সমালোচনা— ওয়েব সিরিজ, ‘স্কুপ’
মুখ্য চরিত্র— করিশমা তান্না, মোহম্মদ জিশান আয়ুব, হারমান বাওয়েজা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জি প্রমুখ।
পরিচালনা— হনসল মেহতা
আবহসংগীত— অচিন্ত্য থাক্কার
হ্যারি পটারের গল্প আমরা সবাই পড়েছি। সেই সিরিজের চতুর্থ বইতে একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, অন্যতম মুখ্য চরিত্র হারমায়নির সঙ্গে রিটা স্কিটার নামে এক সাংবাদিকের জোর তর্ক হচ্ছে। তর্কের মাঝখানে রিটা হারমায়নিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, তোমার কী মনে হয়? আমাদের খবরের কাগজটা আছে কেন?’
হারমায়নি সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘কেন? খবরের কাগজ আছে মানুষকে সত্যি কথাটা জানাবে বলে!’
বিদ্রূপের হাসি হেসে পোড়-খাওয়া সাংবাদিক জবাব দেন, ‘ধুর বোকা মেয়ে! খবরের কাগজ আছে নিজের বিক্রি বাড়াবে বলে।’
এই বই, অর্থাৎ ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অফ ফায়ার’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে। এবার আমরা ২৩ বছর এগিয়ে আসি, চোখ রাখি নেটফ্লিক্সের পর্দায় একটি সমকালীন ভারতীয় সিরিজের মাঝামাঝি একটি এপিসোডে। সেখানে দীপা নামে এক উঠতি সাংবাদিক বদ্ধপরিকর, একটি মুচমুচে খবর তিনি কাগজে প্রকাশ করেই ছাড়বেন। এই খবর যে আসলে কুৎসিত, অপ্রমাণিত কেচ্ছা, এবং সেই কেচ্ছা যে তাঁর নিজের এককালের গুরুস্থানীয় সাংবাদিককে নিয়ে, সে-নিয়ে তাঁর কোনও হেলদোল নেই। তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে মরিয়া হয়ে বলেন, ‘এ-কাজ করিস না। সাংবাদিক হিসেবে কি আমাদের মানুষকে সত্যি কথা বলার কোনও দায়িত্ব নেই?’
দীপা অবাক হয়ে বলেন, ‘মানুষ সত্যি কথা জানতে চাইলে তার জন্য পুলিশ আছে, আদালত আছে, তদন্ত আছে। সংবাদের কাজ তো নিজেকে বিক্রি করা, এবং এই খবরটা ভাল বিক্রি হবে, লোকে খাবে খবরটা!’
সিরিজের নাম ‘স্কুপ’, এবং আমার বিশ্বাস এই একটি কথোপকথনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে গোটা সিরিজের মূল ভাবনা। অবশ্য সিরিজের শিরোনাম গোড়া থেকে সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিল। সাংবাদিকদের জগতের দৈনন্দিন-ভাষ্যে ‘স্কুপ’ কথাটির অর্থ হচ্ছে কোনও একটি টাটকা, মুখরোচক খবর, যা পরিবেশন করতে পারলে দর্শক বা পাঠক গরম কচুরির মতো কিলোদরে কিনবেন এবং গিলবেন। সারাদিন ধরে এক-একজন সাংবাদিক সারা দুনিয়া ছুটে বেড়ান, কোথায় এমন কিছু নিয়ে খবর করা যাবে, যা ছাপলে কাগজের কাটতি বাড়বে, এবং তিনি বোনাস মাইনে পাবেন। আধুনিক কর্পোরেট সাংবাদিকতার এ এক ভয়ানক সংস্কৃতি। কেন ভয়ানক, তার কথা একটু পরেই আলোচনা করব। তার আগে ‘স্কুপ’ সিরিজের ব্যাপারে দু-চার কথা বলে নিই।
‘স্কুপ’ সিরিজের গোটা গল্পটা এখানে ফাঁস করে দিতে চাই না, তাতে সম্ভাব্য দর্শকেরা রাগ করতে পারেন। তা ছাড়া সিরিজটি যেহেতু সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি, সেহেতু খবরের দুনিয়া নিয়ে যাঁরা একটু ওয়াকিবহাল, তাঁদের এ-গল্প ইতিমধ্যেই জানা। ২০১১ সালে একটি খুনের ঘটনা সারা ভারতবর্ষের সাংবাদিকমহলে ঝড় বইয়ে দেয়। ১১ জুন দুপুর তিনটে নাগাদ বাইকে করে বাড়ি ফিরছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে, যিনি মুম্বইয়ের অপরাধজগতের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলা হয়। এই সময়ে তাঁকে দিনেদুপুরে গুলি করে খুন করে তিনজন আততায়ী। জানা যায়, এই খুনের পিছনে হাত আছে কুখ্যাত ডন ছোটা রাজনের। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়, পুলিশের তদন্তে সন্দেহের আঙুল উঠে আসে আর এক সাংবাদিকের দিকে, যাঁর নাম জিগনা ভোরা। অভিযোগ ওঠে, এই ভদ্রমহিলা পেশাদারি রেষারেষির জেরে জ্যোতির্ময় দে-র ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে দেন অপরাধীদের হাতে, যার সাহায্যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়। ভদ্রমহিলা প্রায় ন-মাস বাইকুলা জেলে বন্দি থাকার পর ছাড়া পান, এবং অবশেষে ২০১৮ সালে আদালত তাঁকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে। তাঁর জেলার-অভিজ্ঞতা নিয়েই যে-বইটি লিখেছিলেন জিগনা, তারই সাহায্যে তৈরি হয়েছে হনসল মেহতার এই সিরিজ, ‘স্কুপ’।
জিগনার অভিজ্ঞতা, এবং তাঁকে ঘিরে ব্রেকিং নিউজের যে-কার্নিভাল, তাকে ওটিটির পর্দায় দক্ষভাবে তুলে ধরেছেন কলাকুশলীরা। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় জাগৃতি পাঠকের ভূমিকায় করিশমা তান্না এবং ইমরান সিদ্দিকির ভূমিকায় মোহম্মদ জিশান আয়ুবের কথা। এই দুজন চরিত্রের যাত্রাটা ছিল অনেকটা সাবেকি ট্র্যাজেডির নায়কের মতো; সাফল্য এবং প্রতিপত্তির শিখর থেকে শুরু করে হঠাৎই কিছু ঘটনার জেরে এঁদের পতন ঘটে, এবং একের পর এক ধাক্কা খেতে-খেতে আস্তে-আস্তে ধ্বসে যায় দুজনের গোটা দুনিয়াটা। সিরিজের গোড়াতে এঁদের চরিত্র দুটির যে-মেজাজ, যে-ভাষ্য, যে-বডি ল্যাংগুয়েজ, তা আমূল পালটে যায় ছ-টি এপিসোডের শেষে। অভিনয়ের দক্ষতা না থাকলে এ বড় কঠিন কাজ, এবং এক্ষেত্রে দুজনেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলা যায়। অন্যান্য চরিত্রে খুবই ভাল লাগল হারমান বাওয়েজা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জি, স্বরূপা ঘোষদের। তার পাশাপাশি অচিন্ত্য থাক্কারের আবহসংগীত গোটা সিরিজটাকে বেঁধে রেখেছে সাত সুরের নিপুণ বাঁধনে।
তবে বিশেষভাবে যে-জিনিসের প্রশংসা না করলেই নয়, সেটি হচ্ছে গোটা সিরিজের অভিমুখ। এই সিরিজ দেখতে বসে প্রথমে দর্শক হিসেবে মনে হচ্ছিল, সিরিজটি হয়তো কর্পোরেট সাংবাদিকতার দুনিয়ার ইঁদুর দৌড় এবং ব্রেকিং খবর বানানোর আবেগহীন, ক্লিনিকাল সংস্কৃতির বিষয়ে সোশ্যাল কমেন্টারির দিকে যাবে। একেবারে শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাই, ‘ভাল’ সাংবাদিক আর ‘খারাপ’ সাংবাদিকের কোনও ভাগাভাগি সচেতনভাবেই করা হয়নি। একদিকে মুখ্য চরিত্র জাগৃতি এবং তাঁর ‘ইস্টার্ন এজ’ কাগজের সম্পাদক ইমরান যেভাবে ব্রেকিং খবরের সন্ধানে চিলের মতো ছোঁ মারছেন, উল্টোদিকে তাঁদের রাইভাল সংবাদপত্র ‘সিটি মিরর’-এর অধিনায়িকা লীনা সমান গতিতেই খবরের শিকারে ওত পেতে আছেন। অতএব গোটা সাংবাদিকতার দুনিয়ার মধ্যেই এই স্কুপ-শিকারি মনোভাব, যে-মনোভাবকে আত্মস্থ করে ফেলেছেন প্রত্যেকজন সাংবাদিকই, তার বিশ্লেষণে নিজের অভিমুখ সীমাবদ্ধ রাখতে পারত ‘স্কুপ’। আবার জয়দেব সেনের হত্যার পরে থানা, পুলিশ, তদন্ত, মুম্বইয়ের ক্রিমিনাল গ্যাং, বন্ধ ঘরে একের পর এক অভিযুক্তদের উপর কড়া পুলিশি জেরা; এই গোটা আবহটা আবার আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেল থ্রিলার বা গোয়েন্দা সিরিজের দিকে। একটা সময়ে মনে হচ্ছিল, সাংবাদিকতার দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে হয়তো ক্রাইম থ্রিলার বানানোর রাস্তাই নিয়েছেন পরিচালকেরা। কারণ, বিগত কয়েক দশকে সাবেকি গোয়েন্দা সিরিজ তো বটেই, তার পাশাপাশি ‘হাউজ এম ডি’ বা ‘বেটার কল সল’-র মতো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রহস্যের সমাধান/তদন্তের গল্পও বাণিজ্যিক এবং শৈল্পিক সাফল্য লাভ করেছে।
কিন্তু ‘স্কুপ’-এর নির্মাতারা সে-রাস্তা নিলেন না, বরং জাগৃতির গ্রেফতার হবার পর থেকেই বাকি সিরিজটায় ফোকাস করলেন চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত ভাবনা এবং মানসিকতার উপর। সাংবাদিকতার দুনিয়ায় স্কুপের জন্য ঘোড়দৌড়, এবং পেশাদারি সাফল্যের জন্য কারোর বিষয়ে বেঠিক অথচ মুখরোচক খবরকে ‘ভাইরাল’ করার বাজারের নৈতিক সমস্যা প্রেক্ষাপটে রইল ঠিকই, তবে এ-ধরনের ঘটনার কারণে একজন মানুষের মনে এবং ব্যক্তিগত জীবনে যে প্রচণ্ড চাপ পড়ে, গল্প এগোল মূলত তার সূত্র ধরেই। জেলে থাকার সময়ে জাগৃতি বুঝতে পারেন যে, এতদিন তিনি যে-ফরমুলায় রক্তমাংসের জীবন নিয়ে ‘খবর করেছেন’ এবং টি আর পি বা কাটতির বাইরে মানুষী আবেগ নিয়ে বিশেষ ভাবেননি, আজ ভাগ্যের ফেরে তাঁকে নিয়ে ঠিক সেভাবেই খবর করছেন তাঁর এককালের অনুজ সাংবাদিকেরা।
এখানেই ‘স্কুপ’ আধুনিক নব্য-উদার দুনিয়ার বাজার-সংস্কৃতির একটি বিরাট সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছেন, যার নাম এলিয়েনেশন (alienation)। একজন শ্রমিক যখন তাঁর নিজের শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, এবং শ্রমের ফসলের পিছনে মানুষী আবেগ, কল্পনা, বা কাজকে মান্যতা না দিয়ে তাকে কেবলই বাজারে বেচার জিনিস হিসেবে দেখা হয়, তখন তাকে এলিয়েনেশন নামে ডাকা যেতে পারে। এই এলিয়েনেশনের ফলে আধুনিক জগতে যেসব মানুষ মূলত নিজেদের কাজের পরিসরেই নিজেদের চিহ্নিত বা পরিচিত করেন (যেমন জাগৃতির কাছে সফল এবং দাপুটে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয়টাই সবচেয়ে বড় কথা, এমনকী মাঝে মাঝে মা হিসেবে পরিচয়ের থেকেও), সেসব মানুষকে বঞ্চিত করা হয় তাঁদের মানুষী পরিচিতিটুকু থেকে। এই এলিয়েনেশন যে নিছক সামাজিক বা অর্থনৈতিক তত্ত্ব নয়, এর যে একটা বিরাট প্রভাব পড়ে আমাদের চারপাশের রক্তমাংসের মানুষের উপরে, জাগৃতি বা ইমরানদের মানসিক ব্রেকডাউনের উপর দর্শকের দৃষ্টি টেনে রেখে তা স্পষ্ট দেখিয়ে দিল ‘স্কুপ’।
আমরা যে আসলে খবর দেখি না, খবর আমাদের দেখানো হয়, এবং দেখানো না-দেখানোর পিছনে সততার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক-সামাজিক মূল্যবোধের চাপ আছে, তা সমকালীন পৃথিবীতে আমাদের কাছে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হলে সংবাদমাধ্যম বা বাজারের কথা ভাসা-ভাসা করে বলে লাভ হবে না, বরং চারপাশের মানুষের মনের উপর এই সংস্কৃতির কী প্রভাব পড়ছে, তা আমাদের অনুধাবন করা দরকার। ‘স্কুপ’ নিজের অভিমুখ বজায় রেখে সেই কাজটি চমৎকারভাবে করতে পেরেছে। এই সিরিজ আর কিছু করুক বা না করুক, আমাদের যে একটু ভাবাবে, সে-বিষয়ে সন্দেহ করা যায় না।