শুরুতেই ল্যাঠা চুকিয়ে দিলেই ভাল। যাদের আমরা দুর্গার ছেলেমেয়ে মনে করি, তাদের সংখ্যা চার। লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক। কার্তিককে নিয়ে ল্যাঠা বেশি। বাঙালির ঘরে-ঘরে দুর্গার এই পুত্রটি নিয়ে সবথেকে বড় বদনামটি হল, কার্তিক বড় হ্যাংলা, একবার আসে মায়ের সঙ্গে, একবার আসে একলা! বেশ বোঝা যাচ্ছে, কার্তিকের আসাটা বাঙালি তেমন ভাল চোখে দেখে না। কেন দেখে না? কারণ, কার্তিকের সঙ্গে বাঙালির তেমন কোনও স্বার্থের সম্পর্ক নেই। লক্ষ্মী একবার কেন, বারবার, প্রতি মুহূর্তে আসতে থাকুন বাঙালির সংসারে, এ তো সব বাঙালি চায়। সরস্বতী বাঙালির ঘরে ঘরে বিরাজ করুন, এমন চাহিদা বিশেষ করে পড়ুয়া বাঙালির বাপ-মায়ের মনে থাকেই থাকে। আর সাফল্যের দেবতা গণেশ তো গ্লোবাল ফিগার! যেখানে হিন্দু, সেখানেই গণেশ স্বমহিমায় বিরাজিত। কিন্তু কার্তিক বাঙালির কোনও কাজে লাগে না। সুতরাং মায়ের সঙ্গে একবার এসেছে, আসুক; দু’বার এলেই সে হয়ে গেল হ্যাংলা।
আসল ল্যাঠা কিন্তু কার্তিকের জন্মের গোলমেলে গল্প। বাঙালির শ্লীলতাবোধকে, যৌনতার ব্যাপারে বাঙালির আটপৌরে রক্ষণশীলতাকে ধাক্কা দেয় কার্তিকের জন্মের গল্প। যতদূর মনে পড়ছে ব্রহ্মবৈর্বতপুরাণে কার্তিকের জন্মের ব্যাপারটা আছে। বেশ বেয়াড়াভাবেই আছে। ভারতের প্রাচীন পুরাণে প্রেম বলে কোনও ‘আবেগ’ আছে বলে মনে হয় না। নারী-পুরুষ, কেউই প্রেমে পড়ে না। পড়ে কামে! মহাদেব আর পার্বতীর মধ্যে যে-ব্যাপারটা কার্তিকের জন্মের জন্য ঘনিয়ে এল, সেটি আদৌ প্রেম নয়, ভালবাসা নয়। সেটি হল নিখাদ, নিটোল কাম— যৌন তাড়না। এই কাম, তাড়না, শৃঙ্গারের বর্ণনা দিয়েছেন কালিদাস, তাঁর ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিছুটা অনুবাদ করেছেন বাংলায় এই আদিরসাত্মক কাব্যের। প্রশ্ন করেছিলাম, ‘শক্তিদা, কার্তিকের জন্মের আসল ব্যাপারটা অনুবাদ করলেন না কেন?’ ‘বড্ড অশ্লীল’— শক্তিদার সংক্ষিপ্ত উত্তর। কালিদাস কিন্তু পার্বতীর সঙ্গে মিলনে মহাদেবের উন্মত্ততাকে একেবারে জ্যান্ত করে তুলেছেন। কোনও ডি.এইচ.লরেন্স বা জেমস জয়েস-এর পক্ষেও এই যৌন-বিস্ফোরণের বর্ণনা সম্ভব হয়নি! ব্যাপারটা, আর বাড়াবাড়ি না করে, সংক্ষেপে, ড্রয়িংরুম-শ্লীলতা বজায় রেখে বলছি: মহাদেব আর নিজেকে সামলাতে পারছেন না। কিন্তু তিনি জানেন, তাঁর আগ্নেয় যৌনতাপ্রসূত বহ্নিমান বীর্য ধারণ করার ক্ষমতা পার্বতীর নেই। সুতরাং তিনি ‘ফেলবেন’ কোথায়? ফেললেন ‘পৃথিবী’-তে!
এবার পৃথিবীর অবস্থা ভেবে দেখুন। আগুনের মতো জ্বলতে-জ্বলতে মহাদেবের ‘তেজ’ নামছে। আর ভয়ে কাঁপছে পৃথিবী। পৃথিবী কোনও রকমে নিজেকে বীর্য-দহন থেকে বাঁচিয়ে সেই ‘তেজ’ ছুড়ে দিল স্বয়ং অগ্নিকে! আর অগ্নি লুফে নিয়েই ছুড়ে দিল কাছের কোনও শরবনে। জ্বলন্ত বীর্য সেখানে থিতু হল। এবং যুগ-যুগান্তর ধরে হয়তো শীতল হল শরবনের ছায়ায়। এবং সেই বীর্য থেকে সৃষ্ট হল কার্তিক। তাই কার্তিকের কোনও মা নেই। কোনও মাতৃগর্ভের প্রয়োজন হয়নি কার্তিকের জন্মের জন্য। তবে কৃত্তিকারা নামের এক নারী কার্তিককে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করল। তাই সেই ছেলের নাম কার্তিক। ভাল নাম, কার্তিকেয়। কার্তিক কিন্তু জন্মেছে যুদ্ধ করার জন্যই। অসুরের হাত থেকে দেবতাদের বাঁচাতে কার্তিকের জন্ম। তাহলে দুর্গা-মহিষাসুরের যুদ্ধে কার্তিক অমন হাত-পা গুটিয়ে, তির-ধনুক নিয়েও উদাসীন কেন? কারণ দুর্গা তো তাঁর কেউ নয়। লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশেরও তো কেউ নয় দুর্গা! দুর্গার তো বিয়েই হয়নি। শুধুমাত্র মহিষাসুরকে বধ করার জন্যই সমস্ত দেবতাদের সমবেত বীর্য থেকে দুর্গার জন্ম। এবং মহিষাসুর বধের পরেই দুর্গা ভ্যানিশ! আমরাই তাঁকে গুলিয়ে ফেলেছি কখনও পার্বতী, কখনও মেনকার সঙ্গে। কী কাণ্ড বলুন তো!
আর আমাদের এই গুলিয়ে ফেলার মাসুল গুনছে বেচারা কার্তিক। তাঁর জন্ম তো শুধুমাত্র খাঁটি বীর্য থেকে। কোনও নারী তাঁকে গর্ভেই ধারণ করেনি। সুতরাং কার্তিক বড় হ্যাংলা— একবার আসে মায়ের সঙ্গে, একবার আসে একলা— এই বেয়াদব বদনামের কোনও মানে হয়? কার্তিক তো দ্য আল্টিমেট মা-হীন যোদ্ধা। হ্যাংলা সে হতেই পারে; কিন্তু সে যতবার আসে, একলাই আসে!
ছবি এঁকেছেন দেবাশীষ দেব