ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শব্দ ব্রহ্ম দ্রুম: পর্ব ৬


    রূপম ইসলাম (December 17, 2022)
     

    পর্ব ৫

    ব্রহ্মের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন প্রোফেসর লতিকা— আছে আছে, হিংস্রতার অনেক প্রমাণই আছে। এই অঞ্চলের আবহেই মিশে আছে অদ্ভুত এক রুক্ষতা। আবহাওয়ার খ্যাপামির জন্য বারবার যেমন জাহাজডুবি হয়েছে, তেমনই মার্কামারা এখানকার অধিবাসীদের হিংস্র স্বভাব। সেই অধিবাসী শুধু মানুষ কে বলল? এখানকার সমুদ্র সৈকতে আপনি যখন তখন হিংস্র কুমীরের শিকার হতে পারেন। ঘটেছেও তেমন ঘটনা। এ অঞ্চলের চিংড়িও অতিকায় এবং স্বভাবগতভাবে অন্য চিংড়ির তুলনায় আলাদা। এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এখানকার বিরাট মেগাপড পাখির কথা তো নিশ্চয়ই শুনেছেন, স্নেহহীন এক পাখি-মা। ডিম পেড়ে মেগাপড মা চলে যায়, তার বাচ্চাদের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। আর এই যে কাঁকড়া খাচ্ছি— অন্য এক জাতের কাঁকড়া আমাদেরই যখন তখন ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে, তা জানেন কি? ওই রাক্ষুসে কাঁকড়ার নাম হল ‘কোকোনাট ক্র্যাব’! বিরাট আকারের কাঁকড়া! আন্দামানের জঙ্গুলে দ্বীপগুলোতে নারকেল গাছের মাথায় চড়ে নারকেল ফাটিয়ে খায় এরা। ভাবতে পারছেন? 

    এরিক এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার বললেন— হুম… বুঝলাম। একটা হিংস্রতার পরিবেশ আছে এখানে। কিন্তু সেটার পেছনে কি অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছেন মাদাম? সন্দেহজনক কিছু?

    — ইয়েস। এইবারে আমার সিদ্ধান্তে আসা যাক।— নিজের কোলে আলগোছে রাখা কাগজপত্র ভরতি ফাইলটা খামচে ধরে বললেন লতিকা। মতপ্রকাশের উত্তেজনায় তাঁর উজ্জ্বল ত্বক আরও চকচক করে উঠল— আমার মনে হয়, এখানেই এক বা একাধিক জায়গায় এক রকম রিঅ্যাকটর লুকনো আছে, ধরনটা যাদের পারমাণবিক। যদিও প্রতিটি রিঅ্যাক্টরেরই বয়স যে সমান , প্রতিটিই প্রাগৈতিহাসিক, তা বলছি না। তবে এদের মধ্যে যে কোনও একটার উপস্থিতি খুঁজে পেলেই আমরা অতীতের দিকে আরও খানিকটা হাঁটতে পারব। আরও কিছু অতিপার্থিব নিরীক্ষা খুঁজে পাব। নিরীক্ষাটা কী জাতীয়? দেখুন, এবারে যেটা বলছি তার কোনও প্রমাণ কিন্তু আমি দিতে পারব না। এটা আমার পারিপার্শ্বিক প্রমাণলব্ধ অনুমান বলেই ধরে নিন। কিন্তু আমার মতে, এই অনুমান ছাড়া আর কোনওভাবেই এত মানুষের এটুকু জায়গায় সন্নিবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাবে না। নতুন প্রজাতির পাশবিক এবং হিংস্র মানুষ তৈরি করবার জন্যই বিভিন্ন মানুষকে জড়ো করা হয়েছিল এখানে। জড়ো করা হয়েছিল আদিম যুগ থেকেই। আর এই কাজটা কী উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তা বোঝা না গেলেও, কারা করে এসেছে, পরবর্তীকালেও জাহাজডুবির মাধ্যমে মানুষের সরবরাহ জারি রেখেছে কারা— সেটা আশা করি বুঝতে পারছেন এবার। হ্যাঁ, আমি ভিনগ্রহী যোগাযোগের কথাই বলছি। ভিনগ্রহীরা হয়তো তাদের হিংস্রতার মডেলেই নতুন ধরনের সংকর মানুষ তৈরি করতে চেয়েছিল, হয়তো সেই মানুষদের উপর তারা আরোপ করতে চেয়েছিল নিজেদের চারিত্রিক আদল! অন্যান্য প্রাণীদের উপরেও এই হিংস্রতার প্রভাব যে একটা পড়েছে, সেটা কোল্যাটারাল ড্যামেজমাত্র, বা বলতে পারেন সাইড এফেক্ট। তবে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা আনুমানিক হলেও ভিনগ্রহী যোগাযোগ যে ছিল এবং আজও হয়তো আছে, এই কথাটা নিতান্ত অনুমান মোটেই নয়! এই পারমাণবিক রিঅ্যাকটরগুলোই তো ভিনগ্রহীদের সঙ্গে এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক যোগাযোগের একটা বড় প্রমাণ! এবার বলি, কী করে জানতে পেরেছি এই সব লুকনো রিঅ্যাকটরের কথা। এগুলো থেকে মাঝেমাঝেই পরিবেশে অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া ছড়িয়েছে। খুব অনিয়মিতভাবে কিছু অ্যাগ্রেসিভ শব্দতরঙ্গ হঠাৎ হঠাৎ ধরা পড়েছে, যার একদম সঠিক উৎসস্থল আজও লোকেট করা যায়নি। কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জের পরিসীমার মধ্যেই  যে এর উৎপত্তি, তা বোঝা গেছে। অপার্থিব উৎসের এই তরঙ্গগুলো ধরা পড়েছে নৌসেনার রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থায় আকস্মিক ইন্টারফেরেন্স হিসেবে। আমি এই শব্দতরঙ্গের বিবরণ জেনেছি। মনে হয়েছে অফুরন্ত পারমাণবিক শক্তির আধার এই সাউন্ডওয়েভ। আবার বলছি— এর উৎপত্তিকেন্দ্র আবিষ্কৃত হলে দেখা যাবে তা হল এক অপরিসীম শক্তিসম্পন্ন এনার্জি রিঅ্যাকটর। শব্দতরঙ্গ প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় নিউক্লিয়র ফিউশন ঘটিয়েছে— অবশ্যই এটা সমাপতন বা কোইনসিডেন্স। আমি এটা নিয়ে লিখেওছি একটা ম্যাগাজ়িনে। শুনুন, এটা শুধু আজকের গবেষণার বিষয় নয়। এই তো, খুঁজতে খুঁজতে আমি জানলাম ১৯৭৬ সালে লেখা এক বাংলা উপন্যাসে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক লেখেন জারোয়াদের দ্বীপে অতিপার্থিব কিছু একটা আছে। সেই গল্প থেকে সিনেমাও হয়েছিল। আপনারা তো বাঙালি, সেই গল্প পড়েননি বা সিনেমাটা দেখেননি?

    এরিক বললেন— বুঝতে পারছি আপনি বলতে চাইছেন সেই ঔপন্যাসিকও আন্দামান বেড়াতে এসে এ’রকম একটা কিছু আঁচ করেছিলেন, তারপর তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পেয়ে গল্পচ্ছলে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখেন।

    প্রোফেসর লতিকা এতক্ষণ একটানা কথা বলেছেন। এবারে তাঁর সামনে রাখা কফির কাপে একটা চুমুক দিয়েই মুখটা বিকৃত করে ফেললেন। এহে, একেবারে ঠান্ডা জল হয়ে গেছে। বেয়ারা রামেশ্বরকে ডেকে আরেকপ্রস্ত কফির অর্ডার দিলেন। তারপর ফাইল খুলে বের করে আনলেন বেশ বড় সাইজের প্রিন্ট করা দুটো ছবি। বললেন— এবার তাহলে ভিনগ্রহীদের সঙ্গে এখানকার অধিবাসীদের, যাদের আমি চিহ্নিত করতে চাইছি অতিপার্থিব এক এক্সপেরিমেন্টের প্রোডাক্ট হিসেবে, যোগাযোগের একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়েই ফেলা যাক, কী বলুন? আমি একদম এই আলোচনার শুরুতে বলা আমার কথাটায় ফিরে যাচ্ছি। মনে আছে কী প্রশ্ন করেছিলাম! ‘টকৈ ট্যাবু’ জিনিসটা আসলে কী? এই যে! দেখুন এখানে! এই হল সেই টকৈ ট্যাবু! সবাই দেখতে পাচ্ছেন এই ছবিটা?

    লতিকাদেবীর হাতে ধরা  আলোকচিত্রের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ উপস্থিত সবার। বেশ পুরনো একটা সাদা কালো ফটোগ্রাফ। ছবিতে দেখা যাচ্ছে— তিনকোণা উলটো ত্রিভুজের মতো গাছের ডালে বাঁধা তিনজোড়া ডাবের অদ্ভুত এক ফর্মেশন। প্রোফেসর লতিকা বললেন— ছবিটার মধ্যে যে এই যে নারকেল বা ডাবগুলো দেখছেন, এসব কিন্তু মানুষের প্রতি নিবেদিত নয়। কোনও মানুষ এগুলো খেয়ে ফেললে তাকে আদিমদের সমাজে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হয়। মানে এই ডাব খাওয়া হল নিষিদ্ধ, বা ট্যাবু। আমার কথা হল, এই যে উঁচু ডালে ডাব বেঁধে রাখা হয়েছে, এটা কার জন্য?

    ক্ষিপ্র হাতে লতিকাদেবী প্রথম ছবিটার তলায় লুকনো অন্য ছবিটা এবার বের করে আনলেন। এটা একটা রঙিন ছবি। লতিকা বললেন— এবার আপনাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে এই ছবিটা। আগের ছবিটা এবং এটা, দুটোই তুলেছিলেন বিখ্যাত আলোকচিত্রী মধু মাথুর। এই ছবিটা বহু জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে। বলা যায় না, আপনারা আগে দেখেও থাকতে পারেন। তবে এর গল্প নিশ্চয়ই আপনাদের অজানা। এই ছবির গল্পেই আসলে লুকিয়ে আছে আমার করা আগের প্রশ্নের উত্তর

    ক্ষিপ্র হাতে লতিকাদেবী প্রথম ছবিটার তলায় লুকনো অন্য ছবিটা এবার বের করে আনলেন। এটা একটা রঙিন ছবি। লতিকা বললেন— এবার আপনাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে এই ছবিটা। আগের ছবিটা এবং এটা, দুটোই তুলেছিলেন বিখ্যাত আলোকচিত্রী মধু মাথুর। এই ছবিটা বহু জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে। বলা যায় না, আপনারা আগে দেখেও থাকতে পারেন। তবে এর গল্প নিশ্চয়ই আপনাদের অজানা। এই ছবির গল্পেই আসলে লুকিয়ে আছে আমার করা আগের প্রশ্নের উত্তর।— লতিকা থামলেন একটু। দু’একটি মুহূর্তের নীরবতার সুযোগে পাশের কিচেন থেকে ভেসে এলো বাসনপত্রের টুংটাং শব্দ।

    সবাই চুপ করে আছেন দেখে লতিকা আবার বলতে শুরু করলেন— এটা এখানকার আদিবাসীদের একটা উৎসবের ছবি। উৎসবের নাম হল ‘খারাওগাঁও’, যার উল্লেখ আমি আগেই করেছি। প্রায় নগ্ন নারীপুরুষের এই ভিড়টার পেছনে খেয়াল করে দেখুন, সমুদ্রের ধারে একটা তিনকোণা বাঁশের স্ট্রাকচার কি দেখতে পাচ্ছেন?

    এরিক দত্ত এবং বিলি গিলচার ঝুঁকে পড়লেন ছবিটার দিকে। এরিক বললেন— হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। খুব স্পষ্ট নয়। মানুষের উপরেই ফোকাস। কিন্তু পেছনে একটা স্ট্রাকচার দেখা যাচ্ছে বটে। তবে তেপায়া স্ট্রাকচারটার উপরে ওটা কী রাখা আছে বলুন তো? ওহ্ মাই গড! নৌকো? একটা আস্ত নৌকো?

    — হ্যাঁ। ঠিকই দেখেছেন। ত্রিভুজ বাঁশের কাঠামোটার ওপর ব্যালেন্স করে রাখা আছে একটা নৌকা। আর নৌকোর মধ্যে বোঝাই করা আছে খাবারদাবার। কিন্তু এসব তো আর বিনা কারণে করা হয় না! এই খাদ্যবোঝাই জাহাজের আসল উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো ড: ঠাকুর?

    প্রশ্নটা করেই প্রোফেসর লতিকা সুব্রহ্মণ্যম জানলার দিকে তাকালেন। কিন্তু কোথায় ব্রহ্ম ঠাকুর? একটু আগে তো ওখানেই কফির কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি! এখন দেখা গেল কাপটি জানালার খোপে রেখে তিনি কোথাও উধাও হয়ে গেছেন। 

    এরিক দত্তকে লতিকা সুব্রহ্মণ্যম জিজ্ঞেস করলেন— এ কী ব্যাপার? কথা চলতে চলতে কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল আপনাদের বেঢপ আলখাল্লা পরা অদ্ভুত বন্ধুটি?

    এরিক জানলার দিকে পেছন ফিরে বসেছিলেন। তিনিও দেখতে পাননি ব্রহ্ম কখন চলে গিয়েছেন। তিনি একটু অপদস্থ হয়েই বললেন— ওঁর কথা ছাড়ুন। ওঁর একটু মাথাখারাপ, নিয়মিত মানসিক চিকিৎসা চলছে…

    লতিকা চোখ কপালে তুলে বললেন—- ওহ, তাই নাকি? আমারও একদম পছন্দ হচ্ছিল না ওকে। কী রকম যেন অতিবিজ্ঞ, ‘আমি তো সবই জানি’ হাবভাব! তা সবই জেনে বসে আছ যখন, এসেছ কেন আমার কাছে?

    এরিক অস্থির হয়ে বললেন— ওঁর কথা ছাড়ুন না! আপনি বরং বলুন— কী উদ্দেশ্যে খাবার সাজিয়ে রাখা হয় তিনকোণা বাঁশের উপরে রাখা নৌকায়?

    লতিকা বললেন— হ্যাঁ বলছি। ১৯৭২ সালে দু’টি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল আন্দামান ও নিকোবর নিয়ে। সেগুলি আমার সংগ্রহে আছে, আপনারা দেখতে পারেন। সেখানে এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্যটি আদিবাসীদের ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করে বলা হয়েছিল। সেখানে কী বলেছিল জানেন? বলেছিল— ‘খারাওগাঁও লিটারালি মিনস— সেন্ডিং অ্যাওয়ে দ্য এলিয়েনস ব্যাক টু দেয়ার নেটিভ ল্যান্ডস’। অর্থাৎ ভিনগ্রহীদের কিছু খাদ্য দিয়ে বলা হচ্ছে, আর এসো না। বিদেয় হও।

    এরিক বললেন— কিন্তু মাদাম লতিকা, এটার ব্যাখ্যা ভিনগ্রহী না হয়ে বিদেশী আগন্তুকও তো হতে পারে! বিদেশী নাবিককে ‘এলিয়েন’ বলা যায় না? নিশ্চয়ই যায়!

    লতিকা মুচকি হেসে বললেন— এরিক, যারা বিদেশী কাউকে তীরের কাছাকাছি আসতে দেখলেই বিষাক্ত তির মারে, তারা হঠাৎ উঁচু তিনকোনা বাঁশের স্ট্রাকচারে তাদেরই জন্য খাদ্য সাজাবে—ব্যবহারটা পরস্পরবিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? তাই জন্যই আমার ব্যাখ্যায় ‘এলিয়েন’ মোটেই ভিনদেশী নয়, ‘এলিয়েন’ হল আমরা যা বুঝি তা-ই। ‘এলিয়েন’ হল ভিনগ্রহী। আর আমার চোখে ওই তিনকোণা বাঁশের কাঠামোটা একটা মহাকাশযানের আদিম মডেল ছাড়া অন্য কিছুই নয়।

    (ক্রমশ)

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook