ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ২২


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (February 6, 2024)
     

    ছোট কুঠুরির কাহিনি

    একটা দৃশ্যে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে সারাক্ষণ অপমান করতে থাকে, তাকে বলে হাঁদা, রুচিহীন, বর্বর, শেষে যখন ওই বন্ধুর প্রেমিকা বলে ‘সবসময় ওকে ওভাবে বলো কেন?’, তখন আগের দুর্মুখ বন্ধুটা বলে, ‘আরে আমি ওকে ১৫ বছর ধরে চিনি, তুমি দুদিন চিনে আর কয়েকবার যৌনতা করেই ওকে বুঝে গেছ? আমি না থাকলে ও কোথায় যাবে?’ ‘জাংকইয়ার্ড ডগ’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: জাঁ বাপতিস্ত দুরাঁ, (চিত্রনাট্য রচনার ক্ষেত্রে দুই সহকারীর নাম আছে), ২০২৩) ছবিতে সংকটটা চেনা, দুই বন্ধুর মধ্যে এক মেয়ে এসে পড়ে, তাতে একজনের কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে প্রেম বড় হয়ে ওঠে। অন্যজন তখন সহসা নিজেকে একা ও বেইমানি-হত মনে করতে শুরু করে এবং কর্কশতর হয়ে ওঠে। দুই বন্ধুই যৌবনে সবে পা দিয়েছে, আর যেখানে তারা থাকে তা ফ্রান্সের একটা ঝিমন্ত অজ-গাঁ বললেই চলে। বহু বছর ধরে দুজন একেবারে হরিহরাত্মা, শুধু পরস্পরের সঙ্গেই ঘুরত। এক বন্ধু চালাক-চতুর, ড্রাগ বেচে টাকা রোজগার করে, আরেক বন্ধু বসে বসে ভিডিও গেম খ্যালে, বিশেষ জানেশোনে না, বই পড়ে না, সবকিছুর জন্যেই স্মার্ট বন্ধুটার ওপর নির্ভর করে। স্মার্ট বন্ধু তাকে ভালবাসে, কিন্তু সবার সামনে ছ্যারছ্যার করে কথা শোনায়, এমনিতেই সে একটু উদ্ধত টাইপ। বোকামতো ছেলের প্রেমিকা জুটতেই সব গোলমাল হয়ে যায়। কারণ স্মার্টের কোনও মেয়ে-সান্নিধ্য নেই। ধীরে ধীরে প্রেমিকার সঙ্গে মিশে বোকা বন্ধু মনে করে, তারও ব্যক্তিত্ব আছে বই কী, সে মোটেই ফ্যালনা নয়। স্মার্টের দুর্মুখতা বাড়ে, এবং একসময় তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বোকা বন্ধু হয়তো মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গম করছে, এমন সময় ফোন বাজছে। সে একটু থমকে যায়, তারপর যৌনতা চালিয়ে যায়, ফোন ধরে না। অযৌন বন্ধুত্ব কী করে যৌন সম্পর্ককে পরাজিত করবে? যুগে যুগে লোকে বিয়ে করার পর বন্ধুত্ব থেকে খসে পড়েছে, ক্লাবে আর ক্যারম খেলতে আসেনি। তাছাড়া যৌবনের উন্মেষ-কালে প্রেম অভাবনীয় প্রাপ্তি, সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষার দপদপ। কিন্তু এই গল্পে মুশকিল ঘটে: মেয়েটা তার প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে মেসেজ চালাচালি করে, ফোন নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। তারপর একসময় এই ছেলেটির কাছে বিচ্ছেদ চায়। পরে একদল ছেলে যখন বোকা বন্ধুকে মারতে আসে (কারণ সে কিছু গামবাট গুন্ডামি করেছিল), তখন তাকে বাঁচাতে স্মার্ট বন্ধুই আবার ছুটে যায়। স্মার্ট বন্ধুর পোষা কুকুরও যায়, সে শত্রুদের আক্রমণ করে, আর ছুরির ঘায়ে মরে যায়। ছবি শেষ হয় পোষা কুকুরের (এক প্রিয়বন্ধুর) মৃত্যু ও দুই বন্ধুর মিলনের মধ্যে দিয়ে (ঠিক তা নয়, ছবিটা আরেকটু চলে, কিন্তু সেটা অ-জরুরি)।

    পরিবারের প্রতি প্রেম আত্মস্বাধীনতার পথে প্রস্তর, তাও বলে, আবার পরিবার যাকে প্রেম বলে ভাবছে তা আসলে ব্যক্তিকে খর্ব করার মেশিন, তাও বলে, আবার পারিবারিক বন্ধন সমঝদারও হয়, সেকথাও বলে।

    ছবির গোড়ার দিকে আমাদেরও মন খচখচ করছিল, সপ্রতিভ ছেলেটা তার বন্ধুকে সারাক্ষণ বিদ্রুপ করে কেন, এবং প্রেমিকার সঙ্গে মিশে বোকাসোকা ছেলেটার আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠতে আমরা উল্লসিত হচ্ছিলাম, এই তো, এবার জবাব দেওয়া যাবে, সারাক্ষণ চুপ করে নতমুখে সব মেনে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু মুশকিল হল, মেয়েটার ভালবাসা শেষ হয়ে যাওয়ায়, ছেলেটা অকূল পাথারে পড়ে যায়। তার মনটাও নিভন্ত, এদিকে জীবনের অনেকটাই যে-ছেলে তাকে তরিয়ে দিয়েছে, তার কাছেও ফিরতে পারছে না। এই যে শত অপমানেও সে প্রায় কিছুই বলত না, তার একটা কারণ তার স্বভাবটা নিরীহ, আরেকটা কারণ সে বন্ধুর ভালবাসা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। বন্ধুটাও হয়তো একঘেয়েমি কাটাবার জন্যই তাকে সর্বক্ষণ বিঁধত। একটা ছোট স্তিমিত অঞ্চল— যেখানে প্রায় কিছুই ঘটে না, ছেলেরা জটলা বেঁধে হাবিজাবি আড্‍ডা মারতে থাকে, কয়েকজন মেয়েও তাদের সঙ্গে মেশে, একটু গুন্ডামি একটু চোরাচালান, একটু পিয়ানো-বাজনা কারও বাড়ি থেকে ভেসে আসা, এই খেয়েমেখে জীবন চলে, সেখানে আর করারই বা আছে কী? হয়তো মেয়েটার দিক থেকেও প্রেমটা আর কিছুই নয়, একটা কাজে সে এখানে এসেছে মাসখানেকের জন্য, সেই সময়টাকে প্রায় গায়ের জোরে একটু ঝাঁঝালো করে তোলার চেষ্টা। ছবির শেষে আমাদের সমর্থন আবার স্মার্ট বন্ধুর দিকে ঢলে পড়ায় আমরাই একটু অবাক হয়ে যাই। ছবিটায় চরিত্র কম, ঘটনাও বিশেষ নেই, কিন্তু ত্রিকোণ সম্পর্ক বুনে অনুভূতির তারগুলো টানটান বাঁধা হয়েছে। এদিক-ওদিক কয়েকজন চরিত্র অবশ্যই আছে, স্মার্ট ছেলেটার মা অবসাদগ্রস্ত একজন চিত্রকর, তিনি রান্না করেন না, ছেলেটা রান্না করতে অস্বীকার করলে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েন (বাবা দুর্ঘটনায় মারা গেছে, মা শুধু নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে বসে থাকে— দুর্মুখ ছেলের আচরণের ব্যাখ্যাও এর মধ্যে কিছুটা আছে), একজন বর্ষিয়সী পিয়ানো-বাদিকাও আছেন, প্রতিবেশী, আগে কিছু অনুষ্ঠানে বাজিয়েছেন, এখন নিজের মনে বাড়িতে বসে এক-একটা ধ্রুপদী গৎ বাজান, একজন বুড়োমতো লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, রোজ লটারির টিকিট কেনে, কিন্তু পড়তে পারে না বলে লোককে ডেকে নম্বর পড়িয়ে জিজ্ঞেস করে সে এবার জিতেছে কি না— কিন্তু ছবি এদের ঘিরে ঘিরে মূলত দুই বন্ধুর গল্প বলে, যাদের পানাপুকুরে আচমকা একটা ঢিল পড়ে, আর তার তরঙ্গ-বৃত্তগুলো কিছুদূর ছড়িয়ে যায়। ফর্মুলা সহজ, কিন্তু ছবিটা নিপুণ।

    আরেকটা ক্ষুদ্র অকর্মা শহরের এক সদ্যযুবতীর গল্প বলে রুশ ছবি ‘আনক্লেঞ্চিং দ্য ফিস্টস’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: কিরা কোভালেঙ্কো, ২০২১)। মেয়েটা তার পরিবার থেকে, মূলত বাবার আওতা থেকে মুক্তি চায়। তার সংকটটা প্রায় শারীরিক, কারণ বাবা তাকে একটা ছোট্ট দোকানে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে বটে, কিন্তু বাড়ি ফিরলেই দরজায় চাবি দিয়ে দেয় এবং মেয়েকে বলে দেয় এই সুগন্ধিটা আর কোনওদিন মাখবি না, বা চুল ছোট রাখবি। মেয়েটার একটা ভাই আছে, সে বেশ বড় হলেও, দিদির ন্যাওটা এবং তার কাছে শুতে চায় (যদিও বাবার রাজত্বে তা বারণ), কখনও ‘মা’ বলেও ডাকে। এক দাদা আছে, সে একটা শহরে কাজ করতে চলে গেছে, সে আসার পর মেয়েটা প্রায় তার গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে, বলে, দাদা যেভাবে হোক আমার এখান থেকে পালাবার ব্যবস্থা কর। কিন্তু বাবা মেয়েটার পাসপোর্ট কেড়ে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে, মানে তার কোনও পরিচয়-জ্ঞাপক নথি নেই, তাই পালিয়েও কিছু করতে পারবে না। এই স্বৈরাচারী বাবাকে সব সন্তানই ভয় পায়, তবু চাকুরে সন্তান একটু-আধটু প্রশ্ন করতে পারে, তুমি কেন অমুক করেছ বা তমুক করোনি, বাবার ধমক খেয়ে সেও চুপ মেরে যায়। একটা জমায়েতে যখন কেউ বলে এই বাবার মতো কেউই তার সন্তানদের ভালবাসে না, কেউ বলে এবার দাদা নিশ্চয় ফিরে এখানেই থিতু হবে, ওর একটা চাকরি দেখে দাও, দাদা বলে, ‘আমি ফিরব না, আমার চাকরি বা বাড়ি বা বউ দেখে দেওয়ার দরকার নেই’, তখন বাবা বলে, ‘তাহলে কী করতে এসেছিস? বেরো!’ অনেকে বলেছেন এ হচ্ছে রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই রূপক, কিন্তু ছবিটা নায়িকাকে বহু নারীর প্রতিনিধি হিসেবেই দেখেছে, যারা পিতৃতন্ত্রের জাঁতাকলে ক্রমাগত পেষাই হচ্ছে। মেয়েটার এক প্রেমিক জুটেছে, সে ভ্যান চালিয়ে দোকানে কিছু মাল জোগান দেওয়ার কাজ করে, বাকি সময় বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার কেটে, আড্ডা মেরে, বা গাড়ির কেরামতি দেখিয়ে সময় কাটায়। ঠিক আগের ছবির মতো, এখানেও এলাকার ছেলেপুলের কিচ্ছু করার নেই, অনেকে বোমাবিধ্বস্ত বাড়িতে পটকা ছুড়ে ফাটায়, অনেকে গাড়ির ভেতর যৌনতা করে। ক্রমে আমরা জানতে পারি, ছোটবেলায় মেয়েটার স্কুলে একটা উগ্রপন্থী হানা হয়েছিল, সেখানে বোম ফাটার ফলে তার পেট ও নিম্নাঙ্গে ক্ষত হয়, যার জন্য অপারেশন দরকার। বাবা সেই অপারেশন করাচ্ছে না, হচ্ছে-হবে বলেকয়ে দেরি করে চলেছে। বড়ছেলে বাবাকে বলে, ওটা করালেই বোন আর তোমার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, এই তো তোমার চিন্তা? এক সময় বাবার একটা স্ট্রোক হয়, তখন মেয়েটা ও তার দাদা বাড়িতে আছে, অথচ মেয়েটা দাদাকে আছাড়িপিছাড়ি বাধা দেয়, যাতে সে ডাক্তার ডাকতে না পারে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারে। এমনিতে ভিতু অতিনম্র মেয়েটাকে আমরা দাদা আসতে একটু নালিশবতী ও অধৈর্য হয়ে উঠতে দেখেছি বটে, কিন্তু তার এই নিষ্ঠুর বেপরোয়া রূপটা আমাদের হতবাক করে দেয়। সে দাদার সেলফোনটা জলে চুবিয়ে দেয়, তারপর যখন দাদা প্রতিবেশীদের সাহায্য চাইতে যাচ্ছে, তাতেও বাধা দিতে থাকে। স্পষ্টত সে চায় বাবা মরে যাক, একরকম ভাবে বাবাকে খুনই করতে চায়। তার বাধ্য নতমুখী মিষ্টতার নেপথ্যে যে এমন উগ্র ঘৃণা সঞ্চিত, তা আন্দাজ করা কঠিন ছিল। অনেক পরে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় দু’ভাই, বাবা কিছুটা চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে এবং বাকশক্তি পুরোপুরি হারায়।

    ‘আনক্লেঞ্চিং দ্য ফিস্টস’ (২০২১) ছবির একটি দৃশ্য

    এর মধ্যে মেয়েটার সঙ্গে তার প্রেমিকের প্রায়-সঙ্গম হয় এবং প্রেমিক তাকে জানায় যে মেয়েটির শারীরিক ত্রুটিতে সে এতটুকু বিচলিত নয়। মেয়েটা তার বোবা হয়ে যাওয়া বাবাকে ব্যঙ্গ করে কথা বলতে থাকে, তার প্রেমিকের কথাও জানায়, তার ভাই ও দাদা তাকে কিছুতে থামাতে পারে না। দাদা তাকে বলে, ‘তোর ওই নীচের অংশের নয়, মাথার চিকিৎসা দরকার।’ আবার মেয়েটা যখন প্রেমিককে বলে, ‘তোমার বাড়িতে আমায় এখনই নিয়ে চলো’, সে বলে, ‘ধুর, তা হয় না কি?’ ফলে সংকটটা হল, মেয়েটাকে তার খাঁচা থেকে বেরোতে হবে একটা না একটা ছেলের হাত ধরেই, কিন্তু কেউই তার তছনছ-আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ সমর্থন করে না। ভাইদের মনে হয়, ওকে সাহায্য করতে গিয়ে তো আর বাবাকে মেরে ফেলা যায় না। প্রেমিকের মনে হয়, আহা, ভালবাসলেই তো আর গোটা পরিবারকে খেপিয়ে তোলা যায় না। এইখানেই ছবিটার জিত, মেয়েটার ছটফটানিটা আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু  তার বাস্তবকে তুবড়ে দেওয়ার প্রহারটাকে মাঝেমাঝে আমাদের বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। শেষে বাবা অবশ্য পাসপোর্টটা দেয়, কিন্তু মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে উঠতে গিয়ে তার ক্র্যাম্প ধরে যায় এবং ওই অবস্থাতেই (দুজনকেই) হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। বাবা মেয়েটাকে অনবধানেই প্রতিকারহীন ভাবে জড়িয়ে থাকে, ভোরের দিকে, ইঞ্জেকশনের প্রভাবে তার হাত ও আশ্লেষ শিথিল হযে আসে। বাবা, বা পিতৃতন্ত্র, এক যুবতীকে স্বাধীনতা না দিতে অবচেতনেও বদ্ধপরিকর। ছবিতে বাবা এবং দুই ভাই যেভাবে বারেবারে মেয়েটিকে জড়ায়, এবং মেয়েটিও, তাতে সম্পর্কের মধ্যে স্বাভাবিক প্রীতির অতিরিক্ত আকর্ষণের ছাপও খুঁজে পাওয়া যায়। মনে হয় তিনটি প্রেমিককে পেরিয়ে মেয়েটি অনাত্মীয় প্রেমিকের দিকে হাত বাড়াতে চাইছে। ছবি শেষ হয় অবশ্য দাদার সঙ্গে বাইকে চেপে মেয়েটার বড় শহরের দিকে, খণ্ডিত থেকে পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনার দিকে, মুক্তির প্রতিশ্রুতির দিকে যাত্রা দিয়েই। কিন্তু মেয়েটার সৌন্দর্য-চর্চা ব্যাহত করে বাবার যে তৃপ্তি, তাও আমরা দেখেছি, মেয়েটার বাবাকে হত্যার বাসনাও দেখেছি। বোনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দুই ভাইয়ের নাচও দেখেছি, যেন বিভিন্ন পুরুষের শেকলে তাকে বাঁধা থাকতেই হবে। শেষ দৃশ্যে ইচ্ছে করে খুব ক্লোজ-আপে বাইকের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেখানো, ফলে ছবির এতোল-বেতোল হয়ে যাওয়া, আর আরও শেষদিকে পর্দা মাঝে মাঝে কালো হয়ে যাওয়া ও ছবি স্থির হয়ে যাওয়ায় যেমন শেকল-ভাঙচুর বোঝানো হয়, তেমন অনিশ্চয়তাও। মেয়েটা বাইকে চড়ে যেতে যেতে তার ব্যাগ স্বেচ্ছায় রাস্তায় ফেলে দেয়, যাতে ডায়াপার রাখা থাকত (তার হিসি করায় অসুবিধে হয়)। কিন্তু তার আগে দাদার জ্যাকেটে বারবার নাক ঘষে মেয়েটা বলে, তোর গন্ধটা ঠিক বাবার মতো। আমরা চমকে উঠি। বাবার প্রতি তার ভালবাসাও আছে, একসময় হাসপাতালে তার অচৈতন্য বাবার ক্র্যাম্প-ধরা হাত সে নিজেই জড়িয়ে নিয়েছিল, আবার এতটা বিদ্বেষও আছে যে সদ্য স্ট্রোক হওয়া বাবাকে সে প্রথম কথাই বলে, আমার আই-ডি’টা কোথায়? আর তারপরেই বলে ‘তুমি আর কথা বলতে পারো না? যাক, তাহলে অন্তত আমি কথা বলতে পারব!’ আবার বাবাও শোধ না নিয়ে, পাসপোর্টটা লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দিয়ে দেয়। পানসে শহরে সরু পরিবারকে দেখিয়ে নারীমুক্তির কথা বলে এই ছবি, কিন্তু একবগ্গা ভাবে নয়, বহু স্তর যত্নে সাজিয়ে। পরিবারের প্রতি প্রেম আত্মস্বাধীনতার পথে প্রস্তর, তাও বলে, আবার পরিবার যাকে প্রেম বলে ভাবছে তা আসলে ব্যক্তিকে খর্ব করার মেশিন, তাও বলে, আবার পারিবারিক বন্ধন সমঝদারও হয়, সেকথাও বলে। যে দৃশ্যে বাবার স্ট্রোক হয়েছে এবং মেয়েটি বাবাকে জল এনে দেওয়ার বদলে রান্নাঘরে নিজে জল খাচ্ছে, তা যুগপৎ নিষ্ঠুরতা ও আশায় থরথর করে, আর যে দৃশ্যে মেয়েটির নিম্নাঙ্গ উন্মোচন করছে তার প্রেমিক (ক্যামেরা মেয়েটির মুখে নিবিষ্ট থাকে, আমরা এও খেয়াল করি মেয়েটির হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ), সেখানে মেয়েটির পুলক, লজ্জা, আড়ষ্টতা, বিস্ময় এবং সর্বোপরি উদ্বেগ (প্রেমিক তার অঙ্গবিকৃতি দেখে প্রত্যাখ্যান করবে কি না) এমনভাবে ফুটে ওঠে যে কান ফিল্মোৎসবে ছবিটির ‘আ সার্টেন রিগার্ড’ পুরস্কারকে ‘বাহবা’ বলতে ইচ্ছে হয়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook