ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • একটা আদর্শের মৃত্যু


    অরুণ কর (December 9, 2022)
     

        ছোটবেলায় আমরা ন্যাপাদার খুব ভক্ত ছিলাম। ফটাসগলি সুভাষ ক্লাবের সামনে সাবেকি দোতলা ভাড়াটে বাড়ির একতলায় ন্যাপাদার ছোট্ট পাউরুটি আর লজেন্সের দোকান ছিল। আসলে ক্লাবটার নাম ছিল সুভাষ ক্লাব, কিন্তু সে সময়ে পাড়ায় পাড়ায় সুভাষ বসুর নামে এত ক্লাব গজিয়ে উঠেছিল যে জায়গার নাম না বললে লোকে গুলিয়ে ফেলত। ওই গলির শেষমাথায় একটা লেমনেডের কারখানা ছিল, বোতল খোলার সময় ফটাস করে শব্দ হত বলে লোকের মুখে মুখে জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছিল ফটাসগলি।

       পাড়ার ছেলে-বুড়ো, সকলেই, এমনকী আমার বাবা-কাকারা পর্যন্ত ওঁকে ‘ন্যাপাদা’ বলে ডাকত। কাঁচাপাকা কদমছাট চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গোড়ালির ওপরে-ওঠা ঢোলা পাজামা, হাতকাটা ফতুয়া আর পায়ে কাঠের খড়ম, প্রৌঢ় ন্যাপাদা ছিলেন আমাদের ফটাসগলির আইকন। লোকে বলত, এলাকার মুশকিল আসান। 

       কোনও বাড়িতে কারো শরীর খারাপ হয়েছে, ন্যাপাদা খড়ম খট খট করতে করতে চললেন অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে। কারও বাড়িতে কল খারাপ হয়ে গেছে, ন্যাপাদা খুঁজে পেতে ধরে নিয়ে এলেন কলের মিস্ত্রি। কারও বাড়ির সামনে মরা কুকুর পড়ে আছে, দোকান ফেলে ন্যাপাদা খট খট করে চললেন, কর্পোরেশনের সাফাইকর্মী ধরে আনতে। স্ট্র্যাপবিহীন কাঠের খড়মের সামনে লাগানো একটা গোল-মাথা কাঠের দন্ডকে পায়ের দু’ আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে উনি সর্বত্র চষে বেড়াতেন।  

    অসম্ভব ভালো খেললেও ওঁর ফিনিশিংয়ে সমস্যা ছিল। এক হিটে বোর্ড প্রায় ক্লিয়ার করেও শেষ গুটিটা কিছুতেই ফেলতে পারতেন না। ফলে প্রায় প্রতিদিনই হারতেন। জেতার পুরষ্কার হিসেবে একখণ্ড বাসি পাউরুটি আমাদের বাঁধা বরাদ্দ ছিল। আমাদের মতো রিফিউজি বাড়ির ছেলেছোকরাদের সারাক্ষণ আগুনে খিদের মুখে ওই এক টুকরো পাউরুটি ছিল সাক্ষাৎ অমৃত।

      আমাদের মতো কচিকাঁচারা অবশ্য ন্যাপাদার ভক্ত ছিলাম অন্য কারণে। ওঁর দোকানে খুব একটা বিক্রিবাটা হত না বলে আমরা সকাল-বিকেল দোকানের সামনেই ক্যারামবোর্ড পেতে খেলতাম। কোনওদিন খেলুড়ে কম পড়লে উনি নিজেই আমাদের সঙ্গে খেলতে লেগে যেতেন। সে সময় কোনও খদ্দের এলে গম্ভীর মুখে ‘বিককিরি নেই’ বলে সোজা হাঁকিয়ে দিতেন। 

      অসম্ভব ভালো খেললেও ওঁর ফিনিসিংয়ে সমস্যা ছিল। এক হিটে বোর্ড প্রায় ক্লিয়ার করেও শেষ গুটিটা কিছুতেই ফেলতে পারতেন না। ফলে প্রায় প্রতিদিনই হারতেন। জেতার পুরষ্কার হিসেবে একখণ্ড বাসি পাউরুটি আমাদের বাঁধা বরাদ্দ ছিল। আমাদের মতো রিফিউজি বাড়ির ছেলেছোকরাদের সারাক্ষণ আগুনে খিদের মুখে ওই এক টুকরো পাউরুটি ছিল সাক্ষাৎ অমৃত।

        আমাদের আরেকটা আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ন্যাপাদার দোকানের গলে জমাট-বাঁধা লজেন্স। বিক্রি হত না বলে সেগুলো তিনি অকাতরে দান করতেন। তবে সেই দেওয়ার ভঙ্গিটি ছিল ভারি অদ্ভুত। দোকানের সামনে আমাদের ঘুর ঘুর করতে দেখলেই ডেকে গম্ভীর মুখে বলতেন, চোখ বন্ধ করে দাঁড়া। হ্যাঁ, এবার বড়ো করে হাঁ করে দাঁড়া। 

       তার পর মুখের মধ্যে দলা পাকিয়ে-যাওয়া লজেন্সের মণ্ডটা ফেলে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠতেন। টক-ঝাল-মিষ্টির সঙ্গে কমলা কিংবা আম লজেন্স মেশানো সেই মণ্ডের বিচিত্র স্বাদ আমাদের নেশার মতো টানত। 

       ন্যাপা-বৌদি পাড়ার মেয়েদের নানারকম হাতের কাজ শেখাতেন। আচার, বড়ি, পাঁপড়, ফুচকা, নানারকম সেলাই-ফোঁড়াই, এসব শেখানোর ইস্কুল খুলেছিলেন তিনি। রিফিউজি পরিবারের মেয়েদের তৈরি সেসব জিনিস ন্যাপাদা নিজে দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতেন।

    মাঝে মাঝে গোলাগুলির আওয়াজও ভেসে আসত। আর ছিল টহলদারি পুলিশের ভারী বুটের শব্দ। মাঝে মাঝে ভ্যান থেকে নেমে তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাসি করত। বিছানাপত্তর হাটকে, বাসনপত্তর ফেলে দিয়ে, ঠাকুরের সিংহাসন উল্টে দিয়ে ওরা কী যে খুঁজত, বুঝতাম না। 

       এলাকার ঠিকে ঝি-দের নিয়ে ন্যাপা-বৌদি একটা ইউনিয়নও তৈরি করেছিলেন। তাঁদের জন্যে মাসে চারদিন ছুটি, নিয়মিত বেতনবৃদ্ধি, পুজোর-বোনাস, অসুখ হলে চিকিৎসার খরচ সহ এক গুচ্ছ দাবি নিয়ে তিনি একবার মিছিলও বের করেছিলেন। হাতে হাতে বাতিল পিচবোর্ডের ওপর আলতা দিয়ে দাবি-সনদ লেখা প্ল্যাকার্ড। কিছু না বুঝেও সেই মিছিলে ‘মানতে হবে, মানতে হবে’ স্লোগান দিতে দিতে পাড়ার মাসি-পিসিদের সঙ্গে আমরা কচিকাঁচারাও হেঁটেছিলাম। সেই প্রথম আমার মিছিলে হাঁটার অভিজ্ঞতা। পরদিন খবরের কাগজে সেই মিছিলের ছবিও ছাপা হয়েছিল।  

       সেই সত্তরের গোড়ায় আমাদের এলাকায় নকশাল আন্দোলনের খুব রমরমা ছিল। নকশাল কী, সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণাই ছিল না। শুধু দেখতাম, রাত নামলে চারদিকে অন্ধকার হয়ে যেত। পাড়ার স্ট্রিট লাইটগুলো পর্যন্ত নেভানো থাকত। কোনও কোনও দিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে শুনতাম, দুমদাম বোমা ফাটছে। মাঝে মাঝে গোলাগুলির আওয়াজও ভেসে আসত। আর ছিল টহলদারি পুলিশের ভারী বুটের শব্দ। মাঝে মাঝে ভ্যান থেকে নেমে তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাসি করত। বিছানাপত্তর হাটকে, বাসনপত্তর ফেলে দিয়ে, ঠাকুরের সিংহাসন উল্টে দিয়ে ওরা কী যে খুঁজত, বুঝতাম না। 

        কী কারণে জানি না, ন্যাপাদা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমি তখন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ফ্রি-প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে। ন্যাপাদা একদিন খুব চুপিচুপি একতাড়া কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, তোর ছোটকাকাকে দিবি। দেখিস, কেউ যেন টের না পায়।

       আমার ছোটকাকা সে সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ত। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিল বলে এলাকার সকলেই আমাদের সমীহের চোখে দেখত। তাই নিয়ে আমাদেরও গর্বের শেষ ছিল না।

    কাউকে ওর দিকে তাকাতে দেখলেই হেসে বলত, এই বেলা কিনে নাও, সস্তায় দিয়ে দেব। জামা বানাও, পাজামা বানাও, কেউ মরে গেলে বডি মুড়ে দাও, দেখবে, কী ভালো মানাবে! লং ক্লথের মত জিনিস চিনলে না! তাহলে কচুপোড়া খাও!

       এরপর থেকে ন্যাপাদা আমাকে দিয়ে বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন গোপন চিঠিপত্র পাঠাতেন। 

       এই সময়ে আমাদের এলাকায় একটা লোক কাঁধে একরাশ সাদা কাপড় নিয়ে হেঁকে যেত, ‘লং ক্লথ চাই, লং ক্লথ’। এলাকার কাউকে কখনও তার কাছ থেকে এক টুকরো কাপড়ও কিনতে দেখিনি। তবু লোকটা সকাল-বিকেল অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেই লং ক্লথের বোঝা নিয়ে এগলি-সেগলি ঘুরে বেড়াত। কাউকে ওর দিকে তাকাতে দেখলেই হেসে বলত, এই বেলা কিনে নাও, সস্তায় দিয়ে দেব। জামা বানাও, পাজামা বানাও, কেউ মরে গেলে বডি মুড়ে দাও, দেখবে, কী ভালো মানাবে! লং ক্লথের মত জিনিস চিনলে না! তাহলে কচুপোড়া খাও!

       আমরা ভাবতাম, লোকটার বুঝি মাথার ব্যামো। কিন্তু বড়োরা বলাবলি করত, সে নাকি ‘খোচড়’। তখনও ‘খোচড়’ কাকে বলে তা বোঝার বয়েস হয়নি আমাদের। রোগা ঢ্যাঙা একমুখ দাড়ি আর মাথায় লম্বা লম্বা চুল, ওকে দেখলে ভয় পেয়ে আমরা পালিয়ে যেতাম। বন্ধুদের মধ্যে যারা একটু চালাক, তারা বলত, পাগলও না, খোচড়ও না, লোকটা আসলে ‘ছেলেধরা’। 

       তাতে অবশ্য আমাদের লং ক্লথ-ভীতি বাড়ত বই কমত না!

       সে সময়ে আমাদের পাড়াতে খুব মজার মজার ঘটনা ঘটত। একদিন বিকেলে ছোটকাকার বন্ধু হাবুলকাকা বারান্দায় বসে চা-মুড়ি খাচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশ ভ্যান থেকে কয়েকজন উর্দিধারী নেমে হাবুলকাকাকে জিজ্ঞেস করল, এখানে হাবুল বোস কে আছে?

       হাবুলকাকা খুব নির্বিকার মুখে মুড়ি চিবুতে চিবুতে রাস্তার উলটো দিকে রেশন ডিলার পঞ্চানন সাহার বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল, হাবুল? সিটি কলেজে পড়ে তো? ওই বাড়িতে খোঁজ করুন।

      পুলিশ পেছন ফিরতেই খিড়কি দরজা দিয়ে হাবুলকাকা পগার পার। পরে শুনেছিলাম, হাবুলকাকা নাকি নকশাল। সেই আমার প্রথম নকশাল দেখা। 

       ন্যাপাদার ছেলে ঘোতনকাকু পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিল। একদম উত্তমকুমারের মতো দেখতে, এলাকায় ভাল ছেলে বলে তার খুব সুনাম ছিল। মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে পড়তে এই ঘোতনকাকুও একদিন নিখোঁজ হয়ে গেল। 

     তা নিয়ে অবশ্য ন্যাপাদা কিংবা ন্যাপা-বৌদিকে কখনো দুঃখ করতে দেখিনি। বরং ঘোতন কাকুর প্রসঙ্গ উঠলে ন্যাপাদা গর্ব করে বলতেন, আদর্শের জন্যে একজন এতখানি ত্যাগস্বীকার করল, আর আমরা এটুকু সইতে পারব না!  

       লোকে বলত, সে নাকি নকশাল, পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে।

       ঘোতনকাকুর খোঁজে মাঝে মাঝেই ন্যাপাদার দোকানে পুলিশ এসে হানা দিত। তাঁকে নানাভাবে হেনস্থা করত। দোকানের শিশি-বয়াম ভেঙে দিত। বিছানা পত্তর, হাঁড়ি-কড়াই, গেরস্থালির সব জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করে রাস্তায় ফেলে দিত। 

       তা নিয়ে অবশ্য ন্যাপাদা কিংবা ন্যাপা-বৌদিকে কখনো দুঃখ করতে দেখিনি। বরং ঘোতন কাকুর প্রসঙ্গ উঠলে ন্যাপাদা গর্ব করে বলতেন, আদর্শের জন্যে একজন এতখানি ত্যাগস্বীকার করল, আর আমরা এটুকু সইতে পারব না!  

       যাই হোক, হাবুলকাকার ঘটনাটা শুনে ন্যাপাদা সেদিন খুব হেসেছিলেন। বলেছিলেন, অ্যা! নকশাল যেন সরকারের মাইনে-করা চাকর, পুলিশের মতো উর্দি পরে ধরা দেওয়ার জন্যে বসে আছে! যত্তোসব আহাম্মকের দল! 

      আমাদের ফটাসগলির মুখে একটা পেল্লাই বাড়ি ছিল। সামনে গাড়ি-বারান্দা, ‘গেটে কুকুর হইতে সাবধান’ লেখা সতর্কবাণী। পথেঘাটে রিফিউজিদের দেখলে কথা বলা দূরে থাক, ও বাড়ির লোকেরা বিষ্ঠা দর্শনের মতো ঘেন্নায় মুখ ঘুরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। সেই বাড়িতে অতসী পিসিরা থাকতেন। সেই শৈশবে অতসী পিসিকে দেখলে মনে হত যেন ঠাকুমার গল্পের  পরী।

    আমার হাত থেকে অতসী পিসির দেয়া খামটা পেয়ে খুব অবাক হয়েছিল ছোটকাকা। বর্ষণ-ক্ষান্ত বিকেলের মেঘ ফুঁড়ে বেরনো লালচে আলোয় কেমন এক উদাস-বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠেছিল তাঁর মুখে। আমার হাতে গোটা একটা আধুলি গুঁজে দিয়ে বলেছিল, কাউকে বলিসনে যেন। 

      সেই অতসী পিসি একদিন আচমকা আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, রোহিত কি তোর কাকা?

      তারপর দেখা হলেই তিনি আমার সঙ্গে সেধে কথা বলতেন। ছোটখাট উপহারও দিতেন মাঝে মাঝে। ক্রিম দেয়া বিস্কুট, নরম চকোলেট কিংবা লাল টুকটুকে ক্যাম্বিস বল হাতে পেলেই মনে হত, আমার ছোটকাকা যে সে মানুষ নয়!

      একদিন অতসী পিসি খুব চুপিচুপি একখানা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোর ছোটকাকাকে দিস। দেখিস, কেউ যেন জানতে না পারে। 

       আমার হাত থেকে অতসী পিসির দেয়া খামটা পেয়ে খুব অবাক হয়েছিল ছোটকাকা। বর্ষণ-ক্ষান্ত বিকেলের মেঘ ফুঁড়ে বেরনো লালচে আলোয় কেমন এক উদাস-বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠেছিল তাঁর মুখে। আমার হাতে গোটা একটা আধুলি গুঁজে দিয়ে বলেছিল, কাউকে বলিসনে যেন। 

      ওই একটা আধুলি দিয়ে আমরা চার বন্ধু সেদিন বিকেলে মাংসের ঘুগনি খেয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবার।  

      দিন তিনেক পরে শেষ রাতে পুলিশ আমার ছোটকাকাকে ঘুম থেকে তুলে ধরে নিয়ে গেল। আমার ঠাকুমার কান্না আর বাবার ভীতসন্ত্রস্ত মুখ দেখে একজন পুলিশ অমায়িক হেসে বলেছিল, চিন্তা করবেন না, আমরা জানি রোহিত অত্যন্ত ভালো ছেলে। থানায় বড়বাবু সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, তার পরেই ওকে আমরা ফিরিয়ে দিয়ে যাব।

       কথা রেখেছিল পুলিশ। পরদিন আমাদের পাড়ার একমাত্র ফোনওয়ালা অতসীপিসিদের বাড়িতে পুলিশ ফোন করে সকাল দশটায় আমার বাবা এবং ঠাকুমাকে গলির মাথায় এসে দাঁড়াতে বলেছিল। অতসীপিসিদের বাড়ির চাকর এসে খবর দিয়ে গিয়েছিল।

       কাঁটায় কাঁটায় দশটায় ফটাসগলির মুখে এসে থেমেছিল কালো রঙের পুলিশভ্যান। আশপাশের বাড়ি থেকে ভিড় করে দেখতে এসেছিল পাড়ার লোক। অতসীপিসিও দাঁড়িয়ে ছিল ওদের দোতলার ব্যালকনিতে। ছোটকাকাকে ভ্যান থেকে নামিয়ে দিয়ে পুলিশ বলেছিল যা, পালা!

       ছোটকাকা একবার ঠাকুমার দিকে আর একবার আড়চোখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা অতসীপিসির দিকে তাকিয়ে যেই পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছে, অমনি পুলিশের ভ্যান থেকে ছুটে এসেছিল আগুনের ফুলকির মতো বন্দুকের গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোটকাকা পিচ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সকলের চোখের সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে।

       এই ঘটনার পর আমার ঠাকুমা সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। 

     কখনও ঠাঠা রোদ্দুরে নিজের পরনের থান কাপড় দিয়ে দিয়ে ঘসে ঘসে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে বিড় বিড় করে বলত, ‘এত রক্ত তর শরীলে আছিল? তরে তো কহনো ঠিকমতো খাওনও দি নাই, তবু এত রক্ত!’

       এরও দিন সাতেক বাদে ফটাস গলির শেষপ্রান্তে সেই লংক্লথওয়ালার গলাকাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল পাড়ার লোক। মৃতদেহের উপরে চাপা দেয়া পুরনো খবরের কাগজে আলতা দিয়ে লেখা ছিল ‘শ্রেণিশত্রু নিপাত যাক’। 

      সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভোলবার জন্যে মাসখানেকের মধ্যেই আমরা ফটাসগলি ছেড়ে খালপাড়ের বস্তিতে চলে গিয়েলাম। তবে ছাড়া পেলেই আমার ঠাকুমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ত। ফটাসগলির মুখে ন্যাপাদার দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে জনে জনে শুধাত, ‘আমার রোহিতরে দ্যাকছস নি? দ্যাকস নাই?’

       কখনও ঠাঠা রোদ্দুরে নিজের পরনের থান কাপড় দিয়ে দিয়ে ঘসে ঘসে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে বিড় বিড় করে বলত, ‘এত রক্ত তর শরীলে আছিল? তরে তো কহনো ঠিকমতো খাওনও দি নাই, তবু এত রক্ত!’

      ন্যাপাদা ঠাকুমাকে খুব যত্ন করে স্নান করিয়ে, খাইয়ে রিকশা করে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতেন। যাওয়ার সময় বিড় বিড় করে বলতেন, ‘তোমরা দেখে নিও, দিন বদলাবেই!’ 

       বছরখানেক বাদে আমরা খালপাড় ছেড়ে দত্তাবাদের ওদিকে সরকারি জমিতে চলে গেলাম। খাস জমি জবরদখল করে অনেক রিফিউজিই সেখানে ঘর তুলেছিল। দরমার বেড়া, টালির চাল, তবু নিজেদের ঘর।

       ভর্তি হয়েছিলাম ‘মাস্টারদা জনজাগরণী বিদ্যালয়’-এ। নিতান্ত অকুলীন স্কুল, সহপাঠীদের  বেশিরভাগ আমাদের মতো ছিন্নমূল পরিবারের, প্রত্যেকের বাড়িতেই নুন আনতে পান্তা-ফুরনো অবস্থা। অল্পদিনের মধ্যেই উচ্চ-নীচ ভেদহীন স্কুলটাকে খুব ভালো লেগে গেল। 

         বয়ঃসন্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ফটাসগলির স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। 

        ধীরে ধীরে নকশাল আন্দোলনও একসময়ে স্তিমিত হয়ে এল। তবে মাঝেমধ্যেই লালাঝান্ডা কাঁধে মিছিল বেরোত। দেখতাম, আমাদের জবরদখল কলোনির লোকেরাই সেই মিছিলের সামনের সারিতে। আস্তে আস্তে মিছিল লম্বা হত, গলার শিরা ফুলিয়ে ভাঙাচোরা চেহারার মানুষগুলো স্লোগান দিত, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। 

    তিমির বলল, ‘ঘোতনকাকু, মানে ন্যাপাদার ছেলে ফিরে এসেছে। সঙ্গে একটা মেয়েছেলে আর দু’টো বাচ্চা। পাঞ্জাবে না কোথায় যেন এতদিন গা-ঢাকা দিয়ে ছিল, সেখানেই বিয়ে-থা করে—’

       ছোটকাকার পরিণতির কথা ভেবে বাবা আমাকে বরাবর রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চাইত। তবুও লুকিয়েচুরিয়ে মাঝে মাঝে ঢুকে পড়তাম সেই মিছিলে। চিৎকার করে ‘শ্রেণিশত্রু নিপাত যাক’ বলতে গিয়ে সেই বর্ষণক্ষান্ত বিকেলে লালচে আলো পড়া ছোট কাকার মুখটা মনে পড়ে যেত। ভারী কষ্ট হত আমার।

       আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমড়াতলার মাঠে কী একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে ফটাসগলির তিমিরের সঙ্গে দেখা। বলল, ‘খবর শুনেছিস?’

      জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খবর?’

      তিমির বলল, ‘ঘোতনকাকু, মানে ন্যাপাদার ছেলে ফিরে এসেছে। সঙ্গে একটা মেয়েছেলে আর দু’টো বাচ্চা। পাঞ্জাবে না কোথায় যেন এতদিন গা-ঢাকা দিয়ে ছিল, সেখানেই বিয়ে-থা করে—’

        কথাগুলো বলে সে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল।

       ওর বাকি কথা শোনার ধৈর্য ছিল না আমার। ছুটতে ছুটতে সটান গিয়ে হাজির হলাম ফটাসগলিতে। অতসী পিসিদের বাড়িটা দেখে চমকে উঠলাম। বিরাট বাড়িটার যত্রতত্র আগাছা গজিয়ে উঠেছে, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, বিশাল গেট জুড়ে মাকড়সার বাসা, বন্ধ দরজা-জানালায় উইয়ের ঢিপি।

       আচমকা কাঁধে হাত পড়তে ফিরে দেখি ন্যাপাদা। খুব বিষণ্ণ হেসে বললেন, খন্ডহর দেখছিস? সব শেষ হয়ে গেছে, স—ব!

       আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঘোতনকাকা নাকি ফিরে এসেছে?

       প্রশ্নটা শুনে উনি কেমন ঘোলাটে চোখে আমার দিকে চাইলেন। তারপর উদাস ক্লান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ, কারা যেন এসেছে। একজনকে ঘোতনের মতো দেখতে। তবে সে ঘোতন না, হয়তো ওর প্রেতাত্মা! ঘোতন অনেক দিন আগেই মরে গেছে। আদর্শের মৃত্যু হলে সে কী আর মানুষ থাকে?

        আমার শৈশবে দেখা সেই সদানন্দ মানুষটার বুকের রাশিরাশি হাহাকার কান্না হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। অন্ধকার গলির মুখে আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। একদম একা।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook