ভূতেশ-দুই
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হয়েছে। কিন্তু এর পরের ধাপই চাকরির সন্ধান। ভূতেশের পক্ষে সম্ভব নয় কলেজে পড়ে সময় কাটাবার বিলাসিতায় গা-ভাসানো। হরু কলেজে ঢুকবে বলে তার কোনও ঈর্ষা নেই; উপরন্তু এ ভেবেই সে খুশি যে তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা একজন প্রতিযোগী অন্তত কমল। হরু অবশ্য বার বার তাকে জপিয়ে চলেছে কলেজে ভর্তি হয়ে বি এ পড়ার জন্য। তা ছাড়াও হরু খবর এনেছে যে কলেজে পড়তে মাইনে লাগবে না; কারণ সে জলপানি পাবে। কিন্তু পড়া আর না এগোবার ব্যাপারে ভূতেশ একেবারে অনড়। সংসারের দায় এবং কর্তা হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় সে এখন মশগুল হয়ে আছে। সে বুঝেছে যে মাস-মাইনের সুরক্ষা ছাড়া এ সংসারের হাল ধরা যাবে না। ছোটখুকি অমৃতবালা আর তার বর বিপিন দুজনেই তো সুখের পায়রা; আদায়ে আছে, কিন্তু দায় নেবার বেলা হাওয়া। দুই বিধবা বউদি নিজেদের দুর্ভাগ্যে দিশেহারা; বড়খুকি বিরজাবালা সংসার সামলালেও টাল খেয়ে আছে দেশপ্রেমের ধুয়োয়, আর এ বিষয়ে তার মাথা খাচ্ছে জয়নারায়ণ। বাড়ির মধ্যেই দেশপ্রেমের ঠেক হলে সরকারি চাকরি পাওয়াও মুস্কিলই হবে। এত সব সমস্যার সমাধান করা যে ভূতেশের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব এটা সে ভালই বুঝেছে; তাই চাকরি করে সকলের মাথা কিনে নিতে চায়। সংসারের এই পরিস্থিতির জন্য কাউকেই দায়ী করে না ভূতেশ। সে শুধু চায় তার নিজের জীবনেই কর্তা হয়ে বসতে।
২.
ভোরবেলা পুকুরে স্নান সেরে পাড়ে উঠতেই হরুর সঙ্গে দেখা, সঙ্গে জয়নারায়ণ। গাছপালার আড়ালে থানকাপড়ের আভাস দেখেই অনুমান হল যে বড়খুকি বিরজাবালা ভূতেশকে দেখেই বাঁক নিল অন্য দিকে। সদর দিয়ে না ঢুকে বাগান দিয়ে ঢুকে আসাই সহজ; হরুরাও তাই এসেছে। এদিক দিয়ে ঢুকলে না আছে বেড়ার আড়াল না অন্যের নজর। রাগে রি রি করে উঠল ভূতেশের শরীর। ওদের মুখের দিকে না তাকিয়ে খিড়কির পথ ধরে ঘরে ঢুকে এল ভূতেশ। কাগজের খবর ছাড়াও চারিদিক থেকে খবর আসছে কী ভাবে ধরা পড়ছে ছেলেছোকরার দল। দানা বাঁধছে বঙ্গভঙ্গ রুখে দিতে সন্ত্রাসবাদীদের প্রকাশ্য এবং গুপ্ত আক্রমণ। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম— বাঙালি আধিপত্যে ঢুকে আসছে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিরোধ। কী যে হচ্ছে তা আর বুঝে উঠতে পারে না ভূতেশ! ভূতেশের মন জুড়ে লর্ড কার্জন; এত কম বয়সে কেউ এমন ভাইসরয় হননি। এমন সার্বিক নজরে কে আর দেখেছে ব্রিটিশ শাসনে এখানকার প্রশাসন, পুলিশ, আর্মি, লেখাপড়া, সংস্কৃতি! সেই কার্জনকেও সরে যেতে হল। রাষ্ট্রনীতি ব্যাপারটাই ভীষণ গোলমেলে ঠেকে ভূতেশের কাছে; ঘরের যুদ্ধে অবশ্য ক্ষমতায়নের এই দাবিটা আরও রুক্ষ এবং রূঢ়। ভূতেশ অবাক হয়ে ভাবে, হরু আর জয়নারায়ণ এসব কিছুটা বুঝলেও তার বড় বোন বিরজাবালা কী ভেবে জুটছে! সে নাকি আইরিশ লেডি মারগারেট নোবেলের কথা জেনে খুবই অনুপ্রাণিত; ভূতেশের ভয় যে, ভুলভাল বুঝে সে না পালিয়ে যায় জয়নারায়ণের সঙ্গে! বঞ্চিত বিধবার শরীরের টানটাকেই কি সুড়সুড়ি দিচ্ছে না জয়নারায়ণের দেশপ্রেমের উচ্ছ্বাস!
এটা ঠিকই যে অন্য দুই বিধবা বউদির মতো নিজেকে বিলিয়ে দিতে উদ্যত নয় বড়খুকি। নিজেকে ধরে রাখতেও জানে সে; হয়তো বাবা-মায়ের কাছে থাকে বলেই কর্তব্য এবং মায়া-মমতার একটা বাঁধনও তার আছে! কিন্তু ক্রমাগত উস্কানি পেলে সে বাঁধনই বা কতদিন টিকবে! ভূতেশের সঙ্গে বড়বউদির নিভৃতযাপন পাড়া-প্রতিবেশী থেকে বাবা-মা যে দেখেও দেখবে না, এটা ভূতেশ বেশ বুঝতে পেরেছে। এর উলটোটা হলে বিশ্বাসই করবে না, যেন এটাই দস্তুর! কিন্তু বাড়ির বিধবা মেয়ের প্রেম, সেটা কেউ মানবে না। তা হলে তো বাবা-মা উদ্যোগী হয়ে বড়খুকির আবার বিয়ে দিতেন; সে আইন তো কবেই পাস হয়ে গেছে। ব্রাহ্মণ ঘরে যেন বিধবারাই এক মস্ত ঐশ্বর্য এবং শুচিতার শোভা-স্বরূপ। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই দেওয়ালের গায়ে ছায়া দেখতে পেল ভূতেশ; এরপর হ্যারিকেনের আলোটা আড়াল করে, মাথার কাপড়টা খসিয়ে ঘরে এসে দাঁড়াবে বড়বউদি পদ্ম। ভূতেশ এমনভাবে পাশ ঘুরে শোবে যেন সে দেখেও দেখেনি। আর বড়বউদি নিকটে এসে, তার চৌকিতে বসে শুরু করবে তার গায়েপিঠে হাত বোলানো; ফিসফিস করে কথা বলে যাবে তার কানের গোড়ায়— ‘আর ঘুম দেখিও না তো ঠাকুরপো! সারারাত ধরে সোহাগ-আহ্লাদের কপাল করে তো আসিনি; যে জন্য আসা তাড়াতাড়ি সারা করো দেখি!’
‘কেন আসো? ঘুম ভাঙাতে!’
‘জ্বালা জুড়োতে— তুমিও বোঝো, আমিও জানি।’
‘জ্ঞানত পাপ করছ?’
‘তোমার যে পাপ লাগবে না সে কী আর জানি না! দেহ তো জুড়োয়…’
‘মেজোবউদি, বড়খুকি সবাই বুঝতে পারছে!’
‘ছোটখুকি, ঠাকুরজামাইও তো বাদ নেই। একদিন তো আঁচল ধরে টেনে গোয়ালঘরের দিকে যেতে ইশারাও করল।’
‘কী বলছ? বিপিনের এত সাহস! এ বাড়ির অন্ন ধবংস করে আবার এইসব!’
‘বেওয়ারিশ হলে এমনই হয়; তায় আবার ঘাট–আঘাটায় ঘুরে বেড়ানো বেটাছেলে!’
প্রবল আধিপত্য নিয়ে এদিকে ফিরল ভূতেশ। আবছায়া অন্ধকারে তাকিয়ে রইল বড়বউয়ের চোখের দিকে; ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল বড়বউ। বুঝতে পারল, আজ আর সহজ হবে না ভূতেশ। ঠাকুরজামাইয়ের নামটা না নিলেই ভাল করত। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আলিঙ্গনের আশা ছেড়ে বিছানা থেকে সরে দাঁড়াল বড়বউ। মুখবন্ধ একটা খাম, আঁচলের আড়াল থেকে বের করে, ভূতেশের হাতে দিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল। যেমন ভাবে এসেছিল সে ভাবেই অদৃশ্য হয়ে গেল; ঠিক যেন অশরীরী। খামটা বালিশের নীচে রেখে আবার ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল ভূতেশ।
৩.
কাউকে কিছু না জানিয়ে সকাল সকাল স্নান করে তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কলকাতা যাবে বলে। কী মনে হতে বাঁ দিকে ঘুরে এগিয়ে চলল তনুদাদের বাড়ির দিকে। হরুর কাছে খবর পেয়েছে যে ছুটিতে বাড়ি এসেছে তনুদা। সরকারি চাকরির ব্যাপার, তাই তনুদাকে একবার জানানো উচিত, সুপরামর্শই পাওয়া যাবে। দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই তনুদার বাবা বললেন ওপরে উঠে ছাদে চলে যেতে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়েই ভূতেশ দেখতে পেল তনুদাকে; বদু আর রাণীর সঙ্গে জুটে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। দেখে অবাক হল কি না বোঝা গেল না। খামটা খুলে চিঠিটা বার করে চোখ বুলিয়েই পিঠ চাপড়ে দিল।
‘চিঠিটা নকল নয় তো! সত্যিই কি নিয়োগ হবে?’
‘সরকারি ছাপ্পা মারা চিঠি আবার নকল হয় নাকি! আজকেই জয়েন করে যাও।’
‘সেই ভেবেই তো বেরিয়েছি; তবুও ভাবলাম আপনাকে একবার দেখিয়ে নিই।’
‘আপনি হয়ে গেলাম কবে থেকে! হরুর বন্ধু তো!’
‘এখন কত বড় অফিসার, আমাদের গর্ব!’
‘তুমি অফিসার হলে তোমাকেও আপনি-আজ্ঞে করব তো?’
‘এ কী কথা! আমার সঙ্গে তোমার কোনও তুলনাই হয় না তনুদা!’
‘হরুকে জানিয়েছ? সে কী বলছে?’
‘কাউকেই জানাইনি; শুধু তোমার কাছেই এসেছি। গতকাল রাতেই হাতে পেয়েছি।’
‘একদিকে ভালই হল; কলকাতায় পোস্টিং, বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারবে।’
‘শেয়ালদায় নেমে হেঁটে ডালহৌসি; সময় হাতে নিয়ে বেরোতে হবে।’
‘শুনেছি বহু আগে ‘কুঠির পান্সি’ বলে নৌকো চলাচল ছিল। আমার পূর্বপুরুষ যাঁরা লালদিঘিতে ফোর্ট উইলিয়মে কাজ করতেন তাঁরা নাকি তাতে করেই দপ্তরে যেতেন।’
‘এ গল্প আমিও শুনেছি, তবে বিশ্বাস করিনি। তোমার কথা তো… তা আর ভুল হবে না।’
‘যাও এগিয়ে পড়ো। টেস্টিমোনিয়াল সব সঙ্গে আছে নিশ্চয়ই!’
এক বুক খুশি নিয়ে নেমে আসবার সময়ে মেসোমশাইকে প্রণাম করে ফেলল ভূতেশ; মনে হল বাবা-মাকে প্রণাম না করে বেরনোটা কিছুটা হলেও যেন পুষিয়ে গেল। ‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই’ এই আপ্তবাক্য মনে রেখে চেপে রাখল নিজের অদম্য খুশি। একটাই ভাল হল যে, ট্রেনের কামরায় কোনও চেনা মুখের সঙ্গে দেখা হয়নি। শেয়ালদায় নেমে দলে দলে যারা হাঁটছে, তাদের সকলের গতিই ডালহৌসি অভিমুখে। এ অঞ্চলে সে এই প্রথম এল; তিনতলা ইমারতের এক মস্ত লালবাড়ি, ঢোকার পথ যে কোনটা ভাবতে শুরু করল ভূতেশ! চারপাশেই তো বেয়নেটধারী নেটিভ পুলিশ। সবাই যে বাঙালি তা নয়, বিহার, মিরাট এসব অঞ্চলের লোকই বেশি মনে হয়। ইংরেজি বলতে পারলেও হিন্দি না জানলে সুবিধে হবে না। লালবাজারের দিকে এসে ওদিকের গেট দিয়ে ঢুকছে এমন একজন বাঙালি চাকুরেকে পেয়ে, খামটা দেখাতেই দারোয়ানকে বলে সেই লোকটিই তাকে ঢুকিয়ে দিল। তার নির্দেশ মতো বড়বাবুর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল ভূতেশ। ইনি অবশ্য বাঙালি ক্লার্ক, কিন্তু কথা শুরু করলেন ইংরেজিতেই। জয়েনিং লেটার হাতে দিয়ে বললেন আগামীকাল সাহেবের ঘরে নিয়ে যাবেন; আজ সে বাড়ি চলে যেতে পারে। কথা না বাড়িয়ে হাত জড়ো করে প্রণাম করে বেরিয়ে এল ভূতেশ।
৪.
বেশ কিছুটা হেঁটে এসে, বউবাজারে পড়তেই একটা বাঙালি-বাড়ির রোয়াকে বসে জয়েনিং লেটারটা খুলে পড়তে শুরু করল ভূতেশ। বুঝতে পারল যে তার চাকরি হল যে দপ্তরে, তার নাম মিলিটারি অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। এই দপ্তরের প্রধান কাজগুলি অনেক শাখায় ভাগ করা। আপাতত সে কাজ করবে রেকর্ড কিপিং দপ্তরে। সম্ভবত তার হাতের লেখা এবং ঝকঝকে ইংরেজিতে দরখাস্ত দেখেই এই দপ্তরে কাজ হল। হঠাৎই চোখে জল এল ভূতেশের। মনে হল এই লড়াইটা সারাজীবন তাকে একাই লড়ে যেতে হবে। তনুদার মতোই তার ঘাড়েও বিরাট সংসার; এমন কোনও বন্ধুও নেই যাকে সে এই ব্যাপারে বলে খুশিটুকু ভাগ করে নিতে পারে। নিজেকে বড় একা লাগতে লাগল ভূতেশের।
অচেনা রাস্তায় কিছুটা এলোমেলো ঘুরে, ইছাপুর অবধি ট্রেনের টিকিট কেটে সেখানেই নেমে পড়ল সে। ইছাপুরেও এই দপ্তরের কিছু কর্মী আছে। কলেজে যাতায়াতের সময় ট্রেনে তাদের দেখত। আর্মির একটা বড় সেন্টার এবং গোডাউন এখানে আছে যেটা মূলত চালায় ব্রিটিশ সরকারের নিম্নপদের কর্মীরাই। ভূতেশের আন্দাজ যে এখানেও তার বদলি হতে পারে; কারণ তার সোদপুরের বাড়ি থেকে এ অঞ্চলে যাতায়াতে সময় লাগবে কম। আপাতত তার চোখ জুড়ে তিনতলা ওই লালবাড়িটাই— রাইটার্স। সে হতে চায় সাহেবদের অধীনেই একজন দক্ষ কলমচি। কে বলতে পারে যে লখনউ, দিল্লি, মিরাট বা শিমলা এমন সব অঞ্চলে পোস্টিং হবে না তার! স্যুট-প্যান্ট-টাই পরলে তাকেই তো সাহেব দেখাবে! ভূতেশ মনে মনে ঠিক করে নিল যে প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই, সে একটা দেওয়াল-জোড়া আয়না কিনবে— প্রতিদিন দেখবে ক্রমে তার সাহেব হয়ে ওঠা!
সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরে, হাতেমুখে জল দিয়ে বাবা-মাকে খবরটা জানাল ভূতেশ। বড়খুকি গেছে কৃপানাথের মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতে। ছোটখুকি কী একটা সেলাই নিয়ে বসেছে; তার দু’পাশে বসে স্লেট-পেনসিলে লেখা শিখছে তার নিজের খোকা গুপি আর মেজদার মেয়ে তারা; দুই বউদি এখনও হেঁশেলে। আহ্নিক সেরে বাবা বসেছিলেন চুপ করে, মা তো সবসময় শোয়া। ভূতেশের চাকরির খবর শুনে আজ অনেক দিন বাদে মা উঠে বসলেন, ছোটখুকি সেলাই ফেলে তাকিয়ে রইল দাদার মুখের দিকে, মন্দির থেকে ঘরে ঢুকতে গিয়েও বড়খুকি দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে। মা ইশারা করতেই বড়খুকি তাঁর দিকে এগিয়ে দিল কাঠের বারকোশে বসানো তার হাতে ধরা সেই জ্বলন্ত প্রদীপটা; ভূতেশকে নিজের বিছানার পাশে ডেকে, নিজের তেলোতে সেই প্রদীপ থেকে তাপ নিয়ে, নিয়ম মেনে তিনবার সেই হাত মা ছুঁইয়ে দিলেন ভূতেশের কপালে। বাবা বলে উঠলেন, ‘এই তো মুখ তুলে চেয়েছেন কৃপানাথ।’ ইছাপুর থেকে বাড়ির জন্য একটু কাঁচাগোল্লা এনেছে সে। মা সেই হাঁড়িটা ছোটখুকির হাতে দিয়ে বললেন, ‘হেঁশেলে দিয়ে আয়, রাতে যেন সবার পাতে পড়ে।’
বড় অভিভূত লাগছে ভূতেশের। মনে মনে প্রণাম জানিয়ে সে ভাবল, কৃপানাথ নয়! জয় ইংরেজ সরকারের, জয় ভাইসরয় সাহেবের— এমন আপিস! এমন দপ্তর! এটাকেই তো ঘরবাড়ি করে ফেলবে সে!
৫.
বড়বউ ঠিকই তার ঘরে এল; তবে অনেক রাতে। ভূতেশের চাকরি হওয়ার উত্তেজনায় আজ বোধহয় সবাই জেগে আছে— যে যার মতো, ভূতেশ বসে আছে একটা চেয়ারে, জানালাটা একপাট খোলা। বড়বউয়ের ছায়া পড়তেই সেই পাটটা ভেজিয়ে দিল ভূতেশ। তার চেয়ার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়েই ফুঁসে উঠল বড়বউ, চাকরি পাওয়ার খবরটা কেন সে সবার শেষে জানল!
‘খামটা এনে তো আমিই তোমাকে দিয়েছিলাম!’
‘এটা আর এমন কী! চাকরি তো একটা হতই; সে আজ বা কাল।’
‘কাল সকালেই না হয় সবাইকে জানাতে। চাকরিটা কি খোয়াতে হত তাতে!’
‘চুপ করো, সবাই জেগে আছে।’
‘কেন? বড়খুকি নাগর নিয়ে দেশপ্রেম দেখালে দোষ দেখে তারা!’
‘কী সব বলছ! কাছে এসো…’
বড়বউকে বিছানায় টেনে শান্ত করেও সুখ হল না ভূতেশের; ভয় পেয়ে গেল ভূতেশ। সম্পর্কের বাইরেও শরীরী মেলামেশা এত আধিপত্য চায়! এই প্রথম ভূতেশের মনে হল তার একজন আপনজন চাই, চাই একজন সঙ্গী। নিজেকে রক্ষা করার এ ছাড়া আর উপায় কী!
আমি ভূতেশ। অগাধ কর্তৃত্ব নিয়ে সাবধানী আচরণ করতে লাগলাম। আমি চাকরি পাওয়ার পরই এ বাড়িতে আসা-যাওয়া কমে গেল হরু আর জয়নারায়ণের। বড়খুকিও বিশেষ কাছে ঘেঁষে না আমার, ঠাকুরজামাই বিপিন পিছনের দরজা দিয়েই আসা-যাওয়া করে। প্রকাশ্যে দাপট শুধু বাড়িয়ে চলল বড়বউ। মেজোবউকে দিয়ে মা বলালেন, বড়বউকে কাশী পাঠিয়ে দেবার কথা। আমি নিয়মিত লিপ্ত হতে থাকলাম বড়বউয়ের সঙ্গে।
এখন সে অসঙ্কোচে আমার ঘরে আসে, আমি না থাকলেও। বুঝতে পারি যে বড়খুকিকে ছেড়ে আমিই এখন তার কড়া নজরদারিতে। এখন আর-এক রকম লুকোচুরি চলছে তার আর আমার মধ্যে। গোপন আঁতাঁতের বদলে আধিপত্যের বজ্রআঁটুনি। একটু আলগা দিয়ে দেখাই যাক না এ খেলাটা কী ভাবে, কদ্দূর গড়ায়!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র