শিবাজীর কতজন স্ত্রী ছিলেন? ইতিহাসের কোনও উৎসে সংখ্যাটা আট, কোথাও ছয়, আবার কোথাও চার। যদুনাথ সরকার তাঁর Shivaji and His Time গ্রন্থে এমন উৎসের প্রসঙ্গও এনেছেন যেখানে মরাঠাকুলতিলক শিবাজীর তিনজন কিংবা ছয়জন পত্নীর কথা তো আছেই সঙ্গে আবার দুজন উপপত্নীর কথাও রয়েছে। তবে কিনা, তখনকার হিসেবে এ আর এমন কী! শিবাজী যাঁকে বাঘনখের আঘাতে হত্যা করেছিলেন, বিজাপুর রাজ্যের ওমরাহ সেই আফজল খাঁরই ছিল খান-তেষট্টি বৌ! কথিত আছে এক জ্যোতিষীর মাধ্যমে শিবাজীর হাতে নিজের মৃত্যুর কথা আগে-ভাগে জানতে পেরে, আফজল খাঁ তাঁর ওই তেষট্টিজন পত্নীকেই হত্যা করেন আর তারপর কবর দিয়ে নির্বিঘ্নে তাঁদের পরলোকযাত্রার পরিপাটি ব্যবস্থা করে তবে যুদ্ধযাত্রায় নির্গত হন। পাছে তিনি মারা যাবার পর ওই তেষট্টিজন পত্নীর কোনও একজন-ও অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে পড়েন? কে বলতে পারে? সুতরাং এ বিষয়ে তুলনামূলক বিচারে শিবাজীর আটটা বা চারটে বিয়ে তো নেহাৎই নগণ্য একটা সংখ্যা!
বিয়ে তো রাজা-রাজড়াদের ‘নিত্যকর্ম’— অনেকক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক কর্তব্য মাত্র। বেশিরভাগ সময়েই বেচারা রাজপুত্রের বা রাজারও পছন্দ-অপছন্দ জানানোর বিশেষ সুযোগ থাকত না। তোমার মনোমতো নয় তো কী হয়েছে, রাজ্যের জনমত কী বলছে তা কি ভেবে দেখতে হবে না? কিন্তু তাই বলে রাজাকে কি প্রেমে পড়তে নেই আর সে প্রেমের গল্প থাকতে নেই? এমনই এক প্রেমের গল্পের নায়ক যদি হন শিবাজী আর তিনি প্রেমে পড়েন এ গল্পেরই ‘মোগাম্বো’— স্বয়ং ঔরঙ্গজেবের কন্যার সঙ্গে? শুনতে আজগুবি লাগছে ঠিকই এবং ইতিহাসের তথ্য-ঘরে খুঁজলে এরকম কোনও গল্পবীজের সন্ধান বহু-আয়াসেও পাওয়া যাবে না তাও ঠিক তবু এমন একখানা গল্প-ই উনিশ শতকে বাংলার মাটিতে অঙ্কুরিত হয়ে ডালপালা মেলে উপন্যাসে রূপান্তরিত হয়েছিল, সে উপন্যাসের ইংরেজি ও তেলুগু অনুবাদও হয়েছিল এবং বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত মূল গল্পটা তার অস্তিত্ত্ব টিঁকিয়েও রাখতে পেরেছিল— ইতিহাসের সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও এমন সাফল্য মুখের কথা নয়। রমেশচন্দ্র দত্তের ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’-ই (১৮৭৬) হোক বা গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘ছত্রপতি’ (১৯০৭) কিংবা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘গৈরিক পতাকা’ (১৯৩০)— বীর শিবাজী, হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন-দেখানো রাজা শিবাজীর ঐতিহাসিক জীবনকাহিনী অবলম্বনে বাংলায় বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা লেখা হয়েছে। যদিও রাজপুতানার ইতিহাসই উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে হয়ে উঠেছিল অধিক মাত্রায় আকর্ষণের বিষয় আর এ বিষয়ে টডের Annals and Antiquities of Rajasthan-এরও একটা সদর্থক ভূমিকা ছিল। সে তুলনায় মহারাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রতি বাঙালি যথেষ্ট বিমুখ। অষ্টাদশ শতাব্দীর বর্গি আক্রমণের যে স্মৃতি ছেলেভুলানো ছড়া-য়, অন্নদামঙ্গল কাব্যে আজও সজীব, জাতিগত সেই স্মৃতিই যে এই বিমুখতার একটা কারণ তা অস্বীকার করা চলে না। তবু শিবাজী আর তাঁর মহারাষ্ট্রকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও একটা শীর্ণ ধারা তৈরি হয়েছিল— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে কুশলী যোদ্ধা আর ভাল এক শাসকের ভূমিকাতেই শিবাজীকে দেখা যাবে। এরই মাঝে আরও শীর্ণতর একটা ধারায় আমরা পাই প্রেমিক শিবাজীকে যেখানে ঔরঙ্গজেব দুহিতা রোশিনারার প্রেমে পড়ে যান তিনি।
শিবাজী আর রোশিনারার এই প্রেমকাহিনী নিয়ে প্রথম গল্প ফাঁদলেন এক সাহেব। রেভারেণ্ড জন হবার্ট কন্টার। কন্টারের জন্ম ১৭৯৪ সালের ২১ জুলাই, ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারে। সম্ভবত সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ১৮০৯ সালের কাছাকাছি সময়ে তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন, যদিও দীর্ঘকাল থাকেননি এদেশে। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে ফিরে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মিনিস্ট্রি অফ চার্চ বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৮২৮ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৎকালীন B.D. ডিগ্রি (Bachelor of Divinity) লাভ করেন। এরপর বিভিন্ন ধর্মপ্রতিষ্ঠানে তিনি মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫১ সালে তাঁর মৃত্যু। কন্টারের সবথেকে বিখ্যাত গ্রন্থ The Romance of History: India, ১৮৩৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত মোট পনেরোটি গল্পের মধ্যে শেষ গল্প The Mahratta Chief-ই হল শিবাজী-রোশিনারার প্রণয়কাহিনী। এই গল্পটি অবলম্বন করেই, তার খোলনলচে বদলে দিয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায় লিখলেন ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’— ১৮৫৭ সালে ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় আখ্যান হিসেবে প্রকাশিত হল সে গল্প। ১৮৫৭-র পর ১৮৬৫। না, শিবাজী-রোশিনারার প্রণয়কাহিনী নয়; এ’বছর প্রকাশিত হল তিলোত্তমা-জগৎসিংহ-আয়েষা-র প্রণয়কাহিনী— ‘দুর্গেশনন্দিনী’। বঙ্কিমের এই উপন্যাসের প্রভাবেই তৎকালীন বাংলায় ‘প্রণয়ঘটিত’ আখ্যায়িকা লেখার হিড়িক পড়ে গেল। ১৮৬৯ সালে, ‘বঙ্কিম-অনুগতি’-র ফল হিসেবেই পুনশ্চ শিবাজী-রোশিনারার প্রেমের কিস্সা প্রকাশিত হল। তবে এইবার রীতিমতো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের বিষয় হয়ে উঠল তা। উপন্যাসের নাম নায়িকার নামে— ‘রশিনারা’। লেখক কালীকৃষ্ণ লাহিড়ী। কিন্তু কে এই কালীকৃষ্ণ লাহিড়ী? এতো খুব পরিচিত নাম নয়।
তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত কোড়কদী গ্রামে ১৮৪৭ সালে সুপ্রসিদ্ধ লাহিড়ী বংশে কালীকৃষ্ণ লাহিড়ীর জন্ম। যশোহর সরকারি ইংরেজি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বেশিদূর অগ্রসর না হলেও নিজের গ্রামে তিনি একটি সাধারণ পুস্তকালয় স্থাপন করেন, তাঁর প্রচেষ্টাতেই সে গ্রামে স্থাপিত হয় ডাকঘর। ১৮৬৯ সালে, তাঁর যখন বয়স ২২ বৎসর তখন তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘রশিনারা’ প্রকাশিত হয়। তবে এই প্রথম, আর এই শেষ। এর দু’বছর পর, মাত্র চব্বিশ বৎসর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। স্বল্পায়ু কালীকৃষ্ণের উপন্যাসটিকে Roshinara: A Historical Romance নামে (প্রথম প্রকাশ: ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) অনুবাদ করেন নব চন্দ্র সেন। ১৯১২ সালে অনুবাদটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। ১৯১৭ সালে মাদ্রাজের V. Ramaswamy Sastrulu & Sons নামক প্রকাশন সংস্থা ‘রশিনারা’-র একটি তেলুগু অনুবাদ প্রকাশ করেন। মূল বাংলা উপন্যাসটিও আর একবার ছাপা হয়েছিল ১৮৮৭ সালে— কালীকৃষ্ণ লাহিড়ীর জামাতা শ্রী কৃষ্ণবন্ধু সান্ন্যাল-এর প্রচেষ্টায়। আরও পরে, ১৯০১ সালে নাট্যকার মনমোহন গোস্বামী লিখলেন ‘সাজাদী রোশিনারা’ নামে একটি নাটক; যদিও শুধু শিবাজীর প্রণয়কাহিনী পরিবেশন করা নয় বরং ‘ন্যায়পরায়ণ সর্ব্বধর্ম্মপ্রতিপালক সুসভ্য ইংরাজ রাজত্বে যাঁহারা পুত্রকলত্রবেষ্টিত হইয়া পরমানন্দে শান্তিসুখ অনুভব করিতেছেন, তাঁহাদের সম্মুখে মুসলমান অত্যাচারের চিত্রস্থাপন করাও’ তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু রশিনারা বা রোশিনারা— এই নাম বা এ নামের কাছাকাছি উচ্চারণের কোনও নামেও কি ঔরঙ্গজেবের কোনও কন্যার পরিচয় পাওয়া যায় ইতিহাসে? জেব-উন্-নিসা, জিনাত- উন্-নিসা, জুবদত-উন্-নিসা, বদর-উন্-নিসা ও মেহের-উন্-নিসা— এই হল যথাক্রমে ঔরঙ্গজেবের পাঁচ কন্যার নাম। তাহলে? ইতিহাস বলে, ঔরঙ্গজেবের কন্যা না হলেও মুঘল রাজপরিবারে রোশিনারা বা রোশেনারা নামে এক সম্রাটদুহিতা ছিলেন। তিনি ঔরঙ্গজেবের ভগিনী; সম্রাট শাহজাহানের কন্যা।
সুতরাং ঔরঙ্গজেব-দুহিতা রোশিনারার সঙ্গে শিবাজীর যে প্রণয় তার ঐতিহাসিক কোনও ভিত্তিই নেই। কিন্তু এমন একটা গল্পই বা এল কোত্থেকে? সেইটা একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। এ কথা ঠিক যে আর যা-ই হোক, গল্প অনুসারে শিবাজী যাঁর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি আর যেই হোন, রোশিনারা হতে পারেন না। কেননা কন্টার বা ভূদেবের গল্প শুরুই হচ্ছে রোশিনারার অপহরণ দিয়ে। পশ্চিমঘাট পর্বতের পথে পিতা ঔরঙ্গজেবের কাছে মাদুরাই যাবার সময় রোশিনারা শিবাজীর অনুচরদের দ্বারা অপহৃত হন। ঠিক কোন সময় এই অপহরণ হওয়া সম্ভব? ১৬৫২ থেকে ১৬৫৮ সালের মধ্যবর্তী যে কোনও সময়ে, যেহেতু এই সময়ই ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের শাসক ছিলেন। সুতরাং ১৬২৭ সালে জন্মানো শিবাজীর বয়স অপহরণকালে কমপক্ষে পঁচিশ আর ১৬১৭ সালে জন্মানো রোশিনারার বয়স কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ। কিন্তু কন্টার আর ভূদেব দুজনেরই গল্পে দেখি অপহরণের সময় রোশিনারা সতেরো বছরের যুবতী। তাহলে? বয়সেও মিলছে না, সম্পর্কেও! অবশ্য এ দুই-ই মিলে যেতে পারে যদি নামটাকে গুরুত্ব না দিই। রোশিনারা নয়, শিবাজী যার প্রেমে-পড়লেও-পড়ে-থাকতে-পারেন তিনি ঔরঙ্গজেব-দুহিতা জেব-উন্-নিসা। ১৬৫২ সালে যাঁর বয়স চৌদ্দ, ১৬৫৫ সালে সতেরো। ইতিহাস মানুক আর নাই মানুক, ঔরঙ্গজেবের কোনও-এক-কন্যার সঙ্গে শিবাজীর প্রণয় সংক্রান্ত একটা রটনা যে ছিলই তার একটা অব্যর্থ প্রমাণ মেলে Jessie Duncan Westbrook এবং Magan Lal-এর সম্পাদনায় ১৯১৩ সালে প্রকাশিত The Diwan of Zeb-Un-Nissa নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থে জেব-উন্-নিসার লেখা ৫০টি কবিতা আছে, যেগুলি নাকি তিনি ‘মকফি’ ছদ্মনামে রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থের ভূমিকায় অন্যতম গ্রন্থসম্পাদক, জেব-উন্-নিসা ও আকিল খানের প্রণয়কাহিনী বিষয়ক কিংবদন্তী এবং তার ফলস্বরূপ জেব-উন্-নিসার পরিণতি প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘After this she was imprisoned in the fortress of Salimgarh, some say because her father distrusted her on account of her friendship with her brother, Prince Akbar, who had revolted against him; others say because of her sympathy with the Mahratta chieftain Sivaji. There she spent long years, and there she wrote much bitter poetry.’ যদিও এ-কবিতাগুলিকে জেব-উন্-নিসার লেখা বলে স্বীকার করেননি যদুনাথ সরকার, আর শিবাজীর প্রতি জেব-উন্-নিসার হৃদয়-দুর্বলতার তথ্য ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বহীন গালগল্প হলেও কিন্তু গল্পের গরু কীভাবে গাছে উঠল তার একটা ইতিবৃ্ত্ত এ থেকে অনুমান করা যাচ্ছে বই কী।
সুতরাং এবার ওই গল্পটার দিকেই তাকানো যাক। কন্টারের গল্পে দেখছি— রোশিনারাকে বিবাহ করে মোগল সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার উদ্দেশ্যে শিবাজী পশ্চিমঘাটের পার্বত্যপথে মাদুরাই যাবার সময় রোশিনারাকে অপহরণ করেন। একজন সাধারণ পার্বত্য দস্যুকে বিয়ে করবেন এমনটা রোশিনারার কল্পনারও অগোচর। যাই হোক, শিবাজীর একটি দুর্গে রোশিনারাকে নিয়ে আসা হয়। শিবাজী প্রতিদিন রোশিনারার সঙ্গে দেখা করতে যান আর এইভাবেই যুবতী রোশিনারা ও সুদর্শন শিবাজী পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন। এদিকে শিবাজীর অনুপস্থিতির সুযোগে শিবাজীর অধীনস্থ এক সৈনিক রোশিনারার রূপে মুগ্ধ হয় এবং রোশিনারার প্রতি অশিষ্ট আচরণ করে বসে। রোশিনারা তাকে তিরস্কার করেন। এ কথা জানতে পেরে শিবাজী সৈনিকটিকে আহ্বান করলেন দ্বৈরথযুদ্ধে। যুদ্ধে সৈনিকটি পরাজিত ও আহত হলে তাকে দুর্গপ্রাকারের বাইরে নিক্ষেপ করা হল। তখন ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ-আহত সেই মরাঠি সৈনিক প্রতিশোধকামনায় উন্মত্ত হয়ে মোগল সেনাপতির কাছে গেল এবং শিবাজীর সন্ধান বলে দিতে প্রতিশ্রুত হল। ষড়যন্ত্র অনুসারে শিবাজীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে সে পুনরায় যোগ দিল মরাঠা সৈন্যদলে আর তারপর বিশ্বাসঘাতকতা করে দুর্গে মোগল সৈন্যদের প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিল। অতঃপর শিবাজী সৈনিকটিকে হত্যা করলেন ঠিকই কিন্তু নিজে অন্যপথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। যেহেতু মোগলদের দ্বারা রোশিনারার ক্ষতির কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই তাঁকে দুর্গেই রেখে গেলেন। মোগল সৈন্যরা দুর্গ জয় করে রোশিনারাকে পাঠিয়ে দিল ঔরঙ্গজেবের কাছে। কিছুদিন পর মোগল হারেমে রোশিনারার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেল। ক্রোধান্ধ ঔরঙ্গজেব নিজের কন্যার মুখদর্শন পর্যন্ত করলেন না এবং যথাসময়ে রোশিনারার পুত্র জন্মালে তাকে অজ্ঞাতস্থানে সরিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন।
এদিকে শিবাজী আবার শক্তিসঞ্চয় করে মোগল অধিকৃত দুর্গগুলি একের পর এক জয় করতে লাগলেন, বাড়াতে লাগলেন তাঁর রাজ্যসীমা। এরপর শিবাজীকে শায়েস্তা করতে শায়েস্তা খাঁ-র আগমন ও শিবাজীর কৌশলে পর্যুদস্ত হয়ে প্রত্যাগমন; রাজপুত রাজা জয়সিংহের আগমন ও শিবাজীর নিরূপায় আত্মসমর্পণ, মোগল-মরাঠা সন্ধি; এই সন্ধি অনুসারে শিবাজীর ঔরঙ্গজেবের সভায় গমন, অপমানিত হয়ে গৃহবন্দি হওয়া আর শেষ পর্যন্ত কৌশলে পলায়ন— ইত্যাদি মোটামুটিভাবে ইতিহাস অনুসারী। তবে কন্টারের গল্পে সবার-চোখে-ধুলো-দিয়ে শিবাজীর এই পালানোর পরিকল্পনায় রোশিনারার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই যে শুধু আছে তাই নয়, রোশিনারাও সেখানে শিবাজীর সঙ্গে পালিয়ে এসেছেন মহারাষ্ট্রে। তারপর কেটে গেছে পনেরো-ষোল বছর। ততদিনে দাক্ষিণাত্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন শিবাজী। একদিন ঔরঙ্গজেবের সভায় উপস্থিত হল ষোড়শোত্তীর্ণ এক সৌম্যদর্শন তরুণ। যুদ্ধবিদ্যা, রাজনীতি ও কূটনীতিতে পারদর্শী এই তরুণই ক্রমে হয়ে উঠল ঔরঙ্গজেবের ভরসার পাত্র। এই তরুণেরই নেতৃত্বে শিবাজীর বিরুদ্ধে এক বিরাট সৈন্যদল পাঠালেন ঔরঙ্গজেব। যুদ্ধ হল। যুদ্ধে আহত ওই তরুণটিকে নিজের শিবিরে নিয়ে এলেন শিবাজী। বুকের ডানদিকে জন্মচিহ্ন দেখে রোশিনারা নিজের পুত্রকে চিনতে পারলেন। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর পিতা-মাতার সঙ্গে মিলিত হলেন শম্ভাজী, ভবিষ্যতে যিনি হবেন মরাঠা সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট।
কন্টারের এই গল্পটিই ছিল ভূদেবের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’-এর মুখ্য অবলম্বন। কিন্তু কন্টার যে গোলমাল করেছেন, ইতিহাস সচেতন ভূদেব তা করেননি। ছোটখাটো নানা সংযোজন, পরিবর্তন, হিন্দু-স্বাদেশিকতাবাদী ঝোঁকের কথা শুধু নয়; কন্টারের মিলনান্তক প্রেমের গল্প ভূদেবের হাতে বিষাদান্তক হয়েছে। ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’-এর শুরুতেই শিবাজী-রোশিনারার বিয়ে হয় না এবং তাদের কোনও সন্তানও হয় না। ‘গল্প’ আর ‘ইতিহাস’ কোনওটাকেই বাদ না দিয়ে একূল-ওকূল দু’কূলই রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন বলেই কন্টারের ‘দ্য মারহাট্টা চিফ’-এ যা হয়েছে, ভূদেবের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’-এ তা হয়নি— অনৈতিহাসিকতার অনৌচিত্যদোষ এত বড় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বিয়ে না হলেও শিবাজী আর রোশিনারার প্রেমে কোনও খাদ নেই। নজরবন্দি শিবাজী যখন চোখে ধুলো দিয়ে পালাবার পরিকল্পনা করছেন তার ঠিক আগে এক বারবণিতাকে একটি অঙ্গুরীয় ও উষ্ণীষ দিয়ে তিনি পাঠালেন রোশিনারার কাছে। উদ্দেশ্য একত্রে পলায়ন। কিন্তু পাছে শিবাজী-রোশিনারার বিবাহে সম্রাট অসন্তুষ্ট হন বা শিবাজীর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে মরাঠারা, তাই শিবাজীর মঙ্গলচিন্তাতেই রোশিনারা এ-প্রস্তাব অস্বীকার করে চিরকুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য চিরকুমারী বলাটা ঠিক হল না। কেননা, গল্পের শেষে দেখি শিবাজীর অঙ্গুরীয়টি নিজের কাছে রেখে দেন রোশিনারা এবং নিজের অঙ্গুরীয় ও একটি চিঠি দূতীকে দিয়ে শিবাজীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সে চিঠিতে তিনি লেখেন— ‘আমি আর অধিক কী বলিব—তুমিই আমার স্বামী, তাহার চিহ্নস্বরূপ আমার হস্তাঙ্গুরীয় তোমার অঙ্গুরীয়ের সহিত বিনিময় করিলাম—অতএব অদ্যাবধি আমাদিগের বিবাহ সম্পন্ন হইল।’
শিবাজী-রোশিনারার প্রেমকাহিনীর এই যে দুটি রূপ, তার মধ্যে কালীকৃষ্ণ ভূদেবের গল্পটিকেই অনুসরণ করেছেন— কন্টারের গল্পকে নয়। কিন্তু তফাৎ আছে। কন্টারের গল্পে শিবাজী রোশিনারার প্রেম-বিবাহ-সন্তান সবই হয়েছে; ভূদেবের গল্পে সরাসরি না হলেও, পরস্পরের অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মাধ্যমে একটা প্রতীকী বিবাহ হয়েছে। কালীকৃষ্ণের উপন্যাসে তাও হয়নি। শিবাজীকে ভালবেসে নিজের চিরকৌমার্যকেই ব্রত করেছেন রোশিনারা।
এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় সেই সাহসী, দৃঢ়চিত্ত, অনন্য নারীটির কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের আয়েষা। জগৎসিংহকে ভালবেসেছিলেন তিনি। কিন্তু জগৎসিংহ তো তিলোত্তমার প্রেমে একনিষ্ঠ। ফলত উপন্যাসের শেষে তাঁদের বিবাহ হয়। বিবাহসভায় নিজ রত্নাভরণে নবপরিণীতা তিলোত্তমাকে সাজিয়ে ভগ্নহৃদয়ে আয়েষা ফিরে এলেন তাঁর বাসগৃহে। হাতের গরলাধার আংটিটি খুললেন। ভাবলেন পান করবেন সঞ্চিত বিষ। তারপর সে বাসনা দমন করলেন। আবার তা আঙুলে পরলেন। শেষে ভাবলেন এ প্রলোভন দমন করা রমণীর অসাধ্য তাই দুর্গপরিখার জলে নিক্ষেপ করলেন সে আংটি। জগৎসিংহের প্রতি তাঁর ঐকান্তিক প্রেমবাসনাকে আত্মহননের কলঙ্কে অবনমিত করতে চাননি আয়েষা। নিষ্কলুষ হৃদয়ের প্রেমবৈভবেই আয়েষা ঐশ্বর্যময়ী। ভূদেবের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ আর কালীকৃষ্ণের ‘রশিনারা’-র মাঝে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছিল বলেই না দাম্পত্যসম্ভাবনাহীন প্রতীকী বিবাহের দ্বারা কালীকৃষ্ণের রোশিনারা-র প্রেমের গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়নি। সামাজিক প্রথা নয়, জিতে গেছে ব্যক্তির হৃদয়। বিয়ে নয়, শেষ পর্যন্ত জিতে গেছে প্রেম।
টিপ্পনী:
(১) এই লেখায় গ্রন্থনাম ছাড়া সর্বত্র ‘শিবাজী’, ‘রোশিনারা’ এবং ‘ঔরঙ্গজেব’ এই তিনটি বানান ব্যবহার করেছি। কন্টার লিখেছেন— ‘Sevajee’, ‘Rochinara’, ‘Aurungzebe’; ভূদেব লিখেছেন— ‘শিবজী’, ‘রোসিনারা’, ‘আরাঞ্জেব’ আর কালীকৃষ্ণ লিখেছেন— ‘শিবজী’, ‘রশিনারা’, ‘আরাঞ্জেব’।
(২) ‘প্রণয়ঘটিত’, ‘বঙ্কিম-অনুগতি’—এই শব্দগুলি সুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ (তৃতীয় খণ্ড) গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে।
(৩) কন্টারের ‘দ্য মারহাট্টা চিফ’-এর গল্পটিকে অবলম্বন করে সূর্যনারায়ণ সিং লিখেছিলেন হিন্দী উপন্যাস— ‘মারহাট্টা সর্দার ঔর রোসনারা: ঔরঙ্গজেব কি পুত্রী কা প্রেম’ (প্রকাশ: ১৮৯৮)। মারাঠি ভাষায় লেখা হয়েছিল—‘শুভ কল্যাণ’, ‘শিবাজী কা আত্মদান ব রোশনারা’ নামে যার হিন্দী অনুবাদ করেন কাশীনাথ শর্মা (প্রকাশ: ১৯১৩)। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তেলুগু নাটকে শিবাজী-রোশিনারার প্রেমোপাখ্যান একটি জনপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছিল।
ছবি সৌজন্যে :লেখক