দিল্লি কা লাড্ডু
কী আনলে? খাবার? এ কী, কিছুই আনোনি? একটু বাসি কাবাব-ও না?’
দিন চারেক অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দিল্লি গিয়েছিলাম, শো করতে। ফেরার পর-পরই ম্যানেজিং এডিটর মহাশয়ার এই সুরেলা, তীক্ষ্ণ তিরস্কার। ছোট্ট অফিস হলে কি হবে, আমরা জেনুইন খাদ্যরসিক; এ-সব ব্যাপার সিরিয়াসলি নিই! মনে-মনে নোট করে রাখলাম, পরের বার দিল্লি-ফেরতা খুচরো খাবার কী নিয়ে আসা যায় তা একটু জেনে, আগে-ভাগে জোগার-যন্তর করে রাখতে হবে, নয়তো পেস্টিজ পাংচার।
শহরের বাইরে ঝটিকা-সফরে গান-বাজনা করতে যাওয়া দু-দু বচ্ছরে এই সদ্য চালু হয়েছে; এই সিজনটা চলবে বলেই মনে হয়। মাঝে রাঁচি গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে হোটেলের বাইরে খাওয়ার কোনো সুযোগই পাইনি। দিল্লি গিয়েও যে ঘুরে-ফিরে অনেক সময় পাওয়া যাবে এমন দুরাশা ছিল না, তবে কিছু জায়গায় খেতে হবে, এ-রকম একটা প্ল্যান করে রেখেছিলাম। এবং সেটা জামা মসজিদ বা নিজামুদ্দিন নয়, যা অতুলনীয়।
মুশকিল হচ্ছে, দিল্লিতে খুচরো খাবার বলতে যা বোঝায়, সেটা এই দুটো জায়গা ছাড়া মেলা ভার। দক্ষিণ দিল্লি অগ্নিমূল্য। কিছু-কিছু ‘খুচরো’ খাবারের যা দাম, তা দিয়ে কলকাতায় মোটামুটি দু-বেলা খাওয়া হয়ে যাবে। সি আর পার্কে রাস্তার দোকান থেকে চারজনে লেবু চা খেলাম, ধাঁই করে ১৬০/- খরচ হয়ে গেল! ওলা-উবেরে উঠলেই ৫০০/-। ওদিকে রোজগার তো ঘরের-খেয়ে-বনের মোষ!
এ-হেন পরিবেশে, দিল্লিতে খাওয়ার শুরুটা হল সাকেতের সার্বণ্যা ভবনের দোসা দিয়ে, যা প্যাক করে এলেও বড্ড ভালো, বিশেষত দোসার সাথে টা-গুলো! আমি যে-শহরেই যাই, চান্স পেলে একবার দোসাটা চেখে দেখি; সাংবাদিক জীবনে সময়ের অভাবে পেট ভরানোর অভ্যাস তো! ডিফেন্স কলোনি মার্কেটে সাগর রত্ন নামে দক্ষিণি রেস্তোরাঁ আমার খুব পছন্দের; সার্বণ ভবনের দোসা আর ইডলিও প্রায় কাছাকাছি মানের বা একটু ছাপিয়েও যেতে পারে, খেয়ে আমার তা-ই মনে হল। সম্বর-রসমটা তো নির্ঘাৎ!
এই রেগুলার, অভ্যাসের খাওয়া-দাওয়া তো আছেই, কিন্তু দিল্লি গেলেই আমার যেটা মনে হয় সেটাকে এক কথায় ‘ডাইভার্সিটি’ বলা চলে। আই আই টি ক্যাম্পাসের গায়ে সারি-সারি দোকানের বাটার চিকেন, মজনু কা টিলার আফগানি চিকেন সহযোগে অল্প মিষ্টি শিরমল, বা গ্রিন পার্কের নাগাল্যান্ড কিচেনের বহুল প্রশংসিত নাগা পর্কের পাশাপাশি এই দিল্লিতেই খেয়েছি হউজ খাসের ‘গানপাউডার’রেস্তোরাঁয় কুড্ডি পরোট্টা আর বিফ ফ্রাই, খান মার্কেটে ‘নিমথো’ নামের ‘হিমালয়ান রেস্তোরাঁ’য় কব্জি ডুবিয়ে আদ্যন্ত সিকিমি লাঞ্চ করেছি, আর নেপালি খাবার যে ‘ফাইন ডাইনিং’-এর পর্যায় নিয়ে চলে যাওয়া যায়, তা বুঝেছি জি-কে-২-এর এম ব্লক মার্কেটে ‘ইয়েতি’ নামের রেস্তোঁরায়, যার সর্ষে-ইনফিউজড্ শুয়োরের ঝোলকে তুরীয় লেভেলের তৃপ্তি ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকা যায় না।
দিল্লি আসা-যাওয়া এবং খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে অবশ্য সবচেয়ে বিস্ময়জনক আবিষ্কার ছিল ‘পট বেলি’ নামক বিহারি খানার রেস্তোরাঁ। কলকাতাইয়া হওয়ার দরুন ‘বিহারী’ বিশেষণ শুনলেই প্রথমে লিট্টি-চোখার কথা মনে হয়, এবং খেতে ভালোবাসলেও, নিমতলা ঘাটের রাস্তার স্টলে না খেয়ে দশ গুণ দাম দিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে লিট্টি ইত্যাদি খাচ্ছি এই কল্পনা করে আমি একটু পিছিয়েই গিয়েছিলাম। শেষমেশ, শাহপুর জাটের এক কোনায় অবস্থিত এই ছোট্ট দোকানটা মন কেড়ে নেয়। লেবুর জল থেকেই বাউন্ডারি। অ্যাপেটাইজার হিসেবে ‘মছলি গোলি’, মাছের ছোট্ট গোল চপ; ছাতুর ছোট-ছোট পরোটা, আলু-বেগুনের চোখা, একটা অসাধারণ ডাল; ‘মাড়ুয়া’ রুটির উপর মাছের চোখা, সঙ্গে একটা তুখোড় ধনে-লংকা চাটনি। তারপর, মূল পদে চম্পারণের মাটন কষা, সঙ্গে মুগ ডালের পুরি। শেষ পাতে একটু পান্তুয়া।
গুরুগ্রামের ৩২ মাইলস্টোন নামক যে কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সে আমরা ‘দ্য পিয়ানো ম্যান’ নামের লাউঞ্জ-ক্লাবে বাজাতে গেছিলাম, ‘পট বেলি’-র ব্রাঞ্চ সেখানে দেখে মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠেছিল, যদিও বাজনার রাতে ডিনারে শুধু ছিল ‘পিয়ানো ম্যান’-এরই ফাঁকা মাঠে ২০ গোল দেওয়া-লেভেলের পেপারোনি পিজ্জা। কলকাতায় অসাধারণ পিজ্জা এক গ্র্যান্ড হোটেল বা (কিছুটা) ফায়ার অ্যান্ড আইস ছাড়া তেমন পাই না। ‘পিয়ানো ম্যান’-এর পেপারোনি পিজ্জাটা এতই ভালো ছিল যে লোভ সামলানো মুশকিল; গোটা দশেক পিজ্জার ফিরিস্তি পড়ে গিয়েছিল।
আমি যেহেতু দিল্লি গেলে সাধারণত ডিফেন্স কলোনিতেই থাকি, একটু কলোনি মার্কেটের খাওয়া-দাওয়ার কথা বলি। সাগর রত্নর কথা আগেই লিখেছি, অন্য যে জায়গাটা আমার মাস্ট-ভিজিটের লিস্টিতে পড়ে সেটা হল ‘স্বাগত’, দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের উপকূলীয় কুইজিনের স্বর্গ-বিশেষ। আমি আপ্পম সহযোগে ঘি-রোস্ট চিকেন বলে একটা মার-কাটারি ডিশ খেয়ে থাকি, তবে আর একটু কম মশলাদার চিকেন ইস্টু, সুরমাই মাছের গাসসি, কাঁকড়ার ঝাল এবং নানা রকমের চিংড়িমাছের প্রিপারেশনও এখানে অনবদ্য!
‘ডেফ কল’ মার্কেটের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এখানে রেস্তোরাঁগুলো প্রায়শই বদলে যায় (স্বাগত, ডিফেন্স বেকারি বা সাগর রত্ন ছাড়া), তাই প্রতিবারই গিয়ে কিছু না কিছু নতুন খাবারের জায়গা পেয়ে যাই। এবারে ‘আমিচি’ নামে একটা ইতালীয় কাফেতে গিয়ে চিকেন সিজার স্যালাড আর খুব ভালো এস্প্রেসো খেলাম। এর ঠিক উল্টোদিকে ‘আকু’স বার্গার’ বলে যে নতুন বার্গারের হট-স্পটটি খুলেছে, সেখান থেকে টেক-অ্যাওয়েতে বার্গার নিয়ে গেলাম, খেয়ে দারুণ লাগল।
পরের বার, রাস্তার ওপারের লাজপতনগরের ‘করাচী বেকারি’ আর দিল্লির মিষ্টি নিয়ে লিখব। লিখব, কী ভাবে নামকরা ইংরেজি কাগজের রবিবারের ম্যাগাজিনে নিয়মিত এক খাদ্য কলামনিস্টের খাদ্য-সংক্রান্ত বক্তব্য আমার কাছে অবান্তর হয়ে উঠেছিল।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র