চায়ের দোকানের ভেতর থেকেই দু’বার ছেলেটাকে চাঁটা মারার চেষ্টা করল রঘু। দু’বারই ওর হাত হাওয়ায় আঁক কেটে ফিরে এল। টেবিলের এ পারে একরত্তি ছেলেটা অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় নিচু হয়ে পরপর আঘাত এড়াল। তারপর সে কী খিলখিল হাসি! রঘুর পিত্তি জ্বলে গেল। সক্কাল-সক্কাল আবার আপদটা এসে জুটেছে।
‘হাতের নাগালে পেলে ছাড়ব না তোকে… বিচ্ছু কোথাকার,’ রঘু বেশ রাগের সঙ্গেই বলল। বেহায়া ছেলেটা আরেকবার মুখ ভেঙিয়ে হাসতে-হাসতে রাস্তার ওপারে চলে গেল।
ওপারে শাহাবুদ্দিন সবে সেলাই-মেশিনে একটা ব্লাউজ চড়িয়েছে। নাদিমের কাণ্ড দেখে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। তেরো বছর হতে চলল ছেলেটার, অথচ এখনও সেলাই-মেশিন ধরানো গেল না। ছো্টখাটো রিফুগুলো পর্যন্ত ঠিকঠাক পারে না। সারাক্ষণ শুধু রঘুর দোকানের সামনে ঘুরঘুর করছে সামোসা বানানো শিখবে বলে।
রঘু আর শাহাবুদ্দিন দুজনেই পূর্ণিয়া থেকে দিল্লি এসেছিল কাজের খোঁজে। এখানেই দুজনের আলাপ। জানা গেল দুজনের গ্রামও পাশাপাশি। বাটিকা হাউজিং কমপ্লেক্সের বাইরে একটা সার্ভিস লেনে ওদের মুখোমুখি দোকান। গেট দিয়ে সোজা বেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলেই বড় রাস্তা। আর কমপ্লেক্সের গা বেয়ে চলে গেছে এই সার্ভিস লেন। গেটের কাছাকাছি দুটো মাত্রই দোকান।
রঘুর দোকানের লাইসেন্স আছে। শাহাবুদ্দিনকে মাসে আটশো টাকা ঘুষ দিতে হয় সেকেন্ড-হ্যান্ড সেলাই-মেশিনটা নিয়ে বসার জন্য। আলোর ব্যবস্থা নেই, তাই শেষ-বিকেলে মেশিনটা একটা শেকল দিয়ে, কমপ্লেক্সের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসা শিশু গাছের ডালের সঙ্গে তালা মেরে রেখে যায়। ঘরে ফেরার সময়ে সামনের রডে বসে বকবক করতে থাকে নাদিম, আর সাইকেলের দু’পাশে দুলতে থাকে নানা রঙের পেটফোলা ব্যাগ যাতে থাকে কমপ্লেক্সের বাবু-বিবিদের জামাকাপড়। ফুটপাথের দর্জির কাছে ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় কেউ সেলাই করতে দেয় না— দিলেও বড়জোর নতুন জিন্সের পা কাটতে দেয়। বেশির ভাগই ফলস-পিকো-ব্লাউজ-পর্দার কাজ। বাবু-বিবিরা অবশ্য ফালতু দরদাম করে না; যাই চাও, দেয়। দু’একজন অবশ্য খুব খুঁতখুঁতে হয়।
নাদিমের এই সেলাইফোঁড়াই একেবারেই ভাল লাগে না। সেলাই-মেশিনে পা রাখার প্রাথমিক রোমাঞ্চ ওর কেটে গেছে। অতক্ষণ মাথা নামিয়ে রাখতে ওর ঘাড় টনটন করে। পুরনো এই মেশিনের কটকট শব্দের চেয়েও ওর ভাল লাগে যখন রঘুর তেলের কড়াইয়ে সামোসাগুলো ভুসভুস শব্দে বুদবুদ তুলে হাবুডুবু খেতে শুরু করে, আর তাদের গায়ের রং কাঁচাহলুদ থেকে বাদামি হতে শুরু করে। রঘু বাড়ি থেকে আলুর চটকানো সবজি নিয়ে আসে। সবজি পুরে সামোসার কোনাগুলো টেনে-টেনে রঘুচাচা যখন শিং বানিয়ে দেয়, নাদিম হাঁ করে দেখে। আর গরম, খাস্তা সামোসার গন্ধে শীতের বাতাস যখন ম-ম করে, নাদিমের পেটে মোচড় দেয়। আব্বু চাইলেই পয়সা দেয়, কিন্তু বাপের শুকনো দৃষ্টি ওইটুকু বাচ্চারও চোখ এড়ায় না। সবুজ চাটনিতে ডুবিয়ে সামোসায় কামড় দিতেই অবশ্য সব দুঃখ কোথায় গায়েব হয়ে যায়। তা ছাড়া এই বয়সে এমনিতেই মনখারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
ছোঁড়াটার মতলব রঘুরও অজানা নয়। শাহাবুদ্দিন নিজেই দুঃখ করে বলেছে ছেলেটার সেলাইয়ে মন নেই। সারাদিন শুধু এক চিন্তা— কী করে ভাজতে হয় খাস্তা, তিন শিংওয়ালা, পেটমোটা সামোসা। যার গন্ধে বাতাস ম-ম করে, আর পেটে মোচড় দেয়। এ যেন এক অলৌকিক খাদ্য, সবুজ চাটনিতে ডুবিয়ে যাতে কামড় দিলে গায়েব হয়ে যায় সব দুঃখ। যা বানাতে কোনও মেশিনের পেডালে পা চালাতে হয় না, মাথা নিচু করে রাখতে হয় না ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ঘাড় টনটন করে না।
‘আব্বা আমার হাত ধরে সেলাইয়ের কাজ শিখিয়েছিল, কিন্তু আমি নিজের ছেলেকে শেখাতে পারলাম না,’ দুপুরে চায়ের কাপ নিয়ে একদিন দুঃখ করে বলছিল শাহাবুদ্দিন। ‘অথচ এ সব জায়গায় সেলাইয়ের কাজে কি পয়সা কম? একটা ব্লাউজ ফিটিং-এর পয়সায় হপ্তার আনাজ হয়ে যায়। অথচ ছেলেটার কোনও হুঁশ নেই। গাঠরি-ভরা কাজ, একা মানুষ করতে পারি? একদিন আমারও চোখ চলে যাবে। সময় থাকতে বাপের থেকে শিখে নে, তা না! খালি বলে ‘একটু রঘু চাচাকে বলো না সামোসা বানাতে শিখিয়ে দেবে’। ‘দে দেখি তোর একটা সামোসা, খেয়ে দেখি কী জাদু ওতে…’
রঘু যে শেখাতে চায় না তা-ও নয়। আসলে ইদানীং মনে শান্তি নেই। শুধু চা-শিঙাড়া বেচে তেমন লাভ হয় না। শীতকালে ডিমসেদ্ধ আর ওমলেট— দুয়ের-ই চাহিদা আছে। কিন্তু আজকাল ডিম রাখতে হয় লুকিয়ে। হাফ কিলোমিটার দূরে একটা মন্দির আছে। দিনের বেলা সেখানে ভক্তদের আনাগোনা। কিন্তু সন্ধের পর কালো-কাচের গাড়ি সেখানে থামে, কারা যেন আসা-যাওয়া করে, রঘু নিজে দেখেছে। দিনের বেলা কমপ্লেক্সের অনেকেই সেই মন্দিরে যায়, দু-একজন ফেরা-র পথে ওর দোকানের চা খেয়েও যায়। মন্দিরের আশেপাশে ডিম-মাংস বেচা নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঝামেলার খবর মোবাইলে দেখেছে রঘু। স্কুলের মিড-ডে মিল থেকেও নাকি ডিম তুলে দেওয়া হচ্ছে জায়গায়-জায়গায়। সামোসা মুড়তে গিয়ে অনেকবার কাগজে পড়েছে রঘু। গ্রামে একটা জমি কেনার চক্করে আছে রঘু। তাই অস্বস্তি হলেও হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে মন চায় না।
তা ছাড়া ওর আসল খদ্দের তো কমপ্লেক্সের বাবুরা। এরা সব শিক্ষিত মানুষ। অনেকেই চায়ের সঙ্গে ওমলেট ভালবাসেন। ওদের চুপিচুপি বলা আছে— ওমলেট চাইলেই পাবেন, কিন্তু ডিমসেদ্ধ চাইলে আধঘণ্টা আগে ফোন করে দেবেন। দুটো ডিমের ওমলেট বানাতে খরচ পড়ে বড়জোর বারো টাকা, অথচ রঘু নেয় পঁয়তাল্লিশ টাকা। বাবুরা আবার সঙ্গের পাউরুটিও নেন না। শনি-রোববার ক্রিকেট খেলে কমপ্লেক্সের কিছু ছেলে আসে, তারাও ডিম-পাউরুটি খায়। কেউ-কেউ তো ডবল নেয়। কমপ্লেক্সের গার্ডদের মধ্যেও অনেকে খায়। মোটের ওপর ডিমে অনেক লাভ।
ইদানীং একটা নতুন লোক মাঝেমাঝে ওর দোকানে আসতে শুরু করেছে। মন্দিরের ভেতরে বাগানে নাকি কাজ করে। গেট দিয়ে দেখা যায় মন্দিরের ভেতরে একটা ছোট পুকুর রয়েছে, তাতে গিজগিজ করছে মাগুরজাতীয় মাছ। একটা গোশালা আছে, আর আছে অসংখ্য বেলগাছ। লোকটা কথা বিশেষ একটা বলে না। দাঁড়িয়ে চা খায়, একটা বিড়ি শেষ করে আবার ফিরে যায়। গত সপ্তাহে এক বাবুকে কাগজের প্লেটে রঘু ওমলেট ধরিয়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই লোকটা হাজির। ওর চাউনিটা রঘুর ভাল লাগল না। তবু জিজ্ঞাসা করল, ‘চা?’
লোকটা গম্ভীরভাবে চায়ের কাপটা নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে গেল। ওপারে শাহাবুদ্দিন ছেলেটাকে প্রায় ঘাড়ে ধরে মেশিনে বসিয়ে কাজ শেখানোর চেষ্টা করছে। লোকটার নজর সেদিকে। একটু বাদেই ভিড় পাতলা হয়ে এল। লোকটা দাম দিতে-দিতে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ডিম-মাংস খাও?’ রঘু বুঝতে পাচ্ছিল না কী বলা উচিত। আরেকজন খদ্দের এসে যাওয়ায় তাকে আর জবাব দিতে হল না।
মকর সংক্রান্তির দিন ভোরে ঝিরঝির বৃষ্টি হয়েছিল। সময়মতো ঘুম ভাঙলেও রঘুর আজ দোকানে যেতে ইচ্ছে করছিল না। যাবার আগে শীত যেন আরও জাঁকিয়ে বসেছে। মোজা-টুপি-সোয়েটার পরেই রঘু কম্বলে সেঁধিয়েছিল। ঠিক যে অবস্থায় শুয়েছিল, একটু নড়লেই ঠান্ডা কাপড়চোপড় ভেদ করে ওর হাড়ে পৌঁছে যাচ্ছিল। বিছানার বাকিটা যেন বরফের পাত দিয়ে মোড়া। আরেকটু ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে লোভ হচ্ছিল। কিন্তু রোববারের দিন, দেরি হলেই বিস্তর লোকসান। গ্রামের সেই জমি কিনতেই হবে, এই সময়ে আলসেমি করা চলে না।
মাফলারে নাকমুখ বেঁধে সাইকেলে দোকানে পৌঁছেই রঘুর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। প্লাস্টিকের যে ডাস্টবিনটা ওর দোকানের পাশে একটা লোহার ফ্রেমে রাখা ছিল, কারা যেন সেটা আক্রোশে চৌচির করে দিয়ে গেছে। ছিটকে পড়ে আছে কাগজের প্লেট আর গেলাস, ছড়িয়ে গেছে ডিমের খোলস। সব পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। এদিকে এর মধ্যেই চায়ের জন্য লোক আসতে শুরু হয়েছে।
‘এ তো হবারই ছিল’, কমপ্লেক্সের দারোয়ান চৌবে সন্তর্পণে ডিমের খোসা বাঁচিয়ে এগিয়ে এসে বলল। ‘মন্দিরের রাস্তায় ডিম বেচছিলে, আজ নয় কাল লফরা তো হত-ই। আমি তো বলব তুমি বেঁচে গেছ। মুন্সিপাল্টি নতুন ডাস্টবিন লাগিয়ে দেবে। কিন্তু রামজীর কৃপায় তোমার দোকানে কেউ হাত দেয়নি,’ চৌবে দু’চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠেকাল।
ওর দোকানের নীচে একটা ঝাঁটা রাখা থাকে। রঘু আবর্জনা পরিষ্কার করতেই শুরু করেছিল যখন রাস্তার ওপারের হইচই কানে এল। সামনে তিন-চার জন লোক দাঁড়িয়ে, পিছন থেকে শাহাবুদ্দিনের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। ঝাঁটা হাতেই রঘু এগিয়ে গেল। শাহাবুদ্দিন ছুটে এসে ওর হাতটা চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেল কমপ্লেক্সের পাঁচিলের কাছে।
‘তুই তো জানিস ভাই, এখানে, এখানেই বাঁধা থাকে আমার মেশিন…’
‘হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?’
‘এই ডালের সঙ্গে, এই শেকল দিয়ে…’
সক্কাল-সক্কাল নিজের দোকানের সামনে জঞ্জাল দেখে রঘুর মাথা এমনিতেই ঘোলাটে হয়ে ছিল। শাহাবুদ্দিনের কথা তাই কিছুই বুঝতে পাচ্ছিল না।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, থাকে। তো কি হয়েছে?’
‘মেশিনটা নেই ভাই…’ শাহাবুদ্দিন আর্তনাদ করে উঠল। ‘আমার মেশিনটা নেই ভাই…’
রঘুর মাথার ভেতরকার কুয়াশাটা কেটে গেল। শাহাবুদ্দিনকে ফুটপাতে ফেলে শিশুগাছের কাছে এগিয়ে গেল। ওর ডান হাতে এখনও ঝাঁটা ধরা। রঘু ডালটায় বাঁ হাতটা রাখল। শীতে মানুষের ত্বকের মতো গাছের বাকলও খরখরে হয়ে জায়গায়-জায়গায় ফেটে গেছে। ডাল থেকে ঝুলছে শাহাবুদ্দিনের শেকল। ভাঙা তালাটাও পড়ে আছে নীচে। উধাও শুধু পুরনো মেশিনটা।
একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড সেলাই মেশিন চুরি যাওয়ার প্রাথমিক উত্তেজনা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই থিতিয়ে এল। দুপুরের দিকে দেখা গেল শাহাবুদ্দিন তখনও বসে রয়েছে ফুটপাথে। পাশে নির্বিকার বসে আছে ওর ছেলেটা। নাদিমকে সকালে বাপের সঙ্গে দেখেছে কি না, রঘু মনে করতে পারল না।
না, আজ আর রঘু ডিম বেচেনি। তবে যে তিরিশটা সামোসা ভেজেছিল, তার দুটো বাদে বাকি সব উঠে গেছে। আরও কুড়িটা মতো ভাজার সবজি সঙ্গে আছে। তাড়াতাড়ি শেষ করে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।
লেচিগুলো বেলে সবজি পোরার সময়ে রঘু খেয়াল করল নাদিম ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কী ভেবে রঘু ওকে ইশারা করে ডাকল। একটু ইতস্তত করে ছেলেটা পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল।
‘শিখবি?’
ছেলেটার চোখেমুখে যেন হাজার-ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল।
‘এ পাশে আয়,’ রঘু ডাকল।
‘আসব?’
‘না এলে শিখবি কী করে?’
ছেলেটা চায়ের টেবিল পাশ কাটিয়ে উনুনের সামনে রঘুর পাশে এসে দাঁড়াল।
‘আগে হাত ভাল করে ধুয়ে নে,’ রঘু জলের জগটা দেখিয়ে দিল। ‘ভাল করে দ্যাখ, এই ভাবে সবজি পোরে। আর এই ভাবে কোনাগুলো চ্যাপ্টা করে টেনে-টেনে দিতে হয়, আর…’
নাদিমের চোখের সামনে এক অলৌকিক জগৎ খুলে যায়। চায়ের টেবিলের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর পেরিয়ে, রঘুচাচার ম্যাজিকের জগতে পা রাখার আনন্দে ওর তেরো বছরের মুখ থেকে মুছে যায় সকালের দুর্ঘটনার কালো ছায়া।
তা ছাড়া এই বয়সে এমনিতেই মনখারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র