ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক, ঠিক যেন বিজ্ঞাপনের পাতা থেকে তুলে আনা। ইঁটচাপা দূর্বা রঙের সালোয়ার, আভরণহীন নিটোল ফর্সা হাতের মণিবন্ধে একটা কালো ডায়ালের সোনালি ঘড়ি।
বুক সমান উঁচু কাচের দেয়ালের ওপাশে একটা হাতলছাড়া রিভলভিং চেয়ারে বসে দ্রুত হাতে কাস্টমার সামলাতে ব্যস্ত মেয়েটির দিকে চোখ পড়তে অনির্বাণের সব কিছু এমন তালগোল পাকিয়ে গেল যে, কাউন্টারের ছোট্ট ফোঁকর দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া চেকখানা হাতে নিয়ে চেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
সপ্তাহের প্রথম দিন, তার ওপর আবার মাস পয়লা। ফলে সব গ্রাহক যেন একসঙ্গে ব্যাঙ্কে এসে হাজির হয়েছে। কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইনটা সাপের লেজের মতো এঁকেবেঁকে অনেক দূর চলে গেছে। অনির্বাণকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পেছনের মানুষটি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী হল ভাই, অমন ভ্যবলার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? কলম আনেননি?’
‘ভ্যাবলার মতো’ কথাটা শুনে কাউন্টারের মেয়েটি মরাল গ্রীবা তুলে আড়চোখে একবার তাকাল।
অনির্বাণ লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি বুকপকেট থেকে কলম বের করে চেকের পেছনে সই করল। কাচের ভেতরে সেটা চালান করতে গিয়ে হাতটা যেন একটু কেঁপে গেল।
মেয়েটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেকটা ফেরৎ দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, ‘সরি, সই মিলছে না।’
অনির্বাণ ফেল করা ছাত্রের মতো মুখ করে বলল, ‘মিলছে না? কেন?’
মেয়েটা গম্ভীর মুখে বলল, ‘সেটা কি আমার জানার কথা?’
পেছনের লোকটা ফের তাড়া দিয়ে বলল, ‘লাইন ছেড়ে আপনি বরং নিজের সইটা মনে করার চেষ্টা করুন, আমার তাড়া আছে।’
অনির্বাণ ইচ্ছে করলে ঝগড়া করতে পারত, কিন্তু করল না। লাইন থেকে সরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার সময়কার সইটা মনে করার চেষ্টা করল। নিজের করা সইটাও কয়েকবার দেখল, কিন্তু গোলমালটা যে কোথায় ধরতে না পেরে হাল ছেড়ে দিল। শেষে একটু ইতস্তত করে লাইনের পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা, একটু যদি ক্লু দেন, মানে মিসম্যাচটা ঠিক কোথায় হয়েছে…?’
মেয়েটি অন্য কাস্টমার সামলাতে সামলাতে বলল, ‘যদিও আমাদের বলার নিয়ম নেই, তবু— আপনার নাম এবং পদবিতে স্মল লেটারে যে দুটো ‘আর’ লিখেছেন, গোলমালটা সেখানে। আপনি বরং মনে করে দেখুন, কোনটায় কীভাবে ‘আর’ লিখেছিলেন। নেক্সট—’
বাধ্য হয়ে সরে দাঁড়াতে হল। তবে চোখ রইল মেয়েটার দিকে।
মেয়েটি কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করল না। পেশাদারি ব্যস্ততায় পরের কাস্টমারের চেকের সই মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
নিজের প্রয়োজনটুকু বেশিরভাগ সময়ে এটিএমেই মিটে যায় বলে বহুদিন ব্যাঙ্কে আসেনি অনির্বাণ। ব্যবসার লেনদেনগুলো ম্যানেজারবাবুই সামলে দেন। আজ একসঙ্গে মোটা ক্যাশ দরকার। এটিএমে উইথড্রয়ালের লিমিটে কাজ মিটবে না বলে বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্কে আসতে হয়েছে।
অতঃপর ব্যাগ হাতড়ে এক টুকরো কাগজ বের করে বার কয়েক নিজের সই মকসো করল, কিন্তু ব্যাঙ্কের ডকুমেন্টে কোথায় কীভাবে ‘আর’ লিখেছিল, তা বুঝে উঠতে পারল না। কাউন্টারে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটা নির্বিকার মুখে একের পর এক কাস্টমার সামলে যাচ্ছে।
সেই সূঁচাল চিবুক, তীক্ষ্ণ নাক, ঠোঁটের নীচে ছোট্ট বাদামি তিল, গভীর কালো চোখ, দু’বছরে তেমন পরিবর্তন হয়নি। খালি ছিপছিপে থেকে চেহারাটা কিঞ্চিৎ ভারিক্কি হয়েছে। তাতে ওকে আরও সুন্দর লাগছে, ফর্সা রঙ যেন ফেটে পড়ছে। কপালের ওপর নেমে আসা একগোছা চুল ফ্যানের হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।
অনির্বাণ স্বপ্নেও ভাবেনি, এতদিন পরে ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। তখন অবশ্য ও চাকরি করত না, তবে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিচ্ছিল।
কী যেন নাম মেয়েটার? সুচরিতা? না, না, সুচিস্মিতা… অনির্বাণ অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না। আচ্ছা, মেয়েটা কি ওকে চিনতে পারেনি? নাকি চিনতে পেরেছে বলেই ইচ্ছে করে লেজে খেলাচ্ছে? সই না মেলাটা কি বাহানা?
অনেক ভেবেচিন্তে দ্বিতীয়বার সই করে চেকটা দিতে দিতে অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি, মানে আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
মেয়েটা একতাড়া নোট নিয়ে একমনে গুনছিল। মুখ না তুলে বলল, ‘কাউকে চেনা না চেনাতে কী যায় আসে? আমাদের দরকার শুধু সইটা চেনা। চেকটা দিন তো, দেখি এবার মেলে কি না।’
যন্ত্রের মতো আবেগহীন কন্ঠে উচ্চারিত কয়েকটা শব্দ, কর্কশও নয়, মধুরও নয়। অপমানে অনির্বাণের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। সে কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর দিনের মতো দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে রইল।
মেয়েটা চেকখানা নিয়ে আবার কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রাখল। পুরোদমে এসি চলছে, তবু অনির্বাণের কানমাথা যেন গরম হয়ে উঠল। সে দরদর করে ঘামতে লাগল।
মেয়েটা হতাশ মুখে চেকখানা পুনরায় ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘না! এবারেও মিলল না। যাক, আপনাকে আরেকটা ক্লু দিচ্ছি। পদবি এবং নামের বানানে ‘আর’-লেখার স্টাইলটা ইন্টারচেঞ্জ করলে হয়তো আর সমস্যা হবে না।’
অবশেষে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল অনির্বাণের। দ্রুত হাতে নোটের বান্ডিল গুণে দিয়ে মেয়েটা হাঁকল, ‘নেক্সট—’
অনির্বাণ ধন্দে পড়ে গেল। মেয়েটা কি সত্যিই চেনেনি তাকে? কিন্তু দ্বিতীয়বার সে কথা জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে নোটের বান্ডিলগুলো চেক করে নিতে নিতে আড়চোখে দেখল, মেয়েটি কম্পিউটার স্ক্রিনে পরের কাস্টমারের সই মেলাচ্ছে।
ঠিক সেই সময়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কোনও কারণে চেম্বারের বাইরে বেরিয়েছিলেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়েই অনির্বাণ চেঁচিয়ে বলল, ‘আরে, পালিত সাহেব যে! কেমন আছেন?’
প্রিমিয়ার কাস্টমারদের ব্যাঙ্কের কর্মীরা কিছুটা সমীহের চোখে দেখে। ভদ্রলোক সৌজন্যবশত বললেন, ‘ভাল আছি। আপনি ভাল তো? তা এখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন?’
অনির্বাণ গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আর বলবেন না! টাকা তুলতে এসেছি, কিন্তু সই মিলছিল না। আচ্ছা, আপনাদের রেকর্ডে তো আমার ছবিও আছে, তাই না?’
উনি হেসে বললেন, ‘তা আছে, কিন্তু ছবি মিলিয়ে পেমেন্টের নিয়ম নেই।’
‘তাহলে ছবি রেখে কী লাভ?’
‘লাভ লোকসানের বিষয় নয়। যাকে পেমেন্ট দেওয়া হচ্ছে, তিনি তো টাকা নিয়ে চলে যাবেন, ডকুমেন্টারি এভিডেন্স হিসেবে থাকবে শুধু সই করা উইথড্রয়াল স্লিপটা। বুঝতেই পারছেন, পরে যদি এটা নিয়ে কোনও সমস্যা হয়…’
অনির্বাণ দেখল, কাউন্টারের মেয়েটা আড়চোখে একবার ওকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিয়ে ফের টাকা গোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর মনে হল, মেয়েটির ঠোঁটের কোণে যেন হালকা তির্যক হাসি খেলে গেল।
ভদ্রলোকের হয়তো তাড়া ছিল। কথা না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায়, ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্যে অনির্বাণ তেমনিভাবে হেসে বলল, ‘আপনি খবর পেয়েছেন কি না জানি না, যশোর রোডে আমরা একটা নতুন আউটলেট খুলেছি। একদিন আসুন না।’
উনি যেতে যেতে বললেন, ‘আচ্ছা, যাব।’
অনির্বাণ একই রকম উঁচু গলায় বলল, ‘কফি খাওয়ার নেমতন্ন রইল কিন্তু। কোনও কিছু দরকার হলে বলবেন, আপনার জন্যে স্পেশাল ডিসকাউন্ট!’
ভদ্রলোক হেসে পাশ কাটানোর ভঙ্গিতে বললেন ‘থ্যাঙ্ক ইয়্যু।’
ব্যাঙ্ক থেকে বেরোবার আগে ফের কাউন্টারের দিকে চেয়ে অনির্বাণ দেখল, মেয়েটা ভাবলেশহীন পেশাদারি ব্যস্ততায় একের পর এক কাস্টমার ছেড়ে যাচ্ছে।
এভাবে উপেক্ষিত হওয়ার অভ্যেস নেই অনির্বাণের। সুন্দর চেহারা, তিন পুরুষের ধনী পরিবার, লেখাপড়ায়ও খুব একটা খারাপ ছিল না। চেষ্টা করলে হয়তো চাকরিবাকরি পেতে পারত। কিন্তু প্রয়োজন হয়নি। নিজেদের পারিবারিক ব্যবসায় বছরে কয়েক কোটি টাকা টার্নওভার। সে জয়েন করবার পর সাবেক ব্যবসা ছাড়াও দুটো ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রজেক্ট শুরু করেছে, পালিতের মতো যোগ্যতার অন্তত হাফডজন কর্মচারী ওই দুটো প্রজেক্টে কাজ করছে। ফলে রাগে, অপমানে অনির্বাণের সর্বশরীর যেন রি রি করে জ্বলতে লাগল।
প্রথমে ভাবল, এখানকার কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সহ অন্যান্য অ্যাকাউন্টগুলো ক্লোজ করে দিলে ব্যাটা পালিত এবং ঠ্যাঁটা মেয়েটা খুব জব্দ হবে। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলাল। পালিত ব্যস্ত মানুষ, তা ছাড়া সে কিছু অসম্মানও করেনি। কিন্তু মেয়েটা! ভেতরে ভেতরে অনির্বাণের ভয়ঙ্কর জেদ চেপে গেল, যে করেই হোক এর শোধ তুলতে হবে।
এরপর প্রায় নিয়ম করে সে ব্যাঙ্কে আসতে শুরু করল। ক্যাশ জমা দেওয়া, ফিক্সড ডিপোজিটগুলো রিনিউ করানো, কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স চেক করা, কেওয়াইসি আপডেট করানো— এককথায় এতদিন কর্মচারিদের দিয়ে যে কাজগুলো করানো হত, সবকিছুই ও নিজের হাতে নিয়ে নিল। অবশ্যই ফাইফরমাস খাটার পারিষদ-পরিবৃত হয়ে।
প্রতিদিনই সে এন্ট্রি-মেশিন থেকে পেপার টোকেন নিয়ে কাউন্টার অ্যালটমেন্টের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে মেয়েটাকে দেখে। কিন্তু মেয়েটা যেন ওকে দেখেও দেখে না। পাকা পেশাদারের মতো মুখ নিচু করে কাজ করে যায়। কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালে অপরিচিত কাস্টমারের মতো সই মেলায়, পেমেন্ট করে, কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না। তবে সবদিন অবশ্য অনির্বাণের টোকেন ওর কাউন্টারে অ্যালট হয় না। সেই দিনগুলোতে ওর মনে হয়, দিনটাই বুঝি মাটি হয়ে গেল।
অনির্বাণের অস্থিরতা ক্রমেই বাড়তে লাগল। কিছুদিন যাওয়ার পর ওর মনে হতে লাগল, শিকারি যেন নিজেই শিকার হয়ে বসে আছে। যাকে জব্দ করার জন্যে এই নিত্যি যাতায়াত, তাকে দেখতে না পেলে ক্রমে ক্রমে যেন সবকিছু কেমন পান্সে লাগতে শুরু করেছে। প্রতিদিন আসা যাওয়ার সুবাদে প্রায় সব কর্মীর সঙ্গেই সখ্য তৈরি হয়েছে, দেখা হলে সকলেই হেসে কথা বলে। এমনকী একটা মোটা অঙ্কের টাকা ফিক্সড করার পর স্বয়ং চিফ ম্যানেজার ডেকে কফি খাওয়ালেন। অথচ যার জন্যে এত কাঠখড় পোড়ানো, সে রোবটের মতো চরম নিস্পৃহতার সঙ্গে পেশাদারি দায়িত্বের বাইরে এক ঝলক তাকায় না পর্যন্ত।
মাঝেমাঝে বিরক্তিতে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে অনির্বাণের। খুব সহজেই যাকে পেতে পারত, সে যে এমন দুর্বোধ্য কবিতার মতো আকুলতার সৃষ্টি করবে, সে কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। এখন ওর অবস্থা অনেকটা গলায় বঁড়শিবেঁধা মাছের মতো!
বিয়েটা প্রায় পাকা হয়ে এসেছিল। কথাবার্তা ঠিক, দেনাপাওনা নিয়ে সামান্য দর কষাকষি চলছে, ঠিক এমন সময়ে একটা উড়ো খবরে সবকিছু থমকে গিয়েছিল। এতদিনে বুঝেছে, সুন্দরী মেয়ের নামে অমন দু’একটা কথা রটতেই পারে। সেটাকে অত বড় করে দেখাটা সেদিন ভুলই হয়েছিল। কিন্তু আজ, সে যখন প্রবলভাবে ওর কাছাকাছি আসতে চাইছে, ও কি পারে না, সেই ভুলটুকু শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিতে? কাউন্টারে চেকটা দিয়ে ওর শঙ্খের মতো ফর্সা হাতখানার দিকে তাকিয়ে সে কথাই ভাবছিল অনির্বাণ।
‘কী হল, আজও সই মেলাতে পারলেন না?’
কাচের ওপার থেকে বিরক্তিভরা মৃদু ধমকে চমকে উঠল অনির্বাণ। থতমত খেয়ে বলে, ‘মেলাতে তো চাই, কিন্তু বাবা—’
মেয়েটা রাগের গলায় বলল, ‘কী ব্যা ব্যা করছেন? আপনার কি মাথার গোলমাল হয়েছে? যান আবার করে নিয়ে আসুন।’
ধমক খেয়েও অসহায়ের মতো তাকাল অনির্বাণ। মেয়েটা পাত্তা না দিয়ে হাঁকল, ‘নেক্সট—’
তারপর অন্য দিনের মতো অন্য কাস্টমার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এভাবে মাস কয়েক চলার পর শেষমেশ একদিন অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নিল, যে করেই হোক, ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে হবে।
মেয়েটার সঙ্গে কী কী কথা বলা যেতে পারে, সারাদিন ধরে তার একটা রিহার্সাল করে, দামি গাড়িতে চড়ে বিকেলে ব্যাঙ্ক থেকে সামান্য দূরে মেয়েটার ফেরার রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগল।
ছুটির পর মেয়েটাকে আসতে দেখে অনির্বাণ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বেলাশেষের লালচে আলোয় মেয়েটাকে যেন স্বপ্নপরির মতো লাগছিল। অনির্বাণ মুগ্ধ চোখে ওর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘তোমার, মানে আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
মেয়েটা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ভুরু বাঁকিয়ে ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘আমার সঙ্গে? কী কথা?’
অনির্বাণ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল, সে যদি রুঢ় ব্যবহারও করে, তবু কথাটা আজ বলবেই। তাই শ্লেষটুকু গায়ে না মেখে মুখে চেষ্টাকৃত হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন, আমরা কি কোথাও বসে এক কাপ কফি খেতে পারি?’
মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এই কথাটা বলবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন?’
‘না, ঠিক এই কথাটা বলার জন্যে নয়, কথা বলার জন্যে তো একটু অবকাশ দরকার হয়, চলুন বরং কফি খেতে খেতে—’
‘আমি কফি খাই না।’
‘বেশ, কফি না খান, কোল্ড ড্রিঙ্ক কিংবা আইসক্রিম? আসলে কোথাও একটু নিরিবিলিতে বসে কথাটা বলতে চাইছি।’
‘সরি, প্রথমত আমার বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে; দ্বিতীয়ত, আইসক্রিম কিংবা কোল্ড ড্রিঙ্ক, কোনওটাই আমার চলে না। টনসিলের সমস্যা, ডাক্তারের বারণ আছে।’
অনির্বাণ মরিয়া হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, কোথাও যেতে হবে না। আপনি বরং গাড়িতে বসুন, কথাটা বলে আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দেব।’
মেয়েটা ফের ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর ঝাঁজালো গলায় বলল, ‘আচ্ছা, আপনার মতলবটা কী বলুন তো? আমি লক্ষ্য করেছি, কিছুদিন যাবৎ আপনি আমাকে ফলো করে যাচ্ছেন!’
অনির্বাণ অসহায়ের মতো বলল, ‘এসব কী বলছেন আপনি? আপনাকে কেন ফলো করতে যাব? আসলে রিসেন্টলি ব্যাঙ্কে আপনাকে দেখবার পর আমার মনে হয়েছে, এই কথাটা আপনাকে বলা দরকার। তাই…মানে বলতে পারেন, আমি নিজের ভুল শোধরাবার একটা সুযোগ পেতে চাইছি। কোনও খারাপ উদ্দেশ্য আমার আগেও ছিল না, এখনও নেই। আমাকে প্লিজ কথাটা বলতে দিন।’
মেয়েটা উদাসীন গলায় বলল, ‘বেশ বলুন।’
অনির্বাণ কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বলল, ‘মানে আমি বলছিলাম, আমাদের বিয়েটা তো প্রায় ঠিকই হয়ে গিয়েছিল, দিনক্ষণ পাকা, কার্ড পর্যন্ত ছাপানো হয়ে গিয়েছিল! মাঝখান থেকে একটা তুচ্ছ কারণে…’
‘আপনি জানতেন, কারণটা তুচ্ছ ছিল?’
অনির্বাণ সরাসরি কোনও উত্তর দিতে পারল না। আমতা আমতা করে করে বলল, ‘মানে এটা যেহেতু অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, আমার পরিবার থেকে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল।’
‘তার মানে এতে আপনার কোনও ভূমিকা ছিল না?’
‘না, মানে ঠিক তা নয়, বাবা হঠাৎ আপনার সম্পর্কে কোত্থেকে কী যেন শুনে—’
‘বিয়েটা ভেঙে দিলেন এবং আপনিও লক্ষ্মী ছেলের মতো সেটা মেনে নিলেন, এই তো? তা আজ কোন মন্ত্রবলে আপনার কাছে আপনার বাবা-মায়ের মতামতটা গুরুত্বহীন হয়ে গেল?’
অনির্বাণ ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করল। বলল, ‘আমার বিশ্বাস, বাবা-মাকে আমি বুঝিয়ে বললে তাঁরা রাজি হবেন।’
‘যদি না হন?’
‘সে তখন দেখা যাবে। দরকার হলে তাঁদের অমতেই…’
‘কিন্তু যে কারণে আপনার বাবা বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলেন সেটার কী হবে? ওটা তো রয়েই গেল!’
‘বাদ দিন ওসব পুরনো কথা! তা ছাড়া, পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম—’
‘খোঁজও নিয়েছিলেন তাহলে? ফ্যান্টাস্টিক! আপনাদের কি ধারণা, মেয়েরা দুধের মতো? একটু চোনা পড়েছে কী পড়েনি, অমনি নষ্ট হয়ে গেল, তাই তো?’
অনির্বাণ কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে রইল।
মেয়েটি বিদ্রুপের গলায় বলল, ‘অবশ্য আপনার বোধহয় একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
‘ধন্যবাদ?’
‘হ্যাঁ। একটা চরম অপছন্দ এবং ঘৃণার জীবন থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্যে আপনি এবং আপনার পিতৃদেব একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন! আশা করি, আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।’
মেয়েটা কোনও দিকে দৃক্পাত না করে হনহন করে হাঁটতে শুরু করল।
বজ্রাহতের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল অনির্বাণ।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র