১৮৮৫ সালের ২৮ জুলাই— রামকৃষ্ণ এসেছেন তাঁর ভক্ত জনৈক নন্দ বসুর বাড়িতে। সামান্য কিছু আহারের বন্দোবস্ত হয়েছে, রয়েছে কিছু মিষ্টান্ন। নন্দবাবুর আরও ইচ্ছে রামকৃষ্ণ একটা পান খান। কর্তার ইচ্ছানুসারে বাড়ির কাজের মানুষটি নিয়ে এলেন পিকদানি আর রেকাবি। পিকদানিতে রয়েছে হাত ধোওয়ার জল, পানটি খেয়ে পিক ফেলার কাজটিও তাতেই সম্পন্ন হবে। ওদিকে রেকাবিতে রাখা আছে পান। রামকৃষ্ণ আয়োজনটি এক ঝলক দেখে উঠে পড়লেন, পান না খেয়েই।
শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ডায়েরি পড়ে জানা যাচ্ছে, তাঁর গুরু পান না খাওয়ায় নন্দ বসু কিঞ্চিৎ দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ অনড়, তিনি জানাচ্ছেন পিকদানি (হয়তো রেকাবিও) রজঃগুণের লক্ষণ। সাংখ্যদর্শন অনুযায়ী রজঃগুণ প্রতিটি মানুষেরই থাকে, যে-গুণ না থাকলে কর্মে আসক্তি জন্মায় না। সুতরাং রজঃগুণ নিজে কোনও সমস্যা নয়। সাংখ্যমতে সমস্যা তখনই ঘটে, যখন অধিক রজঃগুণের ফলে প্রাকৃতিক বা মানসিক ভারসাম্যটি নষ্ট হয়। কর্মে প্রবৃত্তি এক কথা, আর তার ছুতো ধরে সেলফ-ইউটিলিটি ভিন্ন আর কিছু না ভাবা আরেক কথা। মহেন্দ্রনাথের ডায়েরিতে যে-কথাটি অনুক্ত থেকে যায়, তা হল রেকাবি বা পিকদানি রামকৃষ্ণের কাছে নেহাতই বাহুল্য বিশেষ। এবং সে-বাহুল্যে মনোনিবেশ করা মানে অকারণে মানসিক ভারসাম্যটিকে বেচাল করে তোলা।
পাঠক, এই বাহুল্যের বিষয়টি আপনি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পেরেছেন কিন্তু তাও হয়তো আপনার মন খুঁতখুঁত করছে— একটা সামান্য পিকদানি বই তো নয়, এ কি খানিক তিল থেকে তাল হল না? বছর তেইশশো পিছিয়ে যাই। সক্রেটীয় দর্শনের ভিত্তিতে তৈরি তাঁর ম্যাগনাম ওপাস ‘রিপাবলিক’ লিখতে গিয়ে প্লেটো জানাচ্ছেন, কিছু মানুষ (আদত ভাষ্যে যদিও পুরুষ) তৃষ্ণার্ত বোধ করলেও সময়ে-সময়ে সে তৃষ্ণা নিবারণ করতে চান না। এখানে মনে রাখা দরকার, প্লেটোর বইটি আদর্শ রাষ্ট্র এবং আদর্শ মানুষ তৈরির সহায়িকা। তাই অনুক্ত বাক্যটি বুঝে নিতে সমস্যা হয় না— তাঁরাই আদর্শ মানুষ, যারা সবসময়ে তৃষ্ণা মেটানোর পক্ষপাতী নন। এক হিসাবে প্লেটো রামকৃষ্ণের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে আছেন, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ এতসব ভেদাভেদে না গিয়ে জানাচ্ছেন কিছুটা খিদে, কিছুটা তেষ্টা সবসময়ে রেখে দেওয়া উচিত। বুঝতেই পারছেন তৃষ্ণা এখানে একটি রূপকমাত্র। চাওয়া এবং পাওয়াকে সমান্তরাল পথে চলতে দিলে যে বিপদ অনিবার্য, সেটিই প্লেটোর মূল কথা। প্লেটো এও বলেছিলেন, মানুষের মন সবসময়েই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকবে প্রাপ্তির ঝুঁকি আর অপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার মধ্যে।
মনে হতে পারে আধুনিক অর্থশাস্ত্রীরা এহেন দর্শনের থেকে বহু যোজন দূরে হাঁটেন। যে-বিষয়ের সূচনাতেই বলে দেওয়া হচ্ছে ‘Consumers prefer variety’, সে-বিষয়ে ত্যাগের কথা আর আসে কী করে! কিমাশ্চর্যম, আধুনিক অর্থশাস্ত্রের অন্যতম রূপকার অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘দ্য থিয়োরি অফ মর্যাল সেন্টিমেন্ট’ বইতে কিন্তু লিখছেন আত্মনিয়ন্ত্রণ একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য অতি জরুরি একটি গুণ। অধিকাংশ মানুষ স্বভাবতই নিজের কথা আগে ভাবে, তারপর তার পরিবারের কথা, এবং সবশেষে রক্তসম্পর্কহীন বাকি মানুষগুলির কথা। এহেন চিন্তাক্রম কোনও পাপ নয়, কিন্তু একইসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, কোনও ব্যক্তির থেকে মানবসভ্যতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেই কারণেই আত্মনিয়ন্ত্রণ জরুরি। অ্যাডাম স্মিথের কথাটি আরেকটু খুঁটিয়ে বুঝতে গেলে চলে যেতে হবে ১৮৩৩ সালে যখন আরেক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ফরস্টার লয়েড common property সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পেশ করছেন, যে-প্রবন্ধের সূত্র ধরে আমেরিকান পরিবেশবিদ গ্যারেট হার্ডিন তৈরি করবেন অধুনা বহুপরিচিত একটি বিশেষ শব্দবন্ধ, ‘The tragedy of the commons’। কল্পনা করে নিন একটি সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ বিশাল মাঠ, যেখানে কোনওরকম ব্যক্তিমালিকানা নেই— শয়ে শয়ে রাখাল, মইষাল তাদের গবাদি পশুগুলিকে নিয়ে গেছে সে-মাঠে চরানোর জন্য। এদের প্রত্যেকেই যদি নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির কথাই ভাবে, তাহলে বিশাল মাঠটির ন্যাড়া হয়ে যেতে বিশেষ সময় লাগবে না। ইংল্যান্ড ও আয়ার্ল্যান্ডের গ্রামীণ ইতিহাসে এহেন উদাহরণ কিন্তু বিরল নয়। মনে রাখা দরকার, যারা গবাদি পশুগুলিকে চরাতে নিয়ে গেছিলেন তাঁরাই কিন্তু ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; কিন্তু তারপরেও স্বল্পমেয়াদী স্বার্থসিদ্ধির ফাঁদ কেটে তাঁরা বেরোতে পারেননি। এক হিসাবে এ যেন সেই প্লেটো বর্ণিত দ্বন্দ্বেরই আরেক রূপ! এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির কি আদৌ কোনো পথ আছে? ১৯৬৮ সালে হার্ডিন ‘ট্র্যাজেডি অফ কমন্স’-এর কথা লিখতে গিয়ে জানাচ্ছেন, মানুষের শুভচিন্তার ওপর ভরসা রেখে এ-সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। দরকার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করা। হার্ডিন তাই ভরসা রাখতে চেয়েছেন ‘responsible system of control’-এর ওপর— রাষ্ট্রীয় বা আইনি ক্ষমতার মাধ্যমে যে-কোনওরকম সার্বজনীন মালিকানাকে তুলে দেওয়ারি হবে যার লক্ষ্য। মনে হতেই পারে, আমরা যারা রাখাল বা মইষাল নই, তাদের জন্য কি এ-আলোচনা আদৌ প্রাসঙ্গিক? জনবিস্ফোরণ, উষ্ণায়ন, খাদ্যসঙ্কটের মতন বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে বসলে কিন্তু বেশ বোঝা যায় ‘ট্র্যাজেডি অফ কমন্স’ জাতীয় সমস্যার আজও কোনও ঘাটতি নেই।
চাইলেই কি আরেকটি সন্তান নিয়ে আসা যায়? ইচ্ছে হলেই কি সন্তানের বিবাহানুষ্ঠানে পাঁচের বদলে পঁয়ত্রিশ আইটেম মেনুতে ঢোকানো যায়? সঙ্গতি থাকলেই কি বছরে দু’বারের জায়গায় দশবার প্লেনে চড়ে বসা যায়? মূলধারার অর্থনৈতিক সূত্র ধরে বিশ্লেষণ করতে গেলে বলা যায়, এ নেহাতই একটি গাণিতিক সমস্যা। দেখে নিন আপনার আর্থিক ক্ষমতা কীরকম, সেই ক্ষমতার প্রেক্ষিতে আপনার লক্ষ্য হবে সর্বোচ্চ উপযোগিতা (Utility) খুঁজে পাওয়া। আর এই ম্যাক্সিমাম ইউটিলিটি পাওয়ার জন্য, নিজের বাজেটের মধ্যে থেকে যদি খান পাঁচেক বাচ্চা, খান পঁয়ত্রিশ মেনু আইটেম আর খান দশেক ফরেন ট্রিপ করে ফেলা যায়, তাতে কার পিতৃদেবের কী? অ্যাডাম স্মিথ ‘থিয়োরি অফ মর্যাল সেন্টিমেন্ট’-এ যে-দর্শনের জায়গা থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন সেই দর্শন কিন্তু এই সর্বোচ্চ উপযোগিতা খুঁজে চলার প্রক্রিয়াটির পরিপন্থী। অর্থাৎ, যে-কোনও ভোক্তার ব্যক্তিগত উপযোগিতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই স্মিথ একটি সমস্যা দেখেছেন। স্মিথের ভাষ্য অনুযায়ী মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এতটা স্বার্থপর হলে চলবে না। কিন্তু সবাই যে নিঃস্বার্থ বা স্বল্পস্বার্থ হয়ে পড়বেন এরকম গ্যারান্টি কোথায়? হার্ডিন এবং আরও অজস্র অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলবেন গ্যারান্টি তো নেইই বরং মানুষের শুভচিন্তার ওপর পুরো বিষয়টি ছেড়ে দিলে ফ্রি-রাইডারদের সংখ্যা এত বেড়ে যাবে যে, সামাজিক কাঠামোটিই ভেঙে পড়তে পারে। তাহলে উপায়? এই বাঁকে এসেই ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের পুরোধারা মাথা চুলকোতে থাকেন। বাজারকেই যদি সব কিছুর ভার নিতে বলা হয়, তাহলে অসাম্য এত চরমে উঠবে যে সবাইকে মানুষ বলা যাবে কি না সে নিয়েই একটা সন্দেহ দেখা দিতে পারে। সবথেকে প্রান্তিক মানুষগুলিকে উচ্চকোটির সমাজ যে মনুষ্যেতর বলে মনে করবে তাতে আর সন্দেহ কী? আবার বাজারের বদলে যদি রাষ্ট্র তার লম্বা নাক সর্বত্র গলিয়ে বসে, তাহলে কী হতে পারে তার একটি দৃশ্যপট এই ভারতেই আমরা দেখেছি— ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার সময়ে এক বছরে প্রায় ষাট লাখ ভারতীয় পুরুষের প্রজননক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
একুশ শতকে এসে তাই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই একটি মাঝামাঝি পথ বেছে নিচ্ছে— উৎপাদন এবং উপভোগের অধিকাংশ ক্ষেত্রগুলিই বাজারের হাতে, কিন্তু সরকারও নিজের মতন করে রাশ টেনে ধরার ক্ষমতা রেখে দিয়েছে। ফলে মিলটন ফ্রিডম্যানের মতন বাজারপন্থী অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যৎবাণীকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে অধিকাংশ দেশেই বিবিধ কর বসে চলেছে বা বসানোর চিন্তাভাবনা চলছে। পরিবেশকর নিয়ে ভাবনাচিন্তা তো অনেকদিনের, সাম্প্রতিক কালে একাধিক দেশ লম্বা বিমানযাত্রার ওপরেও কর আরোপ করে উপভোগের মাত্রা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করছে। ফ্রিডম্যানের মতন চিন্তাবিদদের কাছে এহেন নীতিনির্ধারকরা প্রায় একনায়কদের সমতুল্য, যারা মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করছেন। অর্থনীতির চৌহদ্দি থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরে আসি এবার। এই ব্যক্তিস্বাধীনতা নামক বিষয়টিকে আরেকটু গভীরে গিয়ে বোঝা দরকার।
অর্থনীতিবিদরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে যেমনটি দেখছেন তাকেই ধ্রুব বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু একাধিক ধর্ম এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে— পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিস্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্যতা কি সবার আছে? আর একভাবে হয়তো বলা যায়, স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতার জন্য কি নিজেকে আরও ঘষামাজা করা জরুরি? সমস্ত ধর্মের সূত্র নিয়ে এই পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়, আমি বেছে নিয়েছি একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সূত্রকে— বৌদ্ধধর্ম। গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর পরবর্তী বৌদ্ধ চিন্তাবিদদের দেখানো সূত্র ধরে এগোতে গেলে দেখা যাবে গোড়াতেই গলদ— ব্যক্তি বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে আমরা যা বুঝি তা নিতান্তই মায়া। ‘অহম’, অর্থাৎ এই আমিকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছি? কারণ আমি জানি না যে, বিশ্বের সমস্ত জন্ম-মৃত্যু, ভোগ-ত্যাগ, গ্রহণ-বর্জনের পেছনে রয়েছে একটি সর্বব্যাপী কার্যকারণ নিয়ম। বৌদ্ধদর্শনে যাকে বলা হয় প্রতীত্যসমুৎপাদ বা The theory of dependent origination। এই সর্বব্যাপী কার্যকারণকে অস্বীকার করলেই জন্মায় মায়া, যে-মায়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে লোভ ও হিংসা (বা ঘৃণা)। বৌদ্ধদর্শনকে অনুসরণ করলে বলা যায়, প্রতিটি ভোগজনিত সিদ্ধান্তের পেছনেই রয়ে গেছে কিছুটা মায়া, কারণ আমরা সেখানে খানিক অজ্ঞানতার কারণে নিজেদেরকে যোগ্যতার অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি। কিছুটা মায়াও যদি কাটিয়ে ওঠা যায় তাহলে এই অনর্থক অহং-এর ফাঁদে পড়তে হয় না, ফলে প্রজননের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই হোক কি বিয়েবাড়ির মেনুর, একটি সর্বব্যাপী কার্যকারণ নিয়মের একটা আঁচ সাধারণ উপভোক্তারাও পেতে পারেন বইকি। মনে রাখা দরকার যে, শেষ ফল নিয়ে বৌদ্ধদর্শন কোনও আদেশ দিচ্ছে না, স্রেফ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে-কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে স্বীয়গুরুত্বকে কমিয়ে দেখতে। এ-সূত্র ধরে এগোলে বেশ বোঝা যায় ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সংখ্যালঘু জাতি বা উপজাতির প্রজনন-সিদ্ধান্ত আর স্রেফ নিজ বংশগরিমার তাড়নায় প্রজনন-সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছুটা তফাত নিশ্চয় রয়েছে। বোঝা যায়, ফাস্ট ফ্যাশনের যুগে উপমহাদেশের হতদরিদ্র শিশুশ্রমিকদের কথা মাথায় রাখলে আমাদের willingness to pay কেন বদলে যেতে পারে।
বৌদ্ধদর্শনের আরও একটি সারসত্য হল দুঃখবাদ, যা স্থায়ী নয় তাই দুঃখ। যে-যুক্তি অনুযায়ী সুখও একপ্রকার দুঃখ, বিশেষ কারণ সুখ অনিত্য। এই সূত্র অনুযায়ী চললে ভোগের যে-সিদ্ধান্ত নেহাতই সুখেচ্ছা দ্বারা চালিত তা দুঃখের কারণ, হয় নিজের নয় অন্য কোনো মানুষের। অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী এক ভোক্তা ততক্ষণ অবধি ভোগ করে যাবেন যতক্ষণ না তাঁর মার্জিনাল ইউটিলিটি আর মার্জিনাল কস্ট সমান হয়ে যায়। অর্থাৎ আর এক ইউনিট ভোগ্যবস্তু আপনি কিনে ফেলছেন কারণ শুধু সেটির পেছনে আপনার যা খরচ পড়ছে, উপযোগিতা আসছে তারও বেশি, সামান্য বেশি হলেও বেশি। ফ্রি লাঞ্চ বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে তাহলে আপনি ততক্ষণই খেয়ে যাবেন যতক্ষণ না আপনার শরীর বা মন অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বৌদ্ধদর্শন অনুযায়ী চললে কিন্তু আপনার আরও অনেক আগেই থামা উচিত, কারণ শুরুর কিছুটা সময় বাদ দিলে বাকি সময়জুড়ে আপনি নেহাতই ইন্দ্রিয়সুখ পাওয়ার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। এক হিসাবে হয়তো এই সূত্র প্রাকৃতিক সম্পদের পুনর্বণ্টনের গুরুত্বটিকে মনে করিয়ে দেয়। আজ যখন সাগর-মহাসাগর জুড়ে মাছের আকাল, অর্থকরী শস্যের ফলন হেতু জলের আকাল, আকাল পুষ্টিকর খাদ্যের, তখন নেহাত ইন্দ্রিয়সুখের তাড়নায় পঁয়ত্রিশ প্লেট মেনু নিয়ে বসলে দুঃখের বসতি বাড়বে বই কমবে না।
ওপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে— সমাজবিজ্ঞানীদের ব্যক্তিমানসের ওপর বিশেষ ভরসা না থাকলেও ধর্মপ্রচারকদের আছে। অ্যাডাম স্মিথের মতন সমাজবিজ্ঞানী, যিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব নিয়ে বারংবার কলম ধরেছেন তিনিও বিশ্বাস করতেন প্রকৃতি ঠিক করে দিয়েছে কে কতটা আত্মনিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে। আর সেই কারণেই তাঁকে শেষমেশ ভরসা রাখতে হয়েছে বাজারের অদৃশ্য হাতের ওপর, যা মানুষকে সঠিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে— বাজার ঠিক করে দেবে প্রতিটি মানুষের ঠিক কতটা পণ্য ভোগ করা উচিত। বাজারের অদৃশ্য হাত অবশ্য সামাজিক মঙ্গলকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না, যে-কারণে সিগারেটের ওপরে সরকারকে কর বসাতে হয় অথবা আইন করে নিষিদ্ধ না করা অবধি এমনকী চাইল্ড-পর্নোগ্রাফিরও একটি বাজার থাকে! ধর্মের কথায় ফিরি, একটু আগেই বলছিলাম যে ধর্মপ্রচারকরা কিন্তু ব্যক্তিমানসের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। গৌতম বুদ্ধের মতন প্রচারকরা জানিয়েছেন অজ্ঞানতার অন্ধকার কেটে গেলে মানুষ অবশ্যই সুসিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কিন্তু যদি এ-অন্ধকার না কাটে বা সুশিক্ষা পেয়েও যদি মানুষ ইতির দিকে না ঝুকে নেতির দিকে ঝোঁকেন, তখন কী করণীয়?
ইসলাম ধর্মে যে-কারণে জ্ঞানের পাশাপাশি কর্মও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সঠিক জ্ঞানপ্রাপ্তিতেই যে ব্যক্তিবিশেষের কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে তা নয়, কাজের কাজটা হচ্ছে কি না সেটাও খুঁটিয়ে দেখতেই হবে। ইহুদি ধর্মেও কর্মই শেষ কথা, শারীরিক অক্ষমতা হেতু নিতান্ত অপারগ না হলে কর্মের থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। গর্হিত কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, জন্মান্তর-কর্মফল এরকম কতই না ইনসেন্টিভ, কতই না ভ্রুকুটি! ভাল এবং মন্দের যে বাইনারি, সেটিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই সমস্ত ধর্মে দেখা হয়েছে, যাতে ভালমন্দ সব কাজই করে যাওয়ার আবশ্যিক কোনও কারণ না থাকে। রামকৃষ্ণ তাঁর সহজ কথায় যেরকম বলেছিলেন ‘ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত— মৌমাছির মতো। মৌমাছি ফুল বই আর কিছুতে বসবে না। মধুপান বই আর কিছু পান করবে না। সংসারীভক্ত অন্য মাছির মতো, সন্দেশেও বসছে, আবার পচা ঘায়েও বসছে। বেশ ঈশ্বরের ভাবতে রয়েছে, আবার কামিনী-কাঞ্চন লয়ে মত্ত হয়।’ অর্থাৎ, কর্মজ্ঞান থেকে বিচ্যুত হলে তিরস্কার থেকে নরকগমন সবেরই দরজা খোলা রয়েছে। কিন্তু হিন্দুধর্মের মতন কিছু ধর্ম মেনে নেয় যে ভোগের পথ ধরে ফেলা মানেই সব শেষ নয়। সংস্কারের পথও খোলা আছে। কখনও সংস্কার আসে ‘প্রায়শ্চিত্ত’-র মতন নিদানের হাত ধরে— অত্যধিক ভোগে মন দিয়ে ফেললে কৃচ্ছ্রসাধন করা আবশ্যিক। কিন্তু বহু সময়েই দেখা যায় ‘প্রায়শ্চিত্ত’-র কিছু নির্দিষ্ট মূল্যও আছে— কখনও গোদান করতে হচ্ছে, কখনও অন্ন তুলে দিতে হচ্ছে ক্ষুৎপীড়িতের মুখে। এক হিসাবে এ যেন ট্যাক্সের প্রক্সি বিশেষ। হিন্দুধর্মের লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনপন্থীরা আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বলবেন যে, জন্মান্তর, স্বর্গ-নরক এসব কিছুই নেই। যাজ্ঞবল্ক্যর কথাকে আপ্তবাক্য মেনে চার্বাকপন্থীরা জানাবে্ মৃত্যুর পর কোনো চেতনা নেই, সুতরাং কর্মবিচ্যুতির যা হিসেব তা বেঁচে থাকত,-থাকতেই চুকিয়ে ফেলা দরকার। লোকায়ত দর্শনে কর্মবিচ্যুতির একমাত্র ফল যন্ত্রণা। যতক্ষণ না আনন্দের থেকে যন্ত্রণার পরিমাণ বেশি হচ্ছে ততক্ষণ মানুষ ভোগ করে যেতেই পারেন। এবং সে যন্ত্রণাকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা দরকার। নরকের কড়াইতে ভাজা-ভাজা হওয়ার যন্ত্রণাকে চার্বারকপন্থীরা কিছুতেই মানবেন না। তাই কর্তব্যজনিত কোনও উপদেশ লোকায়ত দর্শনে দেখি না, বরং মানুষের নিজস্ব বিচারবুদ্ধির ওপরেই চার্বাকপন্থীরা ভরসা রাখেন। অর্থাৎ, লোকায়ত দর্শনের অন্তর্নিহিত যুক্তি অনুযায়ী প্রত্যক্ষ যন্ত্রণা না পেলে (বা দেখলে) কোনটা ইতি আর কোনটা নেতি, সে নিয়েই যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ থাকে।
পিকদানি বা রেকাবি দেখে হয়তো অধিকাংশ মানুষ এখনও বিচলিত হবেন না। কিন্তু এ-কথা সত্যি যে, পৃথিবী নামক গ্রহটি যতই বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এক প্রত্যক্ষ যন্ত্রণা কিন্তু নয়-নয় করে বহু মানুষকেই ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে। অপরিসীম ভোগ যে আর সম্ভবপর নয়, সে-কথা আমরা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের কাজে কি তার প্রতিফলন ঘটছে? সম্ভবত নয়। হতে পারে অর্থনীতির ভাষায় আমরা এক ‘প্রিজনার’স ডিলেমা’ সাম্যাবস্থায় আটকে পড়েছি— সহযোগিতার কথা না ভেবে নিজস্ব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে প্রত্যেকের ভাগে ক্ষতির পরিমাণই বেশি পড়ছে। এই সাম্যাবস্থায় আমরা আটকে পড়েছি অজ্ঞানতাবশত নয়, বরং চূড়ান্ত যুক্তিবাদের পরাকাষ্ঠা হেতু। অর্থনীতির মতন সমাজবিজ্ঞান দেখাতে পারছে নেতিবাচক ফলটি কী, কিন্তু এখান থেকে উদ্ধারের আশু কোনও পথ বাতলাতে পারছে না। ধর্মশাস্ত্রগুলি কিন্তু এ-বিষয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। একুশ শতকের সামাজিক কাঠামো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই ধর্ম নিয়ে আমাদের সন্দিহান করে তোলে। কিন্তু ধর্মের খোলসটি পরিত্যাগ করে দর্শনটিকে গ্রহণ করলে কিছু দিশা এলেও আসতে পারে। হাজার তিনেক বছর আগে যে শাণিত মস্তিষ্ক জানিয়ে গেছে ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’, তাকে আরেকটু এক্সপ্লোর করলে ক্ষতি কী?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র