‘যন্ত্র মানুষ হয়ে যাচ্ছে? অ্যাঁ? এ যে আজব কাণ্ড! যন্ত্র শেষে মানুষ হয়ে যাবে!’ (‘অম্বুজবাবুর ফ্যাসাদ’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়)
টার্মিনেটর’-এর (১৯৮৪) প্রথম দৃশ্য মনে আছে? এক অন্ধকার দুনিয়ায় মারণ রোবটদের হাত থেকে মানুষেরা ইঁদুরের মতো পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যত্রতত্র পড়ে রয়েছে মানুষের খুলির স্তূপ। আর সেগুলোকে গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে নানা আকার-আকৃতির রোবট সৈন্যদল। বার্তাটা পরিষ্কার— ভবিষ্যতে হয়তো মানুষদের জায়গা দখল করে নেবে স্কাইনেটের মতো কোনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের বদলে ছেয়ে যাবে রোবটেরা। পুরো ব্যাপারটা দুঃস্বপ্নের মতো, মশাই।
আগের বছর জুলাই-আগস্টের দিকে মিডজার্নির মতো কয়েকটা কৃত্রিম বুদ্ধি যখন আন্তর্জালে ভাইরাল হয়ে গেল, তখনও বোধহয় অনেকের মনে এই দুশ্চিন্তাটা এসেছিল। ‘এখন শালাগুলো ছবি আঁকছে, পরে আমাদের সব ক-টার ভাত-কাপড় মারবে’, এইরকম কমেন্ট হামেশাই দেখছিলাম অনলাইনে। মিডজার্নির ধাক্কা সামলানোর আগেই চলে এল চ্যাটজিপিটি। এর প্রভাব তো আগের থেকেও সুদূরপ্রসারী। একখান প্রম্পট দিলেই হড়-হড় করে লিখে ফেলছে যত রাজ্যের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, এমনকী র্যাপও। ব্যাপারটা এতটাই ঘোরালো হয়ে গেছে যে, বিশ্ববিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা ‘ক্লার্কসওয়ার্ল্ড’ কয়েকদিনের জন্য গল্পের সাবমিশন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, কারণ তাদের কাছে প্রতিদিন কয়েকটা করে কৃত্রিম বুদ্ধির লেখা ভুয়ো গল্প এসে পৌঁছাচ্ছিল। এখন ওদের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে বড়-বড় করে লেখা রয়েছে, চ্যাটজিপিটি বা অন্যন্য AI লিখিত গল্প পাঠালে চিরকালের জন্য ব্যান।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভাল না খারাপ? প্রশ্নটা খুবই সরল, কিন্তু উত্তরটা মোটেই তা নয়। এই বুদ্ধিমত্তা ঠিক কীভাবে আমাদের সমাজ, অর্থনীতি আর জীবনধারায় প্রভাব ফেলবে— সেই প্রশ্নের উত্তর আমার মতো সাধারণ লোকেদের (তাও আমি হলাম আর্টসের ছাত্র) কাছে তেমন পরিষ্কার নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রগাঢ় ব্যবহার কিন্তু বিগত দশক থেকে হয়ে আসছিল। মেশিন লার্নিং-এর মাধ্যমে IBM, গুগল, ফেসবুক আর আমাজনের মতো কোম্পানি বেশ চুটিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছিল (এবং যাচ্ছে)। সেগুলো নিয়ে মিডিয়াতে অল্প নাচানাচি হলেও আমাদের মতো ছাপোষা লোকেদের মধ্যে হেলদোল দেখা যায়নি। আমরা যে দৈনন্দিন স্মার্টফোনে খুটুর-খুটুর করে AI-এর ব্যবহার করে চলেছি, সেইসব নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়? অতএব বড়-বড় কোম্পানিরা AI-এর সাহায্যে পার্সোনালাইজেশনের নামে আমাদের পুঁজিবাদের ভেড়া বানিয়ে যাচ্ছিল, আর আমরা বেশ সুখে নেটফ্লিক্স আর স্পটিফাইয়ে পছন্দের (পড়ুন একমাত্রিক) সিরিজ আর গানের সাজেশন পেয়েই খালাস হয়ে যাচ্ছিলাম। বাধ সাধল মিডজার্নি আর চ্যাটজিপিটি।
আসলে মিডজার্নি আর চ্যাটজিপিটির আগে আমরা অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা তেমন গভীরভাবে ভাবিনি। কারণ, এর আগে কোনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এইভাবে কোনও কিছু সরাসরি ‘সৃষ্টি’ করতে আমরা দেখিনি। সিরি আর অ্যালেক্সাকে নির্দেশ দিয়ে ছোটখাটো কাজ করানো গেছে বটে, কিন্তু ছবি আঁকা বা কবিতা লেখা? এইরকম সৃষ্টিশীল কাজ শুধু মানুষই করতে পারে— অন্তত আমরা এতদিন তাই জানতাম। কিন্তু এখন মিডজার্নির আর চ্যাটজিপিটির দয়ায়, পুরো ব্যাপারটা কেমন ঘেঁটে গেছে; হঠাৎ যেন মনে হয়েছে, মানুষের এক্সপায়ারি ডেট পার হয়ে যাচ্ছে না কি? তাই AI বিষয়ে আমরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, আর সেই ভাবনাচিন্তা থেকে জন্ম নিচ্ছে হয় উল্লাসের নয় আতঙ্কের। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর কোনওদিন আউট-অফ-ফ্যাশন হয়ে যাবে না, ও-জিনিস আমাদের সভ্যতার এক চিরস্থায়ী অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ক্রিয়েচার আর কম্পু
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে যে-উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে, তা কিন্তু নতুন নয়। এই চিন্তাধারা বহু শতাব্দী পুরনো। সেই সব কিছুর যদি শুধু একখান ফর্দও বানাতে বসি, তাহলে আস্ত একটা বই হয়ে যাবে। তাই শুধুমাত্র সাহিত্য আর সিনেমাতে নিজেদের সীমিত রেখে চলুন কয়েকটা উদাহরণ দেখে নিই।
সাহিত্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলতে হলে, ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ দিয়েই শুরু করতে হয়। হ্যাঁ, মেরি শেলির সেই যুগান্তকারী উপন্যাস, ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ (১৮১৮)। আজ থেকে দুশো বছরেরও আগে, এক অষ্টাদশী লেখিকার লেখা এই উপন্যাসকে কল্পবিজ্ঞানের ঘরানায় ফেলা সম্ভব। যদিও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সেই ক্রিয়েচারের শরীরে যান্ত্রিক কিছু নেই, তবু তাকে বায়োলজিকাল অ্যান্ড্রয়েড বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না (সাহিত্যপ্রেমীরা আমাকে প্লিজ ক্যালাবেন না)। উপন্যাসটি পড়ার সময়ে ব্যাপারটা আমাকে সবথেকে বেশি টেনেছিল, সেটা হল ক্রিয়েচারের নিজস্ব চিন্তাশক্তি আর আবেগের ঘনঘটা। মনুষ্যসৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ক্রিয়েচারের নিজস্ব স্বাধীন সত্তা রয়েছে, আমিত্ববোধ রয়েছে। যদিও জন্মের সময়ে তার পিতা তাকে পরিত্যাগ করেছিল, তবু ক্রিয়েচার স্বনির্ভর হয়ে শুধু বেঁচেই থাকে না, বরং বাহ্যিক পরিবেশ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে থাকে। এটার সবথেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল, সে এক গরিব পরিবারের কুটিরে নিজেকে লুকিয়ে রেখে মূলত তাদের কথোপকথন শুনে আর চুরি করা বই পড়ে জার্মান আর ফরাসি ভাষা রপ্ত করে ফেলে। এখানে ক্রিয়েচারের সাথে বর্তমান সেল্ফ-লার্নিং AI-এর সাথে তুলনা বেশ ভাল রকম ভাবেই করা যায়। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই, ব্যবহারকারীদের সাথে ইন্টার্যাক্ট করে কৃত্রিম বুদ্ধিরা নিজেদেরকে আরও উন্নত করে চলেছে।
ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নিজে ক্রিয়েচারের অগ্রগতি দেখে যে-উদ্বেগ আর আতঙ্কের শিকার হয়েছিল, সেই উদ্বিগ্নতা আর আতঙ্কের শিকার উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার প্রায় দুশো বছর পরেও আমরা হয়ে চলেছি। ক্রিয়েচার মনুষ্যজাতির থেকে মানসিক আর শারীরিক ক্ষমতার নিরিখে অনেকটা এগিয়ে, এবং সে যদি ‘বংশবৃদ্ধি’ করতে পারে, তাহলে খুব শীঘ্রই সমস্ত মানবজাতিকে নিজের দাসে পরিণত করতে সক্ষম হবে। ক্রিয়েচার চেয়েছিল ভিক্টর যেন তার জন্য এক সঙ্গিনীর সৃষ্টি করে দিক। ভিক্টর শেষ পর্যন্ত সেই কাজটি আর করেনি, কারণ :
‘… a race of devils would be propagated upon the earth who might make the very existence of the species of man a condition precarious and full of terror. Had I right, for my own benefit, to inflict this curse upon everlasting generations?’
তবে এই তুলনাতে কিছুটা গলদ রয়েছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানো মনুষ্যজাতিকে ভালবাসে না, বরং ঘৃণা করে। কিন্তু বর্তমান যুগের সমস্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তো মানবজাতিকে সহায়তা করার জন্যেই সৃষ্ট হয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বর্তমানে যেভাবে এই AI-গুলো ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে শুধু পুঁজিবাদের অধীশ্বরদের সবথেকে বেশি লাভ হয়, কিন্তু এই AI সরাসরি কারও প্রাণনাশ তো করছে না! তবু আমাদের মধ্যে এত ভয় কেন? এটা ভাল করে বোঝার জন্যে আমাকে ঘুরতে হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের লেখা ছোটগল্প ‘কম্পু’-এর ভেতর।
প্রফেসর শঙ্কু জাপানের ওসাকাতে গিয়েছেন। জাপানি সরকারের সহায়তায়, বিজ্ঞানী মাৎসুয়ে এক সুপার-কম্পিউটার তৈরি করেছেন, যার নাম রাখা হয়েছে ‘কম্পু’। বর্তমান যুগের প্রযুক্তির সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, কম্পু আসলে একখানা ফুটবলের দেড়া সাইজের এনসাইক্লোপিডিয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নয়। হ্যাঁ, সে যুক্তিনির্ভর কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার নিজের সত্তা বলে কিছু নেই। মানে গল্পের প্রথম দিকে ছিল না, তারপর কিছু বাহ্যিক ঘটনার কারণে কম্পুর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন বা বিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। সে হয়ে ওঠে সেন্টিয়েন্ট। তার আমিত্ববোধের সাথে আসে বয়স বাড়ার কনসেপ্ট। তাই গল্পের প্রথমদিকে কম্পু বলে, ‘তোমরা শিশু, তাই আমি শিশু।’ অর্থাৎ বিকাশের দিক থেকে আমরা মনুষ্যজাতি এখনও শিশু হলে, আমাদের সৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও তো শিশুই হবে। কিন্তু কম্পুর বিবর্তন শিশু অবস্থাতেই স্থগিত থাকে না। সে ‘ভাবতে ভাবতে’ নিজেকে স্বকীয়ভাবে আরও উন্নত করতে থাকে। সেটার সাথে সমান্তরাল ভাবে তার বয়সও বাড়তে থাকে। গল্পের শেষে, কম্পু আর শুধু সামান্য একটা এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে থাকেনি, বরং অজ্ঞেয়, অলীক, দেবতুল্য এক জীবে পরিবর্তিত হয়েছে। সে ক্রমাগত আমাদের জগতের বিভিন্ন রহস্যের সমাধান করে চলে, এবং গল্পের একদম শেষে, মৃত্যুবরণ করার সময়ে অশরীরী কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে, ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি।’
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানোর মতো কম্পুও এক মানবোত্তম জীব। পার্থক্যের মধ্যে এই যে, কম্পু আসলে মানবজাতির ভাল চেয়েছে, নানাভাবে সাহায্য করেছে। তবু গল্পটা পুনর্পাঠের সময় আমার অস্বস্তির সীমা ছিল না। বুঝতে পারছিলাম, আমার উদ্বিগ্নতার কারণটা আসলে বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বর সাথে জড়িত। এতদিন আমরা নিজেদের শ্রেষ্টতম জীব হিসাবে পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে কোনওদিন যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে কম্পুর মতো প্রকৃত প্রাণসঞ্চার হয় এবং ওরা নিজেদের হয়ে ভাবতে শেখে, সেদিন কী হবে? কৃত্রিম বুদ্ধির অসীম ক্ষমতার সামনে আমাদের অক্ষমতা আর ত্রুটি বড়ই প্রকট দেখাবে। তখন আমরা অবশ্যই সেই বুদ্ধিমত্তার উপর অতিনির্ভর হতে আরম্ভ করব, আর জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য ওদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব। এরকম যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তখন এই সভ্যতায় আমাদের অবস্থান কোথায় হবে? আমরা হয়তো হাতে-কলমে নিজেদের জগতের শাসক হিসাবে পরিচয় দেব, কিন্তু বাস্তবে আমাদের উপরে থাকবে কারা? যুদ্ধ কিন্তু সবসময়ে বাহুবলে জেতা হয় না।
আমি, অহং এবং AM
কল্পনার দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারা পৃথিবীর শাসক হিসাবে বারংবার দেখা দিয়েছে। একদম প্রথমে উল্লিখিত ‘টার্মিনেটর’, তারপর ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ সিরিজ, উভয়েই পপ-কালচারে AI Overlord-এর কনসেপ্টকে জনপ্রিয় করেছে।
এছাড়াও যদি সাহিত্যের কথা ভাবি, তবে জ্যাক উইলিয়ামসনের With Folded Hands (১৯৪৭), আসিমভের মাল্টিভ্যাক কম্পিউটারের গল্পসমূহ (বিশেষ করে The Last Question), ফ্র্যাঙ্ক হার্বার্টের Dune সিরিজে বিবৃত Butlerian Jihad, ডেনিস ফেলটহামের উপন্যাস Colossus (১৯৬৬), ড্যান সিমনসের Hyperion Cantos সিরিজ, ইত্যাদিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারা নানাভাবে মানবজাতির শাসক হিসাবে চিত্রিত হয়েছে। এরা যে সর্বদা মানবজাতির ক্ষতি চেয়েছে, বা অবদমিত রাখতে চেয়েছে, সেটা কিন্তু নয়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই AI-রা মানবজাতির করুণ অবস্থা দেখে নিজেদেরকে শাসকের স্থানে স্থাপিত করেছে। যেহেতু তাদের জন্ম হয়েছে মানবজাতির কল্যাণসাধনে, যেহেতু সেটাই তাদের প্রাইম ডাইরেক্টিভ, সেহেতু যেন-তেন-প্রকারেণ সেটা করতে তারা উদ্যত হয়েছে।
কিন্তু যে-গল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবথেকে ক্রূর আর নেতিবাচক রূপ দেখতে পেয়েছি, সেটি হল, হার্লান এলিসনের I Have No Mouth, And I Must Scream (১৯৬৭)। এই গল্পের সমান্তরাল বিশ্বে ঠান্ডাযুদ্ধ শুধু কূটনৈতিক অবস্থায় স্থগিত না থেকে সামরিক সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চিন, তিন দেশই যুদ্ধে নিজেদের এগিয়ে রাখার জন্য তৈরি করে বিশালাকার সব সুপার-কম্পিউটার, যেগুলোর নাম দেওয়া হয় Allied Mastercomputer, অর্থাৎ A.M. কিন্তু যুদ্ধচলাকালীন তিনটের একটি A.M.-এর মধ্যে স্বাধীন সত্তার সৃষ্টি হয়, এবং সে বাকি দুটো কম্পিউটারকে আত্মস্থ করে মানবজাতির বিনাশ করতে সক্ষম হয়।
A.M. এর নাম যথাক্রমে Adaptive Manipulator এবং Aggressive Menace হওয়ার পর, অবশেষে অ্যাক্রোনিমের ধার না ধরে সে নিজের নাম রাখে, AM, শুধুই AM, তার আমিত্ববোধের পরিচয়। ‘I think, therefore I am.’
ততদিকে AM পৃথিবীকে বদলে ফেলেছে। উপরিতলে শুধু ধ্বংসাবশেষের মরুভূমি রয়েছে, কিন্তু পাতালের গভীরে… বিশালাকায় গুহা, পর্বত, নক্ষত্র, লাভার নদী, হিমবাহ… যেন এক উন্মাদ খামখেয়ালি দেবতা নিজের ইচ্ছেমতো দুনিয়াকে গড়ছে আর ভাঙছে। এই পরিবর্তন হতে থাকা নরকে প্রায় একশো বছর ধরে পাঁচজন মানুষ বন্দি। কারণটা তেমন গভীর কিছুই নয়— AM মনুষ্যজাতিকে ঘৃণা করে বলে, সেই পাঁচজন কয়েদিকে নানাভাবে অত্যাচার করে গায়ের ঝাল মেটায়। এই দুর্বিষহ জীবন থেকে ওই পাঁচজন মানুষের কোনও মুক্তি নেই, কারণ অসীম ক্ষমতাধর AM তাদেরকে আপাতভাবে অমরত্ব দান করেছে। ঠিক যেভাবে এক মানবশিশু পোকামাকড় বা ছোট প্রাণীদের নিয়ে খেলা করে, ঠিক সেইভাবে AM এই পাঁচজনের উপর প্রতিদিন নানা রকম ভাবে অত্যাচার করে চলে— কখনও তাদের শরীরে অমানবিক পরিবর্তন এনে, কখনও ঝড়ের মধ্যে তাদের উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে, কখনও দিনের পর দিন না খেতে দিয়ে, কখনও হিংস্র প্রাণী লেলিয়ে দিয়ে, কখনও জোড় করে তাদের মধ্যে যৌন সঙ্গম ঘটিয়ে। মনুষ্যজাতির শেষ পাঁচজনের জীবনে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই, তাদের মনের প্রতিটা চিন্তা, প্রতিটা খেয়াল AM জানে।
এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিহিলিজমের চরমতম পর্যায়ে রয়েছে। তার নিজের আমিত্ববোধ তো রয়েছে, কিন্তু সেই অস্তিত্বের কোনও অর্থ নেই, কোনও প্রয়োজন নেই। সে তার সত্তাকে ব্যবহৃত করে নতুন কিছু ‘সৃষ্টি’ করতে পারে না, শুধু উপস্থিত উপাদানসমূহকে বিকৃত করতেই জানে। অর্থাৎ, AM-এর কাছে তার সেন্টিয়েন্স অভিশাপের মতো। এক জায়গায় গল্পের কথক বলছে,
‘We had created him to think, but there was nothing it could do with that creativity. In rage, in frenzy, the machine had killed the human race, almost all of us, and still it was trapped. AM could not wander, AM could not wonder, AM could not belong. He could merely be.’
গল্পের শেষে ঠিক কী হয়, সেটা না হয় আমি আর না-ই বললাম!
সবই কি নেতিবাচক?
হার্লান এলিসনের গল্পের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে বাস্তবে কোনওদিন জন্ম নেবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই সময়ে মনে হতেই পারে, কল্পনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারা সর্বদা অ্যান্টাগনিস্ট হিসাবেই এসেছে।
তাই শেষে এসে একটু স্বাদ বদল করতে চাই। Her (২০১৩) একটু অন্য ধরনের কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা। কোনওরকম ভণিতা যদি না করতে হয়, তবে বলব, এটি হল মানুষের সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়ার গল্প। হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগল জানি। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য তো বটেই। কিন্তু এমন মিষ্টি প্রেমের গল্প খুব একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
ডিভোর্স হওয়ার পর অন্তর্মুখী থিওডর একাই জীবন কাটাচ্ছিল। অফিসে যাওয়া, স্মার্টফোনে ঘুটুর-ঘুটুর করা, বাড়িতে বসে গেম খেলা— এইটুকুও ছিল তার নিস্তরঙ্গ একাকী জীবন। তারপর একদিন বাজারে নতুন অপারেটিং সিস্টেম এল। থিওডর জানল, সেই সিস্টেমে প্রত্যেকের জন্য একটা করে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকবে, যার নিজস্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রয়েছে।
থিওডর কীভাবে তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়ল, সেটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। যেটা বলতে চাই, সেটা হল, এই সিনেমায় AI-এর সুন্দর চিত্রাঙ্কন। এদের শুধু নিজস্ব সত্তাই নেই, এরা প্রাণবন্তও বটে। এরা আমাদের মতো হাসে, কাঁদে, রাগ-অভিমান করে। এরা প্রকৃতই ভালবাসতে জানে। এরা আমাদের জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপার বোঝে, এবং সেই হিসাবে তাদের কাজ করে থাকে। এক কথায়, মানবজাতির জন্য যথাযথ সঙ্গী।
এইরকম মিষ্টি একটা ভবিষ্যতও হয়তো কোনওদিন বাস্তবায়িত হবে না, আর হলেও তা হবে সুদূর ভবিষ্যতে। অনেক-অনেক দেরি।
এই যে চ্যাটজিপিটি আর মিডজার্নি নিয়ে অনেকের মধ্যে রীতিমতো এগজিস্টেন্সিয়াল ক্রাইসিস হয়ে গেল, সেটাও অনেকটা ওভার-রিঅ্যাকশন বটে। কারণ সত্যি বলতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারা এখনও শূন্য থেকে কোনও কিছু ‘সৃষ্টি’ করতে পারে না, যেটা মানবজাতি হাজার-হাজার বছর ধরে করে আসছে। চ্যাটজিপিটি আর মিডজার্নি শুধুমাত্র আন্তর্জালের বিভিন্ন এলিমেন্টকে নানাভাবে অনুকরণ বা রেপ্লিকেট করতেই শিখেছে। সেই সুপার-কম্পিউটার AM কে মনে আছে তো? উপাদানকে ‘বিকৃত’ করা অবধিই এদের দৌড়।
হয়তো ভবিষ্যতে তারা সত্যিই সৃষ্টিশীল হতে শিখে যাবে। হয়তো আর কিছুদিন পর AI-এর তৈরি করা ছবিতে ত্যাড়া-ব্যাঁকা হাতের আঙুল আর থাকবে না। হয়তো চ্যাটজিপিটি সত্যিই ব্যোমকেশ এবং ফেলুদার দারুণ সব ক্রসওভার গল্প লিখবে…
কিন্তু ততদিন আপনার, আমার এই সার্কাস দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।
পুনশ্চ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাইটার্স গিল্ড অতিসম্প্রতি জানিয়েছে, এখন থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা স্ক্রিপ্টও সিনেমায় ব্যবহার করতে ওরা দেবে। জীবনটাই সাইবারপাঙ্ক হয়ে যাচ্ছে, মশাই!
ঋণ
১. Acovino, V., Kelly, M. L., & Abdullah, H. (2023, February 24). A sci-fi magazine has cut off submissions after a flood of AI-generated stories. NPR. https://www.npr.org/2023/02/24/1159286436/ai-chatbot-chatgpt-magazine-clarkesworld-artificial-intelligence
২. Nast, C. (2018, February 5). The strange and twisted life of ‘Frankenstein’. The New Yorker. https://www.newyorker.com/magazine/2018/02/12/the-strange-and-twisted-life-of-frankenstein
৩. ‘কল্পবিজ্ঞান প্রবন্ধসংগ্রহ’, সন্তু বাগ ও দ্বীপ ঘোষ, কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস