ভূতেশ
এ বাড়িটায় বসবাস করা মানুষ বলতে এখন বিষাদকাতর বাবা–মা, তাঁদেরই বিধবা বড়মেয়ে, দুজনেরই একটি করে সন্তান নিয়ে বিধবা দুই বউ এবং বিয়ে হয়েও ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে যাওয়া ছোট মেয়ে আর একমাত্র জীবিত পুত্র-সন্তান ভূতেশ। সামর্থ্য অকুলান না হলেও আনন্দ প্রায় নেই বললেই চলে। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভূতেশের দুই দাদা মহেশ এবং দুর্গেশ দুজনেই অকালপ্রয়াত। এরাই ছিল রোজগেরে এবং সংসারী। কয়েক দিনের আগে-পরে জোয়ান দুই ছেলে মারা যাওয়ায় ভূতেশের মা বাক্যহারা; বুঝেশুনে অর্থব্যয় এবং ছোটখুকির ভবিষ্যৎ চিন্তায় বাবা কিছুটা উঠে বসলেও, তিনিও একরকম গা ছেড়েই দিয়েছেন বলা যায়; তবে শক্ত হাতে হাল ধরেছে বছর কুড়ির ওই নিঃসন্তান বিধবা মেয়ে বিরজাবালাই। ছোটখুকি অমৃতবালাবিয়ের পর সেই যে অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি এল আর গেল না। বছর ঘুরতে এখানেই ছেলে হল তার। সুপুরুষ জামাইটি মাঝে-মাঝে এসে তার হাতে খোরাকি বাবদ সামান্য কিছু টাকা ধরিয়ে, স্তোক দিয়ে বলে যায় যে কলকাতায় ঘর পেলেই তাকে নিয়ে সংসার পাতবে। ভয়ে ভয়ে থাকে অমৃতবালা, কারণ তার গায়ের রং বাপ-দাদাদের মতোই; যাকে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ না বলে কালোই বলা যায়। ভরসা একটাই যে ছেলে হয়েছে বাপের মতোই ফর্সা এবং সুন্দর; বিরজাবালা এবং ভূতেশ— এ দুজনেই মায়ের ওই উজ্জ্বল রংটা পেয়েছে; তবে দু-ভাইবোনের মধ্যে ভূতেশ সত্যিই এক হিরণ্ময় যুবা। চোখ, নাক, কপাল, মাথার চুল এবং দীর্ঘতা— সবই চেয়ে দেখবার মতো। সেই রকম তার মেধাও। খেলাধুলো এবং দাপাদাপির থেকে সে ভালবাসে লেখাপড়া করতে; দেশ-দুনিয়ার খবরাখবর সংগ্রহে তার বিশেষ আগ্রহ; আগ্রহ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এবং ঘড়ির কাঁটা মেনে সময়ের কাজ সময়ে করায়। নিয়মনিষ্ঠ এই ভূতেশের বন্ধু সংখ্যা তাই হাতে গোনা। তবে তার দীপ্র রূপ এবং মেধার কারণে এ-পাড়া এবং ও-পাড়া ছাড়াও স্বজন মহলেও সে বেশ ভালই পরিচিতি পেয়েছে। বন্ধুদের মধ্যে আবার দুজন-ভূতেশের তফাৎ করতে সকলে তাকে ডাকে ‘কটা-ভুতো’ বলে; অন্য ভূতেশের নাম ‘কালা-ভুতো’— কারণ তার গায়ের রং কালো। এ সবকিছু সম্পর্কে ভূতেশও বেশ অবহিত। তা ছাড়াও ভূতেশ জানে যে, বাবা-মা তো তারই দিকে তাকিয়ে আছেন, সংসারের হাল ধরার অপেক্ষায়।
বিঘে খানেক জমির ওপর, দুটো পুকুর এবং একখানা গোয়াল সমেত তাদের বাড়ি। খড়ের চালা দেওয়া খান-তিনেক মাটির ঘরের মধ্যে একটা বড় ঘরকে পাকা করে গেছেন বড়দা মহেশ। অসময়ে চলে যাওয়ায় বাকি ঘরগুলো আগের মতোই। ঘর লাগোয়া জমিতে বাবা যে সবজি বুনতেন সেও কোনও রকমে চলছে। পুকুর-সংস্কার, সে-ও তো সেই মেজদা দুর্গেশ যে টুকু যা করিয়ে গিয়েছে। অনটন এখনও দেখা না দিলেও, উদ্বেগ এবং বিষাদ গ্রাস করে চলেছে বাড়িটাকে। বড়খুকি বিরজাবালার নির্দেশেই সংসারের কাজকর্ম চলে; তার কথামতো হাত লাগায় দুই বউ আর ছোটখুকি। ভূতেশ সকলের বড়; তাই বাবা-মা জীবিত থাকতেও সকলের কাছে সে-ই এখন অলিখিত কর্তা। ভূতেশ বোঝে যে এই জন্যেই তার প্রতি যত্ন-আদর কিছু অধিকও। এ দিকে বিধবা বড়খুকির জন্য সংসারে যে সমীহ এবং সহানুভূতি, তা কিন্তু দুই বিধবা বউয়ের ক্ষেত্রে বর্তায় না। কোলে ছোট ছোট বাচ্চা নিয়েও হাড়ভাঙা খাটুনি চলে তাদের; তবে সব থেকে অনাদর পায় ছোটখুকি; সধবা বলে মায়ের সঙ্গে ভাতের পাতে এক টুকরো মাছ জোটে এই যা! স্বামী যার থেকেও নেই, তার কপালে তো গঞ্জনা জুটবেই; বাড়িতে সেই তো একমাত্র সধবা। এবং ঠাকুরজামাই এলেই, ও পাশের চালাঘরে আলাদা বিছানা পায়; বঞ্চনার হিংসেতে দিদি-বউদি সকলেরই বিষবাক্যে দুর্বিষহ তার জীবন। অমৃতবালা তাই এ সংসারে একটু গা ছেড়ে দিয়েই থাকে; তার স্বামী বিপিনও তাকে সেরকমই বুঝিয়ে দিয়েছে। বুঝিয়েছে এ কথাই ভাবতে যে, সে তার বাপের আমলে থাকে; আর সে যে স্বামীর গলগ্রহ এমনও নয়; এই তো ঘর তাদের বাঁধা হল বলে! সংসারে রোজকার কাজে হাত লাগালেও, বাকি সময়টা ছোটখুকি তার ছেলেকে নিয়েই মশগুল থাকে।
ভাই-বোনেদের মধ্যে বিভেদ না টেনে ভূতেশের মা-ই শিখিয়েছেন, বড় বউয়ের ছেলেকে বড়দা এবং ছোট খুকির ছেলেকে মেজদা বলে ডাকতে। মেজো বউয়ের মেয়ে, ওই দুই ভায়ের মাঝখানে হলেও তাকে তারা শুধুই দিদি বলে; কারণ আর কোনও বোন নেই বলে। বউরা যদিও খুবই অসন্তুষ্ট শাশুড়ি-মায়ের এই ‘ভাগ্নে-পোষা’ ব্যবস্থায়। দুই বউ বয়সে প্রায় সমবয়সি এবং শান্তিপুরের একই গ্রাম থেকে আসা হলেও, দুজনের মধ্যে তফাৎ বিস্তর। বড়বউ দারুণ সুন্দরী, ফর্সা এবং ছেলের মা; অন্যদিকে মেজোবউ সুশ্রী হলেও কালো এবং মেয়ের মা। অপমানের জ্বালায় মেজোবউ যখন লুকিয়ে কাঁদে, বড়বউ তখন ভাল করেই বুঝিয়ে দেয় যে, শাশুড়ি-মায়ের পর সে-ই কিন্তু আসল কর্ত্রী। ফলে নিজের দাপট বজায় রাখতে যথেষ্ট বুদ্ধি করেই চলতে হয় বিরজাবালাকে। এ কারণেই শখ-আহ্লাদ এবং উচ্ছ্বাস-আনন্দ, সব তাকে চাপা দিতে হয়েছে একটু একটু করে; তবু, সাদা থানের আড়ালে কতটুকুই বা ঢাকতে পেরেছে তার সুগঠিত দীর্ঘ অঙ্গ! টিপ-সিঁদুর ছাড়াও যে তার ফর্সা মুখখানি লাবণ্যমাখা! ক্বচিৎ কখনও ভূতেশও তো দেখেছে তার বড় বোনের সেই উন্মনা হয়ে বসে থাকা! দেখেছে, মায়ের কাঁধে মাথা রেখে তার সেই নীরব কান্নাও। এ-ও লক্ষ করেছে ভূতেশ যে, বড়খুকির বিবাহিত সই-রা বাপের বাড়ি এসে তাকে ডাকাডাকি করলে, সে আর সাড়া দেয় না। তাদের নিজেদের খোকা-খুকিকে ‘মাসি’ বলে বড়খুকির কোলে দিলেও, সে তেমন আমল দেয় না। নিজের ভাইপো-ভাইঝি এমনকী বোনপোটির ওপরও যেচে-সেধে টান দেখায় না তেমন; ভূতেশের অনুমান যে বাচ্চারা পর হয়ে যাবার ভয়ে দুই-বউ এবং বোনও এমন ভাবে আগলে রাখে, যাতে পিসি বা মাসির ন্যাওটা না হয়ে পড়ে তারা। মেজোবউদির মেয়েটা তবু পিসির পায়ে পায়ে ঘোরে; কাছে শুয়ে গল্প শোনার আবদার জানায় বা তার সঙ্গে পুতুল খেলতে বলে। নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে, সময় পেলেই বড় খুকি তাই সময় কাটায় হয় বই পড়ে, সেলাই করে আর না হয়তো চুপ করে বসে থাকে মায়ের খাটের একপাশে। তার মুখের দিকে তাকাতেও তো মায়ের বুক ভেঙে যায়।
২.
ভূতেশ জানে যে পাড়ার একজন বলিয়ে-কইয়ে বড়বাবুকে ধরে, বাবা তার জন্যে চাকরির উমেদারি করছেন; দুই দাদার অবর্তমানে কোনও একজনের জায়গাতেও ভূতেশকে যদি বলে- কয়ে কোনও রকমে একবার ঢুকিয়ে দেওয়া যায়! সুপারিশে ভূতেশেরও খুব যে আপত্তি আছে তা নয়। ইস্কুল পাঠ শেষ করে এখন সে আই এ পড়ছে। তবে তার আগেই চাকরি হয়ে গেলে ফাইনাল পরীক্ষাটা আর দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারেও খুব একটা ভাবিত নয় সে। ইদানীং তার ইচ্ছে হয়েছে বৈষ্ণব হয়ে যাবার। হিন্দু পরিবারে, বিশেষত বামুনদের এই এত রকম বিধান তার একেবারেই পছন্দ নয়; ব্রাহ্মদের কথা কানে এলেও সে রকম কাউকে কাছ থেকে সে দেখেনি; ধর্মত্যাগী হয়ে এ দেশে যারা খ্রিস্টান হয়েছে, তাদের দেখেও অনুপ্রাণিত হয়নি সে; কিন্তু এই পেনেটি, সুখচর, খড়দা— এ সব অঞ্চলে গৌরাঙ্গ-চর্চার প্রভাবে তার মনে সাড়া জেগেছে। আরও তিনজন যে বন্ধু পেয়েছে হরিনাম জপার জন্য, তারাও এ ব্যাপারে সহমত যে, এ পথে চললেই সমাজ একদিন সেই যথার্থ উদার মনোভাবের সন্ধান পাবে; এ হেন সময়ে বাদ সেধেছে ভূতেশের ওই দুই দাদার অকালমৃত্যু এবং তার চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে বাবার তদ্বির। ভূতেশ এটাই সার বুঝেছে— যে কোনও নিভৃত সাধনায় যা লাগে, তা হল অগাধ সময়; সে হরিনামই হোক বা স্বদেশিদের সঙ্গে জুটে বন্দুক চালানোই হোক। স্বদেশিদের ব্যাপারটাও ভূতেশ ঠিক ধরতে পারে না। খেয়াল করে সে দেখেওছে যে, সব কাজেই তো ইংরেজরা সেরা; ফলে প্রভু হতে তাদের আর বাধা কোথায়! আপাতত সে হরিনাম চর্চায় মেতে হরুদের পাড়ায় গঙ্গার পাড়ে জড়ো হয়ে, বিকেল কাটায়।
তবে যে দিন থেকে ভূতেশ শুনেছে যে, তাদের চাইতে বছর চারেকের বড় এই হরুরই এক মাসতুতো দাদা, পুলিশে চাকরি পেয়ে, ট্রেনিং শেষ করে বিহারে গেছেন, সে দিন থেকে তার মাথায় ঢুকেছে আরও কিছু। আজ সে হরুকেই সরাসরি বলল।
তরঙ্গনাথ (তনুদা) বা হরশঙ্কর (হরুর)— এদের পরিবারের মতো উকিল-ব্যারিস্টার, পুলিশ বা ডেপুটি ম্যজিস্ট্রেটদের এমন ছড়াছড়ি তো ভূতেশের পরিবারে নেই; তা ছাড়া তার ওই পাড়ার ইস্কুলের বাইরে আর কতটুকুই বা সে দেখেছে; ফলে বাবার উমেদারির ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করে না থেকে, তার হয়ে সুপারিশ করার মতো আরও দু-একজনকে ধরে রাখলে লাভ ছাড়া ক্ষতি তো নেই কোনও! তনুদার এই পুলিশে চাকরি পাওয়ার কথা হরুর কাছে শুনে এবং কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলে, ভূতেশের এই বিশ্বাস আরও স্থির হয়েছে যে, চাকরিই সে করবে এবং তা সরকারি। ইংরেজ বলে ছুঁতমার্গ দেখাবে না। মনে-মনে সে ভালই দেখতে পাচ্ছে যে, উন্নতির সিঁড়িগুলো ভাঙতে-ভাঙতে কত তাড়াতাড়ি, কত না উচ্চপদে কেমন সে উঠেও যাচ্ছে তরতর করে! তনুদার সঙ্গে কথা বলে এ-ও মনে হয়েছে যে, ইংরেজির সঙ্গে হিন্দিটাও ভাল করে শিখে নিতে হবে। রাজধানী দিল্লি বা বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম, এ সব জায়গাতেই চাকরির সুযোগ বেশি। ফলে শুধু ইংরেজিতে কাজ হবে না। কথা প্রসঙ্গে এও সে জেনেছে যে, সাহেবরা বড় ডিস্ট্রিক্টগুলোকে ছোট-ছোট করে ভাগ করতে তৎপর; তা না হলে সমস্ত অঞ্চলটা তাদের আয়ত্তাধীন থাকবে কী করে! ভূতেশ বুঝতে পারে যে, সাহেবদের নজরদারিতে প্রশাসনিক দিকে যে নানা রকম আইন তৈরি হচ্ছে এবং তার ফলে যে নানা পদ এবং মর্যাদার ফারাক— এ ব্যাপারটা ভূতেশের কাছে বেশ জলের মতোই স্বচ্ছ; তনুদা যে বদলটাকে ‘কায়েমিপনা’ ভাবছেন, ভূতেশের কাছে সেটাই চমকপ্রদভাবে সুশাসনের সমার্থক; এই ডিসিপ্লিন ব্যাপারটাকেই ভূতেশ মনে মনে স্বাগত জানিয়েছে।
এই মনোভাব আরও দানা বেঁধেছে তার বন্ধু হরুর সঙ্গে কথা বলে; হরু তো ক্রমশই ঝুঁকে পড়ছে স্বদেশিদের দিকে; সংসারের অভাব মেটাতে চাকরি নেবে এমন সিদ্ধান্তে এলেও, সে অবশ্য পণ করেছে যে, সাহেবদের অধীনে সরকারি চাকরি করবে না; স্বদেশিদের জন্য লুকিয়ে ইস্তাহারও লিখছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আঁচ পেয়ে তাতেই ডুবিয়ে দিচ্ছে নিজেকে। এই সব অবান্তর বিষয়ে ভূতেশের উৎসাহ না থাকলেও, সে বুঝে গেছে যে স্বদেশ চেতনায় হরুদের সংহতি যত দানা বাঁধবে, তনুদাদের মতো নেটিভ পুলিশদের প্রয়োজনও ততটাই বাড়বে; কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলবে সাহেবরাও; অথচ সর্বোচ্চপদে তাদের না বসিয়ে, সেখানেও রাশ টেনে রাখবে নিজেরাই; ফলে এ-দুয়ের মাঝখানে দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠা আর্দালি-পিওন সমেত বড়বাবু-মেজোবাবু-ছোটবাবুদের গায়ে তেমন আঁচ পড়বে না। তাই অতিরিক্ত আশা না করে, যে কোনও দপ্তরে একজন সাদামাটা কেরানি হলেই তার বেশ ভালই চলে যাবে। এমন একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরে খুব শান্তি পেল ভূতেশ। না তাকে আর নাড়া দেয় বৈষ্ণবদের হরিনাম, না সে ভোলে হরুর ওই ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে।
ভূতেশ এও ভাবে যে, ভাগ্যিস তার গান-বাজনা বা কোনও রকম সাহিত্যপ্রীতি নেই! তাই এই সমস্ত পিছুটান থেকে এক বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে!
———————————————————–
আমি ভূতেশ। ঠাকুমা কৃপাময়ীর প্রতিষ্ঠিত কৃপানাথের আশ্রয়ধন্য আমাদের এই পরিবার; এ জন্যই এই বংশের ছেলেদের নাম হয় দেবাদিদেব মহাদেবের নামে; যদিও ডাকনামগুলো পাওয়া বাবা-মায়ের আদরে— মহি, দুর্গা আর ভুতো। বোনেদের নামগুলো বাবার রাখা। কিন্তু দুই বউদির আসল নামগুলো ভুলেই গেছি; বিয়ের পর নাম বদলে, বড়খুকি ওই দুই বউদির নাম রাখে পদ্ম আর গোলাপ; সে নামেও কেউ আর তাদের ডাকে না। এ পাড়ারই আর এক কৃতি ছেলে জয়নারায়ণের সঙ্গে বড়খুকির যোগাযোগটা যে শুধু পত্রপত্রিকা আর বইপত্র চালাচালির নয়, সেটা আমিও বুঝি; আর সকলেও যে ভাল চোখে দেখে, তাও নয়। তবে তারা এমন কোনও বেচাল করে না যে, মুখের ওপর কিছু বলা যায়। অন্য দিকে বড়খুকি কড়া নজর রাখে আমাদের বড়বউদির ওপর; আর সে সন্দেহটা আমাকে নিয়েই; সুযোগ খুঁজে আমার ঘরে এসে বড়বউদির এটা-সেটা গুছিয়ে দেওয়া, কলেজ যাওয়ার সময় মনে করে এগিয়ে দেওয়া ডাবের জল, পাম্প-শু জোড়া আঁচল দিয়ে মুছে রাখা, সব-ই নজরে আসে বড়খুকি আর মেজোবউদির; আমার প্রতি তার ‘কুনজর’ আমিই বা এড়াই কী করে! তার উজ্জ্বল-রূপ এবং অল্পবয়সের কামনায় আমিও কি আকর্ষণ বোধ করি না! বড়বউ তো আমাকে সরাসরি জানায়; নিকট হতে চেয়ে কারোর তোয়াক্কাও সে করে না। আমি ভয় পেলেও, সে তো মরিয়া; এই আকর্ষণ বিনিময়ে আমার মধ্যে যে কোনও পাপ জাগছে এমনও নয়। এও মনে হতে শুরু করেছে যে, কাউকে প্রতারণার প্রশ্ন যখন নেই, তখন তো তা ব্যভিচারও নয়। আর ভালবাসার বন্ধন না থাকলে আকর্ষণকে এড়াবই বা কোন যুক্তিতে! নিন্দে যা হবে সে-ও তো আড়ালে! ভাবী রোজগেরে এই একমাত্র পুত্রসন্তানকে মুখের ওপর কিছু বলার ক্ষমতা মনে হয় বাবা-মায়েরও হবে না। অসম্মান এবং অবজ্ঞার ইট-পাটকেল যেটুকু যা লাগবে, তাতেও রক্তাক্ত হবে ওই বড়বউদি। সেখানে সম্মানের বঞ্চনা ছাপিয়ে, শরীর-সুখ তাকে যদি বেশি টানে তার দায়িত্ব কি আমার!
ফলে মনে-মনে সব ফয়সালা করে নিয়ে, সংসার ভার নিতে প্রস্তুত হলাম আমি। ‘হরিনাম’, ‘বন্দেমাতরম’ এবং উচ্চশিক্ষার ডিগ্রিকে সরিয়ে দিলাম অনায়াসে। সহজলভ্য নারীসঙ্গ পাওয়াকেও যৌবনের অমোঘ আকর্ষণ হিসেবেই ধরে নিয়ে, শুরু হল এক অন্য-যাপন। শেষ অবধি কর্তৃত্বপরায়ণতাই হয়ে উঠল আমার আসল চালিকাশক্তি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র