বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়ির ব্রিটিশ আমলের কড়িবরগা দু-একটা খসে পড়েই যেত, যদি আমরা সময়মতো তিনতলায় না পৌঁছতাম! সকাল-সকাল ঘনাদার হুঙ্কারে সেগুলোর, যাকে বলে আক্ষরিক অর্থেই থরহরি কম্পমান দশা। আমরা এমন প্রবল শব্দব্রহ্মের আস্ফালনে জর্জরিত হয়ে দৌড়ে গেলাম ঘনাদার ঘরের দিকে। দেখি রামভুজ বেচারা কাঁচুমাচু মুখ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। হাতে ঝাড়ু। ওদিকে ঘনাদা ঘরের ভিতর থেকে তার উপর নানারকমভাবে তর্জন-গর্জন করে চলেছেন। শিশির বলল, হল কী? এত শোরগোল কীসের? আমাদের দেখে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ফের দ্বিগুণ গর্জন করে ঘনাদা বললেন, ‘এই হতভাগাটাকে জিজ্ঞেস করো।’ আমি রামভুজের দিকে প্রশ্নবোধকভাবে ভুরু নাচাই। সে হাউমাউ করে যা বলল, তার মর্মার্থ এই দাঁড়াল যে, সে ঝাড়ু দিয়ে একটুকরো তার ফেলে দিচ্ছিল। আর সেটা লক্ষ করেই ঘনাদা এমন কুরুক্ষেত্র বাধিয়েছে। সে বেচারা নিজের দোষটাই বুঝে উঠতে পারেনি এখনও অবধি।
শিশির ঘনাদাকে বলল, ‘কী ব্যাপার ঘনাদা, একটা সামান্য তার নিয়ে এমন তুলকালাম করছেন কেন?’
সামান্য! ঘনাদা প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলেন যেন, ‘একটা তারকে তুমি সামান্য বলে দিয়ে ফস করে! এই একটা তার কীভাবে দুনিয়াতে যোগাযোগ বিপ্লব এনেছিল সে-কথা যদি জানতে…’
ঘনাদার একটা গল্প শুরু হতেই পারত এইভাবে। বিশেষ করে সদ্য টুরিং পুরস্কারের এ-বছরের প্রাপকের নাম ঘোষণার পরে। এই পুরস্কৃত ভদ্রলোকের নাম রবার্ট মেটক্যালফে— সংক্ষেপে অনেকে বব মেটক্যালফেও বলে থাকেন বটে। উনিশশো তিয়াত্তর নাগাদ জেরক্স কোম্পানির পাওলো অল্টো রিসার্চ সেন্টারে, তিনি, আরও তিন সহযোগীর সাথে, একটা এমন একখণ্ড তারের সাহায্যে তৈরি করেছিলেন এমন একখানা ব্যবস্থা যা কিনা গোটা দুনিয়ার যোগাযোগ-ব্যবস্থাটাকেই একেবারে পাল্টে দিল। ফলে ঘনাদার এ হেন হুঙ্কার খুবই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা আরও একটু খোলসা করে বলা যাক।
কথায় বলে, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। ঊনিশশো বাহাত্তর সালের মে মাসের এক সকালে বব মেটক্যালফে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলেন তাঁর পিএইচডি গবেষণার চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা দিতে। বব খাতায়-কলমে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ছাত্র হলেও গবেষণার পুরো কাজটাই করেছেন MIT-তে। তার অবিশ্যি কারণ ছিল। ইউ এস ডিফেন্স সদ্য তৈরি করেছে ARPANET বা Advanced Research Project Agency Network— আমাদের বর্তমান ইন্টারনেট-ব্যবস্থার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ গোছের কিছু ভাবতে পারেন তাকে। হার্ভার্ডের কাছে ববের প্রস্তাব ছিল তাদের একমাত্র কম্পিউটারটাকে তিনি এই ARPANET-এর আওতায় নিয়ে আসবেন— এবং সেটাই হবে তাঁর পিএইচডি-র গবেষণা। হার্ভার্ডের গবেষণার বিষয় নির্বাচন কমিটি পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়ে বলে যে, তুমি কালকের ছোকরা— তুমি এসব কী করে করবে? সময় নষ্ট করে লাভ নেই, আমরা অন্য কোম্পানিকে কাজে লাগাব এই কাজের জন্য। তুমি বরং সহজ কোনও বিষয় খোঁজো। বব নাছোড়বান্দা। হার্ভার্ড করতে দিল না তো কী হয়েছে? সোজা হাজির হলেন MIT-তে। তাদের MAC প্রোজেক্টে যোগ দিলেন। একই কাজ করতে হবে। উল্টে MIT তাকে বিশাল অংকের বেতনও দিলো যা হার্ভার্ডের প্রফেসরদের বেতনের সমান প্রায়। সাফল্যের সাথে MIT-তে ARPANET তৈরি করে গবেষণার ফলাফল লিখে তা জমা দিলেন হার্ভার্ড-এ। কিন্তু মে মাসের সেই সকালবেলায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি-র কমিটি বব মেটক্যালফেকে ফেল করিয়ে দিল। ছাত্রের ভবিষ্যতের চেয়ে শিক্ষককুলের আহত ইগোর দাম অনেক বেশি বৈকি— সকল দেশে, সকল সময়ে!
অতঃপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় বব বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিফোন থেকে দু’জায়গায় ফোন করলেন। প্রথমে নিজের বাড়িতে, বাবা-মা’কে জানিয়ে দিলেন যে পরের মাসে হার্ভার্ডের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁদের আর আসার প্রয়োজন নেই, কারণ ডিগ্রিটাই তিনি আপাতত পাচ্ছেন না। দ্বিতীয় ফোনটা গেল জেরক্স কোম্পানির পাওলো অল্টো রিসার্চ সেন্টারে।
পিএইচডি পাবেন এ-কথা ধরে নিয়ে চাকরির আবেদন করেছিলেন নানা জায়গাতে। এবং ‘মাত্র’ ন’টা চাকরির অফার তাঁর পকেটে চলেও এসেছিল। যদিও তাঁর পছন্দের চাকরিটা— MIT-তে পড়ানোর সুযোগ জোটেনি কপালে। ফলে যোগ দিয়েছেন জেরক্স কোম্পানির পাওলো অল্টো রিসার্চ সেন্টারে। কিন্তু পিএইচডি না পেলে সে চাকরি কি থাকবে?
ও-প্রান্তে ফোন ধরেছিলেন বব টেলর— পাওলো অল্টো রিসার্চ সেন্টার বা PARC-এর অধিকর্তা— ARPANET-এর স্রষ্টা। সব শুনে-টুনে তিনি বললেন, খবরটা বেজায় খারাপ, তাতে সন্দেহ নেই। তবে তুমি বেফিকর হয়ে কাজে লেগে পড়ো। পাশাপাশি পিএইচডি ডিগ্রিটা হাসিল করার চেষ্টা চালিয়ে যাও। একবার না পারিলে দেখো শত বার।
সুতরাং বব মেটক্যালফে কাজে বহাল রইলেন। PARC-এও সেই একই কাজ করতে হবে তাঁকে। তবে হার্ভার্ডের প্রোফেসরদের খুশ করার জন্য মেটক্যালফে ব্যবহারিক প্রয়োগের পাশাপাশি অনুসন্ধান শুরু করলেন এই কম্পিউটার নেটওয়ার্কের তাত্ত্বিক দিক নিয়েও। ঠিক এই সময়ে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নর্ম অ্যামব্রামসন ARPANET-এর মতোই আর একটা নেটওয়ার্কের কথা ভেবেছিলেন, যার নাম ALOHANET। ARPANET-এর মতোই এখানেও এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে তথ্যের আদান-প্রদান ঘটে ছোটো-ছোটো প্যাকেট ডাটার মাধ্যমে। মানে, এক দোকান থেকে অন্য দোকানে হয়তো এক বস্তা চাল চালান করতে হবে, কিন্তু একবারে পুরো বস্তাটা না বয়ে নিয়ে গিয়ে ছোটো-ছোটো প্যাকেটে চাল ভরে-ভরে পাঠানো হল। এর ফলে চালের আদান-প্রদান হবে অনেক দ্রুততার সাথে। অ্যামব্রামসন তাঁর নতুন ALOHANET-এ একটা ছোট্ট বদল আনলেন। তথ্য আদান-প্রদানের সময়ে প্যাকেটগুলো যে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়োদৌড়ি করবে, তখন তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি অবশ্যম্ভাবী। অ্যামব্রামসন বললেন, খেতে দাও ধাক্কা। বাধা পেলে পরমুহূর্তেই বাধাহীন হয়ে সে প্যাকেট নিয়ে আবার দৌড় লাগাবে। যেমন, দুই বন্ধু আড্ডার সময়ে একে অন্যের চুপ করার জন্য অপেক্ষা করে-করে কথা বলে না। বরং দুজনের কথাই চলতে থাকে— একে অন্যের কথার ফাঁক খুঁজে নিয়ে। ALOHANET-এও সেভাবেই তথ্যের আদান-প্রদান চলতে থাকবে। ফলে তার গতিবেগ যাবে বেড়ে।
বব মেটক্যালফের হাতে এই গবেষণাপত্র এল। বব এর মধ্যে কিছু ফাঁক খুঁজে পেলেন। খুব সামান্য তথ্যের আদান-প্রদানের জন্য ALOHANET-এর তত্ত্ব খাটবে ঠিকই, কিন্তু যখন তথ্যের পরিবহনের হার বাড়বে, তখন অনিয়ন্ত্রিত ধাক্কাধাক্কি যাবে বেড়ে। আর এই যানজটের ফলে কোনও খবরই এপাশ থেকে ওপাশে পৌঁছবে না। ফলে এই নতুন নেটওয়ার্ক যে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগী নয়, সেটা বুঝলেন বব। তাই অ্যামব্রামসনের মডেলে আর একটা নতুন প্যারামিটার হিসাবে যোগ করলেন প্যাকেটে-প্যাকেটে সংঘর্ষের পরিমাণকেও। যত বেশি ভিড়, তত পরবর্তী তথ্য প্রেরণের জন্য অপেক্ষার সময় বাড়বে। এই তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য বেছে নিলেন কোয়াক্সিয়াল তার। পূর্বসূররিদের মতো প্রয়োজন পড়ল না কোনও বিশাল ঘর বোঝাই সরঞ্জামের। শুধুমাত্র এই একটা তার দিয়ে পর পর কম্পিউটারকে জুড়ে ফেললেন বব মেটক্যালফে আর তার দুই সহযোগী ডেভিড বগস এবং ডেভিড লিডল। ARPA বা ALOHA-এর থেকে অনেক গুণ দ্রুততার সাথে তথ্য চালাচালি সম্ভব হল PARC-এর ল্যাবরেটরিতে। মেটক্যালফে এই কম্পিউটার থেকে কম্পিউটার সংযোগকারী তারের নাম দিলেন ‘ইথার’। ঊনবিংশ শতকের পদার্থবিদরা ভাবতেন এ-মহাবিশ্বের সকল শূন্যস্থানের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে আছে ইথারের স্রোত। আলো এবং সমস্ত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবাহিত হয় ইথারের মাধ্যমে। সে-তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলেও ববের মনে রয়ে গেছিল ‘ইথার’-এর নাম। ফলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও, ইথারের কপালে জুটে গেল এক কম্পিউটার থেকে আরেক কম্পিউটারে তথ্য পরিবহনের কাজ। জন্ম হল ইথারনেটের। হার্ভার্ডের তাবড় প্রফেসরদের তাক লাগিয়ে বব তাঁর হকের পিএইচডি ছিনিয়ে নিলেন এবার। আর আজও আমাদের বাড়ির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যম এই ইথারনেট। অবশ্যই তার অনেক উন্নতি সাধন হয়েছে এই অর্ধশতাব্দী ধরে। ফলে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক মেগাবাইট থেকে আজ কয়েক গিগাবাইট তথ্য পরিবহনে সক্ষম হয়েছে সে। আর তাই ইথারনেট-এর পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে তার জনক রবার্ট মেটক্যালফে সম্মানিত হলেন কম্পিউটার সায়েন্সের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘টুরিং অ্যাওয়ার্ড’-এ।
সুতরাং ঘনাদা খুব একটা ভুল বলেননি। একটা মাত্র তার দিয়ে বদলে দেওয়া গেছিল যোগাযোগের অর্থ। আজকের সহজলভ্যতার যুগে সব কিছুর মূলে রয়েছে যে-ইন্টারনেট, তার হয়েতো জন্মই হত না এই ‘ইথারনেট’ ছাড়া!