যে জাতি প্রতিনিয়ত, দৈনন্দিন জীবনযাপনে, জনজীবনে, নিজের বাংলা ভাষাকে এইভাবে অপমান করে চলেছে, অপমান মেনে নিচ্ছে, অপমানে পুলকিত হচ্ছে, এবং অপমান করে ভাবছে এই নীচু জাতির বাংলা ভাষাকে অতিক্রম করে আমরা চলে যাব চমৎকার ইংরেজি বা বাংরেজির দিকে, সেই জাতি যেভাবে আত্মবিস্মৃত হয়েছে, তার পাপে যে বাংলা ভাষার পিঠ দেয়ালে ঠেকবে তা বলার কি!’ ‘বাংলা ভাষার দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে’ শীর্ষক বিতর্কে চন্দ্রিলের কথা শেষ হতেই হাততালিতে সভা ফেটে পড়ল। শ্রোতাদের কাছে সে অবিসংবাদিতভাবে জয়ী। আমি কিন্তু বিজয়ীর আড়ালে দেখলাম এক ক্লান্ত, আত্মসমর্পিত, নিরাশ এবং নিরস্ত্র বাংলা ভাষার এক সৈনিককে, যে এই বিতর্কের প্রতিযোগী না হতে হলেই সবচেয়ে খুশি হত। তাঁর মতে, ‘আসল কথা হল বাংলা ভাষাটাকে কোনওভাবে আমরা একটা অসম্মানিত ভাষা হিসেবে, একটা অসম্মানের যোগ্য ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছি।’ মনে-মনে আমিও কি এই মেনে নেওয়ার দলে? এই প্রশ্নের পিছনে যতখানি বাংলা নিয়ে গবেষণা, তার থেকে অনেক বেশি আত্মানুসন্ধান। কুড়ি বছর ধরে প্রবাসী একজন বাঙালির এই ধরনের আত্মবিশ্লেষণ দৈনন্দিন ধন্দের অঙ্গ। ভাবলাম, পৃথিবীতে আজ নানাবিধ সমস্যা— মানুষে-মানুষে হিংসা, বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি-অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরিবেশের প্রতি ঔদাসীন্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান আধিপত্য— এই সকলের মধ্যে অস্তমান একটি আঞ্চলিক ভাষাকে কোরামিন দিয়ে টিকিয়ে রাখা কি আমাদের কাছে সমাজের সবচেয়ে বড় চাহিদা? বৃহত্তর সেই সব সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে অহেতুক বাংলাছন্ন হয়ে আমরা কি শিবসেনা-মার্কা সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার জালে জড়িয়ে পড়ছি না? সেই তো কবে কবি বলে গেছেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ পৃথিবীর এই সংকটকালে বাঙালি হওয়ার থেকে বিশ্বনাগরিক ‘মানুষ’ হওয়াটা বেশি প্রয়োজনীয় নয় কি?
‘বাংলা ভাষা কীভাবে বাঁচানো যায়, এর থেকে বড় প্রশ্ন, কেন বাঁচানো উচিত?’ এ-জাতীয় প্রশ্নে যুক্তির অভাব মৌলবাদী চিন্তার জন্ম দেয়। ‘স্যাপিয়েন্স’-এর লেখক ইউভাল হারারি-র মতে, জাতি-ধর্ম ইত্যাদি ‘ইম্যাজিন্ড রিয়ালিটি’ বা ‘কল্পিত সত্য’; মানুষের এই সত্তাগুলো গোষ্ঠীর প্রকাশ, এগুলোর কোনও মৌলিক ভিত্তি নেই। আমার কাছে একটি আঞ্চলিক ভাষাও সমগোত্রীয়। আমেরিকায় একটা প্রশ্নোত্তরের আসরে এই প্রশ্নটা চন্দ্রিলকে করা গিয়েছিল। সে উড়িয়ে দেয়নি, বরং বলেছিল,‘সত্যিই তো, ভাষার মূল উদ্দেশ্য যদি ভাবনার আদান-প্রদান হয়, তাহলে সেটা ইংরেজি, হিন্দি, চিনা না স্পেনীয়— যে-ভাষাতেই হোক না কেন, কী যায় আসে!’ আরও একটু গুছিয়ে নিয়ে চন্দ্রিল বলল, ‘একটাই কারণ, আবেগ। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি যে আবেগ কাজ করে, ঠিক তাই।’ বাংলার প্রতি আমাদের টান মূলত আবেগজনিত। আমার ছেলেবেলার আবদারের ভাষা, হোস্টেলে গল্পের ভাষা, রকে আড্ডার ভাষা, রেডিওতে গানের ভাষা, টিভিতে খবরের ভাষা, ব্রিগেডে রাজনীতির ভাষা— সবটা জুড়েই বাংলা। এমনকী প্রথম প্রেমের সময়ে বাজারে ‘এ, কেয়া বোলতি তু?’ আসেনি, ফলে সেটিও ছিল লজ্জা আর সংকোচভেজা বাংলায়। অনুরূপভাবে রবি ঠাকুর থেকে দাদাঠাকুর, ঋজুদা থেকে ঘনাদা, রাজলক্ষী থেকে বিনোদিনী, ‘পথের দাবী’ থেকে ‘পথের পাঁচালী’, ‘বোরোলীনের সংসার’ থেকে ‘অপুর সংসার’, নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর থেকে গড়পারের লালমোহনবাবু— ভালবাসার দুনিয়ার ভাষা বাংলা। বুঝলাম, ঝলসানো রুটির রুক্ষতা থেকে একটি শিশিরবিন্দুর স্নিগ্ধতা যে-ভাষায় সাজানো, তাকে শুধু ব্যবহারিক কক্ষে বন্দি করাটা একপ্রকার অপরাধ। এই ভালবাসার প্রতি আবেগে বা আবেগের প্রতি ভালবাসায় বাংলা আর আমি হয়তো নিজের অজান্তেই এক হয়ে গেছি। আজ এই বাংলা ভাষার ক্ষীয়মাণ দশাতে সেই অনুরাগ অনুকম্পায় এসে ঠেকেছে, তবু হাজার হলেও নেশা তো, ছাড়া মুশকিল। ‘মাসিমা মালপোয়া খামু’ ইংরাzতে কইলে কি আর হেই স্বাদ থাকব? সুতরাং, আমার মতো মাঝবয়েসির কাছে ইংরেজি পেশার ভাষা হলেও নেশার ভাষা হিসেবে দূরেই রয়ে গিয়েছে।
তাহলে কয়েক কোটি বাংলাভাষীর এহেন আবেগ একত্রিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলা রুগ্ন কেন? তার একটাই কারণ, পুঁজি। আবেগের ফলে চাহিদার সৃষ্টি না হলে বাজারের চোখে তা অর্থহীন। বাঙালির আজ পকেটে টান, তাই বাংলা সিনেমা বা বাংলা বইয়ের চাহিদা কম, তাই সেগুলোর মূল্যও কম। ঠাকুরবাড়ির অর্থবল ছিল, তাই তারা বাংলার প্রচার এবং প্রসার দুটোই করতে পেরেছিলেন। কলকাতা তখন ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল হওয়ায় উপরি লাভ। এমনকী, অনেক আগে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে যে বাংলায় ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ অনূদিত হয়েছিল, তার মূলেও ছিল পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা। আরও পিছোলে আদি বাংলায় ‘চর্যাপদ’-এর সৃষ্টি পাল বংশের ছত্রছায়ায়। সে-সময়কার, অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে একাদশ শতাব্দীর প্রচুর লেখায় গৌরবাসীকে ‘বণিক জাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা মূলত তাম্রলিপ্তি বন্দর হয়ে মালয়, ব্রহ্মদেশ, যবদ্বীপ, সুমাত্রা প্রভৃতি অঞ্চলে বাণিজ্য করতেন, ফলে তাঁদের হাত ধরে বাংলার বিস্তার ও ছিল রমরমা। বখতিয়ার খিলজির কাছে আত্মসমর্পণে সে-সুদিনের শেষ। তার পর বহু যুগ কেটে গেছে। কেন্দ্রের বিভিন্ন শাসকের মর্জিতে কখন, কীভাবে, এবং কেন সাম্প্রতিক অধঃপতন শুরু সেটা রণজিৎ রায়ের ‘আ্যাগনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ লেখাটিতে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। এবং সে-সকল শাসকের মধ্যে শুধু মুঘল আর ব্রিটিশদের দায়ী করলে সত্যের অপলাপ হবে। গত সাতের দশকের শুরুতে শ্রী রায় লিখছেন, ‘Today, after two decades of planning, no other state provides as cruel evidence of poverty and degradation as does West Bengal. The proud middle class, who built up the culture of Bengal now ridiculed by those who have prospered since independence, has been rendered bankrupt by the famine of 1943 and the partition of 1947.’ তাই যতই কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি চলুক, পুঁজি বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাবিমুখ হয়েছিল। স্বাধীনতার পর তা ক্রমে-ক্রমে ত্বরান্বিত হয়েছে। এই পুঁজিক্ষয় সত্ত্বেও বাঙালি এবং বাংলা টিকে ছিল, যতদিন না সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নামক টি২০ এসে বাঙালি নামক টেস্ট ক্রিকেট টিমটাকে অচলের খাতায় ফেলে দেয়। দীর্ঘ আড়াইশো বছরের শাসনকালে ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থেই একটা ইংরেজিতে শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করেছিল। স্বাধীনোত্তর চল্লিশ বছর আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সেটা দীর্ঘায়িত হয়েছিল। সমাজের উঁচু শ্রেণি আর আমজনতার ভাষায় প্রভেদ ছিল, সিপিএম-এর বিতর্কিত শিক্ষানীতি সেই প্রভেদকে হয়তো আরও বিস্তারিত করেছিল। আর সর্বোপরি, আমাদের ছোটবেলায় ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং রেন-মার্টিন এর মেলামেশা ছিল না, ফলে বাংলা ভাষার নিজস্ব জায়গা পরিসরে স্বল্প হলেও কতকটা অটুট ছিল। কিন্তু গত তিরিশ বছরের বিশ্বায়নের হাত ধরে পুঁজি বাঙালির হেঁসেলে ঢুকে পড়েছে, আর সেই সঙ্গে বাংলার দফারফা হয়ে গেছে। যাঁরা ভাবছেন এই ধারা ভাষার স্বাভাবিক অপভ্রংশ, যা যুগে-যুগে হয়ে আসছে, তাঁরা ভাবের ঘরে চুরি করছেন। ২০১১-র আদমশুমার অনুযায়ী ১৯৯১ এবং ২০১১-র মাঝে হিন্দিভাষীর সংখ্যা ৩৬.৯৯ থেকে বেড়ে ৪৩.৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, বাংলা ৮.৩ থেকে কমে ৮.০৩ শতাংশে। বিশ্বায়নের সুনামি অত্যন্ত নির্মম, যোগ্যতমের বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা। বলা ভাল, ডারউইন সাহেব খুব ভেবেচিন্তে ‘যোগ্যতম’ কথাটি বাছাই করেছিলেন, ‘উৎকৃষ্টতম’ বলেননি। দুর্ভাগা, নির্জিত রূপঙ্করের কথা না হয় থাক, শুধু উৎকর্ষের উপাসনা হলে বেচারা অখিলবন্ধু সাহারায় কাঁদতেন না। খোলা বাজারের প্রতিযোগিতায় দীপাবলি হেরে গেছে ধনতেরাসের কাছে, রসগোল্লা হেরে গেছে লাড্ডুর কাছে, ঝালমুড়ি হেরে গেছে পিৎজার কাছে, জোছন দস্তিদার হেরে গেছেন একতা কাপুরের কাছে, শচীন কর্তা হেরে গেছেন হানি সিংহের কাছে, পাড়ার গোলগাল, সুডৌল লিলি চক্কোত্তি হেরে গেছেন জিম-ফেরত হিলহিলে বিপাশার কাছে। বাংলা ভাষাও তেমনি হেরে গেছে হিন্দি ও ইংরেজির কাছে। অথবা, চরম আশাবাদীর চোখেও হারতে চলেছে। আসলে, যে-কোনওকিছুই পেটের সঙ্গে জুড়ে দিলে তাকে সাদরে গ্রহণ করা ছাড়া মানুষের আর কিস্যু করার থাকে না। শুধু বাংলা জানলে যে ভাতে মরতে হবে!
তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের মধ্যে বাংলাকে বাঁচানোর কোনো আশা-ই নেই? আমার মতে, আছে, তবে সম্ভাবনা ভারতের ফিফা বিশ্বকাপ জেতার থেকেও কম। এই শতাব্দীর গোড়ায় পৃথিবীতে সাত হাজারের মতো ভাষা ছিল। সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অব ন্যাশনালিটিজ কলেজ অফ লিবারেল আর্টস-এর ২০০৪ এ প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, ২০৫০-এর মধ্যে তার ৯০% বিলোপ পাবে। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘লিংগুইসাইড’ বা ভাষার মৃত্যু। এই প্রক্রিয়ার প্রাক্কালে যে যে লক্ষণ দেখা যায়, তার প্রত্যেকটি বর্তমান বাংলাভাষীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত। সেই লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম দ্বিভাষিক প্রবণতা। বাঙালিরা শুধু হিন্দি বা ইংরেজিতে বলছে না, ভাবছেও। চন্দ্রিল ‘কিঁউ-কি’র সহোদর ‘কেন-কি’ নিয়ে অনেক কথা বলেছে, তা ছাড়াও প্রায়োজক, কার্যকর্তা, ইত্যাদি হাজারটা উদাহরণ আছে। বাংলায় ‘কেন-কি’র আমদানি কিন্তু বিহারের লাগোয়া কোনও গরিব আদিবাসী করেনি, করেছে ইন্টারনেটপুষ্ট শিক্ষিত শ্রেণি, ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপ যাদের প্রতিদিনের চারণভূমি। এঁদের কথাই স্যার আশুতোষ লিখেছিলেন ‘জাতীয় সাহিত্যের উন্নতি’ প্রবন্ধে, ‘সরল-বিশ্বাস-সম্পন্ন জনসংঘের চিত্ত শিক্ষিতগণ শিক্ষার চাকচিক্যে বশীভূত করিয়া যে দিকে ইচ্ছা প্রবর্তিত করিতে পারেন। সুতরাং শিক্ষিতগণের হস্তে দেশের প্রকৃত সম্পদ এবং বিপদ—এই দুই-এরই হেতু নিহিত রহিয়াছে। এক হিসাবে ইহাও এক মহা আতঙ্কের কথা, চিস্তার কথা!’
বাঙালি অলস, বাঙালি বাণিজ্যবিমুখ, বাঙালি আঁতেল— হাজার অপবাদের শরসজ্জায় বাঙালির মর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস এমনিতেই তলানিতে। তার ওপর বলিউডি ব্রহ্মাস্ত্রে যতটুকুও শ্বাস চলছিল, তাও বন্ধের দিকে। আজ অবাঙালি ভুল বাংলা বললে সমাজমাধ্যমে যতটুকু খোরাকের পাত্র হন, বাঙালি ভুল হিন্দি বা ইংরেজি বললে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকেন। যেন প্রথমটি নিছক ভুল, দ্বিতীয়টি অমার্জনীয় অপরাধ। অথচ এ-নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ ভাষা অর্থনৈতিক আধিপত্য আর সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। ১৯৯২ সালে লেখা ‘লিঙ্গুইস্টিক ইম্পেরিয়ালিজম’ বইয়ে রবার্ট হেনরি ফিলিপসন লিখেছেন, ‘Scientific imperialism, media imperialism, and educational imperialism are all sub-types of cultural imperialism. So is linguistic imperialism. Linguistic imperialism also permeates all the other types of imperialism, since language is the means used to mediate and express them.’ অর্থাৎ, বিভিন্ন প্রকারের সাম্রাজ্যবাদের বুনিয়াদ হচ্ছে ভাষা। ফিলিপসন ঔপনিবেশিক স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, জিম্বাবোয়ে, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে ইংরেজদের বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে ভাষার প্রসারের সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। এ-ব্যাপারে শুধু ইংরেজদের একচেটিয়া দাপট ভাবলে ভুল হবে। স্প্যানিশ, ফরাসি, রুশ— সকল সাম্রাজ্যই তাদের উপনিবেশিতদের ওপর একই কৌশল অবলম্বন করেছে। স্বাধীনোত্তর ভারতে যা হয়েছে, মূলত দিল্লিকেন্দ্রিক হিন্দি সংস্কৃতির মাধ্যমে। তা হলে বাঙালিদের কি কোনও দায় নেই? বর্তমানে বাঙালির নিম্নমেধাই কি এই সর্বনাশ ডেকে আনেনি? আমার এক বামপন্থী কাকা বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘খেয়াল করবি, আমাদের ছেলেরা দেয়াল লেখায় ভুল বানান করে না।’ পরিস্থিতি বদলেছে। সে বামও নেই, সে বানানও আর নেই। ‘শিক্ষানীতি’-তে ই-কার বনাম ঈ-কার সঠিকস্থানে বসানোর চাপও নেই। কারণ হিসেবে কেউ-কেউ হয়তো কাঁচা বাদাম থেকে শুরু করে জনৈক রাজনীতিবিদের কাঁচা কাব্যচর্চাকে দর্শাবেন। আমার মতে এগুলো কোনওটাই অবনমনের কারণ নয়, তার উপসর্গ মাত্র। অনেকে বলবেন, বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতি তো মিলাবে আর মিলিবে, তাতে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধেটা অসমতায়। আমরা অনেকে ভাবি, কলকাতার জনৈক অবাঙালি জামাই ‘একলা চলো রে’ গাইলেই আদান-প্রদানটা দ্বিমুখী হয়ে গেল। মোটেই না; মগনলাল মেঘরাজ হলে বলত, ‘তো কী হল?’
ভাষা নিয়ে জাতির আবেগ নতুন নয়। ইতিহাসে বহু ভাষাই বিপন্ন হয়েছে, সেগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টাও হয়েছে। ভাষাবিদদের মতে, এই বাঁচানো ক্ষেত্রানুযায়ী বিভিন্ন প্রকার ধারণ করে— হয় পুনর্দখল (reclamation) অথবা পুনরুজ্জীবন (revitalization)। সফল বাস্তবায়নের উদাহরণ উভয় প্রকারেরই খুব কম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হিব্রু (Hebrew)। মধ্যযুগে হিব্রু ইহুদি ধর্মযাজকদের ভাষা হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল, অনেকটা আমাদের সংস্কৃতের মতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা-ই লোকের মুখের ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় হয়। তারপর ১৯২২ সালে তা ব্রিটিশ-প্যালেস্টাইনের জাতীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা পায়, এবং ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের। এর পিছনে এলিজের বেন-য়েহুদা, য়াকোভ আব্রামোভিচ, ডেবরা ব্যারন প্রমুখ লেখক-বুদ্ধিজীবীদের যেমন অবদান ছিল, তার চেয়েও জোরালো ছিল ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গ ইসরায়েলের মতো স্বাধীন বাঙালি-রাষ্ট্র নয়, এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার সমর্থনে স্থানীয় ভাষা-আন্দোলনকারীদের প্রয়াসের অভাব নেই। কিছুটা হয়তো লোকদেখানো, অধিকাংশই আন্তরিক। ভাষা আন্দোলনের নামে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা, গুরুগম্ভীর আলোচনা, বিতর্ক, গানবাজনা, কবিতাপাঠ, ইত্যাদি তো আছেই, কেউ-কেউ একধাপ এগিয়ে বিহারি ফুচকাওয়ালাকেও বাংলা কবিতা আবৃত্তি করিয়ে ছাড়ছেন। এসব দেখে চারিদিকের মগনলালেরা বলতেই পারেন, ‘আপনারা খামোকা টাইম ওয়েস্ট করছেন কেন? বঙ্গাল কো বঁচানা সির্ফ মুশকিল নহি, নামুনকিন হ্যায়।’ সত্যি কথা বলতে কি, এই মুহূর্তে কিন্তু সেটাই অবশ্যম্ভাবী ঠেকছে। বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য, সে শুধু মরছে না, অনেকদিন ধরে কষ্ট পেয়ে মরছে। তিলে-তিলে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র