঊনবিংশ শতাব্দির শেষে এ নগরে রহস্যের সৃষ্টি হয় নাই। কিন্তু আজকাল আমরা দেখিলাম, রহস্যপত্নী গর্ভবতী হইয়াছে। বংশে সন্তান না জন্মিলে শাস্ত্রমতে পিণ্ড লোপ হয়। কুলপুরুষেরা জলগণ্ডুষের অনুরোধে বংশলোপে ব্যথিত হন। মৃত্যুর পর পিতৃপুরুষ দেবতা ও নরলোক প্রাপ্ত হন। তাঁহাদিগের আশীর্ব্বাদে গর্ভবতী রহস্যদেবী একটি সন্তান প্রসব করিলেন। সন্তানের নাম বিদূষক। বিদূষক অতি উপযুক্ত সময়েই ভারতবর্ষে—ভারতবর্ষের রাজধানী কলিকাতা নগরে জন্মগ্রহণ করিল।’ যদিও স্বপনবাবুর মতে, বাংলার প্রথম ‘পান্‌চ’-এর গৌরব ‘বিদূষক’-এর প্রাপ্য নয়। কারণ ‘বিদূষক’ ছিল ছবি-বর্জিত পত্রিকা। সে-দিক থেকে ১৮৭৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘হরবোলা ভাঁড়’ পত্রিকারই এই স্বীকৃতি প্রাপ্য। এখানে কার্টুনধর্মী ছবি তো ছাপা হতই, এমনকী দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে পত্রিকার প্রচ্ছদপটে উল্লেখও থাকত—‘The Indian Punch’।

    ভারত শুধু নয়, পশ্চিমবিশ্বেও সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ জায়গা ধরে রেখেছিল ‘পান্‌চ’। একদা বলা হত—‘The Punch Editors not only write the jokes, but they help to make the laws of England.’ দেড়শো বছর নিরবচ্ছিন্ন চলার পরে ১৯৯২ সাল থেকে বছর চারেক এই পত্রিকা বন্ধ থাকে। ফের চালু হয় ১৯৯৬ সালে। কিন্তু আর বিশেষ সুবিধে করা যায়নি। ২০০২ সালে চিরতরে তালা পড়ে যায় ‘পান্‌চ’-এর দফতরে।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook