পাঁচশো বছর আগে, যখন উত্তর ভারতে চলছে মোগলদের শাসন, সেই সময় ভারতের প্রায় সর্বত্র ভক্তিকাব্যের বিস্ফোরণ ঘটে। উত্তর থেকে দক্ষিণপ্রান্তের মানুষ দেবদেবীর বিভিন্ন রূপের সামনে মাথা নত করে ভক্তিরসের আবেগমথিত ভাষায় একের পর এক কাব্য রচনা করতে শুরু করেন। এমনই এক দেবরূপ হলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর উদ্দেশে নিবেদিত গীত ও কবিতা সাধারণত স্থানীয় ভাষাতেই রচিত হত। এক-এক মন্দিরে কৃষ্ণের এক-এক নামের মতোই প্রতি মন্দিরের জন্য ছিল আলাদা-আলাদা স্তবগান। অতএব গানগুলি প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র। কাজেই কৃষ্ণভক্তিকে যতই আমরা নিখিল-ভারতীয় চেতনা হিসেবে ব্যাখ্যা করি না কেন, বাস্তবে তার প্রতিভাস বহুলাংশেই স্থানীয়। কয়েকটি বিশেষ চিহ্ন না দেখলে, ভারতের এক প্রান্তের কৃষ্ণভক্ত মানুষ হয়তো অন্য আর এক প্রান্তের কৃষ্ণরূপকে চিনেই উঠতে পারবেন না!
উদাহরণ দেওয়া যাক। রাজস্থানে কৃষ্ণের আর এক নাম ‘শ্রীনাথজি’। গিরিগোবর্ধনরূপের পূজারি এই অঞ্চলের মানুষজন। শ্রীকৃষ্ণ আঙুলের উপর ধরে রয়েছেন গোবর্ধন পর্বত, তাঁর চোখের আকৃতি নৌকার মতো। আবার ওড়িশায় কৃষ্ণকে বলা হয় জগন্নাথ। এখানকার মূর্তি হাতবিহীন, কাঠের তৈরি, যা প্রতি বারো বছরে একবার কলেবর পাল্টায়। এই মূর্তির বৈশিষ্ট্যই হল এর বিশাল গোলাকৃতি চোখ। জগন্নাথ পূজিত হন তাঁর ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রার সঙ্গে। কাজেই রাজস্থানের লোক পুরী এলে কৃষ্ণকে চিনতে পারবেন কি না বলা ভার, কারণ রাজস্থানের নাথদোয়ারা-র শ্রীনাথজির সঙ্গে পুরীর জগন্নাথদেবের মিল খুঁজে পাওয়া বেশ দুঃসাধ্য।
গুজরাটে কৃষ্ণ পূজিত হন দ্বারকাধীশ বা দ্বারকার রাজা রূপে। কিন্তু এখানকার মূর্তি চতুর্ভুজ, অর্থাৎ চার হাতবিশিষ্ট। চেহারার দিক দিয়ে বিষ্ণুর সঙ্গেই তাঁর সাদৃশ্য বেশি, কৃষ্ণের সঙ্গে নয়। দ্বারকাধীশের মূর্তি দ্বারকায় তো বটেই গুজরাটের ডাকোর অঞ্চলেও দেখতে পাওয়া যায়। আবার বাংলায় এসে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে তিনি হয়ে যান বাউলাঙ্গের কেষ্ট। চৈতন্য মহাপ্রভু কৃষ্ণের মুরলীধর রূপটিকেই বহুল প্রচার করেছেন বাংলার মাটিতে। সঙ্গে রয়েছেন কৃষ্ণপ্রিয়া রাধিকা। কাজেই বাংলার তথা ভারতের গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের এই রূপটিই পূজিত হয়। আবার অসমে, শংকরদেবের নামঘর পরম্পরা অনুযায়ী কৃষ্ণকে বলা হয় মাধব, যাঁর উৎস মধু থেকে। অসমের গোলাঘাট অঞ্চলের এই নামঘরে কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কোনও ছবি বা মূর্তিই নেই। সেখানে কেবল তাঁর স্তব এবং স্তোত্র গাওয়া হয়।
এবার দক্ষিণদিকে যাওয়া যাক। প্রাচীন তামিল সাহিত্যে এক রাখাল ভগবানের উল্লেখ মেলে, যাঁকে মায়ন বলে সম্বোধন করা হয়। মায়ন গোয়ালিনীদের সান্নিধ্যে থাকেন। তাঁর একজন প্রেমিকা আছেন, যাঁর নাম নাপ্পিন্নাই। আমরা জানি না মায়ন আসলে কে। তবে খুব মন দিয়ে দেখলে হিন্দি সাহিত্যের কানহা-র সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য চোখ এড়ায় না। আর নাপ্পিন্নাই যে শ্রীরাধিকা, সে-বিষয়েও খুব একটা সন্দেহ থাকে না। কর্ণাটকে আবার দেখি কৃষ্ণের বালরূপের আরাধনা। সেখানে তাঁর নাম চেন্নাকেশব। ছবিতে তাঁর হাতে থাকে দই ঘোঁটবার কাঠের দণ্ড। কেরলে কৃষ্ণের নাম গুরুভায়ুর, অর্থাৎ যাকে অর্চনা করেন বৃহস্পতি (গুরু) এবং বায়ু বা পবনদেব। কথিত আছে, কৃষ্ণজননী দেবকী একদা এই রূপের আরাধনা করেছিলেন এবং তাঁর থেকেই কেরলের রাজারা এই রূপের কথা জানতে পারেন। সেই থেকে এই রূপই এখানে পূজিত হচ্ছে।
মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরে শ্রীকৃষ্ণের নাম বিঠ্ঠল। তাঁর সঙ্গে আছেন সহধর্মিণী রুক্মিণী। কৃষ্ণ এখানে ইটের উপর দণ্ডায়মান, দুই হাত কোমরে। প্রাচীন মরাঠিতে বিঠোবা শব্দটি বিঠঠু বা বিষ্ণুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতিতে কৃষ্ণের রূপ সত্যিই বহুলাংশে বিষ্ণুর মতো চতুর্ভুজ। এখানে তাঁর চেহারা গোবিন্দ বা গোপালের, অর্থাৎ কিনা তিনি রাখাল বালকরূপে পূজিত। চেন্নাইয়ের একটি মন্দিরে আবার এক দুর্লভ রূপের অর্চনা চলে। সেখানে তিনি পার্থসারথি, অর্থাৎ তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুনের রথের রশি তাঁর হাতে। এখানের মূর্তি বিশালকায় এবং নাকের নীচে মোটা গোঁফ। হাতে বাঁশি নয়, রয়েছে শঙ্খ। এমন মূর্তি ভূ-ভারতে আর আছে কি না সন্দেহ। এছাড়া শিখদের পবিত্র ধর্মপুস্তক গুরুগ্রন্থসাহিবেও বারংবার মধুসূদন এবং হরির নামোল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ সেখানেও কৃষ্ণের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
শেষমেশ এ-কথা বলাই যায় যে, ভারতের এক-এক প্রান্তে এক-এক রূপে কৃষ্ণের দেখা মেলে। উত্তরের রূপবৈচিত্র্য দক্ষিণের চেয়ে একেবারে আলাদা। কাজেই ভারতের ইতিহাসের যে গোড়ার কথা, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, তার প্রকাশ কিন্তু পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে দিয়েও হয়েছে বারংবার। কৃষ্ণের বিচিত্র স্থানিক চেহারা, বৈশিষ্ট্য, ধারণা পৌরাণিক শ্রীকৃষ্ণচরিত্রের পতাকার নীচে এসে যেন এক হয়ে গিয়েছে। সেখানে তিনি শুধুই বিষ্ণুর অষ্টম অবতার।