১৩৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ মাঘ মাসে একটি গান লেখেন। চৈত্রমাসে একটি কবিতা। রাগ ইমনকল্যাণ। গানটির। ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাটি লেখা মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দে। দুটিরই ভাবমূল বা থিম এক। কবিতাটির নাম ‘প্রবাসী’। গানের পঙ্ক্তি এরকম— ‘মন যে দিল না সাড়া,/ তাই তুমি গৃহছাড়া/ নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’। কবিতায় একই কথা। তবে, সামান্য আলাদা। ‘মন যে দিল না সাড়া/ তাই তুমি গৃহছাড়া,/ পরবাসী বাহিরে অন্তরে।’ এসব প্রসঙ্গ মনে এল পুষ্কর দাশগুপ্তের মৃত্যুসংবাদে। সুদূর গ্রিস থেকে আমরা প্রয়াণ সংবাদ পেলাম অগাস্টের ৩১ তারিখ। জানি না, তিনি নিজেকে ‘নির্বাসিত’ মনে করতেন, না কি ‘পরবাসী’! একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে দুয়ের মধ্যে। একজন স্বেচ্ছায় ‘পরবাসী’ হয়, আর, অন্য কারো হুকুমে ‘নির্বাসিত’। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কলকাতায় আসি শুধু শহরটাকে দেখতে— যত দেখি রাগ হয়, বলতে পারো রাগ করার জন্য কলকাতায় আসি।’
জন্ম ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ। চট্টগ্রামের ছনহরা গ্রামে। বাল্য-কৈশোর-যৌবন কলকাতায়। প্রথম স্ত্রী শুভা চক্রবর্তী। পুত্র সায়মিন্দু। বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যালিওপি। গ্রিককন্যা। দীপক মজুমদার সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘গ্রিসে স্বেচ্ছানির্বাসিত’। জানি না, পুষ্কর দাশগুপ্ত নিজে কী ভাবতেন, নিজের সম্পর্কে। চট্টগ্রাম-কলকাতা-ফ্রান্স-গ্রিস। রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা বটে! আমি, ব্যক্তিগতভাবে কোনোদিন তাঁকে চোখে দেখিনি। দৈবাৎ, ছাত্রবয়সে দু-একটি ‘শ্রুতি’ পত্রিকা হাতে আসায়, তাঁর কবিতা পড়ি। পরে বেশ কিছু লেখাপত্র এবং দু-একটি বই জোগাড় করি। পাঠক হিসেবে আমি তাঁর বেশ গভীর ভক্ত। মতে অনেকবারই মেলেনি। বরং ক্ষুব্ধ হয়েছি। কিন্তু তাঁর নিজস্বতাকে সম্ভ্রম করেছি। শেষবার পুষ্করের লেখা পড়েছি ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার ‘কবিতা যেমন দেখায়’ (২০১৬) এবং ‘কবিতার বিপণন’ (২০১৮) সংখ্যায়। সম্পাদক সুস্নাত চৌধুরী কোন জাদুতে তাঁকে রাজি করিয়েছিল, সে অবশ্য আমার কাছে রহস্য!
২.
লেখাটা অন্যভাবে শুরু করা যেত। পুষ্কর দাশগুপ্তের কবিতা দিয়ে। ‘শ্বেত ময়ূরের দল উড়ে গেল উত্তরের দিকে/ শ্বেত ময়ূরের দল উড়ে গেল দক্ষিণের দিকে/ নীলিমায় উড়ে যায় শ্বেত ময়ূরেরা…’ (‘শ্বেত ময়ূরেরা’)। লক্ষ করুন, এক আশ্চর্য দলবদ্ধ উড়ানের চিত্রকল্পে ঢুকে পড়ে পরাবাস্তবতা। ‘শ্বেত ময়ূর’ এবং ‘নীলিমা’ মিলেমিশে একদিকে বিস্তারকে ছুঁতে চায় উত্তরে-দক্ষিণে, আর একই সঙ্গে শব্দবন্ধের পুনরাবর্তনে সৃষ্টি করে গীতিময়তা।
‘শ্রুতি’ পত্রিকাকে কেন্দ্রে রেখে এমনই এক কাব্য-আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন পুষ্কর দাশগুপ্তেরা। ১৯৬৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭১ সালের অগাস্ট পর্যন্ত মোট চোদ্দটি সংখ্যা। যৌথ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মুখ্যত পাঁচজন কবি। পুষ্কর দাশগুপ্ত, মৃণাল বসুচৌধুরী, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশ মণ্ডল, অনন্ত দাশ। এছাড়া বেশ খানিকটা শরিক ছিলেন অশোক চট্টোপাধ্যায়। বহির্বৃত্তে রত্নেশ্বর হাজরা। এঁদের সবার কবিতার মূল সত্তা শব্দ। কখনও দৃশ্যরূপ, কখনও শ্রুতিরূপ, কখনও বিমূর্ত অনুভবের গতিষ্মানতা— শব্দ থেকে শব্দে সংগীততুল্য তরঙ্গে তাঁরা বাংলা কবিতার ধারাকে ব্যতিক্রমী পথে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। ‘শ্রুতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত ইস্তেহারগুলিতে নবায়নের সন্ধান স্পষ্ট। দৃশ্য-শ্রব্য-বর্ণময় জগৎ থেকে অনুভব আর দুর্জ্ঞেয় জীবনরহস্যকে তাঁরা কবিতায় নিষ্কাশন করে চাইলেন। পুষ্কর সেই কবি। ‘শ্রুতি’-র প্রথম সংকলনে পুষ্কর লিখেছিলেন, ‘কাব্যচিন্তায় কোনো কবিই আজ দেশকালে আবদ্ধ নয়। ফলত পৃথিবীর সমস্ত কাব্যান্দোলনের উদ্ভাবনা, সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ভাঙাগড়ার ইতিহাস আধুনিক কবির অধিকারে। এই দায়ভাগেই তার শিক্ষা এবং এই অধিকারের সঞ্চিত সম্পদকে প্রয়োজনানুসারে ব্যবহার করতে সে পরাঙ্মুখ নয়।’ এই কাব্যনীলিমায় অফুরান উড়ানের আগ্রহেই তাঁর অনুবাদের প্রকল্প নির্মাণ। প্রকল্প সন্ধান। সেসব কথায় পরে আসব। বাংলা কবিতায় তিনি সংযোজন করতে চাইছিলেন এক সচেতন আত্মমগ্নতার। মনে পড়ে গেল, পল ভালেরি বলেছিলেন, কবির সন্ধান সেই স্বপ্নময় ভাষার যা জাগ্রতের। ফরাসি কবিতার সঙ্গে পুষ্করের সখ্য যেন সেই অনিঃশেষ সন্ধানের সূত্রেই গ্রথিত। লৌকিকে আঁকড়ে থেকে অলৌকিক উদ্ভাস খোঁজা। নিরন্তর। পুষ্করের অনেক কবিতা আবার রূপদর্শী। দেহটিও সযত্নে খোদাই করা। একটির দিকে তাকাই। নমুনা কণিকামাত্র।
অসুখ
~
আকাশে বড় অসুখ ছিল তাই
রক্তময় তীব্র কোলাহল
ছড়িয়ে গেল বেগুনি সন্ধ্যায়
অসুখ ছিল বাতাস নদীজল
পৃথিবীময় ব্যাপ্ত অনিবার
হারালো শেষ সুখের সম্বল
রাত্রি তার অন্ধ অধিকার
ব্যাকুল হাতে সহসা দিল খুলে
পাঁচটি ফুলে অসুখ ছিল আর
অসুখ ছিল অসুখ ছিল মূলে
যতিচিহ্নহীন পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তিতে গতির অবারিত অশ্বশক্তি। বর্ণ আর বর্ণহীনতা। দৃশ্য আর রহস্য। ‘বেগুনি সন্ধ্যা’ আর ‘অন্ধ অধিকার’, ফিরে আসে মিলেমিশে, শেষ আর্তনাদে— ‘অসুখ ছিল অসুখ ছিল মূলে’। খুলে/মূলে অন্ত্যানুপ্রাসের দুলুনি মুক্তি আর বদ্ধতায় বেজে ওঠে। দার্শনিক হাহাকার অস্তিত্ববাদী প্রবাহকে উদ্ভাসিত করে। পুষ্কর শিক্ষকের মতো শেখান, কীভাবে দৃশ্য থেকে অরূপরতন মাথা তোলে।
৩.
আমার কথা এলোমেলো হয়ে যাবার আগে, পাঠকের দরবারে পুষ্কর দাশগুপ্তের তিনটি বই পেশ করব। প্রথমটি প্রবন্ধের। ‘কবিতার অনুবাদ এবং আরো দুটি প্রবন্ধ’ (ডিসেম্বর ১৯৯৮)। পরেরটি অনুবাদ কবিতার। ‘গিয়োম আপলিনের-এর কবিতা’ (অগাস্ট ১৯৮৮)। তৃতীয়টি সম্পাদিত গ্রন্থ। ‘বিশ শতকের ফরাসি কবিতা : আটজন কবি’ (সম্ভবত ১৯৭৯ বা ১৯৮০, বইয়ে সাল উল্লেখ নেই)।
তিন কিসিমের এই তিনটি বই প্রকৃতপক্ষে সেই যুগে ছিল তিনটি জানালার মতো। ফরাসি কবিতা, ইউরোপের কবিতা এবং বিশ্বের নানা সাহিত্য-আন্দোলন বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা দূরীকরণের কাজ করেছেন পুষ্কর। মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাংলা কবিতার সমান্তরাল ইতিহাস। যেমন ধরুন, ‘বিশ শতকের ফরাসি কবিতা : আটজন কবি’ বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে ‘বিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাল ও সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য’ শিরোনামে তিনি সাল ধরে-ধরে তুলনামূলক তথ্যসারণী পরিবেশন করেছেন। দু-একটি বলি। ১৯৭৩ সালে মিশেল তুর্নিয়ে (‘উল্কা’), প্রেভের (‘গাছ’)-এর পাশাপাশি আছেন বিষ্ণু দে (‘চিত্ররূপ মত্ত পৃথিবীর’)। ১৯৭৯ সালে সঁগর এবং রনে শার-এর রচনা ছুঁয়ে আছে অরুণ মিত্র আর কমলকুমার মজুমদারকে (‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’)। এত নিষ্ঠায় পুষ্কর দাশগুপ্ত এইসব কাজ করে গেছেন, অভিবাদন জানাতে ইচ্ছে হয়!
তরজমা বাংলায় বহুযুগ ধরেই এক উদ্যাপিত সাহিত্যকর্ম। পুষ্কর তারই একজন সহযাত্রী। কিন্তু, পুষ্কর নতুন এক ভূমিকায় আবির্ভূত হন। অনুবাদ বিষয়ে তিনি সমান্তরালভাবে গড়ে তুলতে চান এক তাত্ত্বিক বুনিয়াদ। নানাভাবে, নানা দিক থেকে বুঝতে চান অনুবাদ প্রক্রিয়ার কৃৎকৌশল, তার অন্দরমহল। কর্মতত্ত্বৈক্য বা প্র্যাক্সিস হিসেবে চর্চাটি চালান। বিচ্ছিন্ন প্রায়োগিক পরিসরটুকু নিয়ে তৃপ্ত থাকেন না। পাশাপাশি, প্রতিটি অনুবাদ বা বিদেশি কবিকে অসীম যত্নে ইতিহাস-ভূগোল-সমাজমুহূর্তে স্থাপন করেন। নিয়ে আসেন তাঁর সামগ্রিক পরিচয়। অন্যদিকে, এদেশের পাঠককে জানিয়ে দেন সাগরপারের তৎকালীন সাহিত্য আন্দোলন বা কাব্যমর্জি বিষয়ে। তাঁর এই নিষ্ঠা এবং শ্রম অতুলনীয়। বুদ্ধদেব বসু এবং মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ব্যতীত এ-পথে পুষ্করের প্রায় কোনও পূর্বসূরি নেই। যখন সম্পাদক তিনি, তখনও তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি পাঠকের দিকে। তথ্য দিয়ে, বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে পুষ্কর পাঠকসমাজকে উপহার দেন আসলে এক স্পন্দমান মানুষকে। যিনি সেই অচেনা কবি। যিনি তাঁর সময়-এলাকা-সংস্কৃতি নিয়ে সদাভ্রাম্যমাণ। তরজমায় কবির প্রতিবিম্বিত ছায়াশরীর ধরা পড়ে। তাঁকে জীবন্ত দেখা যায়। দর্পণের কাঠামো তৈরি করে তত্ত্ব।
৪.
দু-একটি দৃষ্টান্ত দেব। আপলিনের-এর কবিতা-বইটিতে প্রথমে পাওয়া যাবে ‘গিয়োম আপলিনের ও তাঁর কবিতা’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশিকা নিবন্ধ। সেই আলোচনায় আপলিনের কীভাবে ফরাসি কবিতায় সংযোজন করেন নবতরঙ্গের উদ্ভাস— সে-কথা নানা প্রসঙ্গ টেনে এনে চমৎকার বিশ্লেষণ করা হয়। অন্যদিকে, শেষাংশে রয়েছে পরিশিষ্ট, ‘ভূমিকা ও অনূদিত কবিতা প্রসঙ্গে’। ভূমিকার এবং কবিতাগুলির বিস্তারিত টীকা-ভাষ্য। এই ভূমিকা এবং পরিশিষ্ট প্রকৃতপক্ষে উনিশ-বিশ শতকের ফরাসি তথা পশ্চিম ইউরোপীয় সাহিত্য (বিশেষত কবিতা) আস্বাদনের পথ-নির্দেশিকা। অন্তত, আমি এই দুটি অংশ পড়ে বহু নতুন বিষয় জানতে পেরেছি। প্রথম পর্ব থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ‘স্যুররেয়ালিস্ত’ বোঝাতে আপলিনের ‘একটি দৃষ্টান্ত দেন’। ‘মানুষ যখন হাঁটা ব্যাপারটার অনুকরণ করতে চাইল তখন সে তৈরি করল চাকা। চাকা দেখতে পায়ের মতো নয়। মানুষ এভাবে ব্যাপারটা না জেনেই যা করেছে তাই হল স্যুররেয়ালিস্ম।’
পরিশিষ্ট অংশে সযত্নে এবং তথ্যনিষ্ঠ পরিবেশনে তিনি পাঠককে পরিচিত করেন একের পর এক কাব্য-সাহিত্য আন্দোলন এবং তার প্রমুখ্য স্রষ্টাদের সঙ্গে। প্রতীকবাদ, ভবিষ্যদ্বাদ, ক্যুবিজম, দাদা, স্যুররিয়ালিজম প্রভৃতি আন্দোলনের সূত্রে আসেন পল ভালেরি, ব্লেজ সঁদ্রার, অঁদ্রে ব্রঁতো, ত্রিস্তঁ জারা, ভের্লেন, রাসিন, র্যাঁবো থেকে গোতিয়ে কিংবা জিদ। আবার এ-কথাও জানিয়ে দিতে ভোলেন না, ‘… আপলিনের-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহে অঁদ্রে জিদ অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’-র দুটি সংস্করণ (১৯৯৪ ও ১৯৯৭ সালের) পাওয়া যায়।’ এছাড়া পাওয়া যাবে কবিতা ধরে-ধরে বিস্তারিত টিকা-ভাষ্য। আপলিনের-এর কবিতার কত গভীর পাঠক হলে সেইসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপহার দেওয়া যায়, সে-কথা ভাবি! কবিতার অনুবাদও মসৃণ, সাবলীল, স্রোতস্বল। ‘সম্পদ শ্রমের পরিণতি।/ এসো পরিশ্রম করি নিঃস্ব করি যত।/ শুঁয়োপোকা প্রাণপাত করে অবিরত/ অবশেষে হয়ে ওঠে ঋদ্ধ প্রজাপতি।’ (‘শুঁয়োপোকা’) অথবা, ‘প্রেম চলে যায় যেন জলধারা ছুটে যায় তরতর/ প্রেম চলে যায় এ জীবন/ যেন কীরকম মন্থর/ দুরাশার মায়া যেন কিরকম তীব্র ভয়ংকর…’ (‘মিরাবো সেতু’)
অনুবাদক নিজে যশস্বী কবি হলে তরজমায় অতিরিক্ত কাব্যমাধুর্য আসে। পুষ্করের অনুবাদ পড়ে সে-কথায় সিলমোহর লাগাই। ‘এলাকা’ নামক দীর্ঘকবিতার শেষ দুটি পঙ্ক্তি যেন ধক করে বুকে লাগে। শহরজীবনের এ-গোলার্ধ ও-গোলার্ধ যেন মিলেমিশে একই ক্ষোভে জ্বলে ওঠে। আমি মধ্য কলকাতার চৌরঙ্গী থেকে যেন শুনতে পাই— ‘বিদায় বিদায়/ কাটামুণ্ড সূর্য’। অসম্ভবকে সম্ভব করা অনুবাদ, ‘হৃদয় রাজমুকুট আর আয়না’। হুবহু ধরা আছে ‘চিত্র-কবিতা’-র প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। নিখুঁত এবং দীপ্ত। ফরাসি এবং বাংলা পাশাপাশি।
‘কবিতার অনুবাদ ও আরো দুটি প্রবন্ধ’ নামক পুস্তকটি আবার প্রয়োগ থেকে নজর ঘুরিয়ে দেয় তত্ত্বের দিকে। এ-বইয়ের ভূমিকার শিরোনাম ‘ভ্যানতারা’। সেখানে আলগা ব্যঙ্গে বলা হয়েছে, ‘বাংলা বাজারে বিক্রির জন্য গ্যাঁজানো গপ্পো-উপন্যাস-কব্তে বানানোর কারখানা আমার নেই… আমি শালা নামজাদা জ্ঞানের কারবারি কি বাংলার মাস্টার নই… তবু কখনো সখনো দু-একটা ব্যাপার— যা আমি জানি, বুঝি, বা আমার মনে হয়— তা বাংলা বুলিতে হাজির করতে চেস্টা করি।… এখানেও ওরকম একটা মাল নামিয়েছি। মালটা নিট দিয়েছি, একফোঁটা জল মেশাইনি। কড়া, ঝাঁঝালো তিরকুটে কি অখাদ্য ঠেকলে গেলাসটা একপাশে সরিয়ে রেখো বা মালটা নর্দমায় ঢকঢক করে ফেলে দিও।…’ পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে অবশ্য ভাষা বেশ সারস্বত এবং প্রাতিষ্ঠানিক। কবিতার অনুবাদ বিষয়ে তিনি সারণী, স্তম্ভ, ছক, লেখচিত্র প্রভৃতি ব্যবহার করে ভাষাতথ্যের নিরিখে, ভাষান্তরের লেনদেন, সীমান্ত পারাপারের নকশা এবং স্থাপত্য পরিবর্তন বিশ্লেষণ করেছেন।
পাঠক হিসেবে লক্ষ করি, বাংলা অনুবাদের সুবিস্তৃত পাঠপরিধি তাঁর নখদর্পণে। চমৎকার সব সমান্তরাল দৃষ্টান্ত তিনি বিভিন্ন মান্য কবির ভাণ্ডার থেকে আহরণ করেন। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বিচার করেন। প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে টিকা পরিবেশন করেন। সেখানেও ঝলসে ওঠে মেধা আর অনুসন্ধিৎসা। এই প্রবন্ধত্রয়ীর মধ্যে ‘মধুসূদনের ফরাসি-চর্চা’ উল্লেখযোগ্য কাজ। ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের জলহাওয়া তথা চর্চা তাঁকে দূরবর্তী করেছে কিন্তু বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। কে বলে তিনি মননে পরবাসী? বার বার বাংলায় তাঁর প্রত্যাবর্তন, তাঁর আত্মপরিচয়।
‘বিশ শতকের ফরাসি কবিতা : আটজন কবি’ সম্পাদনায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পুষ্কর দাশগুপ্তকে খুঁজে পাওয়া যাবে। মাক্স জাকব, অঁরি মিশো, জাঁক প্রেভের, লেওপল্দ সঁগর প্রমুখ কবিদের অনুবাদ করেছেন অরুণ মিত্র, লোকনাথ ভট্টাচার্য, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, পুষ্কর দাশগুপ্ত প্রভৃতি মান্য অনুবাদকেরা। ছবি এঁকেছেন শানু লাহিড়ী। সেই গুরুত্বপূর্ণ সংকলনের ভূমিকায় পুষ্কর জানিয়ে দেন এক জরুরি তথ্য। ‘বিশ শতকের ফরাসি কবিতার এক নতুন দিগন্ত ফরাসিভাষী অ-ফরাসিদের কবিতা। এর মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের কবিতা। বিশ শতকের ফরাসি কবিতার আধুনিকতার ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোজনা করেছে ঐতিহ্য এবং উপলব্ধি, যাকে বলা হয় ‘নেগ্রিত্যুদ’।’
এইভাবে, পুষ্কর দাশগুপ্ত পাঠকের সঙ্গী হয়ে তাঁকে চিনিয়ে দিতে থাকেন আন্তর্জাতিক নানা সাহিত্যভাবনা, সাহিত্যসৃষ্টি, সাহিত্য-অভিমুখ। ফরাসি কবিতা তথা সাহিত্যের অঙ্গনে পা রেখে তিনি ডানা মেলে দেন। এত নির্ভরযোগ্য, তন্নিষ্ঠ, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পথ-প্রদর্শক আর কোথায়?
৫.
পুষ্কর চলে গেলেন এমন এক প্রবাসে, যেখান থেকে ফেরা যায় না। তাঁর বেশ কিছু বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রবন্ধগ্রন্থটির শেষে মুদ্রিত আছে। আমি সেসব বই দেখিনি। যেমন ‘দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা’ নামের প্রবন্ধগ্রন্থ, তাঁর অনূদিত ‘লোরকার কবিতা’ বা ‘মোপাসঁর ছটি গল্প’। চোখে পড়েনি, আমার দুর্ভাগ্য, ‘কনস্তান্তিনস কাভাফি-র কবিতা’। দেখা হয়নি, ‘ভলতের : জাদিগ ও অন্যান্য উপাখ্যান’।
তাঁর বইগুলি সহজলভ্য নয়, কোনও-কোনওটি নিঃশেষিত। পুষ্কর দাশগুপ্তের ‘রচনাসমগ্র’ সংকলিত হবে না? তাঁকেও কি আমরা ঠেলে দেব বিস্মৃতির অন্ধকারে? বাংলা সাহিত্যের জানালাগুলি একে-একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পুষ্কর দাশগুপ্তের প্রয়াণে দেয়াল আরেকটু বাড়ল। আলোহাওয়া কমে গেল, দমবন্ধ অবস্থা অসহনীয় হল।
‘আর ওরা বেরিয়ে গেলে
ঘরটা নীরব
টেবিল
টেবিলল্যাম্প
বই
কয়েকটা চেয়ার
দেয়ালে ম্লান আলোছায়া…’
(‘ওরা বেরিয়ে গেলে’)